স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারে জিপি মডেল কেন জরুরি
Published: 18th, May 2025 GMT
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর ১৯ মে বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক দিবস পালন করা হয়। শুধু দিবস পালন নয়, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার চাইলে এই জিপি মডেল দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে পারিবারিক চিকিৎসক পদ্ধতি বা জিপি সিস্টেম প্রচলিত আছে। এই জিপি সিস্টেমে রোগীদের ভোগান্তি ও ব্যয় কমে এবং চিকিৎসাপদ্ধতির কার্যকারিতা বাড়ে।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য চিকিৎসাপদ্ধতির জিপি মডেল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ১০০টির বেশি ‘জিপি ক্লিনিক’ খোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটি খুবই সময় উপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারে শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে জিপি মডেল বাস্তবায়ন করতে হবে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই জিপি মডেলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে রোগীদের খরচ কমে, সময় বাঁচে এবং চিকিৎসক পাওয়াও সহজ হয়। জেনারেল প্র্যাকটিস বা জিপি সেন্টার চিকিৎসাবিদ্যায় স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতির প্রথম ধাপ। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের সব বাসিন্দা ওই এলাকার জেনারেল প্র্যাকটিস সেন্টারে একজন চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। এই সেন্টারে ওই এলাকার সব রোগীর তথ্য ও রোগের ইতিহাস থাকে। জটিল রোগের ক্ষেত্রে এই সেন্টারের চিকিৎসক রোগীকে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন।
ফলে একদিকে যেমন সামান্য কাশি নিয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে অর্থ অপচয় হয় না রোগীর, তেমনি জটিল রোগের ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে সেরা চিকিৎসা পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হয় না রোগীকে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ এই কনসেপ্ট গ্রহণ করেছে, কারণ মানুষের যত প্রকার রোগ আছে তার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ একজন জিপি বা পারিবারিক চিকিৎসকের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া সম্ভব। তাই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার সংস্কারে শুধু ঢাকায় ১০০টি ‘জিপি ক্লিনিক’ নয়, বরং সারা দেশে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জিপি মডেলের আওতায় আনা উচিত।
মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে জিপি সেন্টারে চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। এতে করে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমে যাবে, জটিল রোগীরা পর্যাপ্ত সময় পাবেন এবং সবার সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত হবে। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি রোগগুলোর নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিশ্চিত হবে, রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং সর্বোপরি এসডিজি লক্ষ্য পূরণ হবে।দেশের স্বাস্থ্য খাতের সরকারি সম্পদ ব্যবহার করেই জিপি মডেল বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ জন্য সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ও করতে হবে না। প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউনিয়ন সাবসেন্টার) হবে জিপি কেন্দ্র। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে জিপি সেন্টার হবে। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী জিপি সেন্টারের প্রমোশন করবেন এবং সেখানে রোগী পাঠাবেন।
একজন জিপি ওই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রশাসনিক প্রধান হবেন এবং সব স্টাফ তাঁর অধীনে কাজ করবেন।
জিপি সেন্টারে থাকবে কনসালটেশন রুম, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম রুম, রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ রুম ও রোগীদের বসার জায়গা। একটি জিপি সেন্টারে তিনজন চিকিৎসক, দুজন সহকারী ও দুজন নমুনা সংগ্রহকারী হলেই চালানো সম্ভব। জিপি সেন্টার সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
প্রতিটি জিপি সেন্টারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে যেসব সেবা দেওয়া হবে সেগুলো হলো—চিকিৎসাসেবা (কনসালটেশন), অসংক্রামক রোগ স্ক্রিনিং (ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার), পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী মায়েদের সেবা, নেবুলাইজেশন করা, ক্ষতস্থান সেলাই করা, সেলাই কাটা ও ড্রেসিং করা, রক্ত ও প্রসাবের পরীক্ষা। জিপি সেন্টারগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করা হবে, এরপর নমুনাগুলো নিকটবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাবে পাঠানো হবে, সেখান থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট আবার জিপি সেন্টারে পাঠানো হবে। ইসিজি, এক্স–রে এবং আলট্রাসনোগ্রাম জিপি সেন্টারে করানো হবে। ইসিজি ও এক্স–রের রিপোর্ট অনলাইনে করানো হবে এবং ফার্মেসিও থাকবে।
