জাতীয় পার্টির অন্তঃকোন্দলে কার লাভ কার ক্ষতি
Published: 12th, July 2025 GMT
আরেক দফা সংকটে পড়েছে জাতীয় পার্টি (জাপা)। নতুন মহাসচিব নিয়োগ দেওয়ার পর তা উদোম হয়ে পড়েছে। গত ২৮ জুন দলের জাতীয় সম্মেলনের ঘোষণা দিয়েছিলেন জি এম কাদের। এর মধ্যেই তাঁকে বাদ দিয়ে দলে নতুন নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ আঁচ করেন তিনি। এ অবস্থায় ভেন্যু (স্থান) জটিলতার কারণ দেখিয়ে সম্মেলন স্থগিত করেন জি এম কাদের। যদিও সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান আনিসুল ইসলাম মাহমুদ এবং সহযোগীরা ২৮ জুন কাউন্সিল করার ব্যাপারে অনড় থাকেন। তারা এমনকি পাল্টা কাউন্সিল ডেকে নতুন কমিটি করবেন বলেও হুঁশিয়ারি দেন।
সর্বশেষ খবর, সোমবার জাপার মহাসচিব পদ থেকে মুজিবুল হক চুন্নুকে সরিয়ে ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে নিয়োগ দিয়েছেন চেয়ারম্যান। পাশাপাশি ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদারকে সব পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অব্যাহতিপ্রাপ্তরা মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে স্বপদে বহাল থাকার দাবি জানান। এ সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি ও স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ’ বলে মন্তব্য করেন ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা এখনও স্বপদে বহাল আছি। আমরা সবাই প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। দলের চেয়ারম্যান যে সিদ্ধান্তগুলো নিচ্ছেন, তা স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ।’ তিনি নেতৃত্ব নির্বাচনে জাতীয় সম্মেলন আয়োজনের দাবি জানান।
জাতীয় পার্টির এ সংকট এমন সময়ে দৃশ্যমান, যখন একদিকে দেশে নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অধিকাংশ দল, অন্যদিকে সংস্কার নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ চলছে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে। রাজনীতির চলমান এ দুটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে অনুপস্থিত জাতীয় পার্টি। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর ৮ আগস্ট ড.
দ্বিতীয় পর্যায়ে সংলাপের আগে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আবদুল্লাহ তাঁর ফেসবুক পোস্টে লিখেছেন, ‘স্বৈরাচারের দোসর জাতীয় পার্টিকে সংলাপে আমন্ত্রণ জানানো হলে আমরা সেই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের তীব্র প্রতিবাদ ও কঠোর বিরোধিতা করব।’ আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম প্রায় একই সময়ে লিখেছেন, ‘জাতীয় পার্টির মতো মেরুদণ্ডহীন ফ্যাসিস্টের দালালদের প্রধান উপদেষ্টা কীভাবে আলোচনায় ডাকেন?’ অনেকে বলছেন, এই দুই সমন্বয়কের অবস্থানের কারণেই জাতীয় পার্টির কপাল পুড়েছে। তখন জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের বলেছিলেন, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের সংলাপে না ডাকায় আমরা বিব্রত।’
জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের সুবিধা গ্রহণের দিক থেকে দেখলে জি এম কাদের কিংবা নতুন অব্যাহতিপ্রাপ্ত তিন নেতাও কম যাবেন না। বলা চলে, এদিক থেকে তিন নেতা এক ধাপ এগিয়ে থাকবেন। ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ ও মুজিবুল হক চুন্নু উভয়েই আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতার নির্বাচনে টানা চারবার এমপি হয়েছেন। তারা মন্ত্রীও হয়েছেন। জি এম কাদের ২০১৮ সালের চরম বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি হন এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
