উচ্চ আদালতের রায়ের পর নিবন্ধন ও প্রতীক ফিরিয়ে দেওয়ার বিষয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে বৈঠক করেছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী।

সোমবার দুপুরে আগারগাও নির্বাচন ভবনে ঘণ্টাব্যাপী প্রধান নির্বাচন কমিশনার এএমএম নাসির উদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাত করেন তারা। এ সময় চার কমিশনারসহ অন্যান্য কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পরে জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ড.

এ এইচ এম হামিদুর রহমান আযাদ সাংবাদিকদের বলেন, নির্বাচন কমিশন (ইসি) উচ্চ আদালতের রায় বাস্তবায়নের বিষয়ে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছে। 

তিনি বলেন, রোববার সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ ২০১৩ সালের জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়ে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বাতিল করেছেন। এবং ইসিকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে যাওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন। তার মানে অটোমেটিক তালিকার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। আপিল বিভাগের এই নির্দেশনার মধ্যে দিয়ে আমরা আমাদের অধিকার ফিরে পেয়েছি, ন্যায় বিচার পেয়েছি। সেক্ষেত্রে আগে আমাদের দলের নিবন্ধন ও দলীয় প্রতীক যেটা ছিল সেটাই থাকবে। বিগত দিনের মতোই জামায়াত এখন নিবন্ধিত দল এবং প্রতীকও দাঁড়িপাল্লা থাকবে।  তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা মূলকভাবে তৎকালীন সুপ্রিমকোর্টের ফুলকোর্ট সভার সিদ্ধান্ত কোনোভাবেই মানার সুযোগ নেই বলে জানান তিনি।
 
তিনি আরও বলেন, এইসব বিষয় নিয়ে আমরা ছয়জন সিইসির নেতৃত্বে ফুল কমিটির সঙ্গে বৈঠক করেছি। ইসি রায় বাস্তবায়নের ব্যাপারে অত্যন্ত পজিটিভ। আমরা চাই বিলম্ব না করে রায় দ্রুত যেন কার্যকর হয়। কারণ এটার সঙ্গে কোটি কোটি মানুষের আবেগ জড়িত। দেশবাসী অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। 

হামিদুর রহমান আযাদের নেতৃত্বে ৬ সদস্যের প্রতিনিধিদলে ছিলেন জামায়াত নেতা অ্যাডভোকেট এহসানুল মাহবুব জুবায়ের, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট মতিউর রহমান আকন্দ, কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য মোবারক হোসাইন, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য অ্যাডভোকেট জসিম উদ্দিন সরকার ও আইনজীবী শিশির মনির।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: জ ম য় ত ইসল ম সদস য

এছাড়াও পড়ুন:

সংসদ ছাড়া বাজেট ও জবাবদিহির প্রশ্ন

বার্ষিক বাজেট গণতন্ত্রের একটি মৌলিক স্তম্ভ। স্বভাবতই এটি একটি রাজনৈতিক দলিল। বাজেট জনগণ থেকে প্রাপ্ত রাজনৈতিক সরকারের ম্যান্ডেট ও অগ্রাধিকার প্রতিফলিত করার কৌশল ও বাস্তবায়নকাঠামোর আর্থিক প্রতিবেদন। জাতীয় সম্পদ কীভাবে বণ্টিত হবে এবং এর দ্বারা কারা উপকৃত হবে, তার একটি নীলনকশা হচ্ছে বাজেট।

এ কারণেই সরকার বাজেট সংসদে উপস্থাপনের মাধ্যমে জনসমক্ষে তুলে ধরে। প্রতিটি দফা যাচাই-বাছাই ও কাটছাঁট করে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা জনগণের মৌলিক অধিকারের আইনি কাঠামো প্রদান করেন। 