যা কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে নিজের ইউনিয়ন সাবসেন্টারে যাবেন। সেখানে একজন জিপি তাকে দেখবেন ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চিকিৎসা প্রদান এবং ফলোআপ করবেন। এখানে প্রাথমিক স্ক্রিনিং শেষে রোগীর জটিল সমস্যা ধরা পড়লে উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হবে। জিপি সেন্টারে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা হবে। পূর্ববর্তী সিরিয়াল ছাড়া কোনো রোগী দেখানো যাবে না। তবে প্রতিদিন মোট রোগীর এক–তৃতীয়াংশ জরুরি রোগী হিসেবে দেখাতে পারবেন।
তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে জিপি আলাদা ফ্যাকাল্টি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া জিপির জন্য আলাদা কোনো কোর্স নেই এবং আলাদা করে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় না। প্রাথমিকভাবে জিপি হওয়ার জন্য তিন মাসের একটি কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ধীরে ধীরে জিপিকে ফ্যাকাল্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ও ফেলোশিপ, ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে হবে।
জিপিদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে হবে, সিএমই চালু করতে হবে (অনলাইন) এবং সেখানে জিপিদের অংশগ্রহণ এবং নিদিষ্ট পয়েন্ট অর্জন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়া জিপিদের জরুরি সহায়তার জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করতে হবে।
জিপি সেন্টারের ফি সরকারিভাবে নির্ধারিত হবে এবং সব সেবার জন্য ফি প্রদান করতে হবে। পর্যাপ্ত মনিটরিং না করলে জিপি সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি করে হেলথ আইডেনটিটি নম্বর থাকবে। সেটা দিয়ে যেকোনে জায়গা থেকে লগইন করে একজন রোগীর সব তথ্য পাওয়া যাবে। রোগীদের প্রেসক্রিপশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে হতে হবে এবং প্রতিটি উপজেলায় একজন করে মনিটরিং অফিসার থাকবেন। যিনি নিয়মিত সব প্রেসক্রিপশন অনলাইনে মনিটর করবেন। জিপি সেন্টারগুলো নিজেরা আয় করবে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আয় হবে। জিপি সেন্টারে যাঁরা কাজ করবেন তাঁদের নিয়োগ স্থানীয়ভাবে হতে হবে এবং যাঁরা প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করবেন তাঁদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা যেকোনো জিপি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নেওয়া যাবে। তবে স্বাস্থ্যসেবা নম্বর প্রদান করতে হবে, যাতে করে ওই রোগীর সব তথ্য যেকোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বের করা যায়। জিপি সেন্টারের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার (প্রিভেন্টিভ) মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিনেশন, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার স্ক্রিনিং ইত্যাদি। এইগুলো রোগীর জন্য নিদিষ্ট জিপি সেন্টারের মাধ্যমে প্রদান করা হবে। বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য জিপি সেন্টার থেকে রেফারেল থাকবে এবং এই সেবাগুলো নেওয়ার পর রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য জিপি সেন্টারে রেফার করতে হবে।
ডাক্তারখানা আমাদের দেশের প্রথম জিপি মডেল। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক্তারখানা যাত্রা শুরু করে, বর্তমানে সারা দেশে মোট ১৯৫টি ডাক্তারখানা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। ডাক্তারখানার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তার হাতের আছে (বাড়ির পাশে) প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা, জটিল রোগীগুলোকে বিশেষায়িত হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করা। এতে করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও হাসপাতালে রোগীর চাপ কমবে, মানুষকে সাধারণ অসুখবিসুখে দূরের হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে না এবং এতে করে ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয় দুটোই কমে যাবে। বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৩ হাজার রোগীকে ডাক্তারখানায় সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ ডাক্তারখানাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জিপি রেফারেল সিস্টেম চালু ছাড়া সংস্কার করা অসম্ভব, কারণ রোগীরা তাদের দৈনন্দিন সাধারণ রোগে নিজে থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন, আর জুনিয়র চিকিৎসকেরা জিপি না করে শুধু বিশেষজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করে রাখেন, ফলে সার্বিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে।
মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে জিপি সেন্টারে চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। এতে করে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমে যাবে, জটিল রোগীরা পর্যাপ্ত সময় পাবেন এবং সবার সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত হবে। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি রোগগুলোর নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিশ্চিত হবে, রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং সর্বোপরি এসডিজি লক্ষ্য পূরণ হবে।
ডা.
রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত হব আম দ র দ শ জট ল র গ র চ ক ৎসক র র ফ র কর ব যবস থ পর ক ষ লক ষ য র জন য উপজ ল প রথম ন করত সরক র গ রহণ করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
দুবাইয়ে বিকৃত যৌন ব্যবসা চক্রের প্রধানকে চিহ্নিত করল বিবিসির এক অনুসন্ধান
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ের সবচেয়ে চাকচিক্যপূর্ণ এলাকায় একটি যৌন ব্যবসা এবং অসহায় নারীদের শোষণ–নির্যাতনের মূল হোতাকে চিহ্নিত করেছে বিবিসির অনুসন্ধানী দল।
চার্লস মোসিগা নামের ওই ব্যক্তি পরিচয়-গোপনকারী বিবিসি প্রতিবেদককে বলেন, এক সেক্স পার্টির জন্য তিনি ন্যূনতম এক হাজার ডলার দরে নারী সরবরাহ করতে পারবেন। তাঁরা অনেকেই গ্রাহকের চাহিদা মেটাতে ‘প্রায় সবকিছুই’ করতে পারবে। মোসিগা লন্ডন শহরের সবেক একজন বাসচালক হিসেবে নিজের পরিচয় দেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে বহু বছর ধরেই নানা কথা চালু আছে। টিকটকে এ-সংক্রান্ত একটি হ্যাশট্যাগ ৪৫ কোটি বারেরও বেশি দেখা হয়েছে। এটা ধরে অনেক ব্যঙ্গাত্মক ও জল্পনামূলক তথাকথিত অনুসন্ধানী কনটেন্ট ছড়িয়েছে। সেগুলোতে অভিযোগ তোলা হয়েছে যে অর্থলোভী কিছু নারী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ইনফ্লুয়েন্সারের ভূমিকা নেন এবং তাঁরা গোপনে মানুষের যথেচ্ছ যৌন চাহিদা মিটিয়ে বিলাসী জীবনযাপনের খরচ জোগান।
বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে বলা হয়েছে, বাস্তবতা আরও ভয়াবহ।
উগান্ডার কয়েকজন তরুণী বিবিসিকে বলেছেন, তাঁরা কখনো ভাবেননি, মোসিগার অধীনে তাঁদের যৌনকর্ম করতে হবে। কেউ কেউ ভেবেছিলেন, তাঁরা সুপার মার্কেট বা হোটেলের মতো কোনো জায়গায় কাজ করার জন্য আরব আমিরাতে যাচ্ছেন।
‘মিয়া’ (ছদ্মনাম) বলেন, মোসিগার আনা গ্রাহকদের অন্তত একজন নিয়মিত মেয়েদের গায়ে মলত্যাগ করতে চান। তিনি বলেন, মোসিগার চক্র তাঁকে ফাঁদে ফেলে এ কাজে জড়িয়েছে।
মোসিগা অবশ্য অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছেন, তিনি শুধু বাড়িওয়ালাদের মাধ্যমে নারীদের বাসা পেতে সহায়তা করেন। আর তাঁরা মোসিগার সঙ্গে বিভিন্ন পার্টিতে যান, কারণ তাঁর সঙ্গে দুবাইয়ের অনেক ধনাঢ্য মানুষের যোগাযোগ আছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাতে উন্মত্ত ‘সেক্স পার্টি’ নিয়ে নানা কথা প্রচলিত আছে। অভিযোগ আছে, অনেক অর্থলিপ্সু নারী ইনফ্লুয়েন্সার তাঁদের বিলাসী জীবনযাপনের জন্য গোপনে অর্থের জোগান মেটাতে অস্বাভাবিক ও বিকৃত যৌন চাহিদা মেটানোর কাজও করছেন।অনুসন্ধানে বিবিসি আরও জানতে পেরেছে, মোসিগার সঙ্গে যোগসূত্র থাকা দুই নারী দুবাইয়ের সুউচ্চ ভবন থেকে পড়ে মারা গেছেন। যদিও তাঁদের মৃত্যুকে আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদের স্বজন ও বন্ধুরা মনে করেন, পুলিশের আরও তদন্ত করা উচিত ছিল।
