সামাজিক দক্ষতা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম যে কারণে জরুরি
Published: 18th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে ছাত্রছাত্রীকে কতটুকু সহায়তা করছে, নতুনভাবে ভাবা দরকার। স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তীব্র হয়েছে। কয়েক বছর আগে সিপিডি পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেকার তরুণদের প্রায় ৪৬ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী। দেশে এই মুহূর্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
গ্রেড ছাড়াও সামাজিক দক্ষতা তথা আত্মসচেতনতা, যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতা, ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, টিমওয়ার্ক, কমিউনিটি সার্ভিস ইত্যাদিতে যারা ভালো সমন্বয় ঘটাতে পারে, তারাই চাকরির বাজারে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। অনেক ছাত্রছাত্রী সামাজিক দক্ষতা, সেবা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কাজের গুরুত্ব জানতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তারা ব্যয় করে মুখস্থ পড়ালেখা, দুশ্চিন্তা ও অলস আড্ডায়। আরেকটি বড় অংশের ধ্যানজ্ঞান শুধু বিসিএস, যাদের অনেকেই পরে আশাহত হয়।
সব ছাত্রছাত্রী পড়াশোনায় ভালো নাও হতে পারে, যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকে অন্যান্য বিষয় যেমন– বিতর্ক, অভিনয়, সৃজনশীল লেখনী, ফটোগ্রাফি, ক্রীড়া ইত্যাদিতে নৈপুণ্য দেখাতে পারে। ক্লাব কার্যক্রম না থাকলে ছাত্রছাত্রী এসব সুপ্ত প্রতিভাচর্চার সুযোগ পায় না; শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অনেকের সামাজিক দক্ষতার বিকাশও ঠিকমতো হচ্ছে না। দুঃখজনকভাবে সত্যি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। এটি তাদের অপূরণীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত হতে পারে।
আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাদের অনেকে মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার উপদেশ একেবারেই অনুপস্থিত; থাকলেও সুবিধাটির বিষয়ে তারা উদাসীন। প্রকৃতপক্ষে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সুবিধা নেই। অনেক শিক্ষার্থী জানে না, পাস করে বের হওয়ার পর তারা কী করবে? অনেকে তাদের নির্বাচন করা মূল বিষয়ও পছন্দ করে না। আবার সেটি বদলানোর গরজও দেখা যায় না। ক্যারিয়ার উপদেশের দুর্বল অবস্থার কারণে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভালো ফল করা স্নাতকরাও চাকরির বাজারের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিকে মেলাতে পারে না।
এ সময়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মনে করে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হতাশা ব্যক্ত করে বলে, ‘জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষাগত সাফল্যে যতটা গুরুত্ব দিই, মানসিক স্বাস্থ্যে ততটা গুরুত্ব দিই না।’ ছাত্রছাত্রী পারিবারিক চাপ, পড়ালেখার দুশ্চিন্তা, অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর চাপ অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে বিষণ্নতায় ভুগছে। নিজের ক্ষতি, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন একজন মানুষ দরকার, যার সঙ্গে তারা অকপটে নিজেদের কঠিন সময়গুলোর ব্যাপারে আলাপ করে পরামর্শ নিতে পারবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত লেকচারভিত্তিক পাঠদান করা হয়। পরীক্ষাগুলোতে প্রকৃত বা আহরিত জ্ঞান যাচাই করার পরিবর্তে স্মরণশক্তির মূল্যায়ন করা হয়। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসভিত্তিক ও সেবা শিক্ষামূলক বা সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো অবজ্ঞা করা হয়। শিক্ষার্থীরা ধরে নেয়, চাকরিক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে জীবনে উন্নতি করার জন্য ভালো সিজিপিএ বা লেটার গ্রেড পাওয়ার বিকল্প নেই। চার থেকে পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অনুধাবন করে, কত নাজুকভাবে তারা পরিচালিত হয়েছে বা কত দুর্বলভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছে। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি বড় উদাহরণ।
