পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননে বিপুল অর্থ ব্যয় হইলেও উহা অনর্থের কারণ হইয়াছে; নাব্য সংকটে ধুঁকিতে থাকা নদটিকে উদ্ধার করা যায় নাই, উপরন্তু উহার গতিপথ পরিবর্তন হইয়াছে। ইহার জের ধরিয়া নদীভাঙনে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারাইয়া বিপদে পড়িয়াছে অনেক পরিবার। শনিবার প্রকাশিত সমকালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ তথা বিআইডব্লিউটিএ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ খননে যেই প্রকল্পের সূচনা করিয়াছে, তাহা চলতি বৎসর শেষ হইবার কথা থাকিলেও প্রকল্পের মেয়াদ আরও দুই বৎসর বাড়ানো হইয়াছে। ইতোমধ্যে সহস্রাধিক কোটি টাকা ব্যয় হইলেও নদটির পরিস্থিতির উন্নতি হয় নাই, বরং নূতন সংকট তৈয়ার করিয়াছে। বিষম পরিস্থিতিতে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বহুল উদ্ধৃত উক্তি– ‘এই জীবন লইয়া কী করিব?’ পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের অবস্থাদৃষ্টে আমাদেরও বলিতে হয়– এই খনন লইয়া কী করিব?
আমরা জানি, দেশের নদীগুলি সুস্থ নাই এবং অধিকাংশই দখল দূষণে বিপর্যস্ত। নাব্য সংকটে থাকা নদী উদ্ধারে খননকার্য জরুরি হইয়া পড়ে। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদটিও নাব্য সংকটে মৃতপ্রায় হইয়া পড়িয়াছে; যেই কারণে নদটি খননে বিপুল অর্থ ব্যয় করিয়া প্রকল্প গ্রহণ করা হয়। পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নামে পরিচিত ব্রহ্মপুত্রের সাবেক ধারাটি গাইবান্ধা, জামালপুর, শেরপুর, ময়মনসিংহ ও কিশোরগঞ্জ হইয়া ভৈরবে মেঘনা নদীর সহিত মিলিত হইয়াছে, যাহা উজানে যমুনা নদীর সহিত সংযুক্ত। বিআইডব্লিউটিএ পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের সমগ্র ২২৭ কিলোমিটার এলাকাই খননের দায়িত্বে রহিয়াছে। ছয় বৎসরের খননে এই নদে পানিপ্রবাহ তো বাড়ানো যায় নাই, বরং অন্তত তিন স্থানে ঘুরিয়া দেওয়া হইয়াছে নদের গতিপথ। কোথাও অপরিকল্পিতভাবে নদের মধ্যেই খননকৃত বালু ফেলিয়া, আবার কোথাও ভূমি দখল করিতে মূল প্রবাহ সরাইয়া দেওয়া হইয়াছে। ইহাতে নদীভাঙনে বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারাইয়াছে শত শত মানুষ।
প্রকল্পটি গ্রহণকালে বলা হইয়াছিল, খনন শেষ হইলে নদে শুষ্ক মৌসুমেও দশ মিটার পানির প্রবাহ থাকিবে; ইহা তিনশ মিটার প্রশস্ত হইলে জাহাজও চলিবে। এমনকি আন্তর্জাতিক নৌরুট হিসাবেও ব্যবহারের প্রত্যাশা ছিল। পাশাপাশি মৎস্য সম্পদের উন্নয়নের মাধ্যমে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদের দুই পারের মানুষের জীবনধারা বদলাইবার প্রত্যাশা ছিল। সেই কারণেই পৌনে তিন সহস্র কোটি টাকার বিশাল এই প্রকল্প গ্রহণ করা হইয়াছিল। অথচ প্রকল্পের নির্ধারিত সময় শেষ হইবার পর দেখা যাইতেছে পুরাতন ব্রহ্মপুত্রের পরিস্থিতি আরও নাজুক হইয়াছে। উপরন্তু ইহার দুই পারের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের বদলে তাহারা আরও বিপদে পড়িয়াছে।