সংগত কারণেই জুলাই অভ্যুত্থান–পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারকে ২০২৫-২৬ সালের বাজেট প্রণয়নে ভিন্ন পথ বেছে নিতে হয়েছে। সংসদ না থাকায় সংবিধানের ৯৩ (৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাজেটসংক্রান্ত আইনকাঠামো নিষ্পন্ন করা হবে। সংসদীয় বিতর্ক এবং ‘অনুদানের দাবির’ ওপর ভোট অনুপস্থিত থাকায় সরকার জনগণের মতামত চেয়েছে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য স্থাপনের মাধ্যমে আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটি সুবর্ণ সুযোগ ছিল। তা হাতছাড়া হলো। এটি হলে যুগান্তকারী নজির তৈরি হতে পারত। ৯৩ (৩) বিধান ধারাবাহিকতা রক্ষার সুযোগ দেয়।

জুলাই অভ্যুত্থানের মধ্যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার আকাঙ্ক্ষা ছিল। তা ধারণ করতে সরকার জনগণের সঙ্গে ‘অনুপস্থিত সংযোগ’ পূরণে অন্যান্য বিষয়ে যেমন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ করছে, বাজেট বিষয়েও আলোচনা করতে পারত। এতে বিভাজনের বদলে রাজনৈতিক ঐকমত্য মজবুত হতো। বাজেট বিষয়ে বর্তমান সংবিধানের জনগণের সার্বভৌমত্ব ও কর্তৃত্ব স্থাপনবিষয়ক ঘাটতি রয়েছে। এ আলোচনা করতে পারলে সেই ঘাটতি পূরণে সংস্কারের রূপরেখাও অর্জিত হতো।

বাজেট রাজনৈতিক প্রক্রিয়া

বাজেটে সংসদীয় নিয়ন্ত্রণের যাত্রা দীর্ঘ ও সমৃদ্ধ। ১২১৫ সালে ‘ম্যাগনাকার্টা’ রাজার কর আরোপের নিরঙ্কুশ ক্ষমতাকে সীমিত করেছিল। এটি সম্পূর্ণ প্রতিনিধিত্বমূলক না হলেও এতে ‘রাজ্যের সাধারণ পরামর্শের’ সম্মতির প্রয়োজন ছিল। যুক্তরাজ্যে ১৬৮৮-৮৯ সালের বিপ্লব সুদৃঢ় করেছিল কর ও ব্যয়ের ওপর সংসদের কর্তৃত্বকে। পরবর্তী সময়ে ‘প্রতিনিধিত্ব ছাড়া কর আরোপ নয়’, এই স্লোগান অষ্টাদশ শতাব্দীতে আমেরিকান বিপ্লবকে প্রজ্বলিত করেছিল। অর্থাৎ যতক্ষণ না নাগরিকদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কর ধার্য হয় ও সেই কর ব্যয় করা, ততক্ষণ নাগরিকদের কর দিতে বাধ্য করা উচিত নয়।

ঊনবিংশ শতাব্দীতে উদীয়মান বুর্জোয়া ও সামন্ত শাসকশ্রেণির মধ্যে দীর্ঘ সংগ্রামের পর ফ্রান্স আধুনিক বাজেটপদ্ধতি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ফলে জনগণের তথা রাষ্ট্রীয় অর্থের ওপর সংসদের নিয়ন্ত্রণ থাকা গণতান্ত্রিক অগ্রগতির একটি বৈশিষ্ট্য হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে নিশ্চিত হয় যে আইন প্রণয়নকারী পক্ষ জনগণের প্রতিনিধিত্ব করছে এবং রাজস্ব সংগ্রহ ও ব্যয়ের বিষয়েও তাদের চূড়ান্ত অধিকার আছে। 

