ডিজিটালাইজেশনের মাধ্যমে বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো এই শিল্পে বিপ্লব আনতে পারে। তৈরি পোশাক খাতে ডিজিটাল রূপান্তর বলতে দক্ষতা, স্থায়িত্ব এবং ক্রেতা সহযোগিতা উন্নত করার জন্য ইআরপি সিস্টেম, অটোমেশন, এআই, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং ক্লাউডভিত্তিক প্ল্যাটফর্মের মতো ডিজিটাল প্রযুক্তির একত্রীকরণকে বোঝায়। বিশ্ববাজারের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে, উৎপাদনকে সুবিন্যস্ত করতে এবং টেকসই উন্নত করতে শিল্পের জন্য এই রূপান্তর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের কারখানাগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি সময়, খরচ ও অপচয় কমাতে পারে। নিশ্চিত করতে পারে সামঞ্জস্যপূর্ণ গুণমান। নিতে পারে তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত। এমন রূপান্তর স্থায়িত্বকেও উৎসাহিত করে এবং সম্পদের ব্যবহারকে সর্বোত্তম করে তোলে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্প খাতে ডিজিটালাইজেশনের সম্ভাব্য মূল দিকগুলো হচ্ছে– অটোমেশন ও স্মার্ট ম্যানুফ্যাকচারিং, ই-কমার্স এবং অনলাইন মার্কেট প্লেস, সাপ্লাই চেইন অপটিমাইজেশন, ডেটা অ্যানালিটিক্স এবং অন্তর্দৃষ্টি, স্থায়িত্ব এবং ট্রেসেবিলিটি, ব্লকচেইন প্রযুক্তি, আর্থিক অন্তর্ভুক্তি, থ্রিডি ডিজাইন এবং ভার্চুয়াল প্রোটোটাইপিং, ইআরপি সিস্টেম এবং ক্লাউড কম্পিউটিং।
ডিজিটাল রূপান্তরের সুবিধাগুলোর মধ্যে রয়েছে– উন্নত উৎপাদন গতি ও নির্ভুলতা, পরিচালন খরচ ও অপচয় হ্রাস, রিয়েল টাইম আপডেট তথা তথ্যভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে পারা, সরবরাহ শৃঙ্খল ট্রেসেবিলিটি ও বর্ধিত কর্মী নিরাপত্তা এবং উৎপাদনশীলতা।
ডিজিটাল রূপান্তরের কিছু চ্যালেঞ্জও রয়েছে। যেমন– ছোট এবং মাঝারি আকারের কারখানার জন্য প্রাথমিক বিনিয়োগ খরচ, কর্মীদের মধ্যে দক্ষতার ব্যবধান, তথ্য সুরক্ষা, সাইবার নিরাপত্তা ঝুঁকি এবং পরিবর্তনের প্রতিরোধ উল্লেখযোগ্য।
বাংলাদেশে যেখানে প্রতিনিয়ত অনেক ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প নিজেদের টিকিয়ে রাখতে লড়াই করছে, সেখানে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণ টিকে থাকার চাবিকাঠি হতে পারে, এমনকি প্রবৃদ্ধিরও। সঠিক ব্যবস্থার মাধ্যমে কারখানাগুলো এখন উৎকর্ষ বজায় রেখে এবং প্রক্রিয়া ক্ষতি এড়িয়ে সঠিক মূল্যে যে কোনো এওকিউ গ্রহণ করতে পারে এবং সেই সঙ্গে লাভজনক বিনিয়োগে পরিণত করতে পারে।
যেহেতু অতীতে এই শিল্প গড়েই উঠেছিল শুধুই কম মূল্যের শ্রমের বিনিময়ে, তাই বাংলাদেশ মূলত অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের পোশাক করতে পারদর্শী বেশি ছিল। যদিও শুরু দিকে আমাদের শ্রমিকরা ততটা দক্ষ ও পারদর্শী ছিল না। এটি এখন পরিবর্তনের প্রক্রিয়ার দিকে যাচ্ছে অনেক জোরেশোরে। আমাদের দেশের বেশির ভাগ কারখানাই হলো ছোট বা মাঝারি আকারের। আর আজ যখন খরচের বোঝা লাগামহীন এবং প্রতিযোগিতা অপরিসীম, তখন এই শিল্পের ছোট ও মাঝারি কারখানাগুলো টিকে থাকার লড়াইয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। একটা পর্যায়ে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ হতে বাধ্য হচ্ছে। আমরা প্রথম থেকেই দক্ষতার অভাবে ছোট আকারের কাজ করতে পারদর্শী না। আর এর ফলে অনেক গুণগত পণ্যের উৎপাদন আমাদের এখানে কম হয়ে থাকে। কারণ, আমরা সেগুলো নিজেদের জন্য লাভজনক করতে পারি না এবং ক্রেতাকে সঠিক সময়ে