শিক্ষা ব্যবস্থার এসব গুরুতর সমস্যার দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া জরুরি। এখনই যেসব প্রশ্ন তোলা উচিত, তা হলো– আমাদের কী রকম পেশাদার জনবল রয়েছে, যারা কার্যকরভাবে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে উপযুক্ত ইন্টার্নশিপ, সেবা শিক্ষার সুযোগ, ক্লাব কার্যক্রম, ক্যারিয়ার উপদেশ ও মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত উপদেশ দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করতে পারবে? যদি না থাকে, তাহলে ভাবতে হবে কীভাবে তাদের দ্রুততম সময়ে তৈরি করা যায়।
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়নি। একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, আরেকদিকে বাড়ছে তাদের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ। এসব দূর করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের নতুন নতুন বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পেশাদার দক্ষ মানুষ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু আকর্ষণীয় খাত রয়েছে, যার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাকরিক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। তা ছাড়া আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য ভালো উদ্যোক্তা তৈরি করা খুবই জরুরি।
বর্তমান সময়ের প্রধান দাবি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন। যদি সরকার ও নীতিনির্ধারক-শিক্ষাবিদরা বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটান, তাহলে শিক্ষার সার্বিক মানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে এবং ছাত্রছাত্রীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথ আরও সুগম হবে। নতুনভাবে প্রস্তুত শিক্ষিত চৌকস স্নাতকদের ব্যাপারে নিয়োগদাতারা অধিকতর আগ্রহ দেখাবেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক দক্ষতা, সেবা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যাতে আমাদের স্নাতকরা শুধু বিসিএস বা সরকারি চাকরির জন্য মুখিয়ে না থাকে। তাহলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে তারা অনেক ভালো করবে। এমনকি উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
শেখ নাহিদ নিয়াজী; সহযোগী অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ; স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ কর র ব জ র র জন য আম দ র উপদ শ
এছাড়াও পড়ুন:
ধনী ও ক্ষমতাবানেরা কেন কুখ্যাত এপস্টেইনকে এড়িয়ে চলতে পারতেন না
২০১৯ সালে ডোনাল্ড ট্রাম্পের সাবেক আইনজীবী মাইকেল কোহেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে পর্নো তারকাকে অবৈধভাবে অর্থ দেওয়ার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের একটি কমিটির সামনে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সে বছর এটি ছিল ব্যাপক আলোচিত এক ঘটনা।
মাইকেল কোহেন যখন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিষয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছিলেন, তখন সবার নজর ছিল তাঁর দিকে।
ওই কমিটির ডেমোক্র্যাট সদস্য স্টেসি প্লাস্কেট আইনজীবী কোহেনকে প্রশ্ন করার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় একটি ক্যামেরায় দেখা যায়, প্লাস্কেট ফোনে কাউকে খুদে বার্তা পাঠাচ্ছেন।
সেদিন প্লাস্কেট আসলে কাকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন? চলতি সপ্তাহে সেই সত্য সামনে এল। অপর প্রান্তের সেই মানুষটি ছিলেন যৌন নিপীড়নের অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত জেফরি এপস্টেইন।
আদালতের নির্দেশে জনসমক্ষে আনা ই–মেইলগুলো থেকে জানা যায়, স্টেসি প্লাস্কেটকে এপস্টেইন বলেছিলেন, তিনি যাতে কোহেনকে ট্রাম্পের প্রতিষ্ঠানের এক কর্মীর ব্যাপারে প্রশ্ন করেন। কথামতো সেই প্রশ্নই করেন প্লাস্কেট। এরপর এপস্টেইন তাঁকে আরেকটি বার্তায় লিখেন, ‘দারুণ!’
