দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ও দুদকের ক্ষমতায়ন
Published: 25th, May 2025 GMT
সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যতম দু্র্নীতিপরায়ণ দেশের অপবাদ নিতে হয়। বিশেষত আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি খাত ও আর্থিক খাতে দু্র্নীতির ভয়াবহ চিত্র অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে।
বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কাজ ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কীভাবে সাজা দেওয়া বা হয়রানি করা যায়। দুদক কমিশনাররাসহ কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সবচেয়ে ভয়ানক, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বড় বড় দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতায় সব খাতে দুর্নীতির অভয়ারণ্য সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে দুর্নীতির ধরন যেমন বদলেছে, তেমনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থারও আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের প্রচলিত ও বহুল ব্যবহৃত ব্যবস্থাগুলো এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। দীর্ঘায়িত এবং জটিল তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার ফাঁক দিয়ে দুর্নীতির রুই-কাতলা বের হওয়া এখন কঠিন কাজ নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ও সংস্কারের চিন্তা এবং দুদককে শক্তিশালী করতে হবে।
ক.
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রথমবার এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আরেকবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারকদের সম্পদ বিবরণী নেওয়ার উদ্যোগ গৃহীত হয়েছে। যদিও ২০২৪ সালে শুধু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী চাওয়া হয়েছে। তবে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী নিয়ে আগেরবার কী ব্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল বা এখন কী করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি।
এই দুইবারের বাইরে দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী আর কখনও চাওয়া হয়নি। যদিও ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধি, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিতে যোগদানের সময় প্রথমবার এবং পরে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে নিজের ও পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব বিবরণী দাখিল করার বাধ্যবাধকতা কয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন সম্পদ বিবরণী দাখিলে আগ্রহী নন, তেমনি কর্তৃপক্ষও বিধানটির প্রতিপালন নিশ্চিত করায় আন্তরিক নন। কারণ কর্তৃপক্ষও সমগোত্রীয়।
উল্লেখ্য, পাকিস্তান, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রতিবছর বাধ্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হয়। ভারতে ২০১১ সাল থেকে স্থাবর সম্পত্তির বিবরণীও সরকারি ডোমেইনে প্রকাশ বাধ্যতামূলক।
বাংলাদেশেও কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে চাকরিতে যোগদানের সময় এবং প্রতিবছর সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক এবং স্থাবর সম্পত্তির হিসাব সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এ জন্য ‘সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি, ১৯৭৯’ সংশোধন করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণীর একটি ডেটাবেজ তৈরি, সংরক্ষণ এবং তাতে দুদককে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।
খ. দুর্নীতির কঠোরতর শাস্তি
সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ একটি খবরে দেখা গেছে, জাপানের কিয়োটো নগর সরকারের একজন বাস ড্রাইভার ২০২২ সালে মাত্র ৭ ডলার (১০০০ ইয়েন) বাস টিকিটের টাকা সরিয়ে ফেলায় (ভিডিও ক্যামেরায় ধৃত) ২৯ বছরের চাকরির ফসল ৮৪,০০০ ডলারের (১২ মিলিয়ন ইয়েন) পেনশন প্যাকেজ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শাস্তির বিরুদ্ধে ড্রাইভার আপিল করলেও কোর্ট তার পক্ষে রায় দেয়নি। ২৯ বছর চাকরি করার পর মাত্র ৭ ডলার চুরির অভিযোগে অবসরের পর যদি কোনো ব্যক্তিকে শূন্য হাতে ঘরে ফিরতে হয়, তেমন দেশে দু্র্নীতি নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন কাজ নয়। এত বড় শাস্তি দিতে সে দেশের কর্তৃপক্ষ মায়া-মমতা দেখায়নি। কারণ দুর্নীতি বিষয়ে ক্ষমা বা সহানুভূতি দেখাতে গেলে মূল্যবোধের কাঠামোটি ভেঙে পড়তে বাধ্য। আমাদের দেশেও দুর্নীতি রুখতে হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বরখাস্ত এবং পদোন্নতি, পেনশন বাতিলসহ কঠোরতর বিধান সংযুক্ত করতে হবে।