মোসিগা বলেন, ঘটনা দুটি দুবাই পুলিশ তদন্ত করেছে। এ–সংক্রান্ত তথ্যের জন্য তিনি বিবিসিকে পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করতে বলেন। কিন্তু পুলিশ বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেয়নি।
মারা যাওয়া দুই নারীর একজন মোনিক কারুঙ্গি। তিনি পশ্চিম উগান্ডা থেকে দুবাইয়ে আসেন। মোসিগার জন্য কাজ করা আরও অনেক মেয়ের সঙ্গে একটি ফ্ল্যাটে মোনিকের ঠাঁই হয়।
একজন নারী বলেন, তিনি ২০২২ সালে মোনিকের সঙ্গে ওই ফ্ল্যাটে থেকেছেন। বিবিসি এই নারীর নাম দিয়েছে কেইরা।
কেইরা বলেন, ‘(মোসিগার) ওই ফ্ল্যাটটি ছিল বাজারের মতো। সেখানে প্রায় ৫০টি মেয়ে একসঙ্গে থাকত। সে (মোনিক) খুশি ছিল না। কারণ, সে যা চেয়েছিল, তা পায়নি।’
মোনিকের বোন রিতা বলেন, একটি সুপার মার্কেটে কাজ করবেন ভেবে তাঁর বোন দুবাই গিয়েছিলেন।
মোনিকের সঙ্গে মিয়ারও পরিচয় ছিল। বিবিসিকে মিয়া বলেন, ‘আমি বাড়ি ফিরেতে চাইলে তিনি (মোসিগা) সহিংস হয়ে ওঠেন। তিনি জানান, দুবাই আসার পর মোসিগা তাঁকে বলেছিলেন—তিনি ইতিমধ্যে মিয়ার কাছে ২ হাজার ৭১১ ডলার পান। ঠিক সময়ে পরিশোধ না করলে দুই সপ্তাহের মধ্যে এটা দ্বিগুণ হবে।
মিয়া বলেন, ‘বিমান টিকিট, ভিসা খরচ, বাসা ভাড়া, খাবার খরচ মেটাতে তোমাকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। পুরুষদের কাছে অনুনয় করতে হবে, যাতে তারা কাছে আসে ও শয্যাসঙ্গী হয়।’
ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।মাইকেল (ছদ্মনাম) নামে মোনিকের এক আত্মীয় বিবিসিকে বলেন, কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই মোসিগার কাছে মোনিকের প্রায় ২৭ হাজার ডলার ঋণ জমে গিয়েছিল। মোনিকে প্রায়ই মাইকেলকে কাঁদতে কাঁদতে ভয়েস নোট পাঠিয়ে এ কথাগুলো বলত।
মিয়া বলেন, তাঁদের গ্রাহকদের বেশির ভাগই ছিলেন ইউরোপের শ্বেতাঙ্গ মানুষ। এদের অনেকের চরম বিকৃত যৌন চাহিদা ছিল। নিচু গলায় তিনি বলেন, একজন গ্রাহক মেয়েদের ওপর মলত্যাগ করে সেটা খেতে বলতেন।
লেক্সি নামের (ছদ্মনাম) আরেক নারী বলেন, অন্য একটি চক্রের ফাঁদে পড়ে তিনি এই কাজে জড়িয়েছেন। তিনিও বলেন, গ্রাহকেরা প্রায়ই এমনটা করতে চাইতেন। একজন গ্রাহকের অমানুষিক ঘৃণাপূর্ণ বিকৃত চাহিদা বর্ণনা করেন তিনি। বলেন, এমন অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর বিশ্বাস জন্মেছে যে, এসব চরম বিকৃত আকাঙ্ক্ষার মধ্যে জাতিবিদ্বেষ বা বর্ণবিদ্বেষের ব্যাপার থাকতে পারে।