এপস্টেইনের প্রভাব কত দূর বিস্তৃত ছিল
এই ঘটনা ইঙ্গিত দেয়, যুক্তরাষ্ট্রের অভিজাত মহলে এপস্টেইনের প্রভাব কতটা বেশি ছিল।
তবে যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জের প্রতিনিধি প্লাস্কেট এপস্টেইনের কাছ থেকে পরামর্শ নেওয়ার কথা অস্বীকার করে বলেছেন, সেদিন তিনি অনেক মানুষকে খুদে বার্তা পাঠিয়েছিলেন। এপস্টেইনও তাঁদের একজন। এপস্টেইন প্লাস্কেটের নির্বাচনী এলাকার ভোটার ছিলেন।
সাবেক আইনজীবী হিসেবে স্টেসি প্লাস্কেট বলেন, তিনি সব সূত্র থেকেই তথ্য নেন, এমনকি যাঁদের তিনি পছন্দ করেন না, তাঁদের কাছ থেকেও।
প্লাস্কেট বিবিসিকে বলেন, ‘এপস্টেইনের বিকৃত আচরণের কারণে আমি তাঁকে ঘৃণা করি। তাঁর অপকর্মের ভুক্তভোগীদের প্রতি আমি দৃঢ় সমর্থন জানাই ও তাঁদের সাহসের প্রশংসা করি। এপস্টেইনের সম্পূর্ণ নথি প্রকাশ করার বিষয়টিকে আমি দীর্ঘদিন ধরেই সমর্থন দিয়ে আসছি।
যৌন নিপীড়ক ও নারী পাচারকারী জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন এক নারী। এরপর গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেক নারীকে যৌন হয়রানি করার তথ্য পান। এপস্টেইন ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে সাজা দেওয়া হয়।
মিয়ামি হেরাল্ডের এক বছর আগের অনুসন্ধানে এপস্টেইনের যুক্তরাষ্ট্রের ব্যক্তিগত দ্বীপটির কথা উল্লেখ ছিল, যেখানে তিনি বহু অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোরীকে যৌন নির্যাতন করেছিলেন।
স্টেসি প্লাস্কেটের সঙ্গে ওই বার্তালাপের মাত্র ছয় মাস পর ২০১৯ সালের ১০ আগস্ট এপস্টেইন কারাগারে মারা যান। স্বাস্থ্য পরীক্ষকদের মতে, তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন।
এপস্টেইনের মৃত্যু ও তাঁকে নিয়ে ছড়ানো নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ওয়াশিংটন ও ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর ফলে তাঁর বহু পুরোনো প্রভাবশালী বন্ধু রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।
যৌন নিপীড়ক ও নারী পাচারকারী জেফরি এপস্টেইনের বিরুদ্ধে ২০০৫ সালে ফ্লোরিডা পুলিশের কাছে অভিযোগ করেন এক নারী। এরপর গোয়েন্দারা তদন্ত করতে গিয়ে তাঁর বিরুদ্ধে আরও অনেক নারীকে যৌন হয়রানি করার তথ্য পান। এপস্টেইন ২০০৮ সালে পতিতাবৃত্তির দায়ে দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে সাজা দেওয়া হয়।সম্প্রতি এপস্টেইনের প্রায় ২০ হাজার পৃষ্ঠার ব্যক্তিগত নথি প্রকাশ করা হয়। ওই নথিতে বহু ঘটনার মধ্যে স্টেসি প্লাস্কেটের সঙ্গে ওই বার্তালাপের কথাও উল্লেখ ছিল। এ থেকে আরও ভালোভাবে বোঝা যায়, অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হওয়া এবং হেরাল্ডে প্রতিবেদন প্রকাশের পরও এপস্টেইনের অভিজাত মহলে সম্পর্ক বজায় রাখার সক্ষমতা কত বেশি ছিল।
অভিজাত সমাজে এপস্টেইনের এই সম্পর্কগুলো কেন ও কীভাবে টিকে ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ‘দ্য স্পাইডার: ইনসাইড দ্য ক্রিমিনাল ওয়েব অব জেফরি এপস্টেইন অ্যান্ড গিসলেইন ম্যাক্সওয়েল’ বইয়ের লেখক ব্যারি লেভিন বলেন, এপস্টেইন ছিলেন একজন পৈশাচিক দানব। তবে অসাধারণ মেধার কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর কিছু মানুষের সঙ্গে তিনি অবিশ্বাস্য নেটওয়ার্ক তৈরি করতে পেরেছিলেন।
মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট ও বিমোহিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এপস্টেইনের।
আরও পড়ুনএপস্টেইনের যৌন কেলেঙ্কারির নথিতে স্টিফেন হকিংয়ের নামও আছে০৭ জানুয়ারি ২০২৪তথ্য যখন হাতিয়ার
