স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারে জিপি মডেল কেন জরুরি
Published: 18th, May 2025 GMT
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও প্রতিবছর ১৯ মে বিশ্ব পারিবারিক চিকিৎসক দিবস পালন করা হয়। শুধু দিবস পালন নয়, আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কার চাইলে এই জিপি মডেল দ্রুত বাস্তবায়ন করা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে পারিবারিক চিকিৎসক পদ্ধতি বা জিপি সিস্টেম প্রচলিত আছে। এই জিপি সিস্টেমে রোগীদের ভোগান্তি ও ব্যয় কমে এবং চিকিৎসাপদ্ধতির কার্যকারিতা বাড়ে।
দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানোর জন্য চিকিৎসাপদ্ধতির জিপি মডেল বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। গত ১৩ ফেব্রুয়ারির প্রথম আলোর প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজধানী ঢাকায় বসবাসকারী মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য ১০০টির বেশি ‘জিপি ক্লিনিক’ খোলার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এটি খুবই সময় উপযোগী একটি সিদ্ধান্ত। তবে স্বাস্থ্যব্যবস্থার সংস্কারে শুধু ঢাকায় নয়, সারা দেশে জিপি মডেল বাস্তবায়ন করতে হবে।
পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে এই জিপি মডেলে চিকিৎসা দেওয়া হয়। এতে রোগীদের খরচ কমে, সময় বাঁচে এবং চিকিৎসক পাওয়াও সহজ হয়। জেনারেল প্র্যাকটিস বা জিপি সেন্টার চিকিৎসাবিদ্যায় স্ট্রাকচারাল রেফারেল পদ্ধতির প্রথম ধাপ। এ পদ্ধতিতে একটি নির্দিষ্ট ইউনিয়ন বা ওয়ার্ডের সব বাসিন্দা ওই এলাকার জেনারেল প্র্যাকটিস সেন্টারে একজন চিকিৎসকের কাছে প্রাথমিক চিকিৎসা নেয়। এই সেন্টারে ওই এলাকার সব রোগীর তথ্য ও রোগের ইতিহাস থাকে। জটিল রোগের ক্ষেত্রে এই সেন্টারের চিকিৎসক রোগীকে নির্দিষ্ট বিশেষজ্ঞের কাছে রেফার করেন।
ফলে একদিকে যেমন সামান্য কাশি নিয়ে বিশেষজ্ঞের কাছে গিয়ে অর্থ অপচয় হয় না রোগীর, তেমনি জটিল রোগের ক্ষেত্রে কোন পর্যায়ের বিশেষজ্ঞের কাছে গেলে সেরা চিকিৎসা পারবেন, তা নিয়ে সংশয়ে থাকতে হয় না রোগীকে। পৃথিবীর সব উন্নত দেশ এই কনসেপ্ট গ্রহণ করেছে, কারণ মানুষের যত প্রকার রোগ আছে তার শতকরা ৮০-৮৫ ভাগ একজন জিপি বা পারিবারিক চিকিৎসকের চিকিৎসায় সুস্থ হওয়া সম্ভব। তাই আমাদের দেশের স্বাস্থ্যসেবার সংস্কারে শুধু ঢাকায় ১০০টি ‘জিপি ক্লিনিক’ নয়, বরং সারা দেশে পুরো স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে জিপি মডেলের আওতায় আনা উচিত।
মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে জিপি সেন্টারে চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। এতে করে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমে যাবে, জটিল রোগীরা পর্যাপ্ত সময় পাবেন এবং সবার সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত হবে। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি রোগগুলোর নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিশ্চিত হবে, রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং সর্বোপরি এসডিজি লক্ষ্য পূরণ হবে।