এমিলি ডিকিনসনের বেশিরভাগ কবিতা ছিল চিঠিপত্রের অংশ, মূলত বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে লিখিত চিঠির কাব্যিক রূপ। উনিশ শতকের অন্যতম রহস্যময় এই কবির জন্ম ১০ ডিসেম্বর ১৮৩০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের অ্যামহার্স্ট শহরে। সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেতন। নিঃসঙ্গভাবে লেখালেখি করে গেলেও প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ সংযত। তার জীবদ্দশায় মাত্র দশটির মতো কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন। তাও সম্পাদকীয় নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেই সেসব লেখা প্রকাশ করতে হয়েছে।

কবিতা প্রকাশ না করার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। সমসাময়িক সাহিত্য রীতির সাথে এমিলি ডিকিনশনের ব্যতিক্রমী শৈলীর অসংগতিই প্রধান কারণ। এছাড়া তার ব্যক্তিগত আপসহীন জীবনযাপন, এবং সম্ভবত নিজের লেখার ওপর সমালোচকীয় নিয়ন্ত্রণ এড়ানোর কৌশল হিসেবেও জীবদ্দশায় তিনি কম প্রকাশিত থেকেছেন। মৃত্যুর পরে তার বিপুল সংখ্যক কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজ হাতে সেলাই করা ছোট আকারেরর পুস্তিকাতে সাজানো গোছানো অবস্থায়। নিজ হাতে বাঁধাই করা এসব পুস্তিকাকে ফ্যাসিকলস বলা হতো। মূলত এই কবিতাগুলোর মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যে তার একটি শক্তিশালী স্থান নির্ধারিত হয়। কবিতার ভাষা, ছন্দ এবং চিত্রকল্প আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে।

মৃত্যুর পরে আবিষ্কৃত তার ১৮শরও বেশি কবিতায় এমিলির লেখকসত্তা, কাব্যরীতি, শব্দচয়ন ও ভাব পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে। যা আজও একই আবেদন ধরে রেখেছে আর আজ তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ডিকিনসনের কবিতা সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ ও গভীর। প্রায়শই তার লেখকসত্তাকে এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন বিষেজ্ঞরা। তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ কবি। এমনিক প্রকরণতগতভাবেও বেছে নিয়েছিলেন নিজের পথ। অভূতপূর্ব ছন্দ ও চিহ্নের ব্যবহার ছিল কবিতায়। প্রচলিত ছন্দমিল থেকে সরে এসে নিজস্ব ছন্দ তৈরি করেছিলেন। কবিতায় ড্যাশ (-) চিহ্নের ব্যবহার তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মৃত্যু ও অস্তিত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে তার লেখায়। বেশিরভাগ কবিতায় মৃত্যু, প্রকৃতি, প্রেম, ঈশ্বর ও অনন্ত জীবন নিয়ে গভীর চিন্তার খোরাক পাওয়া যায়।

আত্মসচেতনতা ও রহস্যময়তা ছিল কবিতার সঙ্গী। কবিতার অনেক অংশেই ব্যক্তিগত অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ পেলেও, তিনি সবসময় পাঠককে সরাসরি উত্তর দেননি।

এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। যা গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সংবেদনশীলতা এবং মৃত্যুর প্রতি এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এই মৃত্যুবোধ ও জীবন দর্শন আজকের যুগের পাঠককেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি মৃত্যুকে কখনো শান্তিপূর্ণ, কখনো রহস্যময়, আবার কখনো অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যুর উপস্থিতি শুধুমাত্র শোকের গভীরতা বা জীবনের অনিশ্চয়তা প্রকাশ করে না, বরং এটি দর্শন, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির এক জটিল মিশ্রণ। আবার কখনো রহস্যময় এক যাত্রার প্রতিচ্ছবি ।

তার কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, মৃত্যু শুধু জীবনের শেষ নয়, বরং এক গভীর ভাবনার বিষয়। তার অনন্য রচনা শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি মৃত্যুর রহস্য নিয়ে পাঠককে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।

