এমিলি ডিকিনসন : নিঃসঙ্গতা মানেই বিচ্ছিন্নতা নয়
Published: 15th, May 2025 GMT
এমিলি ডিকিনসনের বেশিরভাগ কবিতা ছিল চিঠিপত্রের অংশ, মূলত বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে লিখিত চিঠির কাব্যিক রূপ। উনিশ শতকের অন্যতম রহস্যময় এই কবির জন্ম ১০ ডিসেম্বর ১৮৩০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের অ্যামহার্স্ট শহরে। সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেতন। নিঃসঙ্গভাবে লেখালেখি করে গেলেও প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ সংযত। তার জীবদ্দশায় মাত্র দশটির মতো কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন। তাও সম্পাদকীয় নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেই সেসব লেখা প্রকাশ করতে হয়েছে।
কবিতা প্রকাশ না করার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। সমসাময়িক সাহিত্য রীতির সাথে এমিলি ডিকিনশনের ব্যতিক্রমী শৈলীর অসংগতিই প্রধান কারণ। এছাড়া তার ব্যক্তিগত আপসহীন জীবনযাপন, এবং সম্ভবত নিজের লেখার ওপর সমালোচকীয় নিয়ন্ত্রণ এড়ানোর কৌশল হিসেবেও জীবদ্দশায় তিনি কম প্রকাশিত থেকেছেন। মৃত্যুর পরে তার বিপুল সংখ্যক কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজ হাতে সেলাই করা ছোট আকারেরর পুস্তিকাতে সাজানো গোছানো অবস্থায়। নিজ হাতে বাঁধাই করা এসব পুস্তিকাকে ফ্যাসিকলস বলা হতো। মূলত এই কবিতাগুলোর মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যে তার একটি শক্তিশালী স্থান নির্ধারিত হয়। কবিতার ভাষা, ছন্দ এবং চিত্রকল্প আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে।
মৃত্যুর পরে আবিষ্কৃত তার ১৮শরও বেশি কবিতায় এমিলির লেখকসত্তা, কাব্যরীতি, শব্দচয়ন ও ভাব পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে। যা আজও একই আবেদন ধরে রেখেছে আর আজ তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।
ডিকিনসনের কবিতা সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ ও গভীর। প্রায়শই তার লেখকসত্তাকে এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন বিষেজ্ঞরা। তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ কবি। এমনিক প্রকরণতগতভাবেও বেছে নিয়েছিলেন নিজের পথ। অভূতপূর্ব ছন্দ ও চিহ্নের ব্যবহার ছিল কবিতায়। প্রচলিত ছন্দমিল থেকে সরে এসে নিজস্ব ছন্দ তৈরি করেছিলেন। কবিতায় ড্যাশ (-) চিহ্নের ব্যবহার তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মৃত্যু ও অস্তিত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে তার লেখায়। বেশিরভাগ কবিতায় মৃত্যু, প্রকৃতি, প্রেম, ঈশ্বর ও অনন্ত জীবন নিয়ে গভীর চিন্তার খোরাক পাওয়া যায়।
আত্মসচেতনতা ও রহস্যময়তা ছিল কবিতার সঙ্গী। কবিতার অনেক অংশেই ব্যক্তিগত অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ পেলেও, তিনি সবসময় পাঠককে সরাসরি উত্তর দেননি।
এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। যা গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সংবেদনশীলতা এবং মৃত্যুর প্রতি এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এই মৃত্যুবোধ ও জীবন দর্শন আজকের যুগের পাঠককেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি মৃত্যুকে কখনো শান্তিপূর্ণ, কখনো রহস্যময়, আবার কখনো অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যুর উপস্থিতি শুধুমাত্র শোকের গভীরতা বা জীবনের অনিশ্চয়তা প্রকাশ করে না, বরং এটি দর্শন, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির এক জটিল মিশ্রণ। আবার কখনো রহস্যময় এক যাত্রার প্রতিচ্ছবি ।
তার কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, মৃত্যু শুধু জীবনের শেষ নয়, বরং এক গভীর ভাবনার বিষয়। তার অনন্য রচনা শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি মৃত্যুর রহস্য নিয়ে পাঠককে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।
