যুগে যুগে আন্দোলন-সংগ্রামে গান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। প্রতিবাদের ভাষাকে শক্তিশালী করতে এবং তা জনমানুষের কাছে পৌঁছে দিতে গানের ভূমিকা অতুলনীয়। ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলাদেশে যে গণঅভ্যুত্থান হলো, সেখানেও আমরা গানের শক্তিশালী ভূমিকা দেখি।
এ সময় নতুন-পুরোনো অনেক গান গাওয়া হয়েছে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আমলসহ বিভিন্ন আন্দোলনে নিপীড়িত মানুষের অধিকার আদায়ের দাবিতে যে গানগুলো প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল, সেগুলোর মধ্য থেকে বেশ কিছু জনপ্রিয় গান চব্বিশের গণআন্দোলনে প্রেরণা-শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। এর বাইরেও রচিত হয়েছে নতুন গান।
আমি ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান চলকালে অর্থাৎ ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত গানের একটি সংকলন করছি। সে কাজটি করতে গিয়ে শতাধিক গানের সন্ধান পেয়েছি। তার মধ্যে অধিকাংশই র্যাপ। আমরা জানি, চব্বিশের আন্দোলনের অনুষঙ্গ হিসেবে একটা বিশাল অংশজুড়ে ছিল র্যাপ গান; যা বাংলাদেশে আন্দোলনের ইতিহাসে এক নতুন শক্তিশালী ধারার সংযোজন।
এ সময়ের গানগুলোয় দেশের তৎকালীন চলমান বিচারহীনতার সংস্কৃতি, সরকারের গণতন্ত্রবিরোধী কার্যকলাপ, পাহাড়ের আদিবাসীদের নিপীড়নের কথা, দ্রব্যমূল্য বাড়ার কথা, চাকরিহীন বেকারদের অবস্থা, গণস্বার্থবিরোধী উন্নয়নের কথা উঠে এসেছে। আওয়ামী শাসনামলে চারদিকে যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে রাখা হয়েছিল, গানগুলোয় সেসব বিষয় উঠে এসেছে। উঠে এসেছে আওয়ামী লীগের ছাত্র ও যুব সংগঠনের নিপীড়নের কথা। হেলমেট পরে তারা কীভাবে যে কোনো আন্দোলনকে দমিয়ে দেওয়ার জন্য নিষ্ঠুর নৃশংস তাণ্ডব চালাত, তাও অনেক গানে বর্ণিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে নিজেদের দখলের সম্পত্তি বানিয়ে ফেলেছিল। তাই কথায় কথায় আওয়ামী ন্যারেটিভ ও স্বার্থবিরোধী কিছু হলেই তাকে ‘রাজাকার’ বানিয়ে ফেলার যে সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ চালু করেছিল, জুলাই অভ্যুত্থান তার সমুচিত জবাব দিয়েছে। জুলাইয়ের গানগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকে রিক্লেইম করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারিত গানগুলো মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রেরণা জুগিয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানেও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ, হাসপাতালে গিয়ে আহতদের ওপর হামলায় জনমনে এমনিতেই অসন্তোষ জমাট বাঁধা ছিল। তারপর ১৬ জুলাই রংপুর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবু সাঈদসহ পাঁচজনকে হত্যা করার খবর দাবানলের মতো সারাদেশে ছড়িয়ে পড়লে মানুষ ক্ষোভে, রাগে ফেটে পড়ে। ওই সময় ঘরে ঘরে তরুণরা ফুঁসে উঠছে। কখনও তারা রাজপথে নামছে, কখনও ফেসবুকে বাহাসে, গানে, লেখায় প্রতিবাদ করেছে। যখন দমবন্ধ করা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তখন একটা দারুণ শক্তির ঝড় নিয়ে ১৬ জুলাই হাজির হলো র্যাপার সেজানের ‘কথা ক’ গানটি। ফেসবুকের দেয়ালে, রাজপথের দেয়ালে এই কথা ভেসে বেড়াতে লাগল– ‘মারতে আইলে মাইরা দিবি, মুর্দা নাইলে জিন্দা/রাইত দেইখা ডরাইস না কেউ রাইতের পরেই দিনডা/জবান খুললেই জবান সিলাই, আর সিলাইবো কয়জনের/একজনে মা পইড়া গেলেও খাড়ায় যাইবো ছয়জনে/জন্ম লইসি মরতে, মরার ডর দেহাইস না আমাগো/এক সেজানে মরলেও লাখো সেজান কইবো কথা ক।’ র্যাপার হান্নান ‘আওয়াজ উডা’ গান গেয়ে গণঅভ্যুত্থানে গানের লড়াইকে নতুন মাত্রা দিয়েছেন।
র্যাপ ঘরানার এমন বহু গানে সে সময়কার বাস্তবতা উঠে এসেছে। যেমন– ‘আমার দেশে নাই কেন আজ সত্য কথার ভার/কথা বললেই গলা চেপে ধরে, বলে তুই রাজাকার’ (রক্ত, আহমেদ শুভ); ‘আমার বাপ-মায় জানে কান্দন কয় কারে/আমার আত্মাও জানে মরণ কয় বারে/গিয়া আজরাইলরে ক আমার নামডা কি/আমি ১৮ কোটি শহীদ আবু সাঈদ’ (আবু সাঈদ, সিয়াম ফারদিন)।