একটি কবিতায় মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি একটি মাছির শব্দ শুনতে পান, যা পরকাল সম্পর্কে মানুষের কল্পনার তুলনায় বাস্তবতার এক নির্মমতা প্রকাশ করে। মৃত্যুর সময় কবি কোনো মহিমান্বিত দৃশ্য দেখার আশা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি শুধুই একটি মাছির গুঞ্জন শুনতে পান। এটি দেখায়, মৃত্যুকে যতই মহিমান্বিত করে ভাবা হোক না কেন, বাস্তবতায় এটি একেবারেই সাধারণ এবং অনিবার্য। আরেকটি কবিতায় ডিকিনসনের মৃত্যুকে ব্যক্তিরূপে দেখান। এখানে মৃত্যু একজন ভদ্রলোকের মতো এসে কবির জন্য অপেক্ষা করে। এটি ইংগিত করে মানুষ কখনো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয় অথচ কিন্তু মৃত্যু সদয়ভাবে নিজেই এসে নিয়ে যায়।

তবে ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু শুধু শোক বা শেষের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি দর্শন, অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের এক গভীর প্রশ্ন। কবিতাগুলোতে মৃত্যু অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। তিনি কি মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী? নাকি মৃত্যু হলো চূড়ান্ত শেষ? তার কবিতাগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব অনুভূত হয়।

মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার প্রথম প্রকাশিত বইটি একটি ছোট সংগ্রহ আকারে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর প্রায় চার বছর পরে। সংগ্রহটি ডিকিনসনের অনন্য বাক্যগঠন, বানান এবং বিরামচিহ্ন অপসারণের জন্য ব্যাপকভাবে সম্পাদিত হয়েছিল। পারিবারিক কলহের ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতার অধ্যায় শুরু হয় । যার ফলে ডিকিনসনের কবিতার একটি বড় অংশ ১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত পুনরুদ্ধার ও প্রকাশিত হয়নি।

তার সাহিত্যিক উত্তরাধিকার শুধুমাত্র কবিতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেমে নেই। তিনি কাব্যরীতির প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথ তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক কবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক ও সমসাময়িক সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তার অনন্য শৈলী, সংক্ষিপ্ততা, এবং গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা অনেক কবি ও লেখকের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।

সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় ডিকিনসনের মতোই গভীর ব্যক্তিগত অনুভূতি, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা তুলনামূলকভাবে বর্ণনামূলক হলেও ডিকিনসনের সংক্ষিপ্ততা ও প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ স্পষ্ট।

একইভাবে মারিয়ান মুর, এড্রিয়েন রিচ, বিলি কলিন্স এদের প্রত্যেকের লেখাতেই ডিকিনসনের প্রভাব লক্ষণীয়। তার মতোই ভাষার সংক্ষিপ্ততা, ছন্দের নতুনত্ব ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গভীর বিশ্লেষণ এই লেখকদের লেখায় দেখা যায়। পাশাপাশি লেখার সরলতা ও গভীরতাকেও একসঙ্গে পাওয়া। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক কবিদের ভাষা ও ভাবনার কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

ডিকিনসন প্রমাণ করেছেন যে নিঃসঙ্গতা মানেই বিচ্ছিন্নতা নয়—এটি হতে পারে এক গভীর সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি। তার কবিতা আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে, ভাবায়, এবং মৃত্যুর রহস্য ও জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৫ মে ১৮৮৬ সালে, ৫৫ বছর বয়সে নিজে তিনি মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রহস যময প রক শ ত র জন য অনন য র অনন রহস য

এছাড়াও পড়ুন:

পুশইন করা ৭৫ বাংলাদেশিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর

ভারতের গুজরাট রাজ্য থেকে তুলে এনে সীমান্ত পথে বাংলাদেশে পুশইন করা ৭৮ জনের মধ্যে ৭৫ জন বাংলাদেশিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। বাকি তিনজন ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

মঙ্গলবার (১৩ মে) সকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর থানায় সংবাদ সম্মেলনে কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোনের মিডিয়া কর্মকর্তা লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ এ তথ্য জানান।

আরো পড়ুন: ভারতের রেখে যাওয়া ৭৮ জন শ্যামনগর থানায়, আজ পরিবারের কাছে হস্তান্তর

আরো পড়ুন:

ভারতের হামলায় পাকিস্তানের ১১ সেনা নিহত, আহত ৭৮: আইএসপিআর

যুদ্ধবিরতি বজায় রাখতে সম্মত ভারত-পাকিস্তান

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ জানান, গত ৯ মে ভোরের দিকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৫ জন বাংলাদেশি এবং তিনজন ভারতীয় নাগরিককে পুশইন করে। তাদের অধিকাংশই দীর্ঘদিন ধরে ভারতের গুজরাট রাজ্যে বসবাস করছিলেন। তারা বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত ছিলেন।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুশইন হওয়া ব্যক্তিরা জানায়, গত ২৬ এপ্রিল গভীর রাতে ভারতীয় প্রশাসন তাদের বাসা থেকে আটক করে এবং গত ৯ মে ভোরের দিকে গোপনে সুন্দরবনের মান্দারাড়ি চরে রেখে যায়। পরবর্তীতে ওই ব্যক্তিরা মান্দারবাড়িয়া চর থেকে মান্দারবাড়ি ফরেস্ট অফিসে গিয়ে আশ্রয় নেন। ফরেস্ট অফিস কোস্ট গার্ডকে অবহিত করে। গত ১০ মে বাংলাদেশ কোস্ট গার্ড পশ্চিম জোন পুশইন করা ৭৮ জন ব্যক্তিকে উদ্ধার করে। তাদের প্রয়োজনীয় খাবার ও ওষুধ সরবরাহ করে।

আরো পড়ুন: সুন্দরবন দিয়ে ৭৮ জনকে ‌‌‌‌ঠেলে দিল বিএসএফ 

পুশইন হওয়া ব্যক্তিরা জানায়, ভারতীয় পুলিশ তাদের বস্তিগুলোতে হানা দেয়। তাদের পরিবারের সদস্যদের সামনে নির্যাতন করে। তাদের চোখ বেঁধে একটি সামরিক বিমানে এবং পরিবারের অন্য সদস্যদের অপর একটি সামরিক বিমানে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় স্থানান্তর করে। এখনো তারা তাদের স্ত্রী-সন্তানদের অবস্থান সম্পর্কে কিছুই জানেন না। পরবর্তীতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ জাহাজের মাধ্যমে তাদের বাংলাদেশের সুন্দরবনের একটি জায়গায় রেখে যায়। 

লেফটেন্যান্ট কমান্ডার হারুন-অর-রশীদ জানান, উদ্ধারকৃত ব্যক্তিদের পরবর্তী আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য গত ১১ মে সাতক্ষীরা শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করা হয়। তিন ভারতীয় নাগরিকের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।

সংবাদ সম্মেলন শেষে উদ্ধারকৃত বাংলাদেশি ৭৫ জনকে তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

শুক্রবার (৯ মে) ভোর ৪টার দিকে বঙ্গোপসাগরসংলগ্ন সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পশ্চিম সুন্দরবনের মান্দারবাড়িয়া এলাকার মান্দারবাড়িয়া চরে ৭৮ জনকে রেখে যায় ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সকাল ৯টার দিকে বন বিভাগের মান্দারবাড়িয়া ক্যাম্পের সদস্যরা রেখে যাওয়া ব্যক্তিদের উদ্ধার করে ক্যাম্পে নিয়ে যান। রবিবার (১১ মে) রাত ১১টার দিকে ৭৫ জন বাংলাদেশি নাগরিকসহ ৭৮ জনকে শ্যামনগর থানায় হস্তান্তর করা হয়।

ঢাকা/শাহীন/মাসুদ

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আত্মজীবনীমূলক রচনা: সরল ভাবনা
  • গল্প-আড্ডা-স্লোগানে ৪ দফায় অনঢ় জবি শিক্ষার্থীরা
  • জনস্বার্থ মামলা বিচারিক সক্রিয়তার এক অস্ত্র
  • পুতিনের ওপর নির্ভর করছে পরবর্তী পদক্ষেপ: ইউক্রেন
  • রাজশাহী কলেজে হোস্টেল ভাড়া কমানোর দাবিতে বিক্ষোভ
  • ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রদলের বিক্ষোভ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা–উপাচার্য–প্রক্টরের পদত্যাগ দাবি
  • ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে আইডিএলসি ফাইন্যান্সের ৪৪% একত্রিত নিট মুনাফা বৃদ্ধি
  • পুশইন করা ৭৫ বাংলাদেশিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তর
  • লিবিয়ার রাজধানীতে রাতভর সংঘর্ষ, সশস্ত্র গোষ্ঠীর নেতা নিহত