সর্বশেষ ২০২৪ সালের নির্বাচনে অংশ নিয়েও বিরোধীদলীয় নেতা হন। ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এমপি হওয়ার পর ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে জি এম কাদের বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। যদিও চব্বিশের নির্বাচনের আগে জি এম কাদের আওয়ামী লীগের সমালোচনা করে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। এমনকি চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ছাত্রদের পক্ষেও তাঁর বক্তব্য রয়েছে।
তারপরও বাস্তবতা হলো, জাতীয় পার্টির অতীতের ভূমিকার কারণেই বর্তমানে চাপে রয়েছে দলটি। এমনকি আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জাপাকেও নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। সে জন্যই পূর্ববর্তী ভূমিকার দায় এড়াতে নেতারা নতুন করে বিরোধে জড়িয়েছেন। আওয়ামী লীগের দোসর তকমামুক্ত হতে জি এম কাদেরের পরিবর্তে জাপায় নতুন নেতৃত্ব আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এদিকে জি এম কাদেরপন্থিরাও তা প্রতিরোধে সরব হয়েছেন। সমকালের প্রতিবেদন অনুসারে, জাতীয় পার্টির ৪১ সদস্যের প্রেসিডিয়ামের ২৬ জন সদস্য জি এম কাদেরকে সমর্থন করছেন।
প্রশ্ন হলো, বর্তমান বিরোধে জাতীয় পার্টি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? একদিকে জি এম কাদের, অন্যদিকে তিন শক্তিশালী নেতা, যাদের তিনি দল থেকে বহিষ্কার করেছেন। তারা উল্টো সংবাদ সম্মেলন করে চেয়ারম্যানের এখতিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। এমনকি বলছেন– মুজিবুল হক চুন্নুই জাপার বৈধ মহাসচিব। এমন সন্দেহ অমূলক নয়, যারা জি এম কাদেরকে অব্যাহতি দিয়ে জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগের দোসরমুক্ত করতে চাচ্ছেন, তারা ক্ষমতার কোনো না কোনো অংশ থেকে সহায়তা পাচ্ছেন। তাদের এ প্রবল শক্তিকে মোকাবিলা করে জি এম কাদেরপন্থিরা টিকে থাকতে পারবেন কিনা, তা বলার সময় এখনও আসেনি।
তবে জাতীয় পার্টির বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান ধরে রেখে দলটি যদি ঐক্যবদ্ধ থাকতে পারে তাহলে আপাতবিরোধী শক্তিশূন্য রাজনৈতিক অঙ্গনে দলটির সম্ভাবনা খারাপ নয়। এক সময় সারাদেশে বিচ্ছিন্নভাবে দলটির অনেক ভোটার পকেট থাকলেও, এখন তা নেই। তবে বৃহত্তর রংপুরে দলটির ভিত্তি একেবারে দুর্বল নয়। চিন্তার দিক দিয়ে এসব ভোটার মূলত ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদী ঘরানার। যে কারণে এদের দিকে বিএনপি-জামায়াতের পাশাপাশি এনসিপিরও নজর পড়েছে। ইতোমধ্যে দলগুলো বৃহত্তর রংপুরের সেসব আসনে কাজ শুরু করেছে। জাতীয় পার্টির অন্তঃকোন্দলের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক থাকলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
মাহফুজুর রহমান মানিক: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, সমকাল
mahfuz.manik@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: এম ক দ র র জন ত ক মন ত র দলগ ল সরক র আওয় ম
এছাড়াও পড়ুন:
কাজাকিস্তানের যাযাবর জাতির করুণ ইতিহাস
বিংশ শতাব্দীর আগে পৃথিবীর মানচিত্রে কাজাখস্তান, কিরগিজস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান এবং তুর্কমেনিস্তান নামের এই পাঁচটি দেশ ছিলো না। মূলত ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এই রাষ্ট্রগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা লাভ করে। পরে চীনের সহায়তায় ঐতিহাসিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই অঞ্চলগুলো বাণিজ্যিক কেন্দ্রস্থল হিসেবে পুনরুত্থান হয়েছে। এখন প্রশ্ন করা যেতে পারে, চীন কেন আবারও এই অঞ্চলগুলোকে শক্তিশালী করে তুলছে?
ঐতিহাসিকভাবে মধ্য এশিয়া অঞ্চল সিল্করোডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলো। যা চীনকে মধ্যপ্রাচ্য এবং রোমান সভ্যতার সাথে যুক্ত করেছিলো। বীজ গণিতের জনক আল খারিজমি, আবু সিনার মতো বিজ্ঞানীদের জন্ম হয়েছে এখানে। যাদের লেখা বই ইউরোপে শত শত বছর ধরে চিকিৎসা ও নিরাময়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। চেঙ্গিস খানও এই অঞ্চলে তার সম্রাজ্যের নিদর্শন রেখে গেছেন। পাশাপাশি ঘোড়ার পিঠে আদিম যাযাবর জীবনের ঐতিহ্যও টিকে আছে এখানে।
আরো পড়ুন:
রাশিয়ার বিরুদ্ধে এবার রোমানিয়ার আকাশসীমা লঙ্ঘনের অভিযোগ
রাশিয়ায় ৭.১ মাত্রার ভূমিকম্প, সুনামির সতর্কতা
রাজনৈতিক প্রভাব ও সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় আধিপত্য বিস্তার করেছিলো রুশরা। উপনিবেশিক শাসন এমনভাবে চালু করেছিলো, যা অনেকটা ব্রিটিশ বা ফরাসি সম্রাজ্যের মতো দেখতে।
রাজ্যগুলোকে শিল্পায়ন ও আধুনিকায়নের ফলে বিশাল পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। এমনকি যাযাবর জাতিকে যুদ্ধ যেতে বাধ্য করা হয়েছিলো। আর যাযাবর জাতিকে বসতি স্থাপনে বাধ্য করা হয়েছিলো। এরপর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ফলে কাজাখ জনগোষ্ঠীর চল্লিশ শতাংশ অর্থাৎ ২৫ শতাংশ মানুষ অনাহারে মারা যায়। এবং যাযাবর জনগোষ্ঠীর যে অর্থনীতি, তা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। কারণ সোভিয়েত আমলে কাজাখ যাযাবররা যে পশুপালন করতো তার নব্বই শতাংশই মারা যায়। ফলে বাধ্য হয়ে কাজাখদের যাযাবর জীবনযাত্রা ছেড়ে দিতে হয়। বলতে গেলে সোভিয়েত আমলে কাজাখ সভ্যতা ও সংস্কৃতির বেদনাদায়ক পুনর্গঠনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।
১৯৯১ সালে সোভিয়েন ইউনিয়নের পতন হয়, সৃষ্টি হয় এই পাঁচটি স্বাধীন দেশের। এই দেশগুলো স্বাধীন হয়েছে ঠিকই কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন পরবর্তী বিশ্বে খাপ খাইয়ে নিতে তাদের ব্যাপক সংগ্রাম করতে হয়। তবে বিগত কয়েক দশক ধরে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলো নিজস্ব সীমানার মধ্যে এক অনন্য পরিচয় গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে। যদিও তাদের ওপর বাইরের প্রভাবও রয়েছে। তুরস্ক এই অঞ্চলে নিজেদের উপস্থিতি আরও বেশি জানান দিচ্ছে। সাংস্কৃতিক, ঐতিহাসিক, ধর্মীয় এবং ভাষাগত মিল আছে। এমনকি শিক্ষাগত কাঠামোতেও মিল রয়েছে। তুরস্ক মধ্য এশিয়ায় রাশিয়ার পণ্য রফতানির একটি গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট হিসেবেও বিবেচিত।
জিনজিয়াং প্রদেশে প্রায় এক কোটি উইঘুর বাস করেন। যাদের বেশিরভাগই মুসলিম। এদের নিয়ে চীনের বিরুদ্ধে মানবতা বিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার অভিযোগ রয়েছে। এ ছাড়া উইঘুর পরিচয় মুছে ফেলতে তাদের পুনঃশিক্ষা শিবিরে আটকে রাখার অভিযোগও আছে। যদিও চীন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।
বৈশ্বিক অবকাঠামো উন্নয়নের পরিকল্পনা বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এর চীন মধ্য এশিয়ায় ব্যাপক অবকাঠামো উন্নয়ন করছে। এই অঞ্চলটিকে বাণিজ্যিক কেন্দ্রে পরিণত করতে চাইছে, যা অনেকটা সিল্করুটের মতোই।
চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ উদ্যোগের মাধ্যমে মধ্য এশিয়ায় প্রাচীন সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবিত করার একটি সম্ভবনা দেখা দিয়েছে। এই রোড পুনরুজ্জীবিত হলে রাশিয়া আর চীনের প্রভাব বলয়ে থাকা এই অঞ্চলের ভূ রাজনৈতিক গুরুত্ব কতটা বাড়বে-সেটাও সময় বলে দেবে।
ঢাকা/লিপি