এমিলি ডিকিনসনের বেশিরভাগ কবিতা ছিল চিঠিপত্রের অংশ, মূলত বন্ধুবান্ধব ও পরিবারকে লিখিত চিঠির কাব্যিক রূপ। উনিশ শতকের অন্যতম রহস্যময় এই কবির জন্ম ১০ ডিসেম্বর ১৮৩০ সালে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস রাজ্যের অ্যামহার্স্ট শহরে। সামাজিক জীবন থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখেতন। নিঃসঙ্গভাবে লেখালেখি করে গেলেও প্রকাশের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ সংযত। তার জীবদ্দশায় মাত্র দশটির মতো কবিতা তিনি প্রকাশ করেছেন। তাও সম্পাদকীয় নীতিমালায় ব্যাপক পরিবর্তন এনেই সেসব লেখা প্রকাশ করতে হয়েছে।

কবিতা প্রকাশ না করার পেছনে বেশ কিছু কারণ ছিল। সমসাময়িক সাহিত্য রীতির সাথে এমিলি ডিকিনশনের ব্যতিক্রমী শৈলীর অসংগতিই প্রধান কারণ। এছাড়া তার ব্যক্তিগত আপসহীন জীবনযাপন, এবং সম্ভবত নিজের লেখার ওপর সমালোচকীয় নিয়ন্ত্রণ এড়ানোর কৌশল হিসেবেও জীবদ্দশায় তিনি কম প্রকাশিত থেকেছেন। মৃত্যুর পরে তার বিপুল সংখ্যক কবিতা খুঁজে পাওয়া যায় তার নিজ হাতে সেলাই করা ছোট আকারেরর পুস্তিকাতে সাজানো গোছানো অবস্থায়। নিজ হাতে বাঁধাই করা এসব পুস্তিকাকে ফ্যাসিকলস বলা হতো। মূলত এই কবিতাগুলোর মাধ্যমেই পরবর্তীকালে বিশ্বসাহিত্যে তার একটি শক্তিশালী স্থান নির্ধারিত হয়। কবিতার ভাষা, ছন্দ এবং চিত্রকল্প আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে।

মৃত্যুর পরে আবিষ্কৃত তার ১৮শরও বেশি কবিতায় এমিলির লেখকসত্তা, কাব্যরীতি, শব্দচয়ন ও ভাব পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে শুরু করে। যা আজও একই আবেদন ধরে রেখেছে আর আজ তিনি ইংরেজি সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী একজন কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।

ডিকিনসনের কবিতা সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ ও গভীর। প্রায়শই তার লেখকসত্তাকে এক রহস্যময় অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত করেন বিষেজ্ঞরা। তিনি ছিলেন এক নিঃসঙ্গ কবি। এমনিক প্রকরণতগতভাবেও বেছে নিয়েছিলেন নিজের পথ। অভূতপূর্ব ছন্দ ও চিহ্নের ব্যবহার ছিল কবিতায়। প্রচলিত ছন্দমিল থেকে সরে এসে নিজস্ব ছন্দ তৈরি করেছিলেন। কবিতায় ড্যাশ (-) চিহ্নের ব্যবহার তার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হয়ে ওঠে। মৃত্যু ও অস্তিত্বের প্রতি গভীর দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে তার লেখায়। বেশিরভাগ কবিতায় মৃত্যু, প্রকৃতি, প্রেম, ঈশ্বর ও অনন্ত জীবন নিয়ে গভীর চিন্তার খোরাক পাওয়া যায়।

আত্মসচেতনতা ও রহস্যময়তা ছিল কবিতার সঙ্গী। কবিতার অনেক অংশেই ব্যক্তিগত অনুভূতির গভীরতা প্রকাশ পেলেও, তিনি সবসময় পাঠককে সরাসরি উত্তর দেননি।