দেশের স্বাস্থ্য খাতের সরকারি সম্পদ ব্যবহার করেই জিপি মডেল বাস্তবায়ন করা সম্ভব। এ জন্য সরকারকে অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ও করতে হবে না। প্রতিটি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র (ইউনিয়ন সাবসেন্টার) হবে জিপি কেন্দ্র। সিটি করপোরেশন বা পৌরসভায় প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে জিপি সেন্টার হবে। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা, কমিউনিটি হেলথ কেয়ার প্রোভাইডার, স্বাস্থ্য সহকারী জিপি সেন্টারের প্রমোশন করবেন এবং সেখানে রোগী পাঠাবেন।
একজন জিপি ওই ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের প্রশাসনিক প্রধান হবেন এবং সব স্টাফ তাঁর অধীনে কাজ করবেন।
জিপি সেন্টারে থাকবে কনসালটেশন রুম, ইসিজি ও আলট্রাসনোগ্রাম রুম, রক্ত ও প্রস্রাবের নমুনা সংগ্রহ রুম ও রোগীদের বসার জায়গা। একটি জিপি সেন্টারে তিনজন চিকিৎসক, দুজন সহকারী ও দুজন নমুনা সংগ্রহকারী হলেই চালানো সম্ভব। জিপি সেন্টার সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
প্রতিটি জিপি সেন্টারে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার মধ্যে যেসব সেবা দেওয়া হবে সেগুলো হলো—চিকিৎসাসেবা (কনসালটেশন), অসংক্রামক রোগ স্ক্রিনিং (ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার), পরিবার পরিকল্পনা, গর্ভবতী মায়েদের সেবা, নেবুলাইজেশন করা, ক্ষতস্থান সেলাই করা, সেলাই কাটা ও ড্রেসিং করা, রক্ত ও প্রসাবের পরীক্ষা। জিপি সেন্টারগুলোতে নমুনা সংগ্রহ করা হবে, এরপর নমুনাগুলো নিকটবর্তী উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ল্যাবে পাঠানো হবে, সেখান থেকে পরীক্ষার রিপোর্ট আবার জিপি সেন্টারে পাঠানো হবে। ইসিজি, এক্স–রে এবং আলট্রাসনোগ্রাম জিপি সেন্টারে করানো হবে। ইসিজি ও এক্স–রের রিপোর্ট অনলাইনে করানো হবে এবং ফার্মেসিও থাকবে।
যা কেউ অসুস্থ হলে প্রথমে নিজের ইউনিয়ন সাবসেন্টারে যাবেন। সেখানে একজন জিপি তাকে দেখবেন ও প্রয়োজনীয় পরীক্ষা–নিরীক্ষা করে চিকিৎসা প্রদান এবং ফলোআপ করবেন। এখানে প্রাথমিক স্ক্রিনিং শেষে রোগীর জটিল সমস্যা ধরা পড়লে উপজেলা/জেলা/বিভাগীয় হাসপাতালে রেফার করা হবে। জিপি সেন্টারে প্রতিদিন নির্দিষ্টসংখ্যক রোগী দেখা হবে। পূর্ববর্তী সিরিয়াল ছাড়া কোনো রোগী দেখানো যাবে না। তবে প্রতিদিন মোট রোগীর এক–তৃতীয়াংশ জরুরি রোগী হিসেবে দেখাতে পারবেন।
তবে দুঃখের বিষয়, আমাদের দেশে জিপি আলাদা ফ্যাকাল্টি হিসেবে গড়ে ওঠেনি। এ ছাড়া জিপির জন্য আলাদা কোনো কোর্স নেই এবং আলাদা করে বিএমডিসি রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয় না। প্রাথমিকভাবে জিপি হওয়ার জন্য তিন মাসের একটি কোর্সের ব্যবস্থা করতে হবে এবং ধীরে ধীরে জিপিকে ফ্যাকাল্টি হিসেবে গড়ে তুলতে হবে ও ফেলোশিপ, ডিপ্লোমা কোর্স চালু করতে হবে।
জিপিদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে নিয়মিত সেমিনারে অংশগ্রহণ করতে হবে, সিএমই চালু করতে হবে (অনলাইন) এবং সেখানে জিপিদের অংশগ্রহণ এবং নিদিষ্ট পয়েন্ট অর্জন বাধ্যতামূলক করতে হবে। এ ছাড়া জিপিদের জরুরি সহায়তার জন্য একটি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ করতে হবে।
জিপি সেন্টারের ফি সরকারিভাবে নির্ধারিত হবে এবং সব সেবার জন্য ফি প্রদান করতে হবে। পর্যাপ্ত মনিটরিং না করলে জিপি সিস্টেম সঠিকভাবে কাজ করতে পারবে না।
প্রত্যেক রোগীর জন্য একটি করে হেলথ আইডেনটিটি নম্বর থাকবে। সেটা দিয়ে যেকোনে জায়গা থেকে লগইন করে একজন রোগীর সব তথ্য পাওয়া যাবে। রোগীদের প্রেসক্রিপশন সফটওয়্যারের মাধ্যমে হতে হবে এবং প্রতিটি উপজেলায় একজন করে মনিটরিং অফিসার থাকবেন। যিনি নিয়মিত সব প্রেসক্রিপশন অনলাইনে মনিটর করবেন। জিপি সেন্টারগুলো নিজেরা আয় করবে। বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা থেকে আয় হবে। জিপি সেন্টারে যাঁরা কাজ করবেন তাঁদের নিয়োগ স্থানীয়ভাবে হতে হবে এবং যাঁরা প্রান্তিক পর্যায়ে কাজ করবেন তাঁদের অতিরিক্ত সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে হবে।
জরুরি স্বাস্থ্যসেবা যেকোনো জিপি স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে নেওয়া যাবে। তবে স্বাস্থ্যসেবা নম্বর প্রদান করতে হবে, যাতে করে ওই রোগীর সব তথ্য যেকোনো স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র থেকে বের করা যায়। জিপি সেন্টারের প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবার (প্রিভেন্টিভ) মধ্যে রয়েছে ভ্যাকসিনেশন, ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার স্ক্রিনিং ইত্যাদি। এইগুলো রোগীর জন্য নিদিষ্ট জিপি সেন্টারের মাধ্যমে প্রদান করা হবে। বিশেষজ্ঞ স্বাস্থ্যসেবা নেওয়ার জন্য জিপি সেন্টার থেকে রেফারেল থাকবে এবং এই সেবাগুলো নেওয়ার পর রোগীকে পরবর্তী চিকিৎসার জন্য জিপি সেন্টারে রেফার করতে হবে।
ডাক্তারখানা আমাদের দেশের প্রথম জিপি মডেল। ২০১৯ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি ডাক্তারখানা যাত্রা শুরু করে, বর্তমানে সারা দেশে মোট ১৯৫টি ডাক্তারখানা রোগীদের প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করছে। ডাক্তারখানার প্রধান উদ্দেশ্য হলো মানুষকে তার হাতের আছে (বাড়ির পাশে) প্রাথমিক চিকিৎসাসেবা প্রদান করা, জটিল রোগীগুলোকে বিশেষায়িত হাসপাতাল বা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে রেফার করা। এতে করে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও হাসপাতালে রোগীর চাপ কমবে, মানুষকে সাধারণ অসুখবিসুখে দূরের হাসপাতাল বা চিকিৎসকের কাছে যেতে হবে না এবং এতে করে ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয় দুটোই কমে যাবে। বর্তমানে দৈনিক গড়ে ৩ হাজার রোগীকে ডাক্তারখানায় সেবা দেওয়া হচ্ছে এবং সাধারণ মানুষ ডাক্তারখানাকে সাদরে গ্রহণ করেছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা জিপি রেফারেল সিস্টেম চালু ছাড়া সংস্কার করা অসম্ভব, কারণ রোগীরা তাদের দৈনন্দিন সাধারণ রোগে নিজে থেকে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়ে থাকেন, আর জুনিয়র চিকিৎসকেরা জিপি না করে শুধু বিশেষজ্ঞ হওয়ার লক্ষ্যে তাঁদের মেধা ও শ্রম নিয়োজিত করে রাখেন, ফলে সার্বিক অবস্থা অপরিবর্তিত থাকে। জিপি সিস্টেমের মাধ্যমে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা যাবে।