বাজেট–ব্যবস্থা ও জবাবদিহির ঘাটতি

অর্থমন্ত্রী প্রতি অর্থবছরের জন্য প্রজাতন্ত্রের আনুমানিক আয় ও ব্যয়ের বিবরণ তথা বার্ষিক আর্থিক বিবরণী সংসদে পেশ করেন। তা করা হয় সংবিধানের ৮৭ (১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী। ১ জুলাই থেকে শুরু হওয়া অর্থবছরের পুরো এক মাস আগে বিতর্কের সুযোগ তৈরি করতে এই দলিল সংসদে উপস্থাপিত হয়।

সংসদ সদস্যরা ‘অনুদানের দাবি’ অর্থাৎ মন্ত্রণালয়গুলোর প্রস্তাবিত ব্যয় যাচাই-বাছাই করেন। ৮৯ (২) অনুচ্ছেদমতে, বার্ষিক আর্থিক বিবরণীর ব্যয়সংক্রান্ত বিষয় দাবির আকারে সংসদে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হয়। আর সংসদ অনুমোদন বা অননুমোদন বা উল্লিখিত অর্থের পরিমাণ হ্রাস করার ক্ষমতাপ্রাপ্ত। এটি নিছক আমলাতান্ত্রিক আচার নয়। এটি জবাবদিহির মৌলিক নীতি। অর্থাৎ সরকার রাষ্ট্রের প্রকৃত মালিক (৭ [১] অনুচ্ছেদ) তথা জনগণের কাছ থেকে তহবিল ‘দাবি’ করছে।

সংসদ সদস্যগণ বরাদ্দ কমাতে ‘কাটছাঁট প্রস্তাব’ আনতে পারেন এবং অনুমোদন, কমানো বা বাতিলও করতে পারেন। ৮৮ অনুচ্ছেদের কিছু অ-ভোটযোগ্য ব্যয়ের তালিকা বাদে প্রতিটি ‘অনুদানের দাবি’ ভোটে উপস্থাপিত হয়। এটি নিশ্চিত করে যে জনগণের প্রতিনিধিরা প্রতিটি ব্যয় সরাসরি অনুমোদন করেন। প্রতিটি দাবি অনুমোদিত হওয়ার পর আইনি কাঠামোয় স্থায়ী রূপ পায়। ৮৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কর প্রস্তাব নির্ধারণকারী ‘অর্থ বিল’ নিয়ে বিতর্ক হয়ে পাস হলে নতুন কর আইন কার্যকর হয়। ৯০ (১) অনুচ্ছেদ অনুসরণে ‘সমন্বিত তহবিল’ থেকে অর্থ উত্তোলনের অনুমোদন দিতে ‘আর্থিক অনুমোদন বিল’ উত্থাপন করে পাস করা হয়।

বাজেট ‘অর্থবিল’ হওয়ায় সংসদীয় কমিটিতে আলোচনা হয় না। দলের বাইরে গিয়ে ভোট দেওয়ার সুযোগ না থাকায় দলের বাইরের প্রস্তাব যুক্ত করা কঠিন। সত্যিকারের বিতর্কের অভাব এবং অর্থবহ সংশোধনী প্রস্তাব করার অক্ষমতা সংসদীয় জবাবদিহিকে উল্লেখযোগ্যভাবে দুর্বল করে। সংসদীয় কমিটির সুপারিশগুলো প্রায়ই মন্ত্রণালয় দ্বারা বাস্তবায়িত হয় না।

এই পদ্ধতিগত দুর্বলতা আইন প্রণয়নকারী শাখার তদারকি করার ক্ষমতাকে সীমিত করে। অবাস্তব রাজস্ব পূর্বাভাস এবং পরিপূরক বাজেটের ওপর ঘন ঘন নির্ভরতার কারণে বাজেটের সামগ্রিক বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রায়ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়। পদ্ধতিগত দুর্বলতা, সম্মিলিতভাবে বাংলাদেশের বাজেট–ব্যবস্থায় প্রকৃত জবাবদিহিকে দুর্বল করে। মৌলিক প্রশ্ন থেকেই যায় যে জাতীয় বাজেট কার জন্য, কেন এবং কীভাবে নির্ধারিত হয়? 