এমিলি ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু একটি কেন্দ্রীয় বিষয়। যা গভীর অন্তর্দৃষ্টি, সংবেদনশীলতা এবং মৃত্যুর প্রতি এক অনন্য দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এই মৃত্যুবোধ ও জীবন দর্শন আজকের যুগের পাঠককেও আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তিনি মৃত্যুকে কখনো শান্তিপূর্ণ, কখনো রহস্যময়, আবার কখনো অনিবার্য বাস্তবতা হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যুর উপস্থিতি শুধুমাত্র শোকের গভীরতা বা জীবনের অনিশ্চয়তা প্রকাশ করে না, বরং এটি দর্শন, বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত উপলব্ধির এক জটিল মিশ্রণ। আবার কখনো রহস্যময় এক যাত্রার প্রতিচ্ছবি ।

তার কবিতাগুলো পড়লে বোঝা যায়, মৃত্যু শুধু জীবনের শেষ নয়, বরং এক গভীর ভাবনার বিষয়। তার অনন্য রচনা শৈলী ও দৃষ্টিভঙ্গি মৃত্যুর রহস্য নিয়ে পাঠককে নতুনভাবে ভাবতে বাধ্য করে।

একটি কবিতায় মৃত্যুর মুহূর্তে তিনি একটি মাছির শব্দ শুনতে পান, যা পরকাল সম্পর্কে মানুষের কল্পনার তুলনায় বাস্তবতার এক নির্মমতা প্রকাশ করে। মৃত্যুর সময় কবি কোনো মহিমান্বিত দৃশ্য দেখার আশা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি শুধুই একটি মাছির গুঞ্জন শুনতে পান। এটি দেখায়, মৃত্যুকে যতই মহিমান্বিত করে ভাবা হোক না কেন, বাস্তবতায় এটি একেবারেই সাধারণ এবং অনিবার্য। আরেকটি কবিতায় ডিকিনসনের মৃত্যুকে ব্যক্তিরূপে দেখান। এখানে মৃত্যু একজন ভদ্রলোকের মতো এসে কবির জন্য অপেক্ষা করে। এটি ইংগিত করে মানুষ কখনো মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত নয় অথচ কিন্তু মৃত্যু সদয়ভাবে নিজেই এসে নিয়ে যায়।

তবে ডিকিনসনের কবিতায় মৃত্যু শুধু শোক বা শেষের প্রতিচ্ছবি নয়, বরং এটি দর্শন, অভিজ্ঞতা ও অস্তিত্বের এক গভীর প্রশ্ন। কবিতাগুলোতে মৃত্যু অস্তিত্বের গভীর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজার চেষ্টা করে। তিনি কি মৃত্যু-পরবর্তী জীবনে বিশ্বাসী? নাকি মৃত্যু হলো চূড়ান্ত শেষ? তার কবিতাগুলোর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব অনুভূত হয়।

মার্কিন সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার প্রথম প্রকাশিত বইটি একটি ছোট সংগ্রহ আকারে ১৮৯০ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। তার মৃত্যুর প্রায় চার বছর পরে। সংগ্রহটি ডিকিনসনের অনন্য বাক্যগঠন, বানান এবং বিরামচিহ্ন অপসারণের জন্য ব্যাপকভাবে সম্পাদিত হয়েছিল। পারিবারিক কলহের ফলে পরবর্তী বছরগুলিতে দ্বন্দ্ব এবং প্রতিযোগিতার অধ্যায় শুরু হয় । যার ফলে ডিকিনসনের কবিতার একটি বড় অংশ ১৯৯৮ সালের আগে পর্যন্ত পুনরুদ্ধার ও প্রকাশিত হয়নি।

তার সাহিত্যিক উত্তরাধিকার শুধুমাত্র কবিতার সীমাবদ্ধতার মধ্যে থেমে নেই। তিনি কাব্যরীতির প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পথ তৈরি করেছিলেন, যা আধুনিক কবিদের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক ও সমসাময়িক সাহিত্যকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। তার অনন্য শৈলী, সংক্ষিপ্ততা, এবং গভীর দার্শনিক চিন্তাভাবনা অনেক কবি ও লেখকের কাজে প্রতিফলিত হয়েছে।

