সরকারি সংস্থায় সংস্কারের গতি প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম: লুৎফে সিদ্দিকী
Published: 24th, May 2025 GMT
প্রধান উপদেষ্টার আন্তর্জাতিক বিষয়সংক্রান্ত বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী বলেছেন, বর্তমানে যে গতিতে সরকারি সংস্থাগুলোর সংস্কারকাজ চলছে তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। শিল্পসহ অন্যান্য খাতে সংস্কারের কোনো পথনকশা নেই। এটি হতাশার।
আজ শনিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘এলডিসি-পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা ও চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথাগুলো বলেন লুৎফে সিদ্দিকী।
রাজধানীর মতিঝিলে ডিসিসিআই কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এই সেমিনারে বিশেষ অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সদস্য (কাস্টমস) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান মো.
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, ‘সরকারি সংস্থাগুলোর কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। তবে যে গতিতে বর্তমানে সংস্কার করা হচ্ছে, তা প্রয়োজনের তুলনায় বেশ কম। সত্যিকার অর্থে শিল্পসহ অন্যান্য খাতে আমাদের কোনো পথনকশা নেই, যা হতাশার বিষয়।’
প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার ও সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় বাড়ানো প্রয়োজন বলে জানান লুৎফে সিদ্দিকী। তিনি বলেন, দেশের বন্দরসমূহ অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। তাই এগুলোর ব্যবস্থাপনা সচল রেখে নির্বিঘ্নে কার্যক্রম পরিচালনা করা জরুরি। এ ছাড়া বেসরকারি খাতকে দেশের অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি হিসেবে উল্লেখ করে তিনি ব্যবসায়ী সমাজের দাবিসমূহ যৌক্তিকভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপনের আহ্বান জানান।
সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) নির্বাহী পরিচালক সেলিম রায়হান। এতে তিনি বলেন, দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের প্রতিযোগী সক্ষমতা বাড়াতে রপ্তানি ও আমদানি নীতি সংস্কারের কোনো বিকল্প নেই। বাণিজ্যিক, শিল্প ও আর্থিক খাতের সংশ্লিষ্ট নীতিগুলোর সমন্বয়ের মাধ্যমে বিদ্যমান পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।
সেলিম রায়হান জানান, দেশের রপ্তানি এখনো শুধু তৈরি পোশাক খাতের ওপর নির্ভরশীল। এ খাতে সরকার রপ্তানিতে নগদ সহায়তা ও কর রিটার্নের প্রণোদনা দিচ্ছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ অনেক সময় প্রতিযোগী দেশের তুলনায় আমদানি শুল্ক বেশি নেয়। আমদানি ক্ষেত্রে প্যারা-ট্যারিফ (পরোক্ষ শুল্ক) জটিলতাও রয়েছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় একটি সমন্বিত কাঠামো তৈরি করা জরুরি।
ঢাকা চেম্বারের সভাপতি তাসকীন আহমেদ বলেন, ‘স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে উত্তরণ–পরবর্তী সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আমাদের আমদানি-রপ্তানি নীতিমালা পুনর্মূল্যায়নের কোনো বিকল্প নেই। দীর্ঘদিনের উচ্চ মূল্যস্ফীতি, যুক্তরাষ্ট্রের শুল্কারোপ, রপ্তানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞা, রিজার্ভ স্বল্পতা ও আইনশৃঙ্খলার অস্থিরতার কারণে শিল্পের উৎপাদন কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। আমদানি পর্যায়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় আর্থিক খাতের স্থিতিশীলতার পাশাপাশি শুল্ক ও ট্যারিফ কাঠামোয় দক্ষ ব্যবস্থাপনা জরুরি। সেই সঙ্গে আমদানি-রপ্তানি নীতিমালার বৈসাদৃশ্য দূর করে একটি সমন্বিত বাণিজ্য নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন।’
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশকে এলডিসি থেকে উত্তরণ করতেই হবে। এখান থেকে ফিরে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। এলডিসি–পরবর্তী করণীয় নির্ধারণে শিগগিরই সবার অংশগ্রহণে একটি জাতীয় সংলাপের আয়োজন করা হবে।
এনবিআরের সদস্য (কাস্টমস) কাজী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, কেন্দ্রীয়ভাবে বন্ডেড ওয়্যারহাউস চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে সবাইকে এ সুবিধা প্রদান করা যেতে পারে। এ ছাড়া এনবিআর ইলেকট্রনিক ডেটা এক্সচেঞ্জ ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছে। এটি চালু হলে ব্যবসায়ীরা আরও স্বল্প সময়ে আমদানি করা পণ্য ছাড় করাতে পারবেন।
রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) ভাইস চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন বলেন, বাণিজ্য নীতিমালার সংস্কার, উন্নত কর্মপরিবেশ ও মান (কমপ্লায়েন্স ও স্ট্যান্ডার্ড) এবং বেসরকারি খাতের প্রস্তুতি—এই তিন বিষয়ে সরকার কাজ করছে। তৈরি পোশাক খাতে কৃত্রিম তন্তু ব্যবহারের জন্য বেসরকারি খাতকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য দেন নিট পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক, ট্যারিফ কমিশনের জয়েন্ট চিফ (ইন্টারন্যাশনাল কোঅপারেশন ডিভিশন) মো. মসিউল ইসলাম, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সাবেক সভাপতি সৈয়দ আলমাস কবীর, ডেলটা ফার্মার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মো. জাকির হোসেন ও ফকির ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফকির কামরুজ্জামান।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব সরক র সমন ব এলড স আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।