ফেনী-নোয়াখালীর বন্যা গাফিলতির খেসারত
Published: 12th, July 2025 GMT
গত বুধবারের (৯ জুলাই) খবরের শিরোনাম ছিল ‘রেকর্ড বৃষ্টিতে ডুবল ফেনী শহর, নদী রক্ষা বাঁধে ভাঙন’। এমনটাই হওয়ার আশঙ্কা ছিল। বৃহস্পতিবারের খবর, ‘এবার ডুবল ফেনী-ছাগলনাইয়া সড়ক; মুহুরী, কহুয়া ও সিলোনিয়া নদীর বাঁধভাঙা পানি ফুলগাজী হয়ে ছাগলনাইয়ার দিকে আসতে শুরু করেছে’।
কুমিল্লা বোর্ডের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা থেমে গেছে। ঘোর বর্ষায় এসব পাবলিক পরীক্ষার বন্দোবস্ত কেন? তার আগেই ভারী বৃষ্টি ও জলাবদ্ধতার কারণে নোয়াখালী ও ফেনীর অনেক উপজেলার মাধ্যমিক পর্যায়ের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়। উপদ্রুত এলাকার পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো জানিয়ে দিয়েছে, পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত অনির্দিষ্ট সময়ের জন্য সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকবে। যানবাহন চলাচল বন্ধ, উদ্ধারের নৌকা নেই।
এই দুর্যোগের কোনো আলামত ছিল কি?মে মাস থেকেই ফেনীর বেড়িবাঁধের বিভিন্ন জায়গায় ফাটলের খবর আসছিল। সংবাদকর্মীরা জানাচ্ছিলেন, বর্ষার আগেই এমন ফাটল মানুষের মনে বন্যার ভয় তৈরি করেছে। ফুলগাজী উপজেলার মুহুরী নদীর বাঁধ এবং আনন্দপুর ইউনিয়নের সিলোনিয়া নদীর বাঁধের কিছু অংশের ফাটল দেখে স্থানীয়দের মনে হচ্ছিল, ভারী বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে নদীর পানি বাড়লেই বাঁধগুলো ভেঙে যেতে পারে। একই সময় আনন্দপুর ছাড়াও ফেনী জেলার ফুলগাজী ও পরশুরাম উপজেলায় মুহুরী, কহুয়া এবং সিলোনিয়া নদীর আরও কয়েকটি স্থানে ভাঙন দেখা দেয়। তখন কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, ‘বঙ্গোপসাগরের লঘুচাপজনিত লাগাতার বৃষ্টি ও ভারতের উজানের পানির ঢলে নদীর পানি বেড়ে যাওয়ায় এমনটি হয়েছে। শুনে মনে হবে ‘তাঁহাদের’ কোনো কসুর নেই, ভারত আর বৃষ্টি সব অনিষ্টের মূল।
তবে কি বৃষ্টি হবে না? পাহাড় বেয়ে প্লাবনভূমি বাংলাদেশে পানি আসবে না? এসব ধরে নিয়েই আমরা বাঁধ বাঁধি। ভাগ্যিস বলেনি আষাঢ়ী পূর্ণিমার কারণে বাঁধ টেকেনি। আমরা জানি ভাদ্রের বড় জোয়ারের আগে আষাঢ়-শ্রাবণের পূর্ণিমা অমাবস্যায় সাগর উত্তাল থাকে, জোয়ারের চাপে নদীর পানির সাগরমুখিতার গতি থমকে যায়। বৃষ্টির পানি সরতে সময় লাগে। পঞ্জিকার হিসাবে ১০ জুলাই গুরু পূর্ণিমার লগ্ন শুরু, শেষ ১১ জুলাই বেলা ২টা ৭ মিনিটে। তাই বৃষ্টি কমলেও পানির সাগরযাত্রা বিলম্বিত হবে।
২০২৪ সালের বন্যায় কথিত বাঁধগুলোর নানা জায়গা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ছোট-বড় সেসব ক্ষত মেরামতে সরকারের নাকি প্রায় ২১ কোটি টাকা (২০ কোটি ৬৮ লাখ) খরচ হয়েছিল। এখন পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, ভালোভাবে বাঁধ মেরামতের জন্য ৭ হাজার ৩৪০কোটি টাকার একটি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যা এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। কেন বাস্তবায়িত হয়নি? ঠিকাদার পাওয়া যায়নি? নাকি ১৫ বছরের পুরোনো ঠিকাদারেরা গা ঢাকা দেওয়ায় নতুনদের সঙ্গে ‘নয়া বন্দোবস্ত’ এখনো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। মাথার ওপর একটা রাজনৈতিক আশীর্বাদের হাত না থাকলে আমলারা ঠিক স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না। সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না। ‘ভেজালে’ পড়ার ভয়ে উদ্যোগ নিয়ে কোনো কাজ করেন না—এটাই আমজনতার অনুধাবন।
বন্যা, না জলাবদ্ধতাফেনীর শহীদুল্লা কায়সার সড়কের বাসিন্দা বন্ধু আক্কাস আলী (ছদ্মনাম) ফোন করে জানাল, সে পানিবন্দী। সড়কটি তিন থেকে পাঁচ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে। তাঁর বক্তব্য, ‘পর্যাপ্ত ড্রেন না থাকা এবং অপরিকল্পিত নগরায়ণের কারণে শহরের এই হাল। একটু বৃষ্টি হলেই জলে আবদ্ধ হয়ে থাকি। এর চেয়ে জেলেই ভালো ছিলাম।’ শহরে ড্রেনের ব্যবস্থা করা পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ নয়। পয়োনিষ্কাশন আর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করবে পৌরসভা। এক বছর হলো পৌরসভায় তালা, নম নম করে চলছে প্রশাসক দিয়ে। প্রশাসকদের কোনো হোলদোল নেই। সংবাদমাধ্যমকে তিনি জানিয়েছেন, দু-তিন ঘণ্টা বৃষ্টি বন্ধ থাকলে পানি নেমে যাবে। এসব কথাবার্তা শুনে আক্কাস আলীরা মেঘ কেটে যাওয়ার জন্য প্রার্থনা করছে, আর বৃষ্টি থামার অপেক্ষা করছে।
