সমৃদ্ধ ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ‍্যের উত্তরাধিকার হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশকে বিশ্বের অন‍্যতম দু্র্নীতিপরায়ণ দেশের অপবাদ নিতে হয়। বিশেষত আওয়ামী লীগের টানা ১৫ বছরের শাসনামলে সরকারি খাত ও আর্থিক খাতে দু্র্নীতির ভয়াবহ চিত্র অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে ফুটে উঠেছে।

বিগত সরকারের আমলে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কাজ ছিল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে কীভাবে সাজা দেওয়া বা হয়রানি করা যায়। দুদক কমিশনাররাসহ কর্মকর্তারাও দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। সবচেয়ে ভয়ানক, সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে বড় বড় দুর্নীতিকে পৃষ্ঠপোষকতায় সব খাতে দুর্নীতির অভয়ারণ‍্য সৃষ্টি হয়েছিল।
বর্তমান সময়ে দুর্নীতির ধরন যেমন বদলেছে, তেমনি দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিকারমূলক ব‍্যবস্থারও আধুনিকায়ন জরুরি হয়ে পড়েছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ ও প্রতিকারের প্রচলিত ও বহুল ব‍্যবহৃত ব্যবস্থাগুলো এখন ভোঁতা হয়ে গেছে। দীর্ঘায়িত এবং জটিল তদন্ত ও বিচার প্রক্রিয়ার ফাঁক দিয়ে দুর্নীতির রুই-কাতলা বের হওয়া এখন কঠিন কাজ নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে উদ্ভাবনী দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ ব‍্যবস্থা ও সংস্কারের চিন্তা এবং দুদককে শক্তিশালী করতে হবে।

ক.

সরকারি কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী
২০০৭-০৮ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে প্রথমবার এবং বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আরেকবার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বিচারকদের সম্পদ বিবরণী নেওয়ার উদ‍্যোগ গৃহীত হয়েছে। যদিও ২০২৪ সালে শুধু প্রথম শ্রেণির কর্মকর্তাদের সম্পদের হিসাব বিবরণী চাওয়া হয়েছে। তবে দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী নিয়ে আগেরবার কী ব‍্যবস্থা গৃহীত হয়েছিল বা এখন কী করা হচ্ছে সে সম্পর্কে কিছু জানা যায়নি। 

এই দুইবারের বাইরে দেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণী আর কখনও চাওয়া হয়নি। যদিও ‘সরকারি কর্মচারী আচরণ বিধি, ১৯৭৯’ অনুযায়ী সব কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিতে যোগদানের সময় প্রথমবার এবং পরে প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে নিজের ও পরিবারের স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তির হিসাব বিবরণী দাখিল করার বাধ‍্যবাধকতা কয়েছে। কিন্তু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা যেমন সম্পদ বিবরণী দাখিলে আগ্রহী নন, তেমনি কর্তৃপক্ষও বিধানটির প্রতিপালন নিশ্চিত করায় আন্তরিক নন। কারণ কর্তৃপক্ষও সমগোত্রীয়।
উল্লেখ‍্য, পাকিস্তান, ভারতসহ বিশ্বের অনেক দেশে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীকে প্রতিবছর বাধ‍্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব বিবরণী দাখিল করতে হয়। ভারতে ২০১১ সাল থেকে স্থাবর সম্পত্তির বিবরণীও সরকারি ডোমেইনে প্রকাশ বাধ‍্যতামূলক। 

বাংলাদেশেও কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে চাকরিতে যোগদানের সময় এবং প্রতিবছর সম্পদ বিবরণী দাখিল বাধ্যতামূলক এবং স্থাবর সম্পত্তির হিসাব সরকারি ওয়েবসাইটে প্রকাশ করতে হবে। এ জন‍্য ‘সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি, ১৯৭৯’ সংশোধন করতে হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদ বিবরণীর একটি ডেটাবেজ তৈরি, সংরক্ষণ এবং তাতে দুদককে প্রবেশাধিকার দিতে হবে।

খ. দুর্নীতির কঠোরতর শাস্তি
সম্প্রতি ‘ভাইরাল’ একটি খবরে দেখা গেছে, জাপানের কিয়োটো নগর সরকারের একজন বাস ড্রাইভার ২০২২ সালে মাত্র ৭ ডলার (১০০০ ইয়েন) বাস টিকিটের টাকা সরিয়ে ফেলায় (ভিডিও ক‍্যামেরায় ধৃত) ২৯ বছরের চাকরির ফসল ৮৪,০০০ ডলারের (১২ মিলিয়ন ইয়েন) পেনশন প‍্যাকেজ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। শাস্তির বিরুদ্ধে ড্রাইভার আপিল করলেও কোর্ট তার পক্ষে রায় দেয়নি। ২৯ বছর চাকরি করার পর মাত্র ৭ ডলার চুরির অভিযোগে অবসরের পর যদি কোনো ব‍্যক্তিকে শূন‍্য হাতে ঘরে ফিরতে হয়, তেমন দেশে দু্র্নীতি নিয়ন্ত্রণ খুব কঠিন কাজ নয়। এত বড় শাস্তি দিতে সে দেশের কর্তৃপক্ষ মায়া-মমতা দেখায়নি। কারণ দুর্নীতি বিষয়ে ক্ষমা বা সহানুভূতি দেখাতে গেলে মূল‍্যবোধের কাঠামোটি ভেঙে পড়তে বাধ‍্য। আমাদের দেশেও দুর্নীতি রুখতে হলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর বরখাস্ত এবং পদোন্নতি, পেনশন বাতিলসহ কঠোরতর বিধান সংযুক্ত করতে হবে।

