ঘুমের মধ্যে আগ্রাসী নদী ভিটাবাড়িসহ ভাসিয়ে নেয় কিনা– সেই ভয়ে জেগে থেকে রাত পার করছেন ৩০টি গ্রামের মানুষ। সুনামগঞ্জ জেলার ছাতকে সুরমা নদীর ভয়াবহ ভাঙনের মুখে পড়েছে ওই গ্রামগুলো।

বর্তমান পরস্থিতিতে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে ছাতক-আন্ধারীগাঁও ভায়া সুনামগঞ্জ সড়ক। এই সড়ক ধরে নিজেদের যুক্ত করে রেখেছে সুনামগঞ্জ, ছাতকসহ তিনটি উপজেলার ৩০টি গ্রামের প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। এই সড়ক এবং সেখানে থাকা সেতুটি ভেঙে পড়ার উপক্রম। যে কারণে সড়কপথের যোগাযোগ বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 

স্থানীয়দের অভিযোগ, সম্প্রতি সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এই সড়কের চলমান নির্মাণকাজে অনিয়মের কারণেই সড়ক ও সেতু দুর্বল হয়েছে। নদীভাঙনের প্রবণতা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ছে। তবে উপজেলা স্থানীয় সরকার বিভাগ (এলজিইডি) কর্তৃপক্ষ বলছে, ঠিকাদারের টেকসই কাজ সম্পন্ন করতে নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে। সড়কটি রক্ষায় দ্রুত ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, উপজেলার ছাতক সদর ইউনিয়নের আওতাধীন সুরমা নদীর তীর ঘেঁষে ছাতক-আন্ধারীগাঁও ভায়া সুনামগঞ্জ সড়কের অবস্থান। ২০২২ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যায় গ্রামীণ এই সড়কটির ব্যাপক ক্ষতি হয়। স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগের (এলজিইডি) আওতাধীন সম্প্রতি এই সড়কের ছাতক অংশে প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার রাস্তা সংস্কারে জন্য ৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবের মেসার্স মমিনুল হক এন্টারপ্রাইজ নামে এক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে গত বছরের আগস্ট মাসে কার্যাদেশ দেওয়া হয়।

গত ১ সেপ্টেম্বর সড়কটির সংস্কারকাজ শুরু করা হয়। এ কাজের মেয়াদ চলতি বছরের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত। এরই মধ্যে সংস্কারকাজ প্রায় ৯০ ভাগ শেষ হয়েছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সড়ক মেরামত কাজ চলমান থাকতেই দেখা দেয় নদীভাঙন। কাজের শুরুতে স্থানীয় লোকজন নানা অনিয়মের অভিযোগ করলেও ঠিকাদার এসব অভিযোগ আমলে না নিয়ে নিজের ইচ্ছা মতোই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে গ্রামের বাসিন্দাদের ভিটাবাড়ি এবং ফসলি জমিও রয়েছে হুমকির মুখে। 

সুরমার ভাঙন এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, সড়কের মল্লিকপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সংলগ্ন একটি মাজারের পাশ থেকে শুরু হয়েছে ভাঙন; যা গত কয়েক দিনে মাত্রা বেড়ে যাওয়ার ফলে সড়কের পাকা অংশের কাছাকাছি চলে এসেছে। সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার এখানে বালুর বস্তা দিয়ে দায়সারা কাজ সম্পন্ন করেছেন। এরই মধ্যে বেশকিছু বালুর বস্তা নদীতে ভেসে গেছে। নতুন সংস্কার কাজের বিভিন্ন অংশে ফাটল সৃষ্টি হয়েছে এবং সেখান থেকে মাটি ধসে যাচ্ছে।

অপরদিকে সড়কের মাছুখালী ব্রিজের অ্যাপ্রোচের পশ্চিমাংশ ভেঙে মাটি সরে যাওয়ায় বড় ধরনের দুর্ঘটনার আশঙ্কা রয়েছে। স্থানীয় লোকজন এখানে গাড়ি চলাচলে সতর্কতা অবলম্বনের জন্য বাঁশ বেঁধে রেখেছে। ব্রিজটি বর্তমানে যে অবস্থায় রয়েছে, ভাঙনের মাত্রা আরেকটু বাড়লে তা ধসে যাবে। সেক্ষেত্রে সুনামগঞ্জের সঙ্গে আশপাশের দুটি উপজেলার এ পথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