লেখক ব্যারি লেভিন বলেন, এপস্টেইন নিজেকে একজন ‘মানুষ সংগ্রাহক’ বলে মনে করতেন। তিনি আর্থিক লেনদেনের উদ্দেশ্যে মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক করতেন। তিনি যাঁদের সম্পর্কে তথ্য পেতেন, তাঁদের অনুগ্রহ লাভ, অর্থ আদায় এমনকি ব্ল্যাকমেল করতে সেসব তথ্য ব্যবহার করতেন।
যুক্তরাষ্ট্রে যুক্তরাজ্যের সদ্য সাবেক রাষ্ট্রদূত পিটার ম্যান্ডেলসনের সঙ্গে এপস্টেইনের সম্পর্কের বিষয়টি বিশেষভাবে খতিয়ে দেখছে কিয়ার স্টারমার সরকার। এপস্টেইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার তথ্য সামনে আনা কিছু ই–মেইল ফাঁস হওয়ার পর তাঁকে গত সেপ্টেম্বরে বরখাস্ত করা হয়েছে।
ই–মেইলগুলোয় দেখা গেছে, ম্যান্ডেলসন ২০১৬ সালের শেষ পর্যন্ত এপস্টেইনের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছিলেন, যা মায়ামি হেরাল্ডের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশের আগে ও এপস্টেইন দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পরের ঘটনা।
মানুষকে নিজের প্রতি আকৃষ্ট ও বিমোহিত করার এক অসাধারণ ক্ষমতা ছিল এপস্টেইনের।২০১৫ সালের নভেম্বরে ম্যান্ডেলসনকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়ে একটি ই–মেইল করেন এপস্টেইন। ম্যান্ডেলসন ৯০ মিনিটেরও কম সময়ের মধ্যে সেই ই–মেইলের উত্তর দেন।
তবে ম্যান্ডেলসন দাবি করেছেন, তিনি এপস্টেইনের কোনো অপরাধের ব্যাপারে জানতেন না। তাঁর সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখায় তিনি অনুতাপও প্রকাশ করেছেন।
আরও পড়ুনজেফরি এপস্টেইনের ব্যক্তিগত ইমেইলে একাধিকবার ট্রাম্পের নাম১২ নভেম্বর ২০২৫পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সম্পর্ক
এপস্টেইনের ব্যক্তিগত নথিগুলোয় দেখা গেছে, তিনি কীভাবে পণ্ডিত, ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুসম্পর্কের মাধ্যমে বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছেন।
ব্যারি লেভিন বলেছেন, এটা বললে ভুল হবে না যে এপস্টেইনের সঙ্গে যেসব সাধারণ মানুষের পরিচয় ছিল, তাঁরা তাঁর যৌন নিপীড়ন কিংবা অপরাধের বিষয়ে জানতেন না। অথবা প্রভাবশালী মানুষদের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় তাঁর প্রতি এতটাই মুগ্ধ ছিলেন, বিষয়টি পুরোপুরি এড়িয়ে গেছেন।
ব্যারি লেভিন আরও বলেন, মানুষ অনেক কিছুই ভুলে যায়। ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের কাছে তিনি অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য মানুষ ছিলেন। অনেকে সম্ভবত তাঁর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ সত্য নয় বলেই ধরে নিয়েছিলেন। এ ছাড়া যাঁরা তাঁকে চিনতেন, তাঁরা ইঙ্গিত দিয়েছেন, কেউ কেউ হয়তো তাঁর প্রাচুর্যে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সভাপতি ল্যারি সামারস পর্যন্ত এপস্টেইনের কাছে প্রেম-সম্পর্কিত পরামর্শ চাইতেন। এমনকি ২০১৮ সালের নভেম্বরেও তিনি এক নারীর পাঠানো ই–মেইল এপস্টেইনের কাছে ফরওয়ার্ড করে জানতে চেয়েছিলেন, কীভাবে ওই ই–মেইলের উত্তর দেওয়া উচিত।
জবাবে এপস্টেইন বলেছিলেন, ‘মেয়েটি ইতিমধ্যেই আপনার প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছে বলে মনে হচ্ছে, এটা ভালো।’
এপস্টেইনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা সামারসের জন্য এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। গত সপ্তাহে তিনি ঘোষণা দেন, হার্ভার্ডে ক্লাস নেওয়া ও জনসমক্ষে অন্যান্য কার্যক্রম থেকে বিরত থাকবেন তিনি।