বৃষ্টি ১০ তারিখের পর ১২ তারিখ পর্যন্ত একটা ক্ষণিক বিরতি দিলেও ১৩ তারিখ থেকে বিধি বাম হতে পারে বলে আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অফিস। সরি, আক্কাস আলী, বৃষ্টি একটু থামলেও পূর্ণিমার জোয়ারের কারণে পরিস্থিতির খুব একটা উনিশ-বিশ হবে বলে মনে হচ্ছে না। এর মধ্যে প্রস্তুত হতে হবে অমাবস্যার কাটালের জন্য। আগামী ২৪ জুলাই হবে শ্রাবণের অমাবস্যা। তখন আবার বড় জোয়ার ধেয়ে আসবে। বৃষ্টি হলে আবার ডুববে শহীদুল্লা কায়সার সড়ক।
অস্বাভাবিক বৃষ্টি বনাম বন্যার স্বীকৃতিফেনী-নোয়াখালী থেকে অস্বাভাবিক বৃষ্টির খবর এলেও আমাদের মনে রাখতে হবে, এটা জুলাই মাস। সবচেয়ে বেশি বৃষ্টিপাতের মাস। বাংলা মাস আষাঢ়-শ্রাবণকে ধারণ করে জুলাই। স্বাভাবিক অবস্থায় জুলাই মাসে দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হয় ৫০০ মিলিমিটার। অনেক বছর পর চলতি মাসে দেশে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাতের সম্ভাবনা রয়েছে। আবহাওয়া অফিস জুলাই পূর্বাভাসে বলেছিল, এ মাসে বঙ্গোপসাগরে এক থেকে তিনটি লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে, যার মধ্যে একটি মৌসুমি নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। নদ-নদীর অবস্থার বিষয়ে পূর্বাভাস ছিল, জুলাইয়ের প্রথমার্ধে মৌসুমি বৃষ্টির প্রভাবে দেশের প্রধান নদ-নদীর পানি সামগ্রিকভাবে বৃদ্ধি পাবে। মাসের দ্বিতীয়ার্ধে নদ-নদীর প্রবাহ স্বাভাবিক থাকতে পারে।
বিবিসির সঙ্গে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার সময় বৃষ্টিকে ‘স্বাভাবিক’ উল্লেখ করে আবহাওয়াবিদ আফরোজা সুলতানা ৮ জুলাই দুপুরে জানিয়েছিলেন, সেদিন সকাল ৬টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত ফেনীতে ২২২ মিলিমিটার, পটুয়াখালীতে ১১০ মিলিমিটার, মাইজদীকোর্টে ৬২ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছিল।
বাংলাদেশে এখন যে বৃষ্টি হচ্ছে, তা থেকে বন্যা হতে পারে কি না জানতে চাওয়া হয়েছিল পানি উন্নয়ন বোর্ডের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র ও আবহাওয়া অধিদপ্তরে। উভয় বিভাগ থেকেই জানানো হয়েছে, সে রকম কোনো সম্ভাবনা আপাতত নেই।
তবু বন্যাফেনী-নোয়াখালীর অনেক এলাকা এখনো পানিতে ডুবে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, কোথাও কোথাও বেড়িবাঁধের ওপর দিয়েও নদীর পানি উপচে পড়ছে। এ পর্যন্ত প্লাবিত হয়েছে ফুলগাজীর ৬৭টি, পরশুরামের ২৭ ও ছাগলনাইয়ার ১৫টি, দাগনভূঞার ২টি আর ফেনী সদরের ১টি গ্রাম। ফেনী-পরশুরাম সড়কের অনেক জায়গায় এখনো যান চলাচল বন্ধ। বল্লামুখায় ভারত অংশে বাঁধ ভেঙে বাংলাদেশ অংশে পানি ঢুকেছে। ফেনী জেলায় ৮৩টি আশ্রয়কেন্দ্রে এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার ফেনী ও নোয়াখালীর বন্যা-জলাবদ্ধতা পরিস্থিতি নিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে আলোচনা হয়েছে। পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, মুসাপুর রেগুলেটর ও বামনী ক্লোজারের নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছে। ফেনী জেলায় একটি স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ প্রকল্পের কাজও চূড়ান্তকরণের পথে। সভায় জানানো হয়, বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ফেনী ও নোয়াখালীর ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ, তীর প্রতিরক্ষা এবং পানিনিয়ন্ত্রণ অবকাঠামো মেরামতের কাজ চলমান রয়েছে। এই ভদ্র সমাবেশে কেউ জানতে চাননি, কেন এত দেরি হলো? গাফিলতি কার? গোস্তাখির দায় কে নেবে? মানুষ কেন কাফফারা দেবে বারবার। মেরামতের বাঁধ জুলাইয়ের স্বাভাবিক বৃষ্টিতে কেন বিব্রতবোধ করল, কেন লুটিয়ে পড়ল সামান্য জলের আঘাতে?