লেক্সি বলেন, ‘প্রতিবার যখন আমি বলতাম, এগুলো করতে চাই না, তাঁরা আরও মজা পেত। তাঁরা এমন কাউকে চাইত, যে কিনা কাঁদবে, চিৎকার করবে ও পালাতে চাইবে। এমন কেউ, যে হবে কৃষ্ণাঙ্গ।’
লেক্সি বলেন, তিনি পুলিশের কাছে সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু পুলিশ তাঁকে বলেছিল, ‘তোমরা আফ্রিকানরা একে অপরের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করছ। আমরা এতে জড়াতে চাই না। তারপর তাঁরা ফোন কেটে দেয়।
মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।দুবাই পুলিশের কাছে বিবিসি এই অভিযোগ তুলে ধরলেও তারা কোনো উত্তর দেয়নি।
পরবর্তী সময়ে অবশ্য লেক্সি উগান্ডায় ফিরতে সক্ষম হন। বর্তমানে তিনি এ ধরনের চক্রের ফাঁদে পড়া নারীদের উদ্ধার ও সহায়তায় কাজ করছেন।
চার্লস মোসিগাকে খুঁজে পাওয়ার কাজটি সহজ ছিল না। বিবিসির অনুসন্ধানকারী দলটি শুধু অনলাইনে তাঁর একটি ছবি পেয়েছিল। সেটিও ছিল পেছন থেকে তোলা, তা ছাড়া, নানা নামে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করেন মোসিগা।
উন্মুক্ত উৎস থেকে নেওয়া তথ্য, ছদ্মবেশে অনুসন্ধান এবং মোসিগা চক্রের এক সাবেক সদস্যের দেওয়া তথ্য—সব মিলিয়ে অনুসন্ধানকারী দল তাঁকে দুবাইয়ের মধ্যবিত্ত এলাকা জুমেইরাহতে খুঁজে পায়।
আরও পড়ুনদুবাইয়ের যৌনপল্লি থেকে তরুণী উদ্ধার, আসামিদের অব্যাহতি চায় পুলিশ২৭ মার্চ ২০২২সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছিল, মোসিগার ব্যবসা মূলত অবমাননাকর যৌনকর্মের জন্য নারীদের সরবরাহ করা। বিষয়টি যাচাই করতে অনুসন্ধানী দল একজন ছদ্মবেশী প্রতিবেদককে পাঠায়। তিনি নিজেকে একজন অনুষ্ঠান আয়োজক হিসেবে পরিচয় দেন, যিনি বিলাসবহুল পার্টিগুলোর জন্য নারী খুঁজছেন।
অনুসন্ধানকারী দল যখন মোসিগার সঙ্গে তাঁর ব্যবসার বিষয়ে কথা বলছিল, তখন তাঁকে শান্ত ও আত্মবিশ্বাসী বলে মনে হচ্ছিল।
মোসিগা বলেন, ‘আমাদের কাছে ২৫ জনের মতো মেয়ে আছে। এদের অনেকেই মুক্তমনা…তারা প্রায় সবকিছুই করতে পারে।’
খরচের ব্যাপারে মোসিগা বলেন, রাতপ্রতি একেকজনের জন্য এক হাজার ডলার থেকে শুরু। তবে অস্বাভাবিক কাজের জন্য বেশি অর্থ দিতে হবে। তিনি বিবিসির রিপোর্টারকে একটা নমুনা রাতের দাওয়াত দেন।
মোসিগা বলেন, এই ব্যবসা তাঁর অতি প্রিয়। লটারিতে ১০ লাখ পাউন্ড জিতলেও তিনি এ ব্যবসা চালিয়ে যাবেন। তিনি বলেন, ‘এটি এখন আমারই একটি অংশ হয়ে গেছে।’
ট্রয় নামের এক ব্যক্তি দাবি করেন, তিনি মোসিগার চক্রের অপারেশনস ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। চক্রটি কীভাবে পরিচালিত হয় সে বিষয়ে তিনি বিবিসির অনুসন্ধানী দলকে তথ্য দেন।
