টানা চার দিন ধরে দাবানলে জ্বলছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের লস অ্যাঞ্জেলেস শহর। শত চেষ্টার পরও নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না আগুন। পুড়ে ছারখার হচ্ছে এলাকার পর এলাকা। আগুনে এখন পর্যন্ত দেড় শ বিলিয়ন ডলার মূল্যের সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। মানুষের প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১০ জনে। এই পরিস্থিতির মধ্যে লুটপাটও চালাচ্ছে দুর্বৃত্তরা। লুটপাট ঠেকাতে একটি এলাকায় কারফিউ জারি করা হয়েছে।

লস অ্যাঞ্জেলেসে আগুনের সূত্রপাত হয় গত মঙ্গলবার। স্থানীয় সময় গতকাল বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত পাঁচটি স্থানে দাবানল সক্রিয়ভাবে জ্বলছিল। এর মধ্যে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের পশ্চিম দিকে সান্তা মনিকা ও মালিবু এলাকার মাঝে এবং পূর্ব দিকে পাসাডেনা এলাকার কাছের দাবানল দুটি সবচেয়ে বেশি ধ্বংসের কারণ হয়েছে। এই দুই দাবানলে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে ৩৪ হাজার একর জায়গার গাছপালা, ঘরবাড়িসহ সবকিছু।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষের দেওয়া হিসাবে, আগুনে এখন পর্যন্ত প্রায় ১০ হাজার স্থাপনা ধ্বংস হয়ে গেছে। এর মধ্যে সান্তা মনিকা ও মালিবু এলাকার মাঝে দাবানলে পুড়েছে ৫ হাজার ৩০০ স্থাপনা। পাসাডেনা এলাকার কাছের দাবানলে পুড়েছে ৪ হাজার থেকে ৫ হাজার স্থাপনা। আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে এই ক্ষয়ক্ষতি আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

লস অ্যাঞ্জেলেসের ইতিহাসে ভয়াবহতম এই আগুনে ৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ক্ষতি হয়েছিল বলে গত বুধবার জানিয়েছিল আবহাওয়াবিষয়ক তথ্য সরবরাহকারী ওয়েবসাইট অ্যাকুওয়েদার। এক দিন পরই তা বেড়ে তিন গুণ হয়েছে। ওয়েবসাইটটির বৃহস্পতিবারের তথ্য অনুযায়ী, আগুনে এখন পর্যন্ত ১৩৫ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলারের সম্পদের ক্ষতি হয়েছে।

এদিকে শহরের হলিউড হিল এলাকার আগুন নিয়ন্ত্রণে এনেছেন ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা। দাবানলের ভয়ে সেখান থেকে সরে যাওয়া অনেক মানুষ নিজেদের বাড়িতে ফিরছেন। অভিজাত প্যাসিফিক প্যালিসেইডস এলাকায় পুড়ে ছাই হওয়া ঘরবাড়িগুলোতেও লোকজনকে ফিরতে দেখা গেছে। এমনই একজন বিলাল তুখি। তিনি বলেন, আগুনে পোড়া এলাকাটি তাঁকে যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে।

এই এলাকারই আরেক বাসিন্দা জন কার (৬৫)। প্রাণ বাঁচাতে এলাকা ছাড়ার নির্দেশনা দেওয়ার পরও তিনি নিজ বাড়িতে থেকে যান। জন কার বলেন, বাড়িটি তাঁর মা–বাবা ১৯৬০ সালে নির্মাণ করেছিলেন। অনেক স্মৃতি থাকায় বাড়িটি ছেড়ে যাননি তিনি। তাঁর অভিযোগ, প্রতিবেশীদের ঘরবাড়িগুলো আগুন থেকে বাঁচাতে ফায়ার সার্ভিসের কোনোরকম সহায়তা পাননি তিনি।

যদিও লস অ্যাঞ্জেলেসের মেয়র কারেন বাস বলেছেন, আগুন নিয়ন্ত্রণে আসার পর শহর পুনর্নির্মাণে জোর তৎপরতা শুরু করবেন তাঁরা। আর আজ শুক্রবার প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, এই আগুন নেভাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু করার জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসের গভর্নর ও স্থানীয় সরকারকে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি।

আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িতে ফিরে কান্নায় ভেঙে পড়েন একটি পরিবারের সদস্যরা.