একটি কবিতায় মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি একটি মাছির শব্দ শুনতে পান, যা পরকাল সম্পর্কে মানুষের কল্পনার তুলনায় বাস্তবতার এক নির্মমতা প্রকাশ করে। মৃত্যুর সময় কবি কোনো মহিমান্বিত দৃশ্য দেখার আশা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি শুধুই একটি মাছির গুঞ্জন শুনতে পান। এটি দেখায়, মৃত্যুকে যতই মহিমান্বিত করে ভাবা হোক না কেন, বাস্তবতায় এটি একেবারেই সাধারণ এবং অনিবার্য। আরেকটি কবিতায় ডিকিনসনের মৃত্যুকে ব্যক্তিরূপে দেখান। এখানে মৃত্যু একজন ভদ্রলোকের মতো এসে কবির জন্য অপেক্ষা করে। এটি ইংগিত করে মানুষ কখনো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয় অথচ কিন্তু মৃত্যু সদয়ভাবে নিজেই এসে নিয়ে যায়।
তবে ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু শুধু শোক বা শেষের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি দর্শন, অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের এক গভীর প্রশ্ন। কবিতাগুলোতে মৃত্যু অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। তিনি কি মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী? নাকি মৃত্যু হলো চূড়ান্ত শেষ? তার কবিতাগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব অনুভূত হয়।
মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার প্রথম প্রকাশিত বইটি একটি ছোট সংগ্রহ আকারে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর প্রায় চার বছর পরে। সংগ্রহটি ডিকিনসনের অনন্য বাক্যগঠন, বানান এবং বিরামচিহ্ন অপসারণের জন্য ব্যাপকভাবে সম্পাদিত হয়েছিল। পারিবারিক কলহের ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতার অধ্যায় শুরু হয় । যার ফলে ডিকিনসনের কবিতার একটি বড় অংশ ১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত পুনরুদ্ধার ও প্রকাশিত হয়নি।
তার সাহিত্যিক উত্তরাধিকার শুধুমাত্র কবিতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেমে নেই। তিনি কাব্যরীতির প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথ তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক কবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক ও সমসাময়িক সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তার অনন্য শৈলী, সংক্ষিপ্ততা, এবং গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা অনেক কবি ও লেখকের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।
সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় ডিকিনসনের মতোই গভীর ব্যক্তিগত অনুভূতি, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা তুলনামূলকভাবে বর্ণনামূলক হলেও ডিকিনসনের সংক্ষিপ্ততা ও প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ স্পষ্ট।
একইভাবে মারিয়ান মুর, এড্রিয়েন রিচ, বিলি কলিন্স এদের প্রত্যেকের লেখাতেই ডিকিনসনের প্রভাব লক্ষণীয়। তার মতোই ভাষার সংক্ষিপ্ততা, ছন্দের নতুনত্ব ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গভীর বিশ্লেষণ এই লেখকদের লেখায় দেখা যায়। পাশাপাশি লেখার সরলতা ও গভীরতাকেও একসঙ্গে পাওয়া। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক কবিদের ভাষা ও ভাবনার কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।
ডিকিনসন প্রমাণ করেছেন যে নিঃসঙ্গতা মানেই বিচ্ছিন্নতা নয়—এটি হতে পারে এক গভীর সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি। তার কবিতা আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে, ভাবায়, এবং মৃত্যুর রহস্য ও জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৫ মে ১৮৮৬ সালে, ৫৫ বছর বয়সে নিজে তিনি মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করেন।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: রহস যময প রক শ ত র জন য অনন য র অনন রহস য
এছাড়াও পড়ুন:
দেশে বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন এম এন লারমা