এই ক্ষেত্রে কেবল অপরিকল্পিত খননই দায়ী নহে, একই সঙ্গে প্রকল্পটিতে প্রভাবশালীদের হস্তক্ষেপের কারণে উল্টা ফল দেখা যাইতেছে। বিশেষত জামালপুর শহরের মেডিকেল রোড এলাকায় ব্রহ্মপুত্রের মূলধারা ‘ইউ প্যাটার্ন’ প্রায় দেড় কিলোমিটার ঘুরাইয়া দিয়াছেন ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মির্জা আজম। বিস্ময়কর হইলেও সত্য, তিনি নদের ভরাট করা জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছেন। পাশাপাশি গফরগাঁও উপজেলায় মূল নদ ভরাট করিয়া প্রায় দুই কিলোমিটার দূর দিয়া ‘নতুন গতিপথ’ তৈয়ার করিয়েছেন আওয়ামী লীগেরই আরেক প্রতাপশালী সংসদ সদস্য, যাহার উদ্দেশ্য ছিল জমি দখল। এতদ্ব্যতীত ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের উচাখিলা নামাপাড়ায় মূল গতিপথে বালু ভরাট করিবার কারণে তিনটি উপধারা তৈয়ার হইয়াছে। এই সকল দখল ও গতিপথ পরিবর্তনের কারণে মানুষ বাড়িঘর ও ফসলি জমি হারাইয়াছে এবং কোথাও নদ সরু হইয়া খালে পরিণত হইয়াছে।
পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খননে এক মন্দ নজির স্থাপন করিয়াছে। আমরা চাই, প্রকল্পটি লইয়া সরকার অবিলম্বে তদন্ত কমিটি গঠন করিয়া যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করুক। স্বস্তির বিষয় হইল, এই প্রকল্পের মেয়াদ দুই বৎসর বাড়াইলেও বরাদ্দের অর্ধেকের বেশি রহিয়া গিয়াছে। বাকি অর্থগুলো যাহাতে জলে না ফেলাইয়া যথাযথভাবে ব্যয় করিয়া নদের পরিবেশ ফিরাইয়া আনা যায়, উহা নিশ্চিত করিতে হইবে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: প রকল প র কর য় ছ ই খনন হইয় ছ
এছাড়াও পড়ুন:
দুর্গতদের পার্শ্বে দাঁড়ান
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট লঘুচাপের কারণে মঙ্গলবার হইতে সূচিত বারিধারার কারণে ভোগান্তিতে নিপতিত দেশের লক্ষ মানুষ। বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীর দুর্ভোগ চরমে উপনীত। মাত্র এক বৎসরের ব্যবধানে ফেনী, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, কুমিল্লাসহ চট্টগ্রাম বিভাগের বিভিন্ন জেলা পুনরায় প্লাবিত হইবার শঙ্কায় পড়িয়াছে।
ফসলি জমি ও আমনের বীজতলা নিমজ্জিত হওয়া; পুকুর ও খামারের মৎস্য ভাসিয়া যাওয়া; সড়কপথ জলমগ্ন হওয়ায় চলাচলে অসুবিধাসহ বহুমাত্রিক সংকট ইতোমধ্যে দৃশ্যমান। অতিবর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ফেনীর দুইটি নদীর বেড়িবাঁধের কয়েক স্থান ভাঙিয়া যাইবার কারণে অনেক গ্রাম প্লাবিত এবং গত বৎসরের ন্যায় পুনরায় বৃহদাকার বন্যার আশঙ্কার উদ্ভব হইয়াছে।
