ভারতের গণমাধ্যমগুলো বিনোদন মাধ্যমে পরিণত হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। তিনি বলেন, ভারতীয় গণমাধ্যমে দায়িত্বশীল কোনো সাংবাদিকতা নেই। বাংলাদেশে ফ্যাসিস্টের পতনে ভারতের মাথা নষ্ট হয়ে গেছে। এ জন্য তারা আমাদের গণমাধ্যমের সম্প্রচার বন্ধ করেছে। জবাবে আমরা তা করতে চাই না।

শনিবার যশোরের কেশবপুরের পাথরা পল্লী উন্নয়ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পুনর্মিলনীতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন প্রেস সচিব। তিনি আরও বলেন, ফ্যাসিস্ট সরকারের মন্ত্রী ও নেতারা সব চুরি করে বিদেশে নিয়ে গেছে। এখন চলছে ভঙ্গুর অর্থনীতি মেরামতের কাজ।

শফিকুল আলম আরও বলেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি মো.

আবদুল হামিদ ফ্যাসিস্ট ছিলেন। তার দেশত্যাগের ব্যাপারে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বিবৃতি দেওয়া হয়েছে। এ ঘটনায় জড়িতদের ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়া হচ্ছে। তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র বাসসের বিশেষ প্রতিনিধি এস এম রাশিদুল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন যশোরের জেলা প্রশাসক আজাহারুল ইসলাম, পুলিশ সুপার রওনক জাহান, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আছাদুজ্জামান, কেশবপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেকসোনা খাতুন, যশোর প্রেস ক্লাবের সভাপতি জাহিদ হাসান টুকুন প্রমুখ।

পুনর্মিলনীতে দূর-দূরান্ত থেকে বিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থীরা অংশ নেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে তাদের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠান পরিণত হয় উৎসবে।

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: যশ র ক শবপ র

এছাড়াও পড়ুন:

বেগম খালেদা জিয়া: সুস্থ হয়ে উঠুন বাংলাদেশের দীঘল ছায়া

তাঁর নাম ছিল ‘পুতুল’। হয়তো পুতুলের মতো সুন্দর বলেই এমন নামকরণ। স্কুলের খাতায় সবাই চিনতো ‘খালেদা খানম’ বলে। পড়তেন দিনাজপুর বালিকা বিদ্যালয়ে। বিয়ে হলো সেনাবাহিনীতে কর্মরত ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে। এই বিয়ে প্রসঙ্গে জমির উদ্দিন সরকার ‘দ্য পলিটিক্যাল থট অব তারেক রহমান’ বইয়ের এক রচনা অংশে লিখেছেন: ‘‘তিন বোনের মধ্যে খালেদা সবচেয়ে সুন্দর। এই সময় বৃহত্তর দিনাজপুর জেলার ঘরে ঘরে তাঁকে নিয়ে একটা খবর রটেছিল। একদিন এক ঘটক এক পাত্রীর সন্ধান নিয়ে গেলেন জিয়াউর রহমানের কাছে। জিয়াকে তিনি বললেন, ‘আপনি যদি তাঁকে বিয়ে করতে রাজি হন, তাহলে আপনার বাড়িতে বিজলিবাতির দরকার হবে না। পাত্রী এত রূপসী যে, তাঁর রূপের ছটায় সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে।’ শুনে জিয়া হাসলেন এবং বিয়ে করতে সম্মত হলেন। তারপর দুজন সুখের নীড় বাঁধলেন।’’

এ দেশে যেমন রেওয়াজ, তখনকার দিনে এর ব্যাত্যয় না ঘটাটাই স্বাভাবিক ও যুক্তিসঙ্গত। স্বামী জিয়াউর রহমানের নাম যুক্ত করে দেওয়া হলো স্ত্রীর নামের শেষাংশে। সেই সুবাদে হলেন খালেদা জিয়া। এভাবেই চলছিল । কিন্তু এ দেশের অভিজাততন্ত্র নামের আগে আরও কিছু যোগ করতে চায়; সেটাও রেওয়াজ, এই সমাজের পুরোনো ধারা, যা নামের সঙ্গে যুক্ত হয়ে স্থায়ী হয়ে যায় মূল নামের মতো। যেমন বেগম রোকেয়া সাখাওয়াৎ হোসেন। তাঁরও হলো ঠিক তেমনই, হয়ে উঠলেন বেগম খালেদা জিয়া। সেই থেকে তিনি এই নামেই পরিচিত, শ্রদ্ধেয়, সম্ভ্রম ও সমীহ জাগানিয়া।