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

অন্তঃসত্ত্বার আস্থার নাম হোসনেয়ারা 

কুমিল্লার দাউদকান্দি উপজেলার চন্দ্রশেখরদী গ্রামে থাকেন হোসনেয়ারা বেগম। ১৯৯০ সালে তিনি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করানোর বিষয়ে সরকারি প্রশিক্ষণ শুরু করেন। টানা ৩৬ মাস চলে সেই প্রশিক্ষণ। তখন থেকে উপজেলার নানা গ্রামে গিয়ে কাজ করেন তিনি। 

৩৫ বছর ধরে হোসনেয়ারা বেগম বিনা মূল্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করান। এই কাজের উৎসাহ পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি জয়বাহার আক্তারের কাছ থেকে। তিনি বিনা মূল্যে প্রসব করানোর কাজ করতেন। মা ও নবজাতকের হাসি দেখে আনন্দ পান, তাই কাজটি করে যাচ্ছেন বলে জানালেন হোসনেয়ারা। 

বিপদের বন্ধু হোসনেয়ারা

২০০২ সালের আগস্ট মাসের কথা। এক রাতে দাউদকান্দির এক অন্তঃসত্ত্বা রহিমা আক্তারের প্রসবব্যথা ওঠে। হাসপাতালে নেওয়ার পথে দুর্ঘটনায় তাঁকে বহন করা নৌকার সামনের অংশ ভেঙে যায়। ওই অবস্থায় তাঁকে বাড়িতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। খবর দেওয়া হয় হোসনেয়ারা বেগমকে।

খবর পেয়ে হোসনেয়ারা অন্তঃসত্ত্বা রহিমা বেগমের বাড়িতে যান। স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় যমজ সন্তান প্রসব করান। তাদের শারীরিক অবস্থা নাজুক ছিল। নবজাতকদের মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক করেন। তাদের নাম রাখা হয় সালমা আক্তার ও আমেনা আক্তার। জন্মের ছয় মাস পর আমেনার মৃত্যু হয়। আর সালমা বর্তমানে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করছেন।

সেই ঘটনা গ্রামের মানুষের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে। এর পর থেকে নিজের গ্রাম ও আশাপাশের গ্রামে হোসনেয়ারার কাজ বেড়ে যায়। সবাইকে তিনি হাসিমুখে সেবা দেন। নিজের আন্তরিক চেষ্টা ও কর্মগুণে অল্প দিনেই অন্তঃসত্ত্বা নারীদের বিপদের বন্ধু হয়ে ওঠেন। তাঁর প্রতি অন্তঃসত্ত্বা নারীদের আস্থা ও ভরসা বাড়তে থাকে।

৩৫ বছর ধরে হোসনেয়ারা বেগম বিনা মূল্যে অন্তঃসত্ত্বা নারীদের স্বাভাবিক প্রসব করান। এই কাজের উৎসাহ পেয়েছিলেন তাঁর শাশুড়ি জয়বাহার আক্তারের কাছ থেকে। তিনি বিনা মূল্যে প্রসব করানোর কাজ করতেন।

মাতৃমৃত্যুর ঘটনা নেই

হোসনেয়ারা বেগম একা কৃতিত্ব নিতে চান না। তিনি তাঁর শাশুড়ি ও পরিবারকল্যাণ সহায়িকা রৌশনারা আক্তারের কৃতিত্বের কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, টানা ৩৫ বছরে তাঁর হাতে কমপক্ষে ১১ হাজার নবজাতকের স্বাভাবিক প্রসব হয়েছে। একটি মাতৃমৃত্যুর ঘটনাও ঘটেনি। 

নিজে অসুস্থ থাকলেও খবর পেলে অন্তঃসত্ত্বার কাছ ছুটে যান। এমন একটি ঘটনা স্মরণ করে তিনি বলেন, ২০১৫ সালের জুলাই মাসের ঝড়বৃষ্টির রাতে তিনি অসুস্থ ছিলেন। খবর পান, তাঁর গ্রামের সুলতান মিয়ার মেয়ে অন্তঃসত্ত্বা জোসনা আক্তারের ভীষণ প্রসবব্যথা। ঝড়বৃষ্টির কারণে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তখন তিনি অসুস্থ শরীরে ওই বাড়িতে যান। সুস্থভাবে প্রসব করান। 

আরেকটি ঘটনা ২০১৮ সালের ঈদুল আজহার দিনের। হোসনেয়ারা সকাল থেকে পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ঈদের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এমন সময় খবর আসে পাশের মাইথারদিয়া গ্রামের ইউনুস মিয়ার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী শান্তি আক্তার প্রসবব্যথায় ছটফট করছেন। খবর পেয়ে  তিনি সেখানে গিয়ে স্বাভাবিক প্রসব করান। সেখান থেকে পাশের পাঁচভিটা গ্রামে মনি নামের আরেক অন্তঃসত্ত্বা নারীর প্রসব করাতে যান। বাড়ি ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। 

হোসনেয়ারা বেগমের ভাষ্য, মানবসেবার মধ্যেই তিনি ঈদের আনন্দ খুঁজে পেয়েছিলেন। স্বাস্থ্যসেবায় অবদানের জন্য তিনি এখন পর্যন্ত কোনো পুরস্কার পাননি। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি তিন ছেলে ও তিন মেয়ের মা। তাঁর স্বামী হযরত আলী ২০২৪ সালের ৬ মার্চ মারা যান। যত দিন সুস্থভাবে বেঁচে থাকবেন, তত দিন আনন্দ নিয়ে কাজটি করে যেতে চান তিনি।

সম্পর্কিত নিবন্ধ