সামাজিক দক্ষতা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রম যে কারণে জরুরি
Published: 18th, May 2025 GMT
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি চাকরির বাজারে প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠতে ছাত্রছাত্রীকে কতটুকু সহায়তা করছে, নতুনভাবে ভাবা দরকার। স্নাতক ডিগ্রিধারীদের মধ্যে বেকারত্বের হার তীব্র হয়েছে। কয়েক বছর আগে সিপিডি পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, বেকার তরুণদের প্রায় ৪৬ শতাংশই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্নকারী। দেশে এই মুহূর্তে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় ২৬ লাখ।
গ্রেড ছাড়াও সামাজিক দক্ষতা তথা আত্মসচেতনতা, যোগাযোগ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দক্ষতা, ক্রিটিক্যাল থিঙ্কিং, টিমওয়ার্ক, কমিউনিটি সার্ভিস ইত্যাদিতে যারা ভালো সমন্বয় ঘটাতে পারে, তারাই চাকরির বাজারে প্রাধান্য পেয়ে থাকে। অনেক ছাত্রছাত্রী সামাজিক দক্ষতা, সেবা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কাজের গুরুত্ব জানতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন তারা ব্যয় করে মুখস্থ পড়ালেখা, দুশ্চিন্তা ও অলস আড্ডায়। আরেকটি বড় অংশের ধ্যানজ্ঞান শুধু বিসিএস, যাদের অনেকেই পরে আশাহত হয়।
সব ছাত্রছাত্রী পড়াশোনায় ভালো নাও হতে পারে, যা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। অনেকে অন্যান্য বিষয় যেমন– বিতর্ক, অভিনয়, সৃজনশীল লেখনী, ফটোগ্রাফি, ক্রীড়া ইত্যাদিতে নৈপুণ্য দেখাতে পারে। ক্লাব কার্যক্রম না থাকলে ছাত্রছাত্রী এসব সুপ্ত প্রতিভাচর্চার সুযোগ পায় না; শুধু পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত থাকে। অনেকের সামাজিক দক্ষতার বিকাশও ঠিকমতো হচ্ছে না। দুঃখজনকভাবে সত্যি, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীর সেই সুযোগ নেই বললেই চলে। এটি তাদের অপূরণীয় ক্ষতি বলে বিবেচিত হতে পারে।
আমার বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, তাদের অনেকে মনে করে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার উপদেশ একেবারেই অনুপস্থিত; থাকলেও সুবিধাটির বিষয়ে তারা উদাসীন। প্রকৃতপক্ষে দেশের বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্যারিয়ার কাউন্সেলিং সুবিধা নেই। অনেক শিক্ষার্থী জানে না, পাস করে বের হওয়ার পর তারা কী করবে? অনেকে তাদের নির্বাচন করা মূল বিষয়ও পছন্দ করে না। আবার সেটি বদলানোর গরজও দেখা যায় না। ক্যারিয়ার উপদেশের দুর্বল অবস্থার কারণে এমনকি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ভালো ফল করা স্নাতকরাও চাকরির বাজারের প্রত্যাশার সঙ্গে প্রাপ্তিকে মেলাতে পারে না।
এ সময়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশ মনে করে, প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত পরামর্শকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত। বিষয়টি নিয়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র হতাশা ব্যক্ত করে বলে, ‘জাতি হিসেবে আমরা শিক্ষাগত সাফল্যে যতটা গুরুত্ব দিই, মানসিক স্বাস্থ্যে ততটা গুরুত্ব দিই না।’ ছাত্রছাত্রী পারিবারিক চাপ, পড়ালেখার দুশ্চিন্তা, অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর চাপ অথবা ব্যক্তিগত সম্পর্কজনিত ঝামেলা সহ্য করতে না পেরে বিষণ্নতায় ভুগছে। নিজের ক্ষতি, এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতা অনেক বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন একজন মানুষ দরকার, যার সঙ্গে তারা অকপটে নিজেদের কঠিন সময়গুলোর ব্যাপারে আলাপ করে পরামর্শ নিতে পারবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে মূলত লেকচারভিত্তিক পাঠদান করা হয়। পরীক্ষাগুলোতে প্রকৃত বা আহরিত জ্ঞান যাচাই করার পরিবর্তে স্মরণশক্তির মূল্যায়ন করা হয়। বিশ্বের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ক্যাম্পাসভিত্তিক ও সেবা শিক্ষামূলক বা সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের আয়োজন করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সেগুলো অবজ্ঞা করা হয়। শিক্ষার্থীরা ধরে নেয়, চাকরিক্ষেত্রে এবং সার্বিকভাবে জীবনে উন্নতি করার জন্য ভালো সিজিপিএ বা লেটার গ্রেড পাওয়ার বিকল্প নেই। চার থেকে পাঁচ বছরের কঠোর পরিশ্রমের পর অনুধাবন করে, কত নাজুকভাবে তারা পরিচালিত হয়েছে বা কত দুর্বলভাবে নিজেদের গড়ে তুলেছে। আমাদের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি বড় উদাহরণ।
শিক্ষা ব্যবস্থার এসব গুরুতর সমস্যার দিকে কর্তৃপক্ষের নজর দেওয়া জরুরি। এখনই যেসব প্রশ্ন তোলা উচিত, তা হলো– আমাদের কী রকম পেশাদার জনবল রয়েছে, যারা কার্যকরভাবে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে উপযুক্ত ইন্টার্নশিপ, সেবা শিক্ষার সুযোগ, ক্লাব কার্যক্রম, ক্যারিয়ার উপদেশ ও মানসিক স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত উপদেশ দেওয়ার জন্য যথোপযুক্ত অবকাঠামো তৈরি করতে পারবে? যদি না থাকে, তাহলে ভাবতে হবে কীভাবে তাদের দ্রুততম সময়ে তৈরি করা যায়।
আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কখনোই শিক্ষার্থীদের সার্বিক উন্নয়নের দিকে নজর দেয়নি। একদিকে যেমন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়ছে, আরেকদিকে বাড়ছে তাদের বিভিন্ন দুশ্চিন্তা ও উদ্বেগ। এসব দূর করার ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিবাচক ভূমিকা থাকতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের নতুন নতুন বিষয়ে মানুষকে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ দিয়ে পেশাদার দক্ষ মানুষ তৈরি করতে হবে। শিক্ষার মানোন্নয়নে বেশ কিছু আকর্ষণীয় খাত রয়েছে, যার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চাকরিক্ষেত্র তৈরি করা সম্ভব। তা ছাড়া আমাদের অর্থনীতি শক্তিশালী করার জন্য ভালো উদ্যোক্তা তৈরি করা খুবই জরুরি।
বর্তমান সময়ের প্রধান দাবি হচ্ছে, উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে সমন্বিত ও সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি অবলম্বন। যদি সরকার ও নীতিনির্ধারক-শিক্ষাবিদরা বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষা ব্যবস্থার ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটান, তাহলে শিক্ষার সার্বিক মানে উল্লেখযোগ্য উন্নতি হবে এবং ছাত্রছাত্রীর কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের পথ আরও সুগম হবে। নতুনভাবে প্রস্তুত শিক্ষিত চৌকস স্নাতকদের ব্যাপারে নিয়োগদাতারা অধিকতর আগ্রহ দেখাবেন।