বেগম খালেদা জিয়া এখন অসুস্থ। এই অবস্থা অনেকদিন ধরে। এর আগেও অসুস্থ হয়েছেন, হাসপাতালে গেছেন। সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। তবে এবারের অবস্থা বেশ সংকটাপন্ন। সকলেই দোয়া করছেন, দোয়া চাচ্ছেন- তিনি যেন সুস্থ হয়ে ওঠেন এই অভিপ্রায়ে। দেশবাসীর সকলের দোয়ায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠবেন এই আশাবাদ সবার মাঝে। তাঁর এই সময়ে বেঁচে থাকা জরুরি, দেশের স্বার্থে, জনগণের কল্যাণের লক্ষ্যে, রাষ্ট্র ও সমাজের সংহতি-সম্প্রীতি রক্ষায়।


বেগম খালেদা জিয়া‌ বাংলাদেশের ঐক্যের প্রতীকে পরিণত হয়েছেন। ২০২৪-এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশ তাঁকে আমব্রেলা বা ছাতাজ্ঞান করেছে। যার নিচে আশ্রয় নিয়ে সবাই দূর করতে চায় বিভাজিত রাজনীতির বিষবৃক্ষ। পরিবারে বা সমাজে যেমন একজন অভিভাবক থাকেন, যিনি আপদে-বিপদে সাহস যোগান, দূরদর্শী চিন্তা দিয়ে সুন্দর থেকে সুন্দরতম আগামীর পথ রচনা করেন। আজকের বাংলাদেশে তিনি রয়েছেন সেই অভিভাবকের ভূমিকায়। 
বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ হলেও আমাদের মাঝে আছেন এটাই বড় কথা। পরমতম সান্ত্বনার বিষয়। এ কারণেই দেশের সব বয়সী মানুষ, সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ তাঁর জন্য প্রার্থনারত। দেশবাসী তাঁকে মনে করেন অসূয়ক রাজনীতির বিপরীতে শুভ ও কল্যাণের রাজনীতির আলোকবর্তিকাস্বরূপ, বাতিঘর বিশেষ। বাংলাদেশ এই মুহূর্তে সংকটকালীন এক অবস্থা পার করছে। দেশী-বিদেশী নানামুখী ষড়যন্ত্র মুখিয়ে আছে সর্বনাশ ঘটানোর লক্ষ্যে। চলছে বিরাজনীতিকরণের অশুভ তৎপরতা। ইচ্ছেমতো দাবার গুটি চালছে ভূরাজনীতির খেলোয়াড়গণ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতির মোড়লেরা ও আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রতিপক্ষগণ নিজেদের স্বার্থোদ্ধারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় আমাদের রাষ্ট্রীয় সংহতি খুবই জরুরি।  প্রয়োজন যত দ্রুত সম্ভব অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এসব সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে হলে প্রয়োজন এমন একজন অভিভাবক, যার প্রতি মান্যতা আছে সকলের। যাকে কেন্দ্র করে সব দল ও মতের মানুষ একত্রিত হবে, কাছাকাছি আসার সুযোগ পাবে, নিজেদের মধ্যে আলোচনার পথ ও মত উন্মুক্ত রাখবে। 

বলার অপেক্ষা রাখে না, এই সময়ে সেই ধরনের অভিভাবকের অপশন আমাদের কাছে একজনই রয়েছেন, তিনি হলেন বেগম খালেদা জিয়া। তিনিই এখন পরিবারের সেই অভিভাবকতুল্য গুণী, যার দিকে তাকিয়ে পরিবারের বাকি সদস্যরা ভুলে যায় নিজেদের মান-অভিমান, হিংসা-বিদ্বেষ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান। কারণ পরিবারের সকল সদস্যরা তখন মনে করেন, তিনি যা কিছু করবেন আমাদের স্বার্থে, কল্যাণের লক্ষ্যে, ভালো কিছুর জন্যই করবেন। পরিবারের অভিভাবক যেমন তিলে তিলে এই আস্থা অর্জন করেন, খালেদা জিয়াও দীর্ঘ লড়াই, ত্যাগ-তিতিক্ষা আর অপরিসীম দায় ও দরদের মধ্যে দিয়ে সেটি অর্জন করেছেন।