পৌঁছাতেও ততটা পারি না। এই একই কারণে অনেক দামি পোশাক সরবরাহকারী ক্রেতারা আমাদের দেশে আসতে চান না বা পারেন না। অথচ ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণ করে এই ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলো শুধু লাভজনক হতে পারে না বরং বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে পারে অন্য এক মাত্রায়। বর্তমানে চলছে ফাস্ট ফ্যাশনের যুগ। আর এখন তাই ছোট ছোট ক্রয়াদেশ ও দামি পোশাকের চাহিদা বেড়েই চলেছে, যা আবার ক্রেতাকে পৌঁছেও দিতে হয় গতানুগতিক ক্রয়াদেশের অনেক আগে। তাই লিড টাইম কমিয়ে ডিজিটালাইজেশন এখানে অনেক মূল্যবান ভূমিকা রাখতে পারে, যা ক্রেতাকে সন্তুষ্ট এবং নতুন নতুন ক্রেতাকে আকৃষ্ট করতে পারে।
যদি আমরা এই শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই, তাহলে আমাদের প্রতিনিয়ত নতুন উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে। আর একজন নতুন উদ্যোক্তার পক্ষে বড় ধরনের বিনিয়োগ নিয়ে নামা অনেক কঠিন হয়ে থাকে। আবার ছোট ও মাঝারি শিল্প বৃহৎ শিল্পের থেকে তুলনামূলক কম লাভজনক হওয়ায় এই ক্ষেত্রে বিনিয়োগে উৎসাহ কম দেখা যায়। ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণে ছোট কারখানা করেও লাভজনক করা সম্ভব। সাধারণ ছোট বা মাঝারি কারখানা থেকে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণ করা খরচ বেশি পরে। তবুও তা বৃহৎ শিল্পের চেয়ে অনেক গুণ কম, আর বিনোয়োগ ফেরত পেতে সময়ও কম লাগে। বৃহৎ শিল্পেও একইভাবে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণ করা সম্ভব। যদিও তাতে বিনিয়োগ অনেক বেশি, তবে ফেরত পাওয়ার হারও অনেক দ্রুত হয়, যা সব ধরনের বিনিয়োগকারীদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমরা ছোট ও মাঝারি শিল্পগুলোকে বোঝা মনে না করে ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে আশীর্বাদে রূপান্তর করতে পারি। তবে এই ক্ষেত্রে সরকারি ও বেসরকারি সমন্বিত উদ্যোগ অনেক বেশি প্রয়োজন। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে, যত দিন যাবে, তত শিল্পের প্রতিযোগিতা আন্তর্জাতিকভাবে বাড়তেই থাকবে। আর সেই সঙ্গে জটিল হতে থাকবে নিয়মকানুন। ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অনেক সহজ হবে। আর তা না হলে প্রতিযোগিতায় অন্যদের চেয়ে ছিটকে পড়তে হবে।
যে কোনো শিল্পেই আসলে এক ধরনের ভারসাম্য থাকা প্রয়োজন, যা কারখানার আকার থেকে ক্রয়াদেশের আকার– সব ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আর এই ভারসাম্য না থাকলে শিল্পকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যাওয়া কঠিন। ডিজিটালাইজেশন পদ্ধতি গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি ভারসাম্যপূর্ণ শিল্প গড়ে তুলতে পারে। যার জন্য প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ এবং সঠিক মানসিকতা।
লেখক : সাবেক পরিচালক, বিজিএমইএ ও অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ডেনিম এক্সপার্ট
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প ন তর এই শ ল প ল ভজনক আম দ র র জন য অন ক দ ধরন র ত করত
এছাড়াও পড়ুন:
ভোজ্যতেলের দাম ও চট্টগ্রাম বন্দরের ট্যারিফ বাড়ানো প্রত্যাহারের দাবি বাম গণতান্ত্রিক জোটের
সয়াবিন ও পাম তেলের দাম এবং চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল (ট্যারিফ) বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানিয়েছে বাম গণতান্ত্রিক জোট। এই সিদ্ধান্তকে গণবিরোধী উল্লেখ করে অবিলম্বে প্রত্যাহারের জন্য সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন জোটের নেতারা।