ছাতক সদর ইউনিয়নের মল্লিকপুর গ্রামের বাসিন্দা রমজান আলী ও নোয়াব আলী বলেন, ভাঙনের ভয়ে রাতে ঘুমায় না গ্রামের মানুষ। নিজের সহায় সম্পদ হারানোর পাশাপাশি রাস্তা আর সেতু ভেঙে পড়ার ভয়ও রয়েছে। ভাঙনরোধে যে বস্তা দেওয়া হয়েছে, সেগুলো যে কোনো সময় ভেসে যাবে। দু’দিন পরই বস্তাগুলো নদীতে চলে গেছে। এ বিষয়ে অভিযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি। এ রাস্তাটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে অনেকটাই ঝুঁকিপূর্ণ, যে কোনো সময় বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।

মাছুখালী এলাকার বাসিন্দা সমুজ আলী বলেন, মল্লিকপুর-মাছুখালীর মাঝখানে যে সেতুটি রয়েছে এটি এখন প্রচণ্ড ঝুঁকির মুখে আছে। দুর্ঘটনা এড়াতে স্থানীয়রা সেতুর পশ্চিম পাশে বাঁশ বেঁধে দিয়েছেন। এ সড়ক রক্ষায় নদীভাঙনরোধে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।

অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি সালেক মিয়া তা অস্বীকার করে বলেন, সড়কের কাজ শেষ পর্যায়ে। নদীভাঙনের বিষয়টি তাদের দায়বদ্ধতা নয়। এটি পানি উন্নয়ন বোর্ড দেখবে।

ছাতক উপজেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের (এলজিইডি) প্রকৌশলী রফিকুল ইসলাম বলেন, সড়কের মল্লিকপুর ও মাছুখালীর ঝুঁকিপূর্ণ অংশ পরিদর্শন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীকে সড়কটি নদীভাঙন থেকে রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া জন্য চিঠি দেওয়া হয়েছে।

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স ন মগঞ জ বন য স ন মগঞ জ এই সড়ক সরক র উপজ ল সড়ক র ই সড়ক

এছাড়াও পড়ুন:

ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক

অক্টোবরের প্রথম দিকে লম্বা এক ছুটিতে বেড়াতে গেলাম বগুড়া। দেশের উত্তরের জনপদ বরাবরই আমার পছন্দ। মানুষ কম, হালকা বসতি। পথে বা হাটবাজারে ততটা ভিড়ভাট্টা নেই। বাজারে কম দামে টাটকা শাকসবজি মেলে। এসব কেনার চেয়ে দেখেই তুমুল আনন্দ পাই। নিঝুম গ্রামের ভেতর ফসলের মাঠে ছড়িয়ে থাকা বৈচিত্র্য দেখতে দেখতে উদ্দেশ্যহীন ঘোরাঘুরি বেশ উপভোগ করি। যত দূর চোখ যায়Ñ গ্রামের পর গ্রাম। মুঠো মুঠো সবুজের ভেতর এঁকেবেঁকে ছুটে চলা মেঠো পথ মাড়িয়ে আমরা প্রতিদিন দূরে কোথাও হারিয়ে যাই। দিনের মুহূর্তগুলো মানুষের জীবনাচারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে কতটা নিপুণভাবে ক্ষণে ক্ষণে বদলে যেতে পারে,Ñ এসব গ্রামে না এলে তা বোঝার উপায় নেই। কৃষিনির্ভর এই জনপদে প্রতিমুহূর্তের ব্যস্ততা যেন অনিবার্য নিয়তি।

বগুড়ার গ্রামীণ জনপদ ঘুরে, দর্শনীয় স্থানগুলো দেখে মনে হলো যথেষ্ট নয়! চোখের তৃষ্ণা মেটেনি। মনের ক্ষুধাও যায়নি! তখনই মনে পড়ল নওগাঁর ঘুঘুডাঙ্গার বিখ্যাত তালসড়কটির কথা। এত কাছে এসে তালসড়কটি দেখতে যাব না, তা কি হয়? স্থানীয় সাংবাদিক আনোয়ার পারভেজ বললেন, ‘বগুড়া থেকে মাত্র ৩ ঘণ্টারই তো জার্নি। ঘুরে আসুন।’ আমারও মনে হলো, এমন একটি অসাধারণ দৃশ্যের জন্য এই দূরত্ব কিছুই না।

