চিকিৎসা সেবার পরিবেশকে নিরাপদ রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
Published: 13th, May 2025 GMT
চিকিৎসা সেবার পরিবেশকে নিরাপদ রাখতে সরকার বদ্ধপরিকর বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.)।
মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর শহিদ আবু সাঈদ ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সেন্টারে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুই দিনব্যাপী ১২ ও ১৩ মে সিভিল সার্জন সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন তিনি।
উপদেষ্টা বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রে হামলা, ভাঙচুর কিংবা চিকিৎসকদের হুমকির মতো দুঃখজনক ঘটনা ঘটেছে। সেজন্য সরকার চিকিৎসকদের নিরাপত্তা সহ চিকিৎসার সামগ্রিক পরিবেশকে অনুকূল, নিরাপদ ও জনবান্ধব করতে কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে সিভিল সার্জনদের প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আরও জোরদার করতে হবে।
সিভিল সার্জনদের উদ্দেশ্যে উপদেষ্টা বলেন, আপনারা সমাজের সবচেয়ে মেধাবী মানুষ। তাই আপনাদের ওপর জনপ্রত্যাশা সবচেয়ে বেশি। জেলা পর্যায়ে স্বাস্থ্যখাতের চালিকাশক্তি হিসেবে আপনাদের প্রতিটি সিদ্ধান্ত, প্রচেষ্টা ও ত্যাগ সরাসরি মানুষের জীবনকে প্রভাবিত করে, ছুঁয়ে যায়। তাই, আপনারা হচ্ছেন মানুষের আশার আলো, দুঃসময়ে ভরসার আশ্রয়।
তিনি বলেন, চিকিৎসকদের প্রতি জনগণের কিছু অভিযোগ রয়েছে। আমি বিশ্বাস করতে চাই এ অভিযোগগুলো যেন মিথ্যা প্রমাণিত হয়। জনগণের সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো- অনেক সরকারি চিকিৎসক হাসপাতালে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে উপস্থিত হন না বা পূর্ণ সময় থাকেন না। অনেক উপজেলা বা ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে রোগীরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও চিকিৎসা পান না। এই অনুপস্থিতি স্বাস্থ্যসেবার মানকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ও স্বাস্থ্যখাত সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে।
সেবাকে আরও জনমুখী করতে কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরে উপদেষ্টা বলেন, পোস্টমর্টেম সেবাকে থানা পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া; মহিলাদের পোস্টমর্টেম মহিলা ডাক্তার দিয়ে করানো, ধর্ষণ মামলার ক্ষেত্রে মহিলা ডাক্তার দিয়ে পরীক্ষা করানো, না পাওয়া গেলে মহিলা সেবিকা দিয়ে করিয়ে পুরুষ ডাক্তার দিয়ে প্রতিস্বাক্ষর করা, শিক্ষক ও শিক্ষা উপকরণহীন এবং ভবনকেন্দ্রিক বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো বন্ধ করা, অ্যাক্রেডিটেশন কাউন্সিল গঠন করে মেডিকেল কলেজগুলোর মান উন্নীতকরণ, ইন্টার্ন চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ ৬ মাস শহরে ও ৬ মাস গ্রামে করার ব্যবস্থাকরণ ও গ্রামে থাকাকালীন সম্মানী ভাতা বৃদ্ধিকরণ, ইত্যাদি।
তিনি বলেন, এসব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে জনগণ দ্রুত সেবা পাবে ও জনদুর্ভোগ হ্রাস পাবে। তাছাড়া মানহীন চিকিৎসক তৈরির হাত থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পাবে।
মো.
এসময় অন্যান্যের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. সায়েদুর রহমান, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ড. শেখ আব্দুর রশীদ, স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সচিব মো. সাইদুর রহমান, স্বাস্থ্য শিক্ষা ও পরিবার কল্যাণ বিভাগের সচিব ডা. মো. সারোয়ার বারী প্রমুখ।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: জ হ ঙ গ র আলম চ ধ র চ ক ৎসকদ র উপদ ষ ট জনদ র সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
ঈদুল আজহা ও হজ যখন প্রতিবাদের ক্ষেত্র
মক্কার পবিত্র ভূমিতে হজের ভিড়। হাজার হাজার মানুষ তাওয়াফ করছেন, তাঁদের কণ্ঠে লাব্বাইকের ধ্বনি। কিন্তু এই ভিড়ের মধ্যে একটি ছোট দল মিনায় জড়ো হয়েছে। তারা শাসকের অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলছে, তাদের হাতে কোরআন, চোখে ন্যায়বিচারের আকাঙ্ক্ষা। এই দৃশ্য ইসলামের ইতিহাসে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের একটি অনন্য রূপ। হজ ও ঈদুল আজহা শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং মুসলিমদের জন্য ন্যায়বিচারের দাবি উত্থাপনের একটি পবিত্র প্ল্যাটফর্ম ছিল তখন। এই প্রবন্ধে আমরা ঈদুল আজহা ও হজের প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ, ধর্মীয় আচারের সঙ্গে এর সম্পর্ক এবং মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে এর বিবর্তন নিয়ে আলোচনা করব।