মানবেন্দ্র নারায়ণ (এম এন) লারমাই দেশে প্রথম আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে বৈজ্ঞানিকভাবে চিহ্নিত করেছিলেন। তিনি প্রথম দেশে কাঠামোগতভাবে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে স্পষ্ট করেন। একটি বহুত্ববাদী রাষ্ট্রের ধারণা দিয়েছিলেন তিনি।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (জেএসএস) নেতা ও সাবেক সংসদ সদস্য এম এন লারমার ৮৬তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে আজ সোমবার রাজধানীর বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় বক্তারা এ কথাগুলো বলেন।
‘বিপ্লবী মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমার ৮৬ম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন কমিটি’ এ আলোচনা সভার আয়োজন করে। পরে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।
আলোচনা সভায় লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ বলেন, ১৯৫৫-৬৫ সালের মধ্যে তৈরি হওয়া ‘বাইনারি বিভাজন’ পরবর্তীকালে প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশে সরকার। ‘বাইনারি’ মনস্তত্ত্বকে এখনো এই দেশে টিকিয়ে রাখা হয়েছে। এম এন লারমা ‘বাঙালি হেজিমনি’র বিরুদ্ধে আত্মপরিচয়ের বয়ান বাঁচিয়ে রাখতে তৎকালে জোরালো প্রতিবাদ করেছিলেন।
জেএসএসের কেন্দ্রীয় সদস্য দীপায়ন খীসা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ না করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে গিয়েই ছাত্র এম এন লারমার প্রতিবাদী জীবন শুরু হয়। চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানের পর যে বৈষম্যহীন, অন্তর্ভুক্তিমূলক বাংলাদেশের কথা বলা হচ্ছে, এম এন লারমা ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়নকালেই এসব বিষয় নিয়ে জোরালো বক্তব্য দিয়েছিলেন।
দীপায়ন খীসা বলেন, ‘সংবিধান সংস্কারের বিষয়ে সংবিধান সংস্কার কমিশন বা জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কখনো ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের সঙ্গে সংলাপ করেনি। আমরাও এই দেশের অংশ। তাহলে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের কেন কোনো সংলাপে অংশগ্রহণ করার জন্য আহ্বান জানানো হলো না?’ তিনি বলেন, চব্বিশের গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদেরও অংশীদারত্ব আছে। কিন্তু অভ্যুত্থান–পরবর্তী সময়ে তাদেরই ভুলে গেল এই সরকার।
সভাপতির বক্তব্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়ন আন্দোলনের যুগ্ম সমন্বয়কারী জাকির হোসেন বলেন, ‘বাঙালি হয়ে যাও’ কথাটার পেছনে বাঙালি মুসলিমদের জাত্যভিমানের ব্যাপারটি রয়েছে। এম এন লারমা বাংলাদেশের মধ্যে থেকে নিজেদের অধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন। সেই আন্দোলনের প্রেক্ষিতে পরবর্তীকালে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ নামে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ (পিসিপি) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক শান্তিময় চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের অর্থ সম্পাদক মেইনথিন প্রমীলা, সাংবাদিক এহসান মাহমুদ, বাংলাদেশ মারমা স্টুডেন্টস কাউন্সিলের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক অং শোয়ে সিং মারমা।
অনুষ্ঠানটি শুরু হয় এম এন লারমাকে সম্মান জানিয়ে কবিতা পাঠের মাধ্যমে। কবিতা পাঠ করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রেই চাকমা ও লাল নিকিম বম। কবিতা আবৃত্তির পর এম এন লারমার জীবনবৃত্তান্ত পাঠ করেন হিল উইমেন্স ফেডারেশন ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক রিয়া চাকমা।
অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরামের তথ্য প্রচার ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক হিরণ মিত্র চাকমা, জেএসএসের কেন্দ্রীয় স্টাফ সদস্য অনন্ত বিকাশ ধামাই, হিল উইমেন্স ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি শান্তিদেবী তঞ্চঙ্গ্যা, পিসিপি ঢাকা মহানগর শাখার সভাপতি জগদীশ চাকমা, বাংলাদেশ আদিবাসী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি অনন্ত তঞ্চঙ্গ্যা।