আজ মঙ্গলবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে বাম গণতান্ত্রিক জোটের নেতারা এসব দাবি জানান।
বিবৃতিতে বলা হয়, সরকার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য ও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। বাজারে চাল, ডাল, সবজিসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে চলেছে। তার ওপর নতুন করে বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৬ টাকা, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ৮ টাকা এবং খোলা পাম অয়েলের মূল্যবৃদ্ধির গণবিরোধী সিদ্ধান্ত জনজীবনের সংকটকে আরও ভয়াবহ করে তুলবে।
গত এপ্রিলে বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেল এবং পাম অয়েলের দাম ১২ টাকা বাড়ানো হয়েছিল উল্লেখ করে বিবৃতিতে জোটের নেতারা বলেন, ৫ মাসের ব্যবধানে নতুন করে মূল্যবৃদ্ধির কোনো যৌক্তিকতা নেই।
চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহারে মাশুল বাড়ানো প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়, জনগণের কথা না ভেবে আমদানি-রপ্তানিকারকদের কথা চিন্তা করে একতরফাভাবে বন্দরের মাশুল (ট্যারিফ) ৪১ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্ত মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। লাভজনক অবস্থায় থাকার পরও ট্যারিফ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত খুবই রহস্যজনক। একদিকে জনমত উপেক্ষা করে লাভজনক বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডেলিংয়ের দায়িত্ব বিদেশি কোম্পানিকে দেওয়ার চক্রান্ত চলছে। তারই অংশ হিসেবে বিদেশি কোম্পানিকে যাতে ট্যারিফ বাড়াতে না হয়, সে জন্য বিদেশি অপারেটরদের মুনাফার সুবিধা করে দিতেই ইজারার পূর্বে সরকারই ট্যারিফ বাড়ানোর এই গণবিরোধী সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
আরও পড়ুন৪০ বছর পর চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বেড়েছে, কমানোর সুযোগ নেই: নৌপরিবহন সচিব১২ অক্টোবর ২০২৫বিবৃতিতে বলা হয়, এই ট্যারিফ বাড়ানোর প্রভাব পড়বে আমদানি–রপ্তানি বাণিজ্যে। ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়বে এবং এই বাড়তি মূল্য দেশের জনগণকেই পরিশোধ করতে হবে।
বিবৃতিতে বাড়িভাড়া বৃদ্ধিসহ তিন দফা দাবিতে আন্দোলনরত এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের ওপর পুলিশের হামলার নিন্দা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। অবিলম্বে হামলাকারী পুলিশের বিচারও দাবি করেছেন বাম জোটের নেতারা। একই সঙ্গে শিক্ষকদের দাবি মেনে নিতে সরকারের প্রতি জোর দাবি জানানো হয়।
বাম গণতান্ত্রিক জোট কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের সমন্বয়ক ও বাসদের সাধারণ সম্পাদক বজলুর রসিদ ফিরোজ, সিপিবির সভাপতি সাজ্জাদ জহির চন্দন, সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ ক্বাফী রতন, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল কবির জাহিদ, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাসদের (মার্কসবাদী) সমন্বয়ক মাসুদ রানা ও সমাজতান্ত্রিক পার্টির নির্বাহী সভাপতি আবদুল আলী যৌথভাবে এ বিবৃতি দিয়েছেন।
আরও পড়ুনসয়াবিনের দাম লিটারে ৬ টাকা ও পাম তেলে ১৩ টাকা বেড়েছে২১ ঘণ্টা আগে