হজের প্রেক্ষাপটে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ
হজ মুসলিমদের জন্য একটি বিশাল সমাবেশ, যেখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ একত্র হয়। এই সমাবেশ শুধু ধর্মীয় আচার নয়, বরং সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিযোগ উত্থাপনের একটি মঞ্চ হয়ে উঠেছিল বেশ কয়েকবার।
উমাইয়া যুগে হুসাইন বিন আলী (রা.) হজের সময় মক্কায় জনগণের সামনে ইয়াজিদ বিন মুয়াবিয়ার (৬৪৭-৬৮৩ খ্রি.) শাসনের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তিনি মিনায় একটি সমাবেশে হাজিদের উদ্দেশে বলেন, ‘ইসলামের মূল্যবোধ রক্ষার জন্য আমাদের দায়িত্ব নিতে হবে।’ এই সমাবেশ শান্তিপূর্ণ ছিল এবং হজের পবিত্রতা বজায় রেখে পরিচালিত হয়েছিল। (ইবনে কাসির, আল-বিদায়া ওয়ান নিহায়া, ৮/১৫৪, দামেস্ক: দারুল ফিকর, ১৯৮৮)
এই প্রতিবাদ পরবর্তী সময়ে কারবালার ঘটনার পটভূমি তৈরি করে, কিন্তু হজের সময় এটি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল। বলা যায়, হজের সময় মক্কার পবিত্রতা প্রতিবাদকে শান্তিপূর্ণ রাখতে বাধ্য করেছে। উমাইয়া যুগে আবদুল্লাহ বিন উমর (৬১০-৬৯৩ খ্রি.) হজের সময় মক্কায় শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলেন, কিন্তু তিনি স্পষ্টভাবে সহিংসতা প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, ‘মক্কার পবিত্রতা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব।’ (ইবনে হাজার আল-আসকালানি, আল-ইসাবা ফি তাময়িজিস সাহাবা, ৪/২১০, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৯৫)
আরও পড়ুনদরুদ কেন পড়ব২৮ এপ্রিল ২০২৫আব্বাসীয় যুগের আরেকটি উদাহরণ আছে। ২৪৫ হিজরি সনে (৮৫৯-৬০ খ্রি.) মক্কায় হজের সময় জনগণ খলিফা আল-মুতাওয়াক্কিলের (৮২২-৮৬১ খ্রি.) অত্যধিক করের বিরুদ্ধে মিনায় সমাবেশ করে। তারা কোরআনের কপি হাতে নিয়ে দোয়া করে এবং খলিফার প্রতিনিধির কাছে অভিযোগপত্র পাঠায়। এই প্রতিবাদের ফলে মক্কার হাজিদের জন্য কর হ্রাস করা হয়। (আল-তাবারি, তারিখুল উমাম ওয়াল মুলুক, ৯,/৩২৩, বৈরুত: দারুল কুতুব, ১৯৮৫)
ঈদুল আজহার প্রেক্ষাপটে প্রতিবাদ
সেকালে ঈদুল আজহার সময় মানুষ সমবেত হতো এবং এই সমাবেশ প্রায়ই সামাজিক ও ধর্মীয় অভিযোগ উত্থাপনের সুযোগ তৈরি করত।
ফাতেমীয় যুগে ৪০৫ হিজরি সনে (১০১৪-১৫ খ্রি.) মিসরে ঈদুল আজহার সময় জনগণ খলিফা আল-হাকিম বিআমরিল্লাহর (৯৮৫-১০২১ খ্রি.) কিছু ধর্মীয় নীতির বিরুদ্ধে মসজিদে সমাবেত হয়। তারা ঈদের নামাজের পর কোরআন হাতে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের অভিযোগ তুলে ধরে। এই প্রতিবাদের ফলে খলিফা তাঁর কিছু বিতর্কিত নীতি সংশোধন করেন। (আল-মাকরিজি, ইত্তিআজুল হুনাফা, ১/১৬৫, কায়রো: দারুল কুতুব, ১৯৭০)
প্রতিবাদের বিবর্তন
মধ্যযুগে প্রতিবাদ প্রধানত মসজিদে সমাবেশ, মিছিল ও প্রতীকী অভিযোগের মাধ্যমে প্রকাশ পেত। আধুনিক যুগে এই প্রতিবাদ আরও সংগঠিত ও বৈশ্বিক রূপ নিয়েছে। ২০ শতকে মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ দেখা যায়। ১৯২০ সালে ভারতের খিলাফত আন্দোলনে মুসলিমরা অটোমান খিলাফতের পতনের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন গড়ে তোলে। এই আন্দোলন মহাত্মা গান্ধীর অহিংস নীতির সঙ্গে সমন্বিত হয় এবং মধ্যযুগীয় মুসলিম প্রতিবাদের ঐতিহ্যের সঙ্গে সাদৃশ্য বজায় রাখে। (মিনল্ট, কে., দ্য খিলাফত মুভমেন্ট, পৃ. ৬৭, নিউইয়র্ক: কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৮২)
আধুনিক যুগেও হজের সময় প্রতিবাদ হয়েছে। ১৯৮৭ সালে মক্কায় হজের সময় একটি শান্তিপূর্ণ সমাবেশে হাজিরা রাজনৈতিক অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। যদিও এই সমাবেশ দমন করা হয়। (এস্পোসিটো, জে., দ্য অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব ইসলাম, পৃ. ৬৫৪, অক্সফোর্ড: অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, ১৯৯৯)
ইসলামের ইতিহাসে হজ ও ঈদুল আজহা শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের জন্য একটি পবিত্র প্ল্যাটফর্ম ছিল। এই প্রতিবাদগুলো ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সমন্বিত হয়ে মুসলিম সমাজের ঐক্য ও ন্যায়বিচারের ঐতিহ্যকে সমৃদ্ধ করেছে। এই ঐতিহ্য আমাদের শেখায়, ধর্মীয় আচার ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ একে অপরের পরিপূরক হতে পারে।
আল–জাজিরা ডট নেট অবলম্বনে
আরও পড়ুনহজের প্রস্তুতি যেভাবে নিতে হবে২৫ এপ্রিল ২০২৫