উপকূলে সরকারি পানিবণ্টনে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি
Published: 8th, May 2025 GMT
মীরা ও তাঁর স্বামী দুজনই দিনমজুর। পড়ন্ত বিকেলে পুকুর থেকে পানি সংগ্রহ করার আগে দিনমজুরের কাজ করে আসতে হয়েছে মীরাকে। গ্রামের শেষ প্রান্ত থেকে সরদারবাড়ির এই পুকুর থেকে মীরার মতো অনেকেই পানি সংগ্রহ করেন। তাঁদের বাড়ির আশপাশের কোথাও খাওয়ার পানির ব্যবস্থা নেই। মীরা বলেন, এখান থেকে পানি নিয়ে বাড়ি আসতে-যেতে ঘণ্টাখানেক লাগে। গরম আসছে, চিন্তা বাড়ছে। পানির ট্যাংক পাওয়ার জন্য অনেকের কাছে বলেছেন; কিন্তু কাজ হয়নি।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে লবণাক্ততা বাড়ায় উপকূলের ১৯টির মধ্যে ১৮ জেলার শতাধিক উপজেলায় খাওয়ার পানির সংকট রয়েছে। সুন্দরবনসংলগ্ন উপকূলীয় এলাকায় সুপেয় পানির তীব্র সংকট ক্রমাগত বাড়ছে। এসব কারণে সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত পানির ট্যাংক যেন সোনার হরিণ। সেই সোনার হরিণ পেতে পোহাতে হচ্ছে নানা ভোগান্তি, গুনতে হচ্ছে বাড়তি টাকা। অনিয়ম আর দুর্নীতির বেড়াজালে আটকে আছে উপকূলের মানুষের খাওয়ার পানির উৎস। রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যন্ত অনেকেই জড়িয়ে পড়েছেন এই অবৈধ বাণিজ্যে।
সুন্দরবন উপকূলের কাছে বসবাস করা হাজারো মানুষ খাওয়ার পানির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছেন। মাইলের পর মাইল হেঁটে পুকুর থেকে কাদামাখা লবণাক্ত পানি সংগ্রহ করতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা। ঘূর্ণিঝড় আইলার পর থেকে এখানকার পুকুরগুলোর অবস্থা এতটাই খারাপ যে ফিটকিরি দিয়েও সেই পানি পুরোপুরি পানযোগ্য করা যায় না।
অথচ উপকূলীয় এলাকায় বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের জন্য সরকার কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়েছে। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর থেকে গভীর ও অগভীর নলকূপ এবং রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবে সেই সুবিধা পৌঁছেছে খুব কম মানুষের কাছে। কারণ, এসব প্রকল্পের প্রতিটি স্তরে রয়েছে অনিয়ম আর দুর্নীতি।
সরকারিভাবে নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ টাকা সহায়ক চাঁদা এবং পরিবহন খরচ তো আছেই, উপরন্তু দিতে হচ্ছে ঘুষ।বড় অঙ্কের টাকা খরচ করে কোথাও কোথাও পুকুর পুনঃখনন করা হয়েছে। তবে তা কাজে আসছে না। ‘পন্ড স্যান্ড ফিল্টারের’ (পিএসএফ) বেশির ভাগ অকেজো।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, পানির ট্যাংক পাওয়ার জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও রাজনৈতিক নেতাদের দিতে হচ্ছে ৩ থেকে ১০ হাজার টাকা। সরকারিভাবে নির্ধারিত ১ হাজার ৫০০ টাকা সহায়ক চাঁদা এবং পরিবহন খরচ তো আছেই, উপরন্তু দিতে হচ্ছে ঘুষ। রাজনৈতিক পরিচয়, জনপ্রতিনিধিদের ঘনিষ্ঠতা অথবা আত্মীয়তার সম্পর্ক—এগুলোই যেন পানির ট্যাংক পাওয়ার প্রধান শর্ত। এমনকি ট্যাংকের গায়ে ‘ক্রয়-বিক্রয় শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ লেখা থাকলেও দেদার চলছে এই অবৈধ ব্যবসা।
দাকোপ উপজেলার কালাবগী গ্রামের বিকাশ মণ্ডল সাত-আটবার নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখন ঝুলন্ত ঘরে (মাটির ওপর তৈরি নয়; নদীর চরে কাঠের পাটাতন এবং গোলপাতার বেড়া দিয়ে তৈরি) বসবাস করেন। পানির কষ্ট তাঁর নিত্যসঙ্গী। তিনি বলেন, ‘আমরা পানি একটু চেপেচুপে খাই। দেড় গেলাস খাইলে ভালো হয়; দেখা গেল এক গেলাসে সেরে দিলাম।’