৯ জুলাই নোয়াখালী জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় জানানো হয়, কোম্পানীগঞ্জ, বেগমগঞ্জ, কবিরহাট, সদর, সেনবাগ, সোনাইমুড়ী উপজেলায় ব্যাপকভাবে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়েছে। নোয়াখালী জেলা শহর মাইজদীর সব সংযোগ সড়ক, দোকানপাট ডুবে গেছে। শহরের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ হয়ে গেছে, বিশেষত ছোট কোনো যানবাহন চলাচল করতে পারছে না। ইউনিসেফ এবং ডব্লিওএফপি জেলা প্রশাসনের ডাক পেলে ত্রাণ তৎপরতা শুরু করবে।
উপদ্রুত এলাকার মানুষ চিড়া-গুড়, শাড়ি-লুঙ্গি-ঢেউটিনের দিকে তাকিয়ে নেই। তাঁরা চান স্থায়ী সমাধান। তাঁদের দাবি, বন্যা মোকাবিলায় ৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকার যে প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, সেটি যেন সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়। এই বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া হোক অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্বচ্ছ এবং দ্রুত। জনগণের অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো বাঁধই শেষপর্যন্ত টেকসই হয় না।
গওহার নঈম ওয়ারা: লেখক, গবেষক ([email protected])
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: পর স থ ত নদ র প ন ব যবস থ র জন য র বন য ম র মত হয় ছ ল উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
প্রেমের টানে ভারতে গিয়ে গ্রেপ্তার বাংলাদেশি তরুণী
প্রেমের টানে ভারতে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে এক বাংলাদেশি তরুণী গ্রেপ্তার হয়েছেন। তাকে অনুপ্রবেশে সহায়তা করার অভিযোগে তার প্রেমিক ভারতীয় নাগরিককেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে ত্রিপুরার সেপাহিজলা জেলায়। অভিযুক্তরা বর্তমানে ১৪ দিনের বিচার বিভাগীয় হেফাজতে রয়েছেন।
জানা গেছে, গোপন সংবাদের ভিত্তিতে বিএসএফ তাদের আটক করে। পরে স্থানীয় পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
গ্রেপ্তার ওই বাংলাদেশি তরুণীর নাম প্রকাশ করা হয়নি। তবে তিনি বাংলাদেশের বগুড়া জেলার বাসিন্দা বলে জানানো হয়েছে। আর তার প্রেমিকের নাম দত্ত যাদব। তিনি কর্ণাটকের বাসিন্দা।
পুলিশ জানায়, ওই বাংলাদেশি তরুণী একসময় মুম্বাইয়ের একটি বিউটি পার্লারে কাজ করতেন। পরে বেঙ্গালুরুর একটি বেসরকারি সংস্থায় যোগ দেন। এসময় কর্ণাটকের বাসিন্দা দত্ত যাদবের সঙ্গে তার প্রেমের সম্পর্ক হয়। তবে কয়েক মাস আগে ওই তরুণী আবার বাংলাদেশে চলে যায়। প্রেমিকের অনুরোধ রাখতে আবার ভারতে আসেন। তবে তার সঙ্গে পাসপোর্ট ও ভিসা ছিল না। তাই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় অনুপ্রবেশে সহায়তা করায় তার প্রেমিক দত্ত যাদবকেও গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ আরও জানায়, তারা ত্রিপুরা থেকে বেঙ্গালুরুতে যাওয়ার পরিকল্পনা করছিলেন। এসময় বিএসএফ তাদের আটক করে।
অভিযুক্তদের ভারতীয় পাসপোর্ট আইন এবং ১৪ ফরেনারস অ্যাক্ট ও ভারতীয় ন্যায় সংহিতার অধীন বিভিন্ন ধারায় মামলা দায়ের করা হয়েছে বলেও জানায় পুলিশ।
ত্রিপুরা রাজ্যের পুলিশের এক কর্মকর্তা জানান, ওই বাংলাদেশি তরুণীকে ভারতে অনুপ্রবেশে কোনো দালাল সহযোগিতা করেছে কি না তা খুঁজে বের করা হচ্ছে। সেটি মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত কি না তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে।