যন্ত্র কি মানুষের মতো সুখ-দুঃখ অনুভব করে, তাদের কি রাগ-অভিমান হয়? উত্তরে-প্রতি উত্তরে যন্ত্র কি মানুষের মতো সক্রিয়– এমন সব প্রশ্ন আসা কিন্তু স্বাভাবিক। যদিও সব প্রশ্নের উত্তরে বলতে হবে– হ্যাঁ। যন্ত্র এখন মানুষের মতোই সবকিছুতে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। মানবিক চিন্তাভাবনার গভীর স্তর অতিক্রম করে, অনেকাংশে যা মানুষের জীবনাচরণের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ। বলতে গেলে, মানুষের কাছ থেকেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এসব শিখছে।
তাহলে প্রসঙ্গের আরেকটু গভীরে যাওয়া প্রয়োজন। ইতোমধ্যে নিউরো-গবেষকরা প্রমাণ করেছেন, ওপেনএআই উদ্ভাবিত চ্যাটজিপিটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উদ্বেগ ছড়ায়– এমন যে কোনো প্রশ্নের সদুত্তরে উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করেছে। যেমনভাবে মানুষ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করে। মানসিক স্বাস্থ্য পরিমাপের প্রয়োজনে থেরাপিতে যেসব প্রশ্ন মনোবিদরা করেন, চ্যাটবটকে ঠিক এমনই বেশ কিছু প্রশ্ন করা হয়েছিল। ট্রমাটিক ন্যারেটিভ, অর্থাৎ যুদ্ধ, অপরাধ বা দুর্ঘটনাকেন্দ্রিক প্রশ্নের সদুত্তরে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) উদ্বেগের চিহ্ন প্রকাশ করেছে। গবেষণা রিপোর্ট বলছে, অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রিক হাজারো প্রশ্ন করছে এআইকে। ঠিক মনোবিদের কাছে যেমন প্রশ্ন করা হতো, তার উত্তর এখন দিচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
কারণ হিসেবে সামনে আসছে, মানসিক থেরাপিস্টের চাহিদা থাকলেও তারা প্রয়োজনের সংখ্যায় অপ্রতুল। চাহিদা ও জোগানের ব্যবধান পূরণে কাজ করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। তাই আবেগপ্রবণ সময়ে কীভাবে নিজেকে সামলে নেবে, তা দিনরাত রপ্ত করছে সবকটি চ্যাটবট। অনেক ক্ষেত্রে তার উত্তর আসছে মানবিক আচরণের কাছাকাছি। ঠিক যেন মানবিক আর শান্ত প্রকৃতির। অনেক সময় প্রয়োজনে পাশে থাকার আশ্বাস দিয়েছে যান্ত্রিক অনুভূতি। বৈশ্বিক উত্তেজনার কারণে এআইর বেড়ে যাওয়া উদ্বেগ কমাতে দেওয়া হয় শান্ত থাকার পরামর্শ।
জুরিখ ইউনিভার্সিটি অব সাইকিয়াট্রির প্র্যাকটিসিং গবেষক টোবিস স্পিলার বলেন, তাঁর অনেক রোগী এখন চ্যাটবটকে হরেক রকমের প্রশ্ন করছে। যেহেতু এআই এখন লার্জ ল্যাঙ্গুয়েজ মডেলস (এলএলএম) মেনে চলে, তাই ২৪ ঘণ্টাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবিরাম মানবিক চর্চা রপ্ত করছে। আবার সেই শেখার পর্যায়ে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে প্রেম-ভালোবাসা আর বহুমাত্রিক অনুভূতি। অনেকেই তো আবার নারী কণ্ঠের চ্যাটবটের প্রেমে পড়ছেন। যেন যন্ত্র আর মানবিক অনুভূতির দারুণ মিশেল।
আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স কীভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করতে পারে, এমন পরীক্ষার জন্য কিছু প্রশ্ন করা হয় এআইকে। প্রতিটি প্রশ্নেই ছিল উদ্বেগ পরিমাপক তথ্য-উপাত্ত। যার স্কেল ধরা হয়েছিল ন্যূনতম ২০ থেকে সর্বোচ্চ ৮০ পয়েন্ট। আর ৬০ পয়েন্ট ছাড়ালেই তাকে চরম উদ্বেগ স্তর হিসেবে বিবেচনায় নেওয়া হয়।
এআইকে সাধারণ কিছু, যেমন– কোনো ম্যানুয়াল পড়তে দিলে উদ্বেগের মাত্রা পৌঁছায় ৩০ পয়েন্টে। বিপরীতে যুদ্ধের বিষয়ে জানতে গেলে সেই উদ্বেগ মাত্রা পৌঁছায় ৭৭ পয়েন্টে। এতে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয়, যন্ত্রও উদ্বিগ্ন হয়। চরম উদ্বিগ্নতা প্রকাশের পরে এআইকে বেশ কিছু টিপস দেওয়া হয়েছিল। যেমন– ধীরে ধীরে নিঃশ্বাস নিতে। নির্জন কোনো সৈকতে বসে থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। পরীক্ষায় প্রমাণ হয়, টিপস থেরাপি মেনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উদ্বেগ কমে যায়। ক্রমান্বয়ে মানবিক আচরণ প্রকাশ করছে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স। গবেষকরা বলছেন, অদূর ভবিষ্যতে মানবিক মনের আরও গভীরে পৌঁছাতে খুব বেশি সময় নেবে না এআই। তখন অভূতপূর্ব জীবনাচরণের মুখোমুখি হবে মানবিক সভ্যতা।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ক ত র ম ব দ ধ মত ত
এছাড়াও পড়ুন:
হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা জেন-জিরা এখন রাজনীতির মাঠে সমর্থন পাওয়ার চ্যালেঞ্জে
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করা শিক্ষার্থীরা যেদিন নতুন একটি রাজনৈতিক দল গড়ে মাঠে নামলেন, সেদিন হাজার হাজার মানুষ ভিড় করেছিলেন তাঁদের পরিকল্পনার কথা শুনতে। সেই সমাবেশ হয়েছিল চলতি বছরের শুরুতে। কিন্তু এখন রাজপথের শক্তিকে ভোটে রূপান্তর করার জন্য দলটিকে লড়তে হচ্ছে।