প্রকৃতির নিয়ম হলো, যত বেশি যিনি ক্ষতাক্ত হবেন, তিনি তত বেশি মহৎ হয়ে উঠবেন। এ যেন বাংলা ভাষার সেই চিরন্তন প্রবাদ, ‘যে সহে সে রহে’। পৃথিবীর মহৎ মানুষদের জীবনীর দিকে লক্ষ্য করলে আমরা এর প্রমাণ পাই। যিশু শূলবিদ্ধ হয়েই মহৎ হয়ে উঠেছেন। মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর জীবনও এই সত্যের সাক্ষ্য দেয়। পৃথিবীর সকল মহৎ মানুষ ক্ষতাক্ত হয়েই স্মরণীয় ও বরণীয় হয়েছেন। এ যেন চিরন্তন নিয়ম। ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে’- এই বাক্য তো এ কথাই বলে, আগুনের মতো পরশমণি হতে চাইলে আগে নিজেকে আগুনের মতো পোড়াও। যেভাবে পুড়ে পুড়ে অমর হয়েছেন পৃথিবীর ইতিহাসের মহোত্তম মানুষ। বেগম খালেদা জিয়ার জীবনও যেন সেই মহোত্তম মানুষের প্রতিভূরূপে হাজির হয়েছে আমাদের মাঝে। তিনিও যেন দুঃখ-কষ্ট-বেদনায় পুড়ে পুড়ে আগুনের পরশমণি হয়ে উঠেছেন।

আমরা জানি, বেগম খালেদা জিয়া দুইবারের প্রধানমন্ত্রী, স্বামী জিয়াউর রহমান ছিলেন দেশের রাষ্ট্রপতি। এ রকম ভাগ্য কয়জনের হয়? বাংলাদেশে এমন সৌভাগ্য দ্বিতীয়জনের হয়নি। এ তো গেল জীবনের একটা পিঠ। অপর পিঠের খবরও তো জানা প্রয়োজন। ১৯৭১ সালে দুটি শিশুসন্তানসহ কী দুর্বিষহ সময় পার করেছেন তিনি, তার ইতিহাস কি আমরা জানি? এর জন্য ওই সময়ের দিকে আমাদের দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। একটু উদ্ধৃত করি মহিউদ্দিন আহমদের ‘খালেদা’ বইয়ের ভূমিকা অংশ থেকে। তিনি লিখেছেন: ‘‘সমশের মুবিন চৌধুরী এক সাক্ষাৎকারে আমাকে (‘খালেদা’ বইয়ের লেখক মহিউদ্দিন আহমদ) বলেছেন: ‘মেজর জিয়া বললেন, শহরে থাকা যাবে না। ৩০০ মাত্র সৈন্য আমাদের। থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে কীভাবে যুদ্ধ করবেন? কালুরঘাট ব্রিজ পার হয়ে নদীর অপর পারে গেলাম। এত রাত, কীভাবে যাব? রেললাইন ধরে যাব। তাহলে রাস্তা হারানোর কোনো ভয় নাই।
রেললাইন দিয়ে যাচ্ছি। মেজর জিয়া সৈন্যদের বললেন, আমরা বড় একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে যাচ্ছি। তোমরা আমাদের সাথে আছ? সবাই বলল, আছি। রেললাইন মেজর জিয়ার বাসার ঠিক পাশ দিয়ে। সেখানে যখন গেলাম, বললাম, স্যার, আপনি চলে যাচ্ছেন, ভাবি আর বাচ্চারা তো বাসায়। উনার ইনস্ট্যান্ট রিপ্লাই- অন দ্য স্পট উই আর অল সোলজার্স। আই অ্যাম দ্য লিডার। সো অ্যাবাউট দ্য ফ্যামিলিজ অব থ্রি হান্ড্রেড ম্যান কামিং উইল আস। ইফ আই ক্যান নট প্রটেক্ট দেয়ার ফ্যামিলিজ, আই শুড নট প্রটেক্ট মাইন (এখানে আমরা সবাই সৈনিক। আমি নেতা। আমাদের সঙ্গে আসা ৩০০ জনের পরিবারের কথা ভাবো। আমি যদি তাদের পরিবারগুলোকে নিরাপত্তা দিতে না পারি, তাহলে আমার পরিবারকে সুরক্ষা দেওয়াও উচিত নয়।)