সিলভিয়া প্লাথের কবিতায় ডিকিনসনের মতোই গভীর ব্যক্তিগত অনুভূতি, অস্তিত্বের প্রশ্ন এবং মৃত্যুর প্রতি আকর্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে রবার্ট ফ্রস্টের কবিতা তুলনামূলকভাবে বর্ণনামূলক হলেও ডিকিনসনের সংক্ষিপ্ততা ও প্রকৃতির প্রতি গভীর মনোযোগ স্পষ্ট।

একইভাবে মারিয়ান মুর, এড্রিয়েন রিচ, বিলি কলিন্স এদের প্রত্যেকের লেখাতেই ডিকিনসনের প্রভাব লক্ষণীয়। তার মতোই ভাষার সংক্ষিপ্ততা, ছন্দের নতুনত্ব ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার গভীর বিশ্লেষণ এই লেখকদের লেখায় দেখা যায়। পাশাপাশি লেখার সরলতা ও গভীরতাকেও একসঙ্গে পাওয়া। এমিলি ডিকিনসনের কবিতা আধুনিক কবিদের ভাষা ও ভাবনার কাঠামোকে নতুনভাবে গড়ে তুলতে সাহায্য করেছে।

ডিকিনসন প্রমাণ করেছেন যে নিঃসঙ্গতা মানেই বিচ্ছিন্নতা নয়—এটি হতে পারে এক গভীর সৃষ্টিশীলতার ভিত্তি। তার কবিতা আজও পাঠকদের মুগ্ধ করে, ভাবায়, এবং মৃত্যুর রহস্য ও জীবনের অনন্ত সম্ভাবনাকে অন্বেষণ করতে উদ্বুদ্ধ করে। ১৫ মে ১৮৮৬ সালে, ৫৫ বছর বয়সে নিজে তিনি মৃত্যুস্বাদ গ্রহণ করেন।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: রহস যময প রক শ ত র জন য অনন য র অনন রহস য

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছি আমরা?

২০২৪–এর গণ-অভ্যুত্থানকে আমরা জুলাই মাস দিয়ে নামকরণ করি। ঠিক এক বছর পরের জুলাইয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের চেতনে কিংবা অবচেতনে প্রাপ্তি আর অপ্রাপ্তির একধরনের হিসাব–নিকাশের প্রবণতা তৈরি হয়েছে। একটি পত্রিকার কলামের সুনির্দিষ্ট শব্দসংখ্যার সীমা এত বিস্তৃত বিষয়টি আলোচনার জন্য যথেষ্ট না হলেও কয়েকটি কথা বলা যাক।

একটা বড় প্রাপ্তি দিয়ে শুরু করা যাক। এটা হচ্ছে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতনকে বিপ্লব বলে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা ব্যর্থ হওয়া। এমনকি যাঁরা এই চেষ্টা করেছেন, তাঁরাও সরে এসেছেন এই চেষ্টা থেকে; তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানুষগুলোকেও এখন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ শব্দটি ব্যবহার করতে দেখছি। এমনকি স্বয়ং প্রধান উপদেষ্টা শুরুর দিকে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে ‘বিপ্লব’ শব্দটি ব্যবহার করলেও পরবর্তী সময়ে ব্যবহার করেছেন ‘গণ-অভ্যুত্থান’ শব্দটি। শেখ হাসিনার পতনের জন্য আমরা যা করেছি, সেটা বিপ্লব নাকি গণ-অভ্যুত্থান, এটা আমাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানোর জন্য খুবই জরুরি। সেই প্রসঙ্গে আসব শেষের দিকে।

দীর্ঘ এক বছর চলে গেলেও আমরা আজও এই সিদ্ধান্তে এসে পৌঁছাতে পারিনি, শেখ হাসিনার পতন আমরা কেন চেয়েছিলাম এবং পতন–পরবর্তী সময়ে আমাদের উদ্দেশ্য কী ছিল। কেউ কেউ অবশ্য ঝটপট উত্তর দিয়ে দেবেন ৩ আগস্ট ২০২৪ শহীদ মিনারে ছাত্ররা তো শেখ হাসিনার পতনের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং ভবিষ্যতে এ ধরনের ব্যবস্থা ফিরে আসা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির ঘোষণা করেছিলেন।