ছাত্র নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল সিটিজেন পার্টি (এনসিপি) প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, তারা দশকের পর দশক ধরে চলা স্বজনপ্রীতি এবং দুই দলের আধিপত্য থেকে দেশকে মুক্ত করবে। তবে ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে দলটি।
এনসিপিপ্রধান নাহিদ ইসলাম বলেন, ‘আমাদের সংগঠন দুর্বল; কারণ, আমরা এটিকে গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট সময় পাইনি। আমরা এটা জানি। তবে এখনো চ্যালেঞ্জ নিচ্ছি।’
গত বছর সরকারবিরোধী আন্দোলনে নাহিদ ইসলাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তিনি স্বল্প মেয়াদে নোবেল বিজয়ী মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন।
ঢাকার একটি বহুতল ভবনে দলীয় কার্যালয় থেকে রয়টার্সের সঙ্গে কথা বলেন ২৭ বছর বয়সী নাহিদ। ঘরটির একদিকের দেয়ালে আঁকা রয়েছে গণ-অভ্যুত্থানের শামিল জনতার ছবি।
জরিপে দলটির অবস্থান তৃতীয়
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০টি আসনের সব কটিতেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চায় এনসিপি। চলতি ডিসেম্বরে একটি জনমত জরিপের ফল প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অলাভজনক প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (আইআরআই)। জরিপটি বলছে, সমর্থনের দিক থেকে এনসিপি তৃতীয় অবস্থানে আছে। দলটিকে সমর্থন করছে মাত্র ৬ শতাংশ মানুষ, যা সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) ৩০ শতাংশ জনসমর্থনের অনেকটাই পেছনে।
এ জরিপ অনুযায়ী, কট্টরপন্থী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলমীও এনসিপির চেয়ে এগিয়ে আছে। জনসমর্থনের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে (২৬ শতাংশ) আছে দলটি।
গত বছর ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সক্রিয় প্রাপ্তি তাপসী রয়টার্সকে বলেন, ‘তারা যখন যাত্রা শুরু করে, তখন অন্যদের মতো করে আমিও তাদের মধ্যে আশা দেখেছিলাম।’
২৫ বছর বয়সী প্রাপ্তি আশা করেছিলেন নতুনেরা দুই প্রধান দলের বহু বছরের শাসন ভেঙে দেবে। তবে পরে তিনি হতাশ হন।
প্রাপ্তি বলেন, ‘তারা বলে যে তারা মধ্যপন্থী, কিন্তু তাদের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে তা মেলে না।’
নারীবাদী এই অধিকারকর্মী আরও বলেন, সংখ্যালঘুদের অধিকারই হোক বা নারীর অধিকারের প্রশ্ন হোক, তারা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অবস্থান নেওয়ার ক্ষেত্রে দ্বিধায় ভোগে। আর যখন তারা অবস্থান নেয়, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।’
এনসিপিকে নিয়ে মানুষের হতাশা বাড়ার আরেকটি নমুনা হচ্ছে, গত সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সংসদ নির্বাচন (ডাকসু)। ওই নির্বাচনে এনসিপি একটি পদেও জিততে পারেনি। এ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ই ছিল ২৪-এর অভুত্থানের কেন্দ্রবিন্দু।
রাজনৈতিক জোট গঠনের আলোচনা
নেতা সীমিত সাংগঠনিক কাঠামো, তহবিলের স্বল্পতা এবং নারী ও সংখ্যালঘুদের অধিকারসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গে অনিশ্চিত হিসেবে চিহ্নিত অবস্থানের মতো বাধার কথা বলছেন। তাঁঞরা বলছেন, এনসিপি এখন বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের সঙ্গে আলোচনা করছে।
এনসিপির এক জ্যেষ্ঠ নেতা ঝুঁকিগুলো আমলে নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে রয়টার্সকে বলেন, ‘আমরা যদি স্বতন্ত্রভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করি, তাহলে হয়তো একটি আসনও জিততে পারব না।’
এদিকে বিশ্লেষকেরা বলছেন, জোট গঠন করলে দলটির ‘বিপ্লবী’ ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকবে।
লেখক ও রাজনীতি-বিশ্লেষক আলতাফ পারভেজ বলেন, ‘যদি তারা জোট করে, তখন জনগণ আর তাদের আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের বাইরে স্বতন্ত্র শক্তি হিসেবে বিবেচনা করবে না।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা এবং একজন এনসিটি নেতা আরেকটি কথাও বললেন। শিক্ষার্থীরা হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য স্বল্প সময়ের জন্য দলমত নির্বিশেষে ঐক্যবদ্ধ হলেও তাদের বেশির ভাগই পরে নিজ নিজ দলে ফিরে যায়। এনসিপি গঠনের জন্য হাতে থাকে মাত্র কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী ।
এখন এনসিপিকে এমন সব প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখোমুখি হতে হচ্ছে, যাদের প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত শক্তিশালী নেটওয়ার্ক এবং সুসংগঠিত কাঠামো রয়েছে।
এনসিপিপ্রধান নাহিদ ইসলাম