আরও পড়ুনকুখ্যাত যৌন নিপীড়ক এপস্টেইন-সম্পর্কিত নথি প্রকাশের বিলে কংগ্রেসের অনুমোদন১৯ নভেম্বর ২০২৫ল্যারি সামারস বলেন, ‘আমি আমার কাজের জন্য গভীরভাবে লজ্জিত এবং স্বীকার করছি যে এগুলো বহু মানুষের কষ্টের কারণ হয়েছে।’
এপস্টেইনের অর্থসম্পদ ব্যবস্থাপনার দক্ষতার মধ্য দিয়ে নোয়াম চমস্কিকেও সাহায্য করেছিলেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে। বিখ্যাত এই ভাষাতাত্ত্বিকের সঙ্গে বহু বছর ধরে তাঁর বার্তা আদান-প্রদান হয়েছিল। এমনকি এপস্টেইন তাঁকে নিজের বাড়িতেও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এমনকি একজন আরেকজনের প্রশংসাও করেছিলেন।
প্রকাশিত নথিতে দেখা গেছে, এক ই–মেইলে নোয়াম চমস্কি লিখেছিলেন, তাঁর সঙ্গে এপস্টেইনের অনেক দীর্ঘ ও গভীর আলাপ হয়েছে।
চমস্কি পরে ওয়াল স্ট্রিট জার্নালকে জানান, এপস্টেইন তাঁকে কয়েকটি অ্যাকাউন্টে অর্থ স্থানান্তরে সাহায্য করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমি তাঁকে চিনতাম এবং মাঝেমধ্যে দেখা হতো।’
এপস্টেইনের মৃত্যু ও তাঁকে নিয়ে ছড়ানো নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ওয়াশিংটন ও ওয়াল স্ট্রিটে ব্যাপক আলোড়ন তোলে। এর ফলে তাঁর বহু পুরোনো প্রভাবশালী বন্ধু রাজনৈতিক-সামাজিকভাবে বিপর্যয়ের মুখে পড়েন।চমস্কি আরও বলেন, জেফরি এপস্টেইনের সম্পর্কে যেসব তথ্য তাঁর জানা ছিল, তা হলো তিনি একটি অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং শাস্তি ভোগ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের আইন ও প্রচলিত মানদণ্ড অনুযায়ী, এরপর একজন মানুষকে নতুনভাবে জীবন শুরু করার সুযোগ দেওয়া হয়।
তবে এ বিষয়ে মন্তব্যের জন্য বিবিসির অনুরোধে সাড়া দেননি চমস্কি।
ব্যারি লেভিনের মতে, চমস্কি এপস্টেইনের বিখ্যাত আর্থিক পরিষেবা গ্রাহকদের একজন ছিলেন। এপস্টেইন তাঁর অনেক ক্লায়েন্টকে এমনভাবে সাহায্য করেছিলেন যে তাঁরা কয়েক বিলিয়ন ডলার সঞ্চয় করতে পেরেছিলেন। এ ধরনের অর্থনৈতিক পরামর্শ ও সাহায্য দেওয়ার ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
লেভিন আরও বলেন, এপস্টেইন সফলভাবে এটি করতে পারতেন। কারণ, তিনি করনীতি ও আর্থিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এমন গভীর জ্ঞান রাখতেন, যা হয়তো ওয়াল স্ট্রিটের সবচেয়ে বেশি বেতনভোগী পেশাজীবীদের চেয়েও ভালো ছিল।
যিনি সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন
এপস্টেইনের প্রায় ২৩ হাজার পৃষ্ঠার নথিতে এক ব্যক্তির নাম বারবার উঠে এসেছে, তিনি হলেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। তবে ট্রাম্প ও এপস্টেইনের মধ্যে কোনো বার্তা আদান-প্রদানের তথ্য পাওয়া যায়নি। কারণ, তিনি অনেক আগেই এপস্টেইনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন।
২০০২ সালে ট্রাম্প এপস্টেইনকে ‘একজন চমৎকার মানুষ’ হিসেবে বর্ণনা করেছিলেন। এপস্টেইনও পরে মন্তব্য করেছিলেন, ‘আমার সঙ্গে ডোনাল্ড ট্রাম্পের ১০ বছরের ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব ছিল।’
তবে দুজনের এই সম্পর্ক দ্রুতই তিক্ত হয়ে ওঠে। ট্রাম্প বলেছেন, এপস্টেইন গ্রেপ্তার হওয়ার দুই বছর আগেই তাঁর সঙ্গে সম্পর্কে ফাটল ধরে। ২০০৮ সালে ট্রাম্প বলেছিলেন, ‘আমি তাঁর ভক্ত ছিলাম না।’
ডোনাল্ড ট্রাম্প স্পষ্টভাবে বলেছেন, তিনি এপস্টেইনের যৌন নিপীড়নের বিষয়ে কিছুই জানতেন না। হোয়াইট হাউসও জানিয়েছে, ট্রাম্প বহু বছর আগে এপস্টেইনকে তাঁর ক্লাব থেকে বের করে দিয়েছিলেন। কারণ, তিনি নারী কর্মীদের সঙ্গে বাজে আচরণ করতেন।
আরও পড়ুনএপস্টেইনের নথি প্রকাশের পক্ষে হঠাৎ কেন অবস্থান নিলেন ট্রাম্প১৭ নভেম্বর ২০২৫