কখনও অনেক স্লোগান পরপর জুড়ে দিয়ে তাতে সুর সংযোজন করে গান হয়েছে। কোনো গানে গ্রামীণ কেচ্ছা-কাহিনির প্রচলিত সুরে শহীদের আত্মত্যাগের কথা গীত হয়েছে। কোনো কোনো গান ইসলামী গজলের সুরে গাওয়া হয়েছে, শহীদের আত্মার শান্তি চেয়ে সেই মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে গান হয়েছে। শহীদ মীর মুগ্ধর ‘পানি লাগবে পানি’ এই শব্দবন্ধকে কেন্দ্র করে গান রচিত হয়েছে। কোনো কোনো গানে সিনেমার জনপ্রিয় গানের সুর ব্যবহার করা হয়েছে। আবার কোনো গান জারি গানের ঢঙে করা হয়েছে। এ ছাড়া প্রচলিত আধুনিক সুর, রক গানের সুরে গীত হয়েছে অনেক গান। র্যাপারদের বিশেষ ঢঙের গানগুলো তো রয়েছেই। কিছু এআই (কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা) সহযোগিতায় তৈরি গান প্রকাশিত হয়। দুয়েকটা গানে এআইয়ের উল্লেখ থাকলেও অন্যগুলোয় উল্লেখ নেই। তবে গানের ধরন, কিছু ক্ষেত্রে শব্দের উচ্চারণের ধরন, সংগীতায়োজন, উপস্থাপন– সবকিছু মিলিয়ে ধারণা করা যায়, তা এআই দ্বারা নির্মিত। সময়ের প্রয়োজনের বিবেচনায় এ গানগুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
লেখক: শিক্ষক ও সংস্কৃতিকর্মী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ ল ই গণহত য জ ল ই অভ য ত থ ন গণঅভ য ত থ ন ত হয় ছ আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
১০০ কোটি টাকার পাচারের অভিযোগ, জাহাঙ্গীরের নামে মামলা
ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দপ্তরের সাবেক পিয়ন জাহাঙ্গীর আলম ওরফে পানি জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ১০০ কোটি টাকা পাচারের অভিযোগে মামলা করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)।
শুক্রবার (৩১ অক্টোবর) নোয়াখালীর চাটখিল থানায় মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে এই মামলা করেছে সিআইডির ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিট।
আরো পড়ুন:
নাফিসা কামালসহ ৮ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অর্থপাচারের মামলা
সাজিদ হত্যার তদন্তে সিআইডিকে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমোদন
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান জানান, প্রাথমিক অনুসন্ধানে উল্লেখযোগ্য প্রমাণ পাওয়ায় নোয়াখালীর চাটখিল থানায় জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার এক নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান জাহাঙ্গীর আলম জাতীয় সংসদ সচিবালয়ে দৈনিক মজুরিভিত্তিক কর্মচারী হিসেবে কাজ করতেন। পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর তিনি অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে স্বল্প সময়ের জন্য ‘ব্যক্তিগত সহকারী’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এই দায়িত্বই তাকে আর্থিকভাবে লাভবান করেছে মর্মে প্রাথমিক অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
জসীম উদ্দিন খান জানান, ২০১০ সালে জাহাঙ্গীর ‘স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড’ নামে একটি কোম্পানি গঠন করে বিকাশের ডিস্ট্রিবিউশন ব্যবসা নেন। কিন্তু এর আড়ালে তিনি অসংখ্য সন্দেহজনক ব্যাংকিং কার্যক্রম করেন। কোম্পানির নামে একাধিক ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অস্বাভাবিক অঙ্কের টাকা জমা হয়, যার বৈধ উৎস পাওয়া যায়নি ও ব্যবসার সঙ্গে অসামঞ্জস্যপূর্ণ।
সিআইডির এই কর্মকর্তা জানান, প্রতিষ্ঠানটির অ্যাকাউন্টগুলোতে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে বিভিন্ন ব্যাংকে মোট ৫৬৫ কোটিরও বেশি টাকা লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশ নগদে জমা হয়েছে দেশের নানা স্থান থেকে। এসব অর্থের উৎস অজানা এবং হুন্ডি ও মানিলন্ডারিং কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত বলে প্রাথমিক প্রমাণ মেলে।
বিশেষ পুলিশ সুপার জসীম উদ্দীন জানান, জাহাঙ্গীর আলম তার স্ত্রী কামরুন নাহার ও ভাই মনির হোসেনের সহায়তায় দীর্ঘদিন ধরে অবৈধ অর্থ লেনদেন করতেন। জাহাঙ্গীর আলম ও তার স্ত্রী ২০২৪ সালের জুন মাসে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমান এবং বর্তমানে ভার্জিনিয়ায় অবস্থান করছেন। বিদেশে তাদের বিনিয়োগ বা সম্পদ ক্রয়ের কোনো সরকারি অনুমোদন না পাওয়া গেলেও তারা যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি জমিয়েছেন বলে প্রাথমিক অনুসন্ধানে প্রমাণ মেলে।
অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে, জাহাঙ্গীর আলম, তার স্ত্রী কামরুন নাহার, ভাই মনির হোসেন এবং প্রতিষ্ঠান স্কাই রি অ্যারেঞ্জ লিমিটেড যৌথভাবে ২০১০ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে প্রায় ১০০ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করেছেন। অপরাধের পূর্ণাঙ্গ তথ্য উদঘাটন, অপরাপর সদস্যদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তার করার স্বার্থে সিআইডির তদন্ত ও অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ঢাকা/মাকসুদ/সাইফ