গ. দুদকের কৌশলে পরিবর্তন
দুদকের দুর্নীতি দমন কৌশলে দু্টি প্রধান কর্মসূচি রয়েছে : ১.দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিকদের নিয়ে সচেতনমূলক কর্মসূচি এবং ২. দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে বিচারযোগ্য হলে কোর্টে মামলা। আজ অবধি এ দুই কর্মসূচির তেমন সাফল্য দেখা যায়নি।
দুদককে এখন প্রচলিত কর্মসূচির বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যেমন– দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরতে অধিকতর গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি কৌশল অবলম্বন, স্টিং অপারেশন, সম্ভাব্য দুর্নীতিবাজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিদেশে লেনদেন যাচাই, বড় বড় ক্রয় আদেশ-সংশ্লিষ্টদের নজরদারি, নিয়মিত স্পট অভিযান, গোয়ন্দা তৎপরতা ইত্যাদি। ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে গোপন আলোচনা ও লেনদেনের সম্ভাব্য স্থান যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিমানবন্দর, ক্লাব, পার্ক ইত্যাদিতে গোয়েন্দা তৎপরতা।
ঘ. দুর্নীতি তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিংহভাগ প্রচেষ্টা দুদকের তদন্তের জটিল প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে সফল হয় না। সুতরাং দুর্নীতি সম্পর্কিত ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’ সম্পর্কিত বিধিবিধান সহজতর ও সংক্ষিপ্ত করতে হবে। দুদক ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’– এ দুই নামে ও দফায় সময়ক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দাখিল প্রক্রিয়া অযথা দীর্ঘায়িত হয়।
২০০৭ সালের দিকে এডিবির কারিগরি সহায়তায় সিঙ্গাপুরের ‘করাপ্ট প্র্যাক্টিসেস ইনভেস্টিগেশন ব্যুরো’র সাবেক প্রধান মি. চুয়া দুদককে সুপারিশ করেছিলেন, দুর্নীতির তদন্তকার্য ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’ দুই দফায় না করে এক স্তরেই সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু দুদকের সে সময়কার চেয়ারম্যান ও কমিশনাররা তাঁর মতামত গ্রহণ করেননি। তদুপরি দুদকের বিধি এটাও বলছে, দুর্নীতির পক্ষে অভিযোগ পেলেই তবে সেটা তদন্ত হবে, স্বতঃপ্রণোদিত কোনো তদন্ত করবে না।
ঙ. বিচার ও সাজা সম্পর্কিত আইন সংশোধন
বর্তমানের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড’ বা ‘সিআরপিসি’ এর অধীনে দ্রুততম সময়ে বিচারকার্য সম্পন্ন সম্ভব নয়। কারণ এতে দীর্ঘ শুনানির সুযোগ রয়েছে। সুতরাং ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড’ এবং ‘পেনাল কোড’ সংস্কার অথবা বিশেষ আইন প্রণয়ন করে দুর্নীতির শুনানির সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া এবং দুর্নীতির সাজা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।
চ. দুদকের লোকবল ও ক্ষমতায়ন
দুদকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী সবাই যেমন সচিব এবং মহাপরিচালকদের ৮ জনের মধ্যে ৭ জন ও বেশ কয়েকজন পরিচালক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, যারা প্রেষণে দুদকে কাজ করছেন। যদিও দুদকের আইন অনযায়ী, সচিব ও মহাপরিচালকসহ দুদকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়গের ক্ষমতা কমিশনেরই। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় বেড়ে ওঠা এসব কর্মকর্তার পক্ষে দুদকের কর্মকাণ্ডে খুব অবদান রাখা সম্ভব হয় না। তদুপরি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগের কারণে একদিকে দুদকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে, অন্যদিকে দুদককেও বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সাধারণ আমলা নয়, দুদকের প্রয়োজন তদন্তের কাজ জানা বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক অডিট বিশেষজ্ঞ, মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ, ব্যাংকিং বিশেষজ্ঞ, অর্থ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, সরকারি ক্রয়বিধি জানা বিশেষজ্ঞ, গোয়েন্দাগিরি এবং নজরদারি করতে জানা বিশেষজ্ঞ; সর্বোপরি দুর্নীতির আইন জানা বিশেষজ্ঞ। দুদকের আইনে নিজস্ব আইন কর্মকর্তা গড়ে তোলার কথা থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ও চুক্তিভিত্তিক আইন কর্মকর্তা দিয়েই প্রসিকিউশনের কাজ চলছে।