এই যে একটা চরম স্যাক্রিফাইস করার ক্ষমতা, এটা না হলে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট হতো না, এটা না হলে মাও সে তুং হতো না, এটা না হলে নেলসন ম্যান্ডেলা হতো না, এটা না হলে মহাত্মা গান্ধী হতো না। এবং এটাও ঠিক, শেখ মুজিব হতো না।

এই যে কথাটা, ইফ আই ক্যান নট লুক আফটার দেয়ার ফ্যামিলিজ, আই ক্যান নট লুক আফটার মাই ফ্যামিলি। দ্যাটস অল। হি ইজ ইকুয়েটিং হিজ স্ট্যাটাস উইথ দ্য স্ট্যাটাস অব এ কমন সোলজার। দিজ ইজ হোয়াট মেকস হিম আ লিডার।’’

এই উদ্ধৃতির পর একটু ব্যক্তিগত প্রসঙ্গে আসি। ৭ নভেম্বর প্রশ্নে, জিয়াউর রহমানের ক্ষমতার কেন্দ্রে আবির্ভাব ও রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া প্রসঙ্গে, রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপির জন্ম নিয়ে কিছু প্রশ্ন ছিল। আমার বয়সী অনেকেরই হয়তো আছে এখনও কিংবা নেই। এসবের উত্তর ও বোঝাপড়ার জন্য নানা ধরনের বই পড়েছি। পত্রপত্রিকায় এ সংক্রান্ত লেখা যখনই পেয়েছি তাতেও করেছি অনুসন্ধান। কিন্তু সন্তুষ্ট হওয়ার মতো তেমন কিছু পাইনি। সময় পেরিয়ে যাচ্ছে একটা জিজ্ঞাসা নিয়েই। অমীমাংসিত কিছু বিষয়ের মতো এই বিষয়টাও হয়তো সঙ্গে নিয়েই শেষ হয়ে যাবে ইহজাগতিক পর্ব। ২০২৪ এর জুলাই-আগস্টের গণঅভ্যুত্থান সেই সব প্রশ্নের উত্তর হাজির করেছে। যেসব প্রশ্নের উত্তর আমি বইপত্রে পাইনি, তা বাস্তব ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে দৃশ্যমান হয়েছে। এ কারণেই বুঝি সাংবাদিকতায় বলা হয়, হাজারও শব্দের চেয়ে একটি ছবি গুরুত্বপূর্ণ। বই পড়ে যা পাওয়া যায়নি, মেলেনি যে প্রশ্নের উত্তর তার সমাধান পাওয়া গেছে ২০২৪ এর গণঅভ্যুত্থানে সংঘটিত ঘটনা প্রবাহের মধ্যে দিয়ে। 

১৯৭৫’র ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের প্রকৃত ইতিহাস এখনও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন। কিছু প্রশ্নের উত্তরও এখনও অমীমাংসিত, অনালোচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে কঠিন ও ধোঁয়াশাচ্ছন্ন সময়ে ঘটনার কেন্দ্রে হাজির হন জিয়াউর রহমান। তারপর থেকে বাংলাদেশের রাজনীতির কেন্দ্রীয় চরিত্রদের প্রতিভূ হয়ে ওঠেন তিনি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে ভরকেন্দ্র হয়ে আছে তাঁর সৃষ্ট রাজনৈতিক দল ও বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এ দেশে ক্ষমতার কেন্দ্রে যে বা যারাই থাকুক ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’কে ‘আত্মীকরণ’ ও ‘সাঙ্গীকরণ’ করেই চলতে হয়েছে প্রত্যেককে। এই বাস্তবতার আলোকে কী বলা যায়, ৭ নভেম্বর জিয়াউর রহমান এই দায়িত্ব গ্রহণ করে এ জাতির ভাগ্যাকাশে ত্রাণকর্তা হিসেবেই আবির্ভূত হয়েছিলেন, অবশ্যই। 