গত বৎসর ফেনীর স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার পর সরকারের তরফ হইতে বাঁধ সুরক্ষার অঙ্গীকার করা হইয়াছিল। অথচ ঐ ভয়াবহ বন্যার পরও গতানুগতিক বাঁধ সংস্কার পদ্ধতিমুক্ত হইতে পারেনি বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড। এই বৎসরও দায়সারা প্রকারে বাঁধ সংস্কার ও পুনর্নির্মাণ হইয়াছে বলিয়া সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে আসিয়াছে। খোদ পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাগণ বলিয়াছেন, এই প্রকার সংস্কার ও মেরামত কার্যক্রমের মাধ্যমে ক্ষুদ্রাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ করা হইলেও গত বৎসরের আগস্টের ন্যায় বৃহদাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব নহে। অথচ বন্যা নিয়ন্ত্রণে টেকসই বাঁধ নির্মাণের বিকল্প নাই।
কেবল ফেনীতেই নহে; সমগ্র দেশেই বাঁধ লইয়া অভিযোগের অন্ত নাই। অনিয়মের কারণে বৎসরে বাঁধ নির্মাণে কোটি কোটি টাকা ব্যয় হয় বটে; উহা টেকসই হয় না। নির্মাণজনিত ত্রুটি ও নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার করিয়া বাঁধ নির্মাণের ফলে উহা মানুষকে বন্যা ও অন্যান্য দুর্যোগ হইতে সুরক্ষা দিতে অক্ষম।
সমকালের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ফেনীর বন্যা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে ২০০৬ সালে সূচিত ১৫১ কোটি টাকা ব্যয়ে মুহুরী-কহুয়া-সিলোনিয়া বন্যা নিয়ন্ত্রণ, নিষ্কাশন ও সেচ প্রকল্প ২০১০ সালে সমাপ্ত হইবার পর কয়েক বৎসর বন্যামুক্ত ছিল এলাকাবাসী। ২০১৩ সালে আকস্মিক বন্যায় বাঁধের তিনটি স্থানে ভাঙন ধরিবার পর প্রতি বৎসরই বাঁধ ভাঙিতেছে। অভিযোগ রহিয়াছে, দুষ্টচক্র প্রতি বৎসর বাঁধ মেরামতের নামে অর্থ লোপাট করিতেছে। ভাঙনের পর পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রভাবশালী মহল স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের দিকে অগ্রসর না হইয়া অতি দ্রুততায় কোটি টাকা ব্যয়ে অস্থায়ী বাঁধ নির্মাণ করে, যাহাতে পরের বৎসর পুনরায় বরাদ্দপ্রাপ্তি সহজ হয়। এই ক্ষেত্রে প্রতিবারই নির্দিষ্ট কয়েকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কার্যাদেশপ্রাপ্তির অভিযোগ রহিয়াছে।
আমরা বারংবার বলিয়া আসিয়াছি, বর্ষার পূর্বেই টেকসই বাঁধ নির্মাণ করিতে হইবে। তবে বর্তমান ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে যেই দুর্ভোগের উদ্ভব, উহা হইতে তাৎক্ষণিক মানুষের মুক্তিও জরুরি। ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাবাসীকে আশ্রয়কেন্দ্রে গমন বিষয়ে সচেতন করিতে হইবে।
আমরা জানি, উপকূলীয় অঞ্চলের অধিবাসীরা বন্যা, ঘূর্ণিঝড়সহ নানা প্রকার দুর্যোগ মোকাবিলা করিয়া জীবন ধারণ করিয়া থাকেন। সরকার তাহাদের স্বস্তির বিষয়ে বিভিন্ন ধরনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে অনেক সময় উহা প্রতিপালিত হয় না। আমরা মনে করি, সংগ্রামী এই সকল মানুষের পাশে সরকারকে দাঁড়াইতেই হইবে। তাহাদের জন্য টেকসই বাঁধ নির্মাণ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের আবাসন নিশ্চিতকরণ এবং প্রয়োজনে তথাকার মানুষদের অধিক হারে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় লইতে হইবে।