ঘটনাচক্রে একটা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানের সামনের সারিতে চলে আসা কিছু ছাত্রনেতা যে ঘোষণা দিয়েছেন, সেটা কি দেশের সব শ্রেণির মানুষের মনের চাওয়া ছিল? এক দফার মধ্যে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির কথাটা বাদ দিয়ে শুধু শেখ হাসিনার পতনের কথা বললে আন্দোলনরত জনগণ রাস্তা থেকে ফিরে যেত ওই দিন? ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা ফিরে আসা প্রতিরোধ করার জন্য নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির প্রয়োজনীয়তা স্বীকার করেও এই প্রশ্ন করা কি অমূলক হবে যে এই লক্ষ্যটি কি আসলে ‘চাপিয়ে দেওয়া’ নয়? 

নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত তৈরির প্রসঙ্গেই গত এক বছরে ‘সংস্কার’ একটি বহুলশ্রুত শব্দে পরিণত হয়েছে। সত্যি বলতে আমাদের প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির হিসাব মেলানোর ক্ষেত্রে সংস্কারই সম্ভবত এই মুহূর্তের সবচেয়ে বড় মানদণ্ড। যাঁরা খুবই গভীর, বিস্তৃত সংস্কারের পক্ষে খুব কঠোরভাবে অবস্থান নিয়েছেন, তাঁরা প্রায়ই বলেন, ‘জনগণ সংস্কার চায়।’ নিজের চাওয়াকে জনগণের নামে বলার প্রবণতা এই মাটিতে অনেক পুরোনো। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যেও সংস্কার নিয়ে ঐকমত্য রয়েছে। তবে বিভেদ রয়েছে সংস্কারের ব্যাপ্তি ও ধরন নিয়ে। সেটারই চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি। বলা বাহুল্য, এটা দেখেই অনেকে ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েছেন।

সবকিছুর পরও আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার প্রধান বাধা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছি আমরা। এবং এর পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের নামে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করতে পেরেছি আমরা, এগুলো আমাদের খুব বড় অর্জন। ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হাঁটতে, আলোচনা-বিতর্ক (মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝঁাটি) করতে করতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বাকি ইস্যুগুলোর সমাধান করতে পারব।

সংস্কার বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের আন্তরিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়। কমিশনগুলোর যেসব সংস্কার প্রস্তাব ঐকমত্য কমিশনে আসেনি, সেগুলো এবং কমিশনের আলোচনায় প্রাথমিকভাবে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হওয়া বিষয়গুলো সরকার দ্রুত শেষ করতে আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। ওদিকে সরকার কর্তৃক গঠিত অর্থনৈতিক পরিস্থিতির শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কিছুদিন আগে অর্থনৈতিক সংস্কারের প্রশ্নেও হতাশা প্রকাশ করেছেন।

দীর্ঘদিন একটা স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যে জীবনযাপন করার পর অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বাধীন সরকারের কাছে মানুষের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী। ধারণা করি, সরকার মোটাদাগে মানুষকে হতাশ করেছে। শেখ হাসিনার সময়ে বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে, এটা মেনে নিয়েও বলতে চাই, অনেক অসাধারণ কিছু করা দূরেই থাকুক, একটা সরকারের খুবই সাধারণ রুটিন কাজের ক্ষেত্রেও সরকারের ব্যর্থতা আমরা দেখেছি। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ক্ষেত্রে সরকারের ব্যর্থতা একেবারে নজিরবিহীন। পুলিশ বাহিনী অন্তর্গতভাবে দুর্বল হয়ে পড়লেও ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার নিয়ে সামরিক বাহিনীর মাঠে উপস্থিতির পরও এমন ব্যর্থতা ক্ষমার অযোগ্য।