বিষয়টা বুঝতে আমাদের ২০২৪-এর ৫ আগস্টের ঘটনাপ্রবাহের দিকে দৃষ্টি ফেরাতে হবে। এই সময়ের যারা প্রত্যক্ষদর্শী, গবেষণামনস্ক এবং জিজ্ঞাসু মননের অধিকারী- প্রত্যেকেরই নিশ্চয় মনে আছে ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্টের দিনগুলোয় কী উৎকণ্ঠা-অনিশ্চয়তা আর শঙ্কার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। রাতগুলোর কথা কি মনে আছে আমাদের? কী ভয়াবহ এক দুঃসময় গেছে তখন! দিনরাতের প্রতিটি মুহূর্তে মনে হয়েছে, এই বুঝি গ্রহণ লাগা এক অন্ধকারে ঢাকা পড়বে প্রিয় স্বদেশ। ২০২৪ এ আমাদের স্বাধীনতার বয়স ৫৩ বছর পেরিয়েছে। তারপরও আমরা ৫ আগস্ট থেকে ৮ আগস্ট পর্যন্ত অজানা এক আশঙ্কায় কম্পমান ছিলাম ভেতরে বাইরে। এবার আমরা যদি ’৭৫-এর ৩ নভেম্বর থেকে ৭ নভেম্বরের দিনগুলোয় ফিরে যাই, তাহলে কী উপলব্ধি করি? কেমন ছিল সেদিনের ওই দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত। আর তখন তো দেশের স্বাধীনতার বয়স ছিল মাত্র চার বছর। এই অবস্থায় জিয়াউর রহমানের সেদিনের পদক্ষেপ অনিবার্য ও যথার্থ ছিল নিশ্চয়, অবশ্যই।


বেগম খালেদা জিয়ার বড় গুণ ও কৃতিত্বের জায়গা হলো জিয়াউর রহমানের লিডারশিপকে, ক্ষমতায় আবির্ভূত হওয়ার পর থেকে প্রতিটি পদক্ষেপকে; তাঁর অনুপস্থিতিতেও সমানভাবে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছেন, উচ্চকিত করেছেন। কোনোভাবেই অবনমন ঘটাননি। এখানেই তাঁর  অনন্য ভূমিকাকে দল হিসেবে জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিকে চিরদিন স্মরণে রাখতে হবে। তিনি দলের প্রতিষ্ঠাতাদের কেউ নন, প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য নন। কিন্তু জিয়াউর রহমানের নেতৃত্ব ও আদর্শকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন। বিএনপিকে সর্বান্তকরণে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। দলের লক্ষ্য ও আদর্শকে কখনোই কোনোভাবে ওভারল্যাপ করার চেষ্টা করেননি। নিজেকে উৎসর্গ করেছেন দলের স্বার্থে, জিয়াউর রহমানের আদর্শ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং দেশবাসীর সর্বজনীন কল্যাণে। এখানেই তিনি কেবল দেশে নয়, আন্তর্জাতিক বিশ্বেও অনন্য এক নজির স্থাপন করেছেন। সম্ভবত সেই কারণেই এখনও বিএনপি বলতে জিয়াউর রহমানের বিএনপিকেই বোঝানো হয়। যার মধ্যেই নিহিত ছিল-আছে খালেদা জিয়ার প্রেম-ভালোবাসা আর আত্মাৎসর্গের মহোত্তম উদাহরণ।


ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার দিনটির স্মৃতি আমার এখনও স্পষ্টকারে মনে আছে। তখন আমার বয় পাঁচ। সেই সময়ের তেমন কিছুই মনে নেই আমার। তবে ওই দিনটার কথা মনে আছে। এর কারণ হয়তো সেটা গভীরভাবে রেখাপাত করেছিল আমার মনে। খবরটা শুনি আমাদের ফুপাতো ভাই শামসুর ইসলাম লালনের কাছে। আমরা তাঁকে ডাকতাম ‘লালান ভাই’ বলে। তিনি খুবই দুঃখ ভারাক্রান্ত হয়ে খবরটা দিয়েছিলেন, রেডিওতে শোনার পর। ভাইয়ের ঘরের দরোজার সঙ্গে সাঁটানো ছিল জিয়াউর রহমানের ধানের শীষ সম্বলিত একটা পোস্টার। সেই দিনটি খুব বিষণ্নতার মধ্যে দিয়ে যায়। খেলতেও বাইরে বের হইনি। স্মৃতিতে জিয়াউর রহমান মানেই গেঞ্জি পরা, ক্যাপ মাথায় দেওয়া বিখ্যাত সেই ছবি। বায়োস্কোপেও এই ছবিটাই জায়গা করে নিয়েছিল। ক্ষুদিরাম আর জিয়াউর রহমানের ছবিটা প্রত্যেকটা বায়োস্কোপেই দেখা যেত। এর ভেতর দিয়ে একটা জিনিস স্পষ্ট হয়। ক্ষুদিরাম ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অংশ হিসেবে ফাঁসির দড়িতে আত্মোৎসর্গ করে রূপান্তর হন ‘মিথ’রূপে। জিয়াউর রহমান জীবদ্দশাতেই খালকাটা কর্মসূচি, ১৯ দফা রূপরেখার কারণে সকলের কাছে ‘মিথ’ হিসেবে দৃশ্যমান হন। যার প্রতীকি রূপ ছিল বিখ্যাত সেই ক্যাপ মাথায়, গেঞ্জি গায়ে, চোখে সানগ্লাস, গলায় লকেট, হাতঘড়ি পরা সেই ছবি; যা পরিশ্রমী-কৃষিজীবী বাংলাদেশের মূর্তপ্রতীক হয়ে উঠেছিল। অবশ্য রাজনীতি নিরপেক্ষ দৃষ্টিকোণ থেকে না দেখলে বিষয়টার অনুভব করা সম্ভব নয়।