অন্তর্বর্তীকালীন শাসনসংক্রান্ত রীতিনীতির অনুপস্থিতি

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ডিসেম্বর-জুন নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছে। একটি সাধারণ নির্বাচন আসন্ন। এবারের বাজেটের অর্থবছরে নির্বাচিত সরকার আসার সম্ভাবনা আছে। বাজেট অনুমোদনের পদ্ধতিতে অবিচ্ছিন্ন সরকারি সেবার প্রয়োজনের সঙ্গে গণতান্ত্রিক বৈধতার নীতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন পন্থা থাকে। বাংলাদেশের বহাল সংসদীয় গণতন্ত্রে তা নেই। 

ওয়েস্টমিনস্টার ঐতিহ্য অনুসরণকারী দেশ, যেমন কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড ইত্যাদি ‘অন্তর্বর্তীকালীন শাসনসংক্রান্ত রীতিনীতি’ মেনে চলে। তাদের অলিখিত কিন্তু দৃঢ়ভাবে অনুসৃত নিয়মগুলো নির্দেশ করে যে নতুন ম্যান্ডেট নেই এবং দায়িত্ব ছেড়ে দেবে, এমন সরকার বড় ধরনের নীতি পরিবর্তন, উল্লেখযোগ্য কর সমন্বয় বা নতুন, বৃহৎ আকারের আর্থিক প্রতিশ্রুতি এড়ানো উচিত।

উদাহরণস্বরূপ, যতক্ষণ না নতুন নির্বাচিত সরকার তার বাজেট উপস্থাপন করে, কানাডা নতুন অর্থবছরের প্রথম কয়েক মাসের সরকারি ব্যয় মেটানোর জন্য ‘অন্তর্বর্তীকালীন সরবরাহ’ বা ‘হিসাবের ওপর ভোট’ ব্যবহার করে। একইভাবে ভারত ‘অন্তর্বর্তীকালীন বাজেট’ এবং ‘হিসাবের ওপর ভোট’ (সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদের অধীনে) ব্যবহার করে অস্থায়ী আর্থিক পরিকল্পনা করে। জার্মানির সংসদীয় ব্যবস্থায় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সম্পর্কে আরও সংজ্ঞায়িত আইনি কাঠামো রয়েছে। ব্রাজিলের মতো দেশগুলো ‘অংশগ্রহণমূলক বাজেটিং’ ব্যবস্থায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে।

জবাবদিহির মাধ্যমে এগিয়ে যাওয়া

বাজেট অনুমোদনের জন্য প্রচলিত সাংবিধানিক পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে। সংবিধানে উল্লিখিত জনগণের চূড়ান্ত মালিকানা এবং সরকারি তহবিলের ওপর নিয়ন্ত্রণ-বাস্তবায়নে ব্যাপক সংস্কার জরুরি।

সংসদ না থাকা অবস্থায় অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব গণতান্ত্রিক জবাবদিহির চেতনাকে যথাসম্ভব সমুন্নত রাখা। আনুষ্ঠানিক সংসদীয় বিতর্ক না থাকলেও অন্তর্বর্তী সরকারের উচিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের সঙ্গে বাজেট নিয়ে আলোচনা করা। জবাবদিহি এবং বাংলাদেশে সংসদীয় তদারকি শক্তিশালী করার জন্য মৌলিক সাংবিধানিক ও পদ্ধতিগত সংস্কারও অপরিহার্য। এ ক্ষেত্রে জুলাই সনদে সংসদীয় কমিটিকে শক্তিশালী করা, স্বচ্ছতা এবং জনসাধারণের অংশগ্রহণ, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য পরিষ্কার নির্দেশিকাসহ বিস্তৃত বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা যায়। 

ড. রাশেদ আল মাহমুদ তিতুমীর অধ্যাপক, উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