চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে তরুণদের দেশভাবনা ও প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছে নানা মাধ্যমে– গানে, স্লোগানে, ফেস্টুনে, গ্রাফিতিতে, কবিতায়। তবে আন্দোলনের সময় চোখে পড়ার মতো সংখ্যায় গান তৈরি হয়েছে, যার অধিকাংশই র্যাপ ধারার। শহীদদের রক্তে জারিত আন্দোলনের মাঠে শরীর কাঁপানো এই গানগুলো শুধু আবেগ নয়, ছিল শিকল ছেঁড়ার সুরও। অন্য মেলোডি ঘরানার গানও কম হয়নি।
ছাত্র-জনতার এই আন্দোলনে কিছু গান রীতিমতো উৎসাহ আর অনুপ্রেরণার জ্বালানি হিসেবে কাজ করেছে। এর মধ্যে যেটি একাধিক লাইনে স্লোগানের রূপ নিয়েছে, তা হলো ‘শূন্য’ ব্যান্ডের *শোনো মহাজন*। এক দশক আগের এই গান যেন পুনর্জন্ম পেল এবারের বিপ্লবে। ২০১৪ সালে প্রকাশিত ‘শূন্য’র চতুর্থ অ্যালবাম ‘ভাগো’ থেকে নেওয়া গানটি এর আগেও নানা প্রতিবাদ-আন্দোলনে ব্যবহৃত হয়েছে।
‘শূন্য’র দলপ্রধান ও ভোকাল ইমরুল করিম এমিল বলেন, ‘গানটি লিখেছেন শাহান কবন্ধ। তিনি যেমন অনুভব করে লিখেছিলেন, আমরাও পারফর্ম করার সময় সেই আবেগটাই পেয়েছি। এবার এই আন্দোলনে গানটি নতুনভাবে অর্থবহ হয়ে উঠেছে– এটি আমাদের গর্ব।’
গণঅভ্যুত্থানের অবরুদ্ধ সময়ে দ্রোহের সুরে গান বেঁধেছিলেন গায়িকা পারশা মাহজাবীন। তাঁর লেখা ও সুর করা গান ‘চলো ভুলে যাই’ আন্দোলনে আলোড়ন তোলে। পারশা বলেন, ‘এখনও অনেকে বলেন, গানটা শুনলে মন ভার হয়ে আসে, কান্না পায়।’ আন্দোলনের ভেতর মাত্র ১০ মিনিটে লেখা এই গান তাঁর ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। ‘তিন বছরের ক্যারিয়ারে এটিই আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি’, বলেন পারশা– ‘জনপ্রিয়তার কথা ভেবে গানটি লিখিনি। হয়তো সে কারণেই গানটি মানুষের মনে এমনভাবে জায়গা করে নিয়েছে।’
রাজপথে যখন শিক্ষার্থীরা লড়ছিল, তখন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন আবু সাঈদ। সেই অবরুদ্ধ সময়কে র্যাপ গানে তুলে ধরেন নারায়ণগঞ্জের তরুণ শিল্পী সেজান। তাঁর লেখা ‘কথা ক’ গানটি ১৬ জুলাই প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সেজান সাধারণ মানুষের গলা টিপে ধরা কথাগুলোকে তুলে আনেন র্যাপে– ‘আমার ভাই-বইন মরে রাস্তায়, তর চেষ্টা কইরে? কথা ক?’ সেজান বলেন, ‘‘জেদ থেকেই ‘কথা ক’ গানটি লেখা। যে কোনো মানুষের দাবি থাকতেই পারে। সেটি নিয়ে যদি অত্যাচার করা হয়, তাহলে আমাদের স্বাধীনতা কোথায়। এমন অনেক প্রশ্ন মাথায় নিয়েই গানটি লিখেছি।’’
গণঅভ্যুত্থানের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল বাংলা র্যাপ গানের অভূতপূর্ব উত্থান। আন্দোলনের মধ্যে প্রকাশিত হয় অন্তত ৪০টির বেশি র্যাপ গান, যা অন্য কোনো ঘরানায় ঘটেনি। র্যাপ গানের শ্রোতা এবার ছড়িয়ে পড়ে আন্দোলনমুখী জনতার ভেতরেও।
আরেকটি বহুল আলোচিত র্যাপ গান ছিল ‘আওয়াজ উডা’, যা এক সময় স্লোগানে পরিণত হয়। গানটি লিখেছেন ও গেয়েছেন নারায়ণগঞ্জের আরেক তরুণ র্যাপার হান্নান হোসাইন। ১৭ জুলাই লেখা ও রেকর্ড করা গানটি ১৮ জুলাই ইউটিউবে প্রকাশের পরপরই ছাত্রলীগ নেতাদের হুমকি আসে তাঁর বিরুদ্ধে। বাড়িতে পুলিশ যায়।
আত্মগোপনে থাকতে হয় হান্নানকে। এক আত্মীয়ের জানাজা থেকে ফেরার পথে গ্রেপ্তার হয়ে ১২ দিন কারাগারে থাকতে হয় তাঁকে। এক সাক্ষাৎকারে হান্নান বলেন, ‘‘আন্দোলনে আমার ভাইবোনদের রাস্তায় মারা হচ্ছিল। আবু সাঈদের মতো অনেক শিক্ষার্থী গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছেন। সেই সময় আর চুপ থাকার অবস্থায় ছিলাম না। ভাবছিলাম আমার অবস্থান থেকে কিছু একটা করার। সেই চেষ্টা থেকেই ‘আওয়াজ উডা’। লেখা শুরু করার পর অটোম্যাটিক গানের কথাগুলো চলে আসছিল। মাত্র আড়াই ঘণ্টায় লিখেছিলাম গানটি।’’
কোটা সংস্কার আন্দোলন থেকেই সংগীতশিল্পী ফারজানা ওয়াহিদ সায়ান ছিলেন সরব। এবারের আন্দোলনে তিনি ‘ভয় বাংলায়’ শিরোনামে একটি গান এনেছেন। নিহত শিক্ষার্থীদের স্মরণে অনি হাসান গেয়েছেন ‘আমরা বীর’। শহরতলী ব্যান্ডের ভোকাল সোহাগ গেয়েছেন ‘ও প্রধান’।