১৯৮১ সালে স্বামী জিয়াউর রহমান মারা যাওয়ার সময় খালেদা জিয়া ছিলেন স্রেফ গৃহবধূ। তারপর দলের হাল ধরেছেন। সেই লড়াই কি মনে হয় খুব সহজ ছিল? দলের সেই সময়ের নেতৃত্ব কি অতি সহজেই দলীয় প্রধান হিসেবে মেনে নিয়েছেন তাঁকে? নাকি নেতৃত্ব দিয়েই প্রমাণ করতে হয়েছে, তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপির মতো একটা রাজনৈতিক দলের হাল ধরার মতো অবিকল্প ও যোগ্য এক নেতা। এসবও সবিস্তারে পাঠ করা প্রয়োজন। তারপর এরশাদবিরোধী আন্দোলনে তিনি যে লৌহমানবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন। তার জন্য কি কম খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে? ‘দেশনেত্রী’ ‘আপসহীন নেত্রী’র গুণাবলীর এই অর্জন ধরে রাখতে কী কঠোর সাধনা-সহ্যক্ষমতা আর লড়াই সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে- তাও মনে রাখা প্রয়োজন।


খালেদা জিয়াকে একবারই অনেক বেশি কাছে থেকে দেখার সুযোগ হয়েছে। ১৯৯১ সালে তখন এসএসসি পরীক্ষার দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে, বলা যায় ওল্ড টেনে পড়ি। তিনি গেলেন কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুরে। জনসভা হলো উপজেলার বয়েজ হাইস্কুল প্রাঙ্গণে। হেঁটে মঞ্চে উঠলেন, বক্তৃতা দিলেন। সবই দেখলাম, শুনলাম একেবারে কাছাকাছি থেকে। বক্তৃতার কী আর কত কিছু বুঝি। কেবলই ছিল কৈশোরক এক বিস্ময়! যে বিস্ময়ের ভাষারূপ খুঁজে পেয়েছিলাম কালিদাসের ‘অভিজ্ঞান শকুন্তলম’ নাটকে। যেখানে দুষ্মন্ত বলেছেন শকুন্তলাকে দেখে- ‘এ কী শরীরের রূপ, নাকি রূপের শরীর’। মুহূর্তটা যেন রূপকথাকেও হার মানিয়েছিল।

স্নিগ্ধতা, বাঙ্গালিয়ানা, মাতৃস্বরূপা, আভিজাত্য সব মিলেয়ে যেন তিনি বলে গেলেন, ‘আমি তোমাদেরই লোক’। কৈশোরক সেই অনুভূতির একটা অনূদিত রূপ যেন খুঁজে পেলাম মহিউদ্দিন আহমদের ‘খালেদা’ বইয়ের ভূমিকা অংশে। তিনি লিখেছেন: ‘‘আমি যেদিন তাঁকে সামনাসামনি দেখি, তখন তাঁর বয়স সত্তর। পড়ন্ত বিকেলে রোদের তেজ কমে গলে একটা শান্ত সমাহিত ভাব জেগে ওঠে। তাঁর মুখটা অবিকল সেরকম।