ট্রয় বলেন, মোসিগা বিভিন্ন নৈশক্লাবের নিরাপত্তাকর্মীদের টাকা দেন, যাতে তাঁর পাঠানো নারীরা ভেতরে ঢুকে গ্রাহক খুঁজতে পারে।
আরও পড়ুনদুবাইয়ে ধর্ষণের শিকার নরওয়েজীয় নারীর কারাদণ্ড২১ জুলাই ২০১৩ট্রয়ের দাবি, মোসিগা এত দিন এ ব্যবসা চালিয়ে যেতে পেরেছেন কারণ, তিনি আনুষ্ঠানিক কাগজপত্রে কখনো নিজের নাম ব্যবহার করতেন না। গাড়িচালক, গাড়ি ও বাড়ি ভাড়াসহ সব কাজে ট্রয় এবং তাঁর মতো অন্যদের নাম ব্যবহার করা হতো।
২০২২ সালের ২৭ এপ্রিলে দুবাইয়ে প্রবাসীদের মধ্যে জনপ্রিয় আবাসিক এলাকা আল বারশায় একটি সেলফি তুলে পোস্ট করেছিলেন মোনিক। এর চারদিন পরই তিনি মারা যান। দুবাইয়ে আসার চার মাসের মাথায় তাঁর মৃত্যু হয়।
মিয়ার বলছেন, মোনিক যত দিন ছিলেন, মোসিগার সঙ্গে তাঁর নিয়মিত ঝগড়া হতে দেখেছেন। মোনিক মোসিগার চাহিদা পূরণ করতে অস্বীকার করছিলেন এবং চক্র থেকে বেরিয়ে আসার উপায় খুঁজে পেয়েছিল।
মিয়া বলেন, মোনিক একটি চাকরি পেয়েছিলেন। তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। ভেবেছিলেন, অবশেষে ঘৃণ্য জীবন থেকে মুক্তি পাবেন এবং স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন।
মোসিগার ভাড়া করা ফ্ল্যাট ছেড়ে প্রায় ১০ মিনিট হাঁটা দূরত্বে অন্য একটি ফ্ল্যাটে চলে যান মোনিক। ২০২২ সালের ১ মে ওই বাসার বারান্দা থেকে তিনি নিচে পড়ে যান।
মোনিকের আত্মীয় মাইকেল তখন দুবাইতে ছিলেন। তিনি বলেন, মোনিকের মৃত্যুর কারণ খোঁজার চেষ্টা করেছিলেন। পুলিশ তাঁকে বলেছিল, তারা তদন্ত বন্ধ করে দিয়েছে, কারণ, মোনিকের বাসা থেকে মাদক ও অ্যালকোহল পাওয়া গেছে। বারান্দায় শুধু মোনিকের আঙুলের ছাপ ছিল।
আরও পড়ুনদুবাইয়ের ড্যান্স বারে বাংলাদেশ থেকে তরুণী পাচার, বাধ্য করা হচ্ছে যৌন পেশায়২২ নভেম্বর ২০১৯মাইকেল হাসপাতাল থেকে মোনিকের মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করেছেন। কিন্তু এতে উল্লেখ ছিল না, তিনি কীভাবে মারা গেছেন।
মোনিকের পরিবারের জন্য এখন শোকের সঙ্গে ভয় মিলেমিশে গেছে। ভয় অন্য পরিবারগুলোর জন্য, যারা একই ধরনের ক্ষতির মুখে পড়তে পারে।
বিবিসি চার্লস অ্যাবি মোসিগার কাছে তাঁর বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগগুলো সম্পর্কে জানতে চায়। তিনি অবৈধ যৌন ব্যবসা পরিচালনার অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘এগুলো সব মিথ্যা।’
এদিকে মোনিকের পরিবার তাঁর লাশ পায়নি। বিবিসির অনুসন্ধান বলছে, তাঁকে দুবাইয়ে আলকুসাইস কবরস্থানের ‘অজ্ঞাতপরিচয়’ অংশে দাফন করা হয়েছে।