শেখ হাসিনার সময় বাংলাদেশ আদতে কোনো রাষ্ট্র ছিল না, ছিল ‘মগের মুল্লুক’। দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই আলাপ এখন অনেকেই তুলছেন এই সরকারের সময়ে দেশ ‘মবের মুল্লুকে’ পরিণত হয়েছে কি না। বিশেষ করে ধর্মের নামে তৈরি হওয়া মব নিয়ন্ত্রণে সরকার কিছুই করতে পারেনি কিংবা পরিকল্পিতভাবেই করেনি। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গেছে যে নিউইয়র্ক টাইমস–এর মতো পত্রিকা বাংলাদেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডানপন্থী উগ্রবাদীরা তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে খানিকটা সম্ভাবনা দেখতে পাচ্ছে, এমন শিরোনামে রিপোর্ট করেছে। 

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের স্থিতিশীলতা, মুদ্রাস্ফীতি না বাড়ার মতো অর্থনীতির ক্ষেত্রে কিছু সাফল্য আছে সরকারের। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারের নীতি বাস্তবায়নের চেয়ে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে যাওয়ার কারণে চাহিদা হ্রাস পাওয়ার বড় প্রভাব রয়েছে। এ ছাড়া এই সরকারের ক্যাবিনেটকে মোটাদাগে দুর্নীতিমুক্ত বলেই মনে করা হয়, যদিও সরকারি অফিসে দুর্নীতি দমনে সরকার কিছুই করতে পারেনি। এমনকি পারেনি বিভিন্ন জায়গায় চাঁদাবাজি, দখলদারির মতো ক্ষেত্রে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে।

একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে তাদের চিন্তা এবং আদর্শগত মতপার্থক্য বা ভিন্নতা থাকবেই কিন্তু প্রত্যাশিত ছিল শেখ হাসিনা–পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক আচরণের ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক সহনশীলতা অনেক ভালো থাকবে। কিন্তু পরিস্থিতি খুব খারাপ পর্যায়ে চলে না গেলেও দলগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে পরস্পরের প্রতি শত্রুতামূলক আচরণ করছে। দীর্ঘকাল একটা স্বৈরাচারী ব্যবস্থার মধ্যে থেকে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মিথস্ক্রিয়া থেকে অনেক দূরে ছিল দীর্ঘকাল। তাই এমন সংকট হয়তো অভাবনীয় নয়। কিন্তু এটাকেও আমরা বেশ খানিকটা নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারতাম যদি গণ-অভ্যুত্থানের ঠিক পরবর্তী মুহূর্ত থেকেই এর কৃতিত্ব দাবি করে অন্যদের অবদানকে তুচ্ছ করার প্রবণতাকে আমরা রোধ করতে পারতাম। একই সঙ্গে সরকারের দিক থেকে একটি দলের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ করাও রাজনীতিতে অবিশ্বাস তৈরির ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছে।

শেখ হাসিনার পতন–পরবর্তী সময়ে সবচেয়ে বেশি হতাশা তৈরি করেছে সম্ভবত গণ-অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারী এবং সামনের সারিতে থাকা ছাত্রদের কেউ কেউ নানা রকম অনিয়ম–দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছেন বলে সাধারণের মধ্যে ধারণা তৈরি হওয়া। জুলাইয়ের নামে নতুন ‘চেতনা ব্যবসা’ চালু করছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠেছে। সম্প্রতি গণ-অভ্যুত্থানের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মুখ উমামা ফাতেমা ‘বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন’ সংগঠনটি থেকে বেরিয়ে আসার ঘোষণা দিয়ে যে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন, সেটা দীর্ঘদিন থেকে সমাজে প্রচলিত ধারণাকেই শক্ত ভিত্তি দিয়েছে।