মানুষের আগ্রহ সরকারের দেওয়া ৩ হাজার লিটারের ট্যাংকের প্রতি। খুলনা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের ২০২৫ সালের এপ্রিলের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় বিভিন্ন ধরনের মোট ৭৬ হাজার ৫৫৯টি পানির উৎস আছে। এর মধ্যে ২৪ হাজার ১১২টি গভীর নলকূপ, ১৩ হাজার ৪২৬টি অগভীর নলকূপ, ১ হাজার ৩৯০টি পিএসএফ, ৩২ হাজার ৬৩৬টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং ইউনিট করা হয়েছে। এর বাইরে অন্যান্য উৎসের মধ্যে রয়েছে রিভার্স অসমোসিস (আরও) ইউনিট, সোলার ডি-স্যালানাইজেশন ইউনিট, এসএসটি, সোলার পিএসএফ, পুকুরখনন, সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট ইত্যাদি। এর মধ্যে সরকারি হিসাবে ১২ হাজার ৭৩টি খাওয়ার পানির উৎস অকেজো হয়ে আছে। বর্তমানে জলাধার শুকিয়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ পিএসএফ ঠিকভাবে কাজ করছে না।
‘উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন’ প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নীতিমালা অনুসরণ করা হয়নি; বরং সাবেক সংসদ সদস্য ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা তাঁদের নিজস্ব তালিকা তৈরি করে দিয়েছেন। নিয়ম অনুযায়ী উঠান বৈঠক, ওয়ার্ডসভা, ইউনিয়নের পানি ও পয়োনিষ্কাশন (ওয়াটসান) কমিটির মাধ্যমে তালিকা তৈরির কথা থাকলেও বাস্তবে তা হয়নি।
আমরা পানি একটু চেপেচুপে খাই। দেড় গেলাস খাইলে ভালো হয়; দেখা গেল এক গেলাসে সেরে দিলাম।বিকাশ মণ্ডলবরাদ্দ কীভাবে, কাদের পাওয়ার কথাখুলনায় রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম (ঘরের চালার ওপর পড়া বৃষ্টির পানি পাইপ দিয়ে ট্যাংক বা পাত্রে ধরে রাখার পদ্ধতি) স্থাপনের বেশ কয়েকটি প্রকল্প রয়েছে। সবচেয়ে বড় প্রকল্প উপকূলীয় অঞ্চলে বৃষ্টির পানি সংরক্ষণের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন প্রকল্প। খুলনার দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা, পাইকগাছা, তেরখাদা, ডুমুরিয়া ও রূপসা উপজেলায় এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এ প্রকল্পে ৪০ হাজার ৫টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপনের জন্য দরপত্র আহ্বান করে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে।
২০২২-২৩ অর্থবছরে শুরু হওয়া এ প্রকল্পে গত ফেব্রুয়ারি মাসে জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রতিবেদন অনুযায়ী ১৫ হাজার ৮৩৩টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় পাইকগাছায় ৯ হাজার ৭৯২, কয়রায় ৮ হাজার ১৯২, দাকোপে ৫ হাজার ৮২৬, ডুমুরিয়ায় ৫ হাজার ৪৯০, তেরখাদায় ৪ হাজার ৯২৬, রূপসায় ৩ হাজার ২৪৫ ও বটিয়াঘাটায় ২ হাজার ৫৩৪টি রেইন ওয়াটার হার্ভেস্টিং সিস্টেম স্থাপন করার কাজ চলছে।
এ প্রকল্পে উপজেলায় বরাদ্দকৃত ট্যাংকের ৫০ শতাংশের তালিকা দিয়েছেন সাবেক স্থানীয় সংসদ সদস্যরা। বাকি ৫০ শতাংশ বণ্টন করা হয় উপজেলা পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন (ওয়াটসান) কমিটির মাধ্যমে। ওই কমিটির সভাপতি উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সহসভাপতি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ও সদস্যসচিব উপজেলা জনস্বাস্থ্যের সহকারী বা উপসহকারী প্রকৌশলী। তবে উপজেলা ওয়াটসান কমিটির জন্য বরাদ্দকৃত ট্যাংকের ১০-২০ শতাংশ উপজেলা চেয়ারম্যানের জন্য রেখে বাকিগুলো দেওয়া হতো ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যানদের তালিকা অনুযায়ী।
জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল দপ্তরের কর্মকর্তা ও জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, কারা পাবেন, এখানে একেবারে সুস্পষ্ট করে তা না থাকায় বাস্তবায়নে অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে।জনপ্রতিনিধিদের বাড়িতেও বসানো হয়েছে সরকারি এই ট্যাংক। সম্প্রতি দাকোপ ইউনিয়নের এক ইউপি সদস্যের বাড়িতে.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: প রকল প র এ প রকল প উপক ল য় প এসএফ বর দ দ অন য য় র জন য কম ট র ইউন ট সদস য সরক র উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
তামাবিল সীমান্তে যৌথ জরিপের সময় বিএসএফের সঙ্গে স্থানীয়দের উত্তেজনা
সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার তামাবিল সীমান্তে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ সীমান্ত জরিপ চলার সময় বিএসএফ সদস্যদের বাংলাদেশি ভূখণ্ডে প্রবেশে বাধা দিয়েছেন স্থানীয় লোকজন। বাংলাদেশের ভূখণ্ড বিএসএফ দখল করে নিচ্ছে- এমন অভিযোগে তারা লাঠিসোঁটা নিয়ে মাঠে হাজির হলে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে। বৃহস্পতিবার বেলা ১১টার দিকে সীমান্ত পিলার ১২৭৮ ও ১২৭৯ এর মধ্যবর্তী এলাকায় এ ঘটনা ঘটে।
এ বিষয়ে সিলেট ব্যাটালিয়নের (৪৮ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. নাজমুল হক সমকালকে বলেন, কিছুদিন ধরে যৌথ জরিপ চলছে। গোয়াইনঘাট উপজেলার নলজুরি খাসি হাওর ১২৭৮-১২৭৯ পিলারের মধ্যে সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলার মাঠে আজ বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে জরিপ কাজ শুরু হয়। জরিপ চলার সময় বাংলাদেশি কিছু লোক আবেগপ্রবণ হয়ে ভিড় করেন। বিএসএফের সঙ্গে বাদানুবাদ হয়। পরে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসে। পরবর্তীতে কবে জরিপ হবে তা এখন বলা যাচ্ছে না।
জানা গেছে, তামাবিল সীমান্তে বাংলাদেশের জায়গা (খেলার মাঠ এলাকা) অপদখলীয় ভূমি হিসেবে দেখছে বাংলাদেশ। ২০১৫ সালে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির আলোকে সীমান্ত এলাকায় সম্প্রতি জরিপ কাজ শুরু করে বাংলাদেশ ও ভারত। বৃহস্পতিবার ধারাবাহিক জরিপের অংশ হিসেবে জরিপ শুরু হলে সংশ্লিষ্টরা ছাড়াও দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবি ও বিএসএফ সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।
জরিপ শুরু হলে বিএসএফের কয়েকজন সদস্যের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে খাসি হাওর এলাকায় প্রবেশ করা নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা প্রতিবাদ জানান। ওই সময় স্থানীয় লোকজন হাতে লাঠিসোঁটা নিয়ে অবস্থান নেন। বিএসএফ সদস্যদের সঙ্গে ধাক্কাধাক্কি করতেও দেখা যায়। এক বিএসএফ সদস্যকে হিন্দিতে বলতে শোনা যায়, ‘এ হামারা মুল্লুক হ্যা। সমস্যা কিয়া হ্যায় তুম লোগকো।’
গোয়াইনঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রতন কুমার অধিকারী বলেন, যতটা জানতে পেরেছি সীমান্তে যৌথ সমীক্ষা চলছিল। তবে কে বা কারা সমীক্ষা চালিয়েছে তা আমরা জানি না।