প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সামাজিক দক্ষতা, সেবা শিক্ষা ও সহ-পাঠ্যক্রমিক কার্যক্রমের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া দরকার, যাতে আমাদের স্নাতকরা শুধু বিসিএস বা সরকারি চাকরির জন্য মুখিয়ে না থাকে। তাহলে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক চাকরির বাজারে তারা অনেক ভালো করবে। এমনকি উদ্যোক্তা হিসেবেও প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে।
শেখ নাহিদ নিয়াজী; সহযোগী অধ্যাপক; ইংরেজি বিভাগ; স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: চ কর র ব জ র র জন য আম দ র উপদ শ
এছাড়াও পড়ুন:
ইউরোপের সবচেয়ে বাজে ক্লাব তারা, ৩৫ ম্যাচের একটিও জেতেনি
ইউরোপিয়ান ফুটবলে অপরাজিত থেকে মৌসুম শেষ করার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। গত মৌসুমে জার্মান চ্যাম্পিয়ন বায়ার লেভারকুসেন যখন অপরাজিত মৌসুম শেষ করার অপেক্ষায় ছিল, তখন এই রেকর্ড নিয়ে অনেক মাতামাতিও হয়েছে।
তবে এবার লেভারকুসেনের উল্টো চিত্রই উপহার দিচ্ছে চেক প্রজাতন্ত্রের ক্লাব এসকে দিনামো চেস্কে বুদেয়োভিৎসে, যারা এখন পর্যন্ত চলতি মৌসুমে ৩৫ ম্যাচ খেলে কোনোটিতেই জিততে পারেনি। এখনো মৌসুমে ২ ম্যাচ বাকি আছে তাদের। এই দুই ম্যাচে জিততে না পারার ধারা বদলাতে পারে কি না, সেটাই দেখার অপেক্ষা।
চেক ফুটবলের শীর্ষ স্তরের লিগে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের অবস্থান স্বাভাবিকভাবেই এখন সবার নিচে। ৩৩ ম্যাচে তাদের পয়েন্ট মাত্র ৬। পুরো মৌসুমে এখন পর্যন্ত একটা ম্যাচও জিততে পারেনি তারা। এমনকি ২৬ এপ্রিল ম্লাদা বোলেস্লাভের কাছে ২-১ গোলের হারের পর অবনমনও নিশ্চিত হয়ে যায় তাদের।
এরপরও অবশ্য থামেনি হারের ধারা। এমনকি গত বছরের জুনে সিলোন তাবোরস্কোর বিপক্ষে রেলিগেশন প্লে-অফে জয়ের পর এখন পর্যন্ত কোনো লিগ ম্যাচে জেতেনি চেস্কে বুদেয়োভিৎসে। লিগে ৩৩ ম্যাচে জয়হীন থাকার পাশাপাশি চেক কাপেও ২ ম্যাচ খেলে কোনোটিতে জিততে পারেনি তারা।
আরও পড়ুনআর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্স, ইংল্যান্ডের কোচরা কে কত টাকা বেতন পান১৫ মে ২০২৫এমন পরিস্থিতিতে ইউরোপীয় ফুটবলে জয়হীন ধারার কথা উঠলে চেক প্রজাতন্ত্রের এই ক্লাবের দুর্দশার সঙ্গে তুলনা টানার মতো আর কোনো ক্লাব নেই। একুশ শতকে শীর্ষ স্তরের ফুটবলে আর কোনো দলের এত বেশি ম্যাচ জয়হীন থাকার রেকর্ডও খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রশ্ন হচ্ছে, কোথায় ভুল করেছে তারা?
চেক ফুটবলের ইতিহাসে এই মৌসুম নিঃসন্দেহে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের জন্য অন্যতম ভয়াবহ এক মৌসুম হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ক্লাবটির জয়হীন মৌসুমের পেছনে একাধিক কারণ রয়েছে। ট্রান্সফারমার্কেট-এর তথ্যবিশ্লেষক ও চেক ফুটবলবিশেষজ্ঞ আন্তোনিন শ্রায়ের বলেন, ‘গত মৌসুমে দিনামো কোনোমতে অবনমন প্লে-অফ জিতে লিগে টিকে ছিল। আর ট্রান্সফার উইন্ডোতে দলটি তাদের স্কোয়াড অনেকটাই দুর্বল করে ফেলে। তাই মৌসুম শুরু হওয়ার আগেই তাদের অবনমন হওয়ার একটা আশঙ্কা ছিল। কিন্তু কেউই ভাবেনি যে তারা পুরো মৌসুমে একটা ম্যাচও জিততে পারবে না, এমন কিছু ঘটে যাওয়ার শঙ্কা সামান্যই ছিল।’
অনুশীলনে চেস্কে বুদেয়োভিৎসের খেলোয়াড়রা