মোট রোগীর ৮০ শতাংশকে জিপি সেন্টারে চিকিৎসা প্রদান করা যাবে। এতে করে উপজেলা, জেলা এবং বিভাগীয় হাসপাতালগুলোতে রোগীর চাপ কমে যাবে, জটিল রোগীরা পর্যাপ্ত সময় পাবেন এবং সবার সুচিকিৎসা সুনিশ্চিত হবে। অসংক্রামক ব্যাধি যেমন ডায়াবেটিস, হাইপ্রেশার ইত্যাদি রোগগুলোর নির্ণয় এবং চিকিৎসা নিশ্চিত হবে, রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় কমবে এবং সর্বোপরি এসডিজি লক্ষ্য পূরণ হবে।
ডা.
রতীন্দ্র নাথ মণ্ডল, সহযোগী অধ্যাপক, প্রাইম মেডিকেল কলেজ, রংপুর।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ন শ চ ত হব আম দ র দ শ জট ল র গ র চ ক ৎসক র র ফ র কর ব যবস থ পর ক ষ লক ষ য র জন য উপজ ল প রথম ন করত সরক র গ রহণ করব ন
এছাড়াও পড়ুন:
নৃত্যশিল্পীকে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ, গ্রেপ্তার ১
সিরাজগঞ্জের তাড়াশে এক নৃত্যশিল্পীকে ডেকে নিয়ে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে রফিকুল ইসলাম (৪৫) নামে এক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ।
শনিবার (১৭ মে) দুপুরে ওই নৃত্যশিল্পী বাদী হয়ে তাড়াশ থানায় তিনজনের বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করেন। এর আগে, শুক্রবার (১৬ মে) রাতে উপজেলার রানীরহাট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ঘটনাটি ঘটে বলে মামলায় উল্লেখ করেছেন ভোক্তভোগী।
গ্রেপ্তার রফিকুল ইসলাম বগুড়া জেলার শেরপুর উপজেলার বেওয়াপাড়া গ্রামের বাসিন্দা।
আরো পড়ুন:
চিত্তরঞ্জনকে হত্যার ঘটনায় মামলা, প্রেমিকার বাবা-মা ও ভাবি গ্রেপ্তার
আইভীকে আরো ২ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানোর নির্দেশ
পুলিশের হেফাজতে থাকা রফিকুল ইসলাম বলেন, “ওই মেয়ে একজন যৌনকর্মী। টাকার বিনিময়ে তাকে তাড়াশে আনা হয়ে হয়েছিল। এখন আমাদের ফাঁসানোর জন্য থানায় মিথ্যা অভিযোগ করেছেন তিনি।”
তাড়াশ থানার ওসি জিয়াউর রহমান বলেন, “অভিযোগে ভুক্তভোগী কিশোরী নিজেকে একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে দাবি করেছেন। তিনি মেলা ও সার্কাসে নৃত্য করেন। পূর্বপরিচিত হওয়ায় তাড়াশের রানীরহাট বাজারের ডেকোরেটর ব্যবসায়ী কফিল উদ্দিন তাকে ডেকে এনেছিল। এরপর শুক্রবার রাত ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত তাকে ধর্ষণ করা হয়। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী থানায় মামলা করলে রফিকুল ইসলাম নামে একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। ভুক্তভোগীকে শারীরিক পরীক্ষার জন্য তাকে থানা হেফাজতে রাখা হয়েছে।”
ঢাকা/অদিত্য/মাসুদ