সকালে তুমুল বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভাঙল। কিছুক্ষণের মধ্যে আবার থেমেও গেল। গাড়িতে ওঠার সময় স্থলপদ্মের গাছটি চোখে পড়ল। গাছভর্তি ফুলগুলো বৃষ্টির দাপটে একেবারে নেতিয়ে পড়েছে। অথচ বিকেলে ভেবে রেখেছিলাম, সকালে শরতের মধুর আলোয় স্থলপদ্মের ছবি তুলব। তা আর হলো না। দ্রুত বেরিয়ে পড়ি। প্রথমে গেলাম নওগাঁর সাপাহারের কৃষি উদ্যোক্তা সোহেল রানার বাগানে। তাঁকে সঙ্গে নিয়ে আমরা যখন স্বপ্নমণ্ডিত সেই তালসড়কে পৌঁছাই, তখন ঠিক দুপুরবেলা।

কিন্তু দুপুর হলেও দর্শনার্থীদের পদচারণে মুখর তালসড়ক। শুধু বৃহত্তর রাজশাহী নয়, দূরদূরান্ত থেকেও পর্যটকেরা এখানে আসেন। নওগাঁ জেলার নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নে এই তালসড়কের অবস্থান। মূলত ঘুঘুডাঙ্গা-শিবপুর সড়কের দুপাশজুড়ে থাকা বীথিবদ্ধ তালগাছের জন্যই সড়কটি ‘তালসড়ক’ বা ‘তালতলী’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছে। হাজীনগর গ্রামের মজুমদার মোড় থেকে ঘুঘুডাঙ্গা পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার সড়কজুড়ে এই তালসড়কের অবস্থান।

বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, ২০০৮ সাল থেকে বিভিন্ন রাস্তা ও খালপাড়ে ৭২০ কিলোমিটারের বেশি জায়গাজুড়ে লাগানো হয়েছে কয়েক লাখ তালগাছ। তখন বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে পরিচিত নওগাঁর নিয়ামতপুর, পোরশা, পত্নীতলা ও ধামইরহাট, রাজশাহীর তানোর, গোদাগাড়ী, চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল, রহনপুর উপজেলার রাস্তার দুপাশে রোপণ করা হয়েছে অনেক তালগাছ। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যার অভাবে অনেক গাছই হারিয়ে গেছে। কোথাও কোথাও বিক্ষিপ্তভাবে বেঁচে আছে কিছু। তবে নওগাঁর নিয়ামতপুর উপজেলার ঘুঘুডাঙ্গার এই গাছগুলো এখনো কালের সাক্ষী হয়ে টিকে আছে। বর্তমানে গাছগুলো ৫০ থেকে ৬০ ফুট উঁচু হওয়ায় রাস্তার দুপাশে শোভাবর্ধন করছে।

একসময় নিয়ামতপুর উপজেলার হাজীনগর ইউনিয়নের ঘুঘুডাঙা-শিবপুর সড়কটি ছিল একটি মেঠো পথ। ২০১২ সালের দিকে সড়কটি পাকা করা হয়। বর্তমানে তালসড়কের দুপাশে দিগন্তবিস্তৃত ফসলের মাঠ থাকায় সড়কটি বেশ আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে।

ভাদ্র মাসে তাল পাকার মৌসুমে তালসড়ক ঘিরে উৎসবেরও আয়োজন করা হয়। নানা স্বাদের তালের পিঠা এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ। তবে বেড়াতে আসা পর্যটকদের উদ্বুদ্ধ করার জন্য এখানে মানসম্পন্ন পর্যটনসেবা থাকা প্রয়োজন।

শুধু বরেন্দ্র অঞ্চলই নয়, বৃহত্তর ফরিদপুরের বিভিন্ন স্থানেও প্রচুর পরিমাণে তালগাছ চোখে পড়ে। খেতের আলপথ, বাড়ির সীমানা, খালপাড়, পুকুরপাড় বা পথের ধারে এসব সুদৃশ্য তালগাছ প্রকৃতিতে ভিন্ন এক ব্যঞ্জনা তৈরি করেছে। দেশের বিভিন্ন জনপদে ছড়িয়ে থাকা এসব তালগাছের অর্থনৈতিক সম্ভাবনাও আছে। দক্ষিণ ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে দৃশ্যমান তালগাছের রস থেকে ভালো মানের সুস্বাদু গুড় ও মিছরি তৈরি করা হয়। বাজারে এসব গুড়-মিছরির চাহিদাও ব্যাপক। আমাদের দেশেও এসব গাছ থেকে বাণিজ্যিকভাবে তালের গুড় তৈরি করা সম্ভব। প্রয়োজন যথাযথ উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতার।

 মোকারম হোসেন, প্রকৃতি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ঘুঘুডাঙ্গার মনোরম তালসড়ক
  • চলন্ত অবস্থায় বৈদ্যুতিক গাড়ি চার্জ করতে সক্ষম সড়ক চালু ফ্রান্সে