যাঁরা চেয়েছিলেন শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঘটা স্বতঃস্ফূর্ত গণ-অভ্যুত্থানটিকে বিপ্লব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে বিপ্লবী সরকার গঠনের মাধ্যমে সংবিধান স্থগিত করে, ছাত্রদের দিয়ে মিলিশিয়া বাহিনী গঠন করে, রাষ্ট্রক্ষমতা দীর্ঘকালের জন্য কুক্ষিগত করবেন, তাঁরা হতাশ হয়েছেন। যাঁরা চেয়েছেন অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত সরকারটিকে যতটা সম্ভব (নিদেনপক্ষে পাঁচ বছর) টেনে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব উপভোগ করা, হতাশা আছে তাঁদেরও; কারণ দেশ নির্বাচনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। হতাশ হয়েছেন তাঁরাও, যাঁরা চেয়েছেন এবারই এই বাংলাদেশের সব ধরনের সাংবিধানিক ও আইনি সংস্কার করে আমাদের গণতন্ত্রকে চিরস্থায়ী করে তুলবেন। তাঁদের এ ধরনের চিন্তার সদিচ্ছাকে প্রশ্ন না করেও বলা যায়, এটা শিশুতোষ অতি আশাবাদ। এখন পর্যন্ত সংস্কার নিয়ে যেভাবে আলাপ–আলোচনা হয়েছে এবং যতটুকু মতৈক্য হয়েছে, সেটা খুবই আশাব্যঞ্জক।

এই অভ্যুত্থানের সুফল আমরা যতটা পেলাম, শেষ পর্যন্ত সেটা খুব সন্তোষজনক নয় বটেই। যদি শুরুতেই এ গণ-অভ্যুত্থানটাকে বিপ্লব বলে সংজ্ঞায়িত করার চেষ্টা না করতাম এবং একটা দক্ষ সরকার পেতাম, তাহলে এর সর্বোচ্চ সুফল পাওয়া সম্ভব ছিল। একটা বিপ্লবের কাছে একটা জাতি এবং রাষ্ট্র যা চাইতে পারে, একটা গণ-অভ্যুত্থানের কাছে কোনোভাবেই সেটা চাইতে পারে না। বাস্তবতার জমিনে দাঁড়িয়ে যদি আমরা আমাদের গণ-অভ্যুত্থানটাকে এবং এর ধরনটাকে সঠিকভাবে আত্মস্থ করতে পারতাম, তাহলে আমরা অনেক বেশি বাস্তব স্বপ্ন দেখতে পারতাম, বাস্তবায়নযোগ্য লক্ষ্য ঠিক করতে পারতাম।

সবকিছুর পরও আমাদের গণতান্ত্রিক পথচলার প্রধান বাধা শেখ হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করে পালিয়ে যেতে বাধ্য করতে পেরেছি আমরা। এবং এর পরবর্তী সময়ে বিপ্লবের নামে দেশকে নৈরাজ্যের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ করতে পেরেছি আমরা, এগুলো আমাদের খুব বড় অর্জন। ধারাবাহিকভাবে নির্বাচনী গণতন্ত্রের পথে হাঁটতে হাঁটতে, আলোচনা-বিতর্ক (মাঝেমধ্যে ঝগড়াঝঁাটি) করতে করতে আমরা আমাদের প্রয়োজনীয় বাকি ইস্যুগুলোর সমাধান করতে পারব।

জাহেদ উর রহমান বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

* মতামত লেখকের নিজস্ব

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • খুলনায় প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ প্রসঙ্গ: পরীক্ষা বাতিল, তদন্ত কমিটি
  • তিন বিভাগে ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাস
  • ‘শাপলা’ প্রতীক নিয়ে সিইসির সঙ্গে বৈঠক নাগরিক ঐক্যের
  • বন্দরে টিসিবি পন্য নিয়ে কারসাজি, প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা 
  • নাক ভেঙেছে আদাহর
  • রাজনীতিতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে যা জানালেন প্রেস সচিব 
  • জাবির গণিত বিভাগের ভবন নির্মাণ কাজ দ্রুত শুরুর দাবি শিক্ষার্থীদের
  • ইবিতে ফের ছাত্রী হেনস্তাসহ নানা অভিযোগ এক শিক্ষকের বিরূদ্ধে
  • বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক: সেই সব না-বলা কথা
  • জুলাই গণ-অভ্যুত্থানকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারছি আমরা?