এ ছাড়া সোহেল আরমানের লেখা ও হাবীব ওয়াহিদ, আরফিন রুমি ও প্রদীপ কুমারের গাওয়া ‘হৃদয় আমার বাংলাদেশ’, ইথুন বাবুর লেখা ও মৌসুমীর গাওয়া ‘ দেশটা তোমার বাপের নাকি’ গানগুলোও আন্দোলনে প্রচণ্ড আলোচিত হয়।
আন্দোলনের দিনগুলোতে কাজী নজরুল ইসলামের বিখ্যাত গান ‘এই শিকল পরা ছল’-এর এক নতুন সংস্করণে কণ্ঠ দিয়েছেন শেখ ইশতিয়াক, শাকিব চৌধুরী, রায়েফ আল হাসান রাফা, প্রবর রিপন ও জামশেদ চৌধুরী। ভিডিও চিত্রে শেখ ইশতিয়াক বলেন, ‘আমি ধিক্কার জানাই এই সমাজকে, যে সমাজে কোনো বাক্স্বাধীনতা নাই। কথা বলতে গেলে ছাত্রদের ওপর গুলি চলে– ধিক্কার জানাই।’
প্রথমে কোটা সংস্কার আন্দোলন দিয়ে শুরু হলেও এই আন্দোলন দ্রুতই রূপ নেয় সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণে এক গণঅভ্যুত্থানে। দীর্ঘ স্বৈরশাসনের অবদমিত ক্ষোভ ও যন্ত্রণার বিস্ফোরণ ঘটে রাজপথে। নিপীড়ন যত বাড়ে, গণরোষ তত গাঢ় হয়। সর্বস্তরের মানুষ মুক্তির লড়াইয়ে রাস্তায় নামে।
এই গণঅভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় যে নতুন সাংস্কৃতিক সত্তা গড়ে উঠছে, তার গুরুত্বপূর্ণ বাহক হয়ে উঠেছে গান। গান এখানে শুধু আবেগ নয়, প্রতিরোধের ভাষা, শিকল ছেঁড়ার সুর। এই সময়ের গানগুলো আমাদের ভবিষ্যৎ সাংস্কৃতিক বিনির্মাণেও রাখবে অনন্য ভূমিকা– বাক্স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার ও মর্যাদার লড়াইয়ে।
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই অভ য ত থ ন জ ল ই গণহত য গণঅভ য ত থ ন প রক শ
এছাড়াও পড়ুন:
আমাদের দায়িত্ব তরুণদের পাশে দাঁড়ানো : মাসুদুজ্জামান
আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবক দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি নারায়ণগঞ্জ ইউনিট আয়োজিত অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে তরুণদের জন্য সহযোগিতা ও সুযোগ সৃষ্টির গুরুত্ব তুলে ধরেছেন নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে বিএনপির মনোনীত প্রার্থী, বিশিষ্ট ক্রীড়া সংগঠক ও মাসুদুজ্জামান মাসুদ।
রবিবার (৭ ডিসেম্বর) সকালে নগরীর আলী আহাম্মদ চুনকা পাঠাগার ও মিলনায়তনে আয়োজিত আলোচনা সভায় তিনি বলেন, “তরুণরা কাজ করতে চায়, কিন্তু ফান্ডের অভাবে এগোতে পারে না। আমাদের দায়িত্ব তাদের পাশে দাঁড়ানো। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানের জায়গাগুলো মসৃণ হলে তরুণরা ভবিষ্যতে আমাদের জায়গায় আসতে পারবে।’’
ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে তিনি তীব্র সমালোচনা করে বলেন, “প্রতি বছর নারায়ণগঞ্জে ডেঙ্গু ভয়াবহ রূপ নেয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন, সিভিল সার্জন, সিটি করপোরেশন আগেই কেন উদ্যোগ নেয় না? পরিস্থিতি খারাপ হলে তখন ফগার মেশিন নিয়ে নামা এটা অভিনয়ের মতো।
তিনি আরও বলেন, আমাদের অধিকার আছে স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার। প্রশাসন কিংবা সিটি করপোরেশন পাশে দাঁড়াবে, এটা কোনো দয়া না, নাগরিকের অধিকার।
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সুস্থতা কামনায় দোয়া চেয়ে তিনি বলেন, দেশনেত্রী অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় আছেন। স্বাধীনতার পরে এত ত্যাগ কোনো মা খুব কমই দিয়েছেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আলমগীর হুসাইনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন, মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব এড. আবু আল ইউসূফ খান টিপু, জামায়াতের নারায়ণগঞ্জ-৫ আসনে মনোনীত প্রার্থী মাওলানা মঈনুদ্দিন আহমাদ, মহানগর যুবদলের আহ্বায়ক মনিরুল ইসলাম সজল, সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. শাহজাহান, মডেল গ্রুপের পরিচালক শামীম আহমেদ, রেড ক্রিসেন্ট ইউনিটের যুব প্রধান সানজিদা আক্তার মিতু, সিনিয়র অফিসার তানভীর মোহাম্মদ সুজন, জাতীয় যুবশক্তির কেন্দ্রীয় সংগঠক নিরব রায়হান, বিডি ক্লিনের সমন্বয়ক কামরুজ্জামান রানাসহ বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সদস্যরা।