দুদককে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব্যবস্থা এবং নিজস্ব ক্যাডার সৃষ্টি করতে হবে। বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দুদকে হস্তান্তর করা না হলে সংস্থাটি কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। ২০০৮ সালের শেষ দিকে দুদকের তখনকার চেয়ারম্যান জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী সরকারের কাছে এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে পট পরিবর্তনে আমলারা সবকিছু উল্টে দেন।
ছ. সরকারি দপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা
দুদকের গণসচেতনতামূলক ও প্রচারধর্মী কার্যক্রম দুর্নীতি হ্রাসে তেমন ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি প্রতিরোধের একটি প্রধান অস্ত্র হতে পারে সরকারি দপ্তরে দুর্নীতির সুযোগগুলো বন্ধ এবং নাগরিকদের তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা। সরকারি দপ্তর, বিশেষত জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা। সরকারি সেবাগুলো অনলাইনে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধ বেশি কার্যকর হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইউটিলিটি সার্ভিস ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সব সেবা অনলাইন বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নির্বাহ করা গেলে সরকারি খাতের দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পেতে বাধ্য।
উপসংহার
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদকের কৌশল, স্বাধীনতা এবং সক্ষমতা– সবকিছুতেই যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দুদকে একজন যোগ্য চেয়ারম্যান নিয়োগ দিয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু ইতিবাচক ও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সরকারের সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এখনই বলা যাচ্ছে না। মূল কথা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও সমর্থন ছাড়া দুদকের পক্ষে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দুরূহ।
ফিরোজ আহমেদ: সদস্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক
firozlxp@gmail.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: স শ সন কর মকর ত প রক র য় সরক র র স থ বর যবস থ র সময় তদন ত দ দকক ক ষমত
এছাড়াও পড়ুন:
দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে পরাজিত শক্তি
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, আমরা বড় যুদ্ধাবস্থার ভেতরে আছি। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য যত রকম পারে, চেষ্টা চলছে। এখান থেকে আমাদের দেশকে রক্ষা করতে হবে। তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। আগামী বছরের ৩০ জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেছেন, জুলাইয়ের ১ তারিখেও যাবে না।
গতকাল রোববার তাঁর সরকারি বাসভবন যমুনায় রাজনৈতিক দলগুলোর ১৯ নেতার সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টা এসব কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। রাজনৈতিক দলের নেতারা জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা বিদ্যমান সংকট কাটিয়ে উঠতে তাদের সহযোগিতাও চেয়েছেন।
বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, বিভাজন থেকে আমাদের উদ্ধার পেতে হবে। ঐকমত্য থাকতে হবে। আত্মমর্যাদাপূর্ণ জাতি হিসেবে আমরা যতটুকু দাঁড়াতে পেরেছি, এটি যেন সামনের দিকে যায়। অভ্যুত্থানের কারণে মহাসুযোগ পেয়েছি ধ্বংস হয়ে যাওয়া দেশকে টেনে আনার। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করার সঙ্গে সঙ্গে আরেকটা যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে দেশের ভেতর এবং বাইরে আমরা যাতে এগোতে না পারি। যাতে সবকিছু ধ্বংস হয়ে যায়। আবার যাতে গোলামিতে ফেরত যাই।
তিনি বলেন, সবাই একসঙ্গে বসায় সাহস পেলাম। সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারলে আমি অপরাধী অনুভব করব।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, আমি যতদিন আছি, দেশের কোনো অনিষ্ট হবে, এমন কোনো কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। নিশ্চিত থাকেন।
বৈঠক শেষে রাতে প্রেস ব্রিফিংয়ে প্রেস সচিব আরও বলেন, রাজনৈতিক নেতারা অধ্যাপক ইউনূসকে সমর্থন জানিয়েছেন। আমরা যে সংস্কার করছি, আমরা যে বিচারকাজ শুরু করেছি, নির্বাচনের কার্যক্রম শুরু করেছি, সেটাতে তারা সম্পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, অনেকগুলো বিষয়ে কথা হয়েছে। নির্বাচন নিয়ে ও সংস্কার বিষয়ে কথা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা আবারও জানিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন করবেন। ৩০ জুনের ওই পারে যাবে না। এতে সবাই সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় দিনের বৈঠকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তিন উপদেষ্টা উপস্থিত ছিলেন। তারা হলেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক-ই-আজম, ধর্মবিষয়ক উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ ও শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান।
গতকাল বিকেল ৫টায় প্রথম দফার বৈঠকে যোগ দেন এলডিপি সভাপতি কর্নেল (অব.) অলি আহমদ বীরবিক্রম, সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, আমার বাংলাদেশ পার্টির (এবি পার্টি) চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু, নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, জাতীয় গণফ্রন্টের সমন্বয়ক টিপু বিশ্বাস, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম এবং জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন।
পরে সন্ধ্যা ছয়টায় দ্বিতীয় দফায় প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম, খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর, ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা সাদিকুর রহমান প্রমুখ। বৈঠক শেষে দলগুলোর নেতারা যমুনার সামনে বৈঠকের আলোচনার বিষয়বস্তু তুলে ধরেন।
বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, প্রধান উপদেষ্টা আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিসহ নানা সংকটে রাজনৈতিক নেতাদের কাছে তাঁর উদ্বেগের কথা জানান। এই অবস্থায় নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার বিষয়ে সংশয়ের কথাও জানান তিনি। জবাবে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁকে পেশাদারিত্ব বজায় রেখে কাজ করার আহ্বান জানান। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা ও তাদের পরামর্শ গ্রহণের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন তারা।
বৈঠক শেষে ব্রিফিংয়ে সিপিবির সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, জুলাই আন্দোলনের স্পিরিট নস্যাৎ করার প্রক্রিয়া চলছে। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে যদি আমরা সংস্কার কাজে এগিয়ে নিয়ে যাই, তাহলে সেটাই হবে আসল সংস্কার। তাই আমরা জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত নিয়ে সংস্কার প্রক্রিয়া বাস্তবায়নের কথা বলেছি। অবাধ নির্বাচনের জন্য যতটুকু সংস্কার প্রয়োজন, সেটুকু করে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলেছি। এটাও বলেছি, এ ক্ষেত্রে যত বেশি বিলম্ব করা হবে, ততই সংকট বাড়বে। দেশ রক্ষায় ব্যর্থ হলে জুলাই গণআন্দোলনের রক্তের সঙ্গে বেইমানি হবে।
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান মঞ্জু বলেন, সংস্কার এবং জুলাই গণঅভ্যুত্থানে হওয়া হত্যাকাণ্ডের বিচার করে আগামী বছরের ৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি।
তিনি বলেন, আমরা প্রধান উপদেষ্টার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি আসলে পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন কিনা? তাঁর কথায় যেটি বুঝেছি, তাঁর কাছে মনে হয়েছে, একটা সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার মতো যে সহযোগিতা ও পরিবেশ, সেটা পাচ্ছেন না বলেই উপদেষ্টাদের বৈঠকে বলেছিলেন, তিনি আর থাকবেন না। তিনি জাতির উদ্দেশে একটা বক্তব্য দিয়ে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নেওয়ার কথা বলেছিলেন। শেষ পর্যন্ত উপদেষ্টারা বুঝিয়ে তাঁকে তা থেকে নিবৃত করেছেন।
মঞ্জু বলেন, আমরাও তাঁকে বলেছি, তিনি পদত্যাগ করলে নির্বাচন, সংস্কারসহ সবকিছু আরও অনিশ্চিত হয়ে যাবে। প্রধান উপদেষ্টা আমাদের যা বলেছেন তাঁর মূল টার্গেট হচ্ছে, একটা সুষ্ঠু ও ঐতিহাসিক নির্বাচন দেওয়া। কিন্তু সেই নির্বাচন দেওয়ার জন্য প্রশাসনসহ সব বিষয়ে তাঁর একটা নেতৃত্ব ও কর্তৃত্ব স্থাপন করার দরকার।
তিনি বলেন, আমরা বলেছি, রাজনৈতিক দলগুলো বিশেষ করে বিএনপি ও সেনাবাহিনীর সঙ্গে ড. ইউনূসের টানাপোড়েন চলছে। সমঝোতা বা যেভাবেই হোক, এটিকে একটা স্বস্তির জায়গায় নিতে হবে। তা ছাড়া ছাত্রদের সঙ্গেও দূরত্ব দূর করার কথা বলেছি।