চেয়ারপার্সনের রূপের প্রশংসা অনেক শুনেছি। এবার দেখছি কাছে থেকে (সাক্ষাৎকার নিচ্ছিলেন)। আসলেই তিনি সুন্দর। অবশ্যই তিনি একজন সফল রাজনীতিবিদ। একজনের রাজনীতির সাফল্য প্রধানত নির্ভর করে ওই ব্যক্তি তার চূড়ায় উঠতে পেরেছেন কি না। খালেদার শুরুটাই হয়েছে নেতৃত্বের শীর্ষে থেকে কিন্তু ক্ষমতার কাঠামোর চূড়ায় তিনি পৌঁছেছেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। এটা তাঁর গুণ বলা যেতে পারে। রূপ আর গুণের এই রাজযোটক পৃথিবীতে খুব কম আছে। রূপকথায় আছে অনেক।’’

রূপকথার চরিত্ররা যেমন অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারেন। যদিও তাদের ঠিকই দুঃখ-কষ্ট বেদনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। অনেক লড়াই-সংগ্রাম আর মন্দ মানুষের মোকাবিলা করেই এগুতে হয় সামনের পানে। খালেদা জিয়ার ক্ষেত্রেও হয়েছে ঠিক তেমনটাই। কারণ মহোত্তম মানুষের এ এক অনিবার্য নিয়তি।

খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, বিরোধীদলীয় নেত্রী ছিলেন। আবার তিনিই একমাত্র প্রধানমন্ত্রী যিনি নিজের বাড়ি থেকে রাজরোষে পড়ে উৎখাত হয়েছেন। এতিমের টাকা চুরির দায় দিয়ে পাঠানো হয়েছে কারাগারে। সেই টাকার পরিমাণ শুনলে রামগরুড়ের ছানাও হেসে উঠবে। তারপর কারাগারে দিনেগুলোতে হয়েছেন অসুস্থ। অসুস্থতার জন্য বিদেশ যেতে চাইলে তা নিয়ে হয়েছে রঙ্গতামাশা। এসবই তাঁকে দেখতে হয়েছে, সহ্য করেছেন। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশে কি আর এরকম দ্বিতীয় উদাহরণ দেখাতে পারব, যিনি এভাবে ক্ষতাক্ত হয়েছেন?

এসবের পরও তিনি দেশ ছেড়ে যাননি। যেখানে খুনের আসামি জামিন পেয়ে পালিয়ে যায়। যার রেকর্ড আঙুলের কড় গুণে শেষ করা যাবে না। যেখানে টাকা পাচার আর হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি করেও মুক্ত বাতাসে ঘুরে বেড়ানো যায়। সেখানে সব রোষ গিয়ে পড়েছে কেবল খালেদা জিয়ার ওপর। এখানে চিকিৎসা করানোর নামে সকলেই বিদেশ যেতে পারে। এমনকি চিহ্নিত সন্ত্রাসীরাও। কিন্তু খালেদা জিয়া চিকিৎসা করানোর সুযোগ পান না, বিদেশ যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয় না। এই সব আঘাত, অপমান, অত্যাচার, চোগলখুরি রাষ্ট্রের তরফে করা হয়েছে। কিন্তু তারা বুঝতে অপারগ ছিল যে, এসবই খালেদা জিয়াকে নিয়েছে মহোত্তম মানুষের সারিতে। ইতিহাস যেমনটা বলে, মহৎ মানুষদের জীবনীতে যেটা দেখা যায়।

মহৎ মানবিকতার ঐশ্বর্যে খালেদা জিয়া আজ হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের সর্বজনীন ঐক্যের আশ্রয়। সংহতি আর সম্প্রীতির দীঘল ছায়া। তাই তাঁর অসুস্থতায় ভালো নেই বাংলাদেশ, ১৮ কোটি মানুষ। ভালো নেই ছাপান্নো হাজার বর্গমাইলের বাসিন্দারা। সবার চাওয়া তিনি সুস্থ হয়ে উঠুন। দুখিনী বাংলার সকলের মুখে হাসি ফোটাতে বেঁচে থাকুক আরও কিছুটা সময়। বেগম খালেদা জিয়া, সুস্থ হয়ে উঠুন বাংলাদেশের দীঘল ছায়া। 

লেখক: চিন্তক, সাংবাদিক ও গবেষক
 

সম্পর্কিত নিবন্ধ