চলমান সংকট নিয়ে প্রধান উপদেষ্টা চিন্তিত জানিয়ে নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, অনেক বড় সংকটের মধ্যে আমরা আছি। এই সংকটের জন্য প্রধানত ভারতীয় আধিপত্যবাদের ষড়যন্ত্রের কথা তিনি বলেছেন। ভারতীয় আধিপত্যবাদ আমাদের এই পরিবর্তনকে একেবারে স্বীকার করতে চায় না। পারলে আমাদের একদিনে ধ্বংস করে দিতে চায়। সে জন্য যা যা করার দরকার, সব তারা করছে– এই ছিল তাঁর (প্রধান উপদেষ্টা) কথা।’
মান্না আরও বলেন, প্রধান উপদেষ্টা চাইছেন, সব জাতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর ঐক্যবদ্ধ হওয়া দরকার। কিন্তু দিন দিন এই ঐক্য দুর্বল হচ্ছে। এ জন্যও তিনি চিন্তিত এবং বেশ খানিকটা হতাশ।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করেছি। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, সবাইকে যেন সমানভাবে মূল্যায়ন করা হয়। কারণ, সরকারের নেতৃত্বের মধ্যে সমন্বয়হীনতা দেখা যাচ্ছে। উপদেষ্টারা একেক সময় একেক কথা বলছেন। করিডোর ও বন্দরের বিষয়ে সিদ্ধান্ত না নিতে বলা হয়েছে। ছাত্র উপদেষ্টাদের বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টাকে বলেছি, বিতর্কিতদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত কী নেবেন, তা তাঁর ওপর নির্ভর করছে।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, সরকার এরই মধ্যে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলেছে। আজকের বৈঠকে আমরা বলেছি, একটা নির্দিষ্ট মাস ও সপ্তাহ কিংবা সুনির্দিষ্ট তারিখ বলা যেতে পারে।
তিনি বলেন, জনগণ জুলাই গণহত্যার দৃশ্যমান বিচার দেখতে চায়। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, এই বিচারকাজে সরকারের দিক থেকে বিচার বিভাগকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা করার নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে।
ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু বলেন, পুলিশ, সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে আস্থায় আনতে হবে। একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য এটি অত্যন্ত প্রয়োজন।
রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী অ্যাডভোকেট হাসনাত কাইয়ুম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা আসলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ খুঁজে বের করতে চেয়েছেন। আমরা বিচার, সংস্কার ও নির্বাচনকে পরস্পরের বিপরীতে দাঁড় না করিয়ে একটা সমন্বিত রোডম্যাপ প্রণয়ন করার জন্য বলেছি।
হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব মাওলানা সাজিদুর রহমান বলেন, বিগত সরকারের আমলে হেফাজতের বিরুদ্ধে করা ২০০-এর বেশি মিথ্যা মামলা আগামী জুনের মধ্যে প্রত্যাহার করতে হবে– এ দাবি জানানো হয়েছে। নারী সংস্কার কমিশনের অনেক সুপারিশ কোরআন-হাদিসের পরিপন্থি। এ জন্য এমন কোনো সুপারিশ বাস্তবায়নযোগ্য নয়। প্রয়োজনে পরিষদ পুনর্গঠনের কথাও বলা হয়েছে।
খেলাফত মজলিসের আমির মাওলানা মামুনুল হক বলেন, পরিস্থিতি যাই হোক না কেন, প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস যেন মাঝপথে হাল ছেড়ে না দেন– এ বিষয়ে আমরা তাঁকে অনুরোধ করেছি। তিনি নিজেও আমাদের আশ্বস্ত করেছেন।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমেদ আবদুল কাদের বলেন, যেসব উপদেষ্টাকে নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে, সে ব্যাপারে বিবেচনা এবং একই সঙ্গে জুলাই আন্দোলনের বিচার দৃশ্যমান করার কথা বলেছি।
ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির মুফতি রেজাউল করিম (চরমোনাই পীর) বলেন, সরকারকে চারটি পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এগুলো হচ্ছে– সংস্কার করে নির্বাচন করা, স্পর্শকাতর বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ করা, স্থানীয় নির্বাচন আগে করা এবং ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের বিষয়ে আমাদের সমর্থন আছে।
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর বলেন, দুই উপদেষ্টাকে পদত্যাগের দিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য সরকারকে বলেছি। আমাদের আন্দোলনকারী ছাত্র নেতৃত্বের মধ্যে যারা উপদেষ্টা রয়েছেন, তারা যেহেতু একটি দল করেছেন, বাইরে এ কথাটি প্রচলিত– এই দলটি সরকারের সুবিধা পাচ্ছে এবং সরকার পৃষ্ঠপোষকতা করছে। দলের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এনসিপির দু’জনকে অপসারণ করা বা তাদের বুঝিয়ে পদত্যাগের দিকে যাওয়া সরকারের দিক থেকে একটি ভালো দিক হবে।
এর আগে শনিবার বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী ও জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।