গ. দুদকের কৌশলে পরিবর্তন
দুদকের দুর্নীতি দমন কৌশলে দু্টি প্রধান কর্মসূচি রয়েছে : ১.দুর্নীতি প্রতিরোধে নাগরিকদের নিয়ে সচেতনমূলক কর্মসূচি এবং ২. দুর্নীতির অভিযোগ তদন্ত করে বিচারযোগ‍্য হলে কোর্টে মামলা। আজ অবধি এ দুই কর্মসূচির তেমন সাফল‍্য দেখা যায়নি। 
দুদককে এখন প্রচলিত কর্মসূচির বাইরে গিয়ে উদ্ভাবনী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। যেমন– দুর্নীতিবাজদের হাতেনাতে ধরতে অধিকতর গোয়েন্দাগিরি ও নজরদারি কৌশল অবলম্বন, স্টিং অপারেশন, সম্ভাব‍্য দুর্নীতিবাজের ব‍্যাংক অ্যাকাউন্ট, বিদেশে লেনদেন যাচাই, বড় বড় ক্রয় আদেশ-সংশ্লিষ্টদের নজরদারি, নিয়মিত স্পট অভিযান, গোয়ন্দা তৎপরতা ইত‍্যাদি। ঘুষদাতা ও গ্রহীতার মধ‍্যে গোপন আলোচনা ও লেনদেনের সম্ভাব্য স্থান যেমন হোটেল-রেস্তোরাঁ, বিমানবন্দর, ক্লাব, পার্ক ইত‍্যাদিতে গোয়েন্দা তৎপরতা। 

ঘ. দুর্নীতি তদন্তের দীর্ঘসূত্রতা
দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব‍্যবস্থা গ্রহণের সিংহভাগ প্রচেষ্টা দুদকের তদন্তের জটিল প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতার কারণে সফল হয় না। সুতরাং দুর্নীতি সম্পর্কিত ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’ সম্পর্কিত বিধিবিধান সহজতর ও সংক্ষিপ্ত করতে হবে। দুদক ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’– এ দুই নামে ও দফায় সময়ক্ষেপণ প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত করে। ফলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দাখিল প্রক্রিয়া অযথা দীর্ঘায়িত হয়।
২০০৭ সালের দিকে এডিবির কারিগরি সহায়তায় সিঙ্গাপুরের ‘করাপ্ট প্র্যাক্টিসেস ইনভেস্টিগেশন ব‍্যুরো’র সাবেক প্রধান মি. চুয়া দুদককে সুপারিশ করেছিলেন, দুর্নীতির তদন্তকার্য ‘অনুসন্ধান’ ও ‘তদন্ত’ দুই দফায় না করে এক স্তরেই সম্পন্ন করা যায়। কিন্তু দুদকের সে সময়কার চেয়ারম‍্যান ও কমিশনাররা তাঁর মতামত গ্রহণ করেননি। তদুপরি দুদকের বিধি এটাও বলছে, দুর্নীতির পক্ষে অভিযোগ পেলেই তবে সেটা তদন্ত হবে, স্বতঃপ্রণোদিত কোনো তদন্ত করবে না।

ঙ. বিচার ও সাজা সম্পর্কিত আইন সংশোধন
বর্তমানের ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড’ বা ‘সিআরপিসি’ এর অধীনে দ্রুততম সময়ে বিচারকার্য সম্পন্ন সম্ভব নয়। কারণ এতে দীর্ঘ শুনানির সুযোগ রয়েছে। সুতরাং ‘ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কোড’ এবং ‘পেনাল কোড’ সংস্কার অথবা বিশেষ আইন প্রণয়ন করে দুর্নীতির শুনানির সর্বোচ্চ সময়সীমা নির্ধারণ করে দেওয়া এবং দুর্নীতির সাজা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন।

চ. দুদকের লোকবল ও ক্ষমতায়ন
দুদকের ঊর্ধ্বতন নির্বাহী সবাই যেমন সচিব এবং মহাপরিচালকদের ৮ জনের মধ‍্যে ৭ জন ও বেশ কয়েকজন পরিচালক জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা, যারা প্রেষণে দুদকে কাজ করছেন। যদিও দুদকের আইন অনযায়ী, সচিব ও মহাপরিচালকসহ দুদকের সব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়গের ক্ষমতা কমিশনেরই। আমলাতান্ত্রিক কাঠামোয় বেড়ে ওঠা এসব কর্মকর্তার পক্ষে দুদকের কর্মকাণ্ডে খুব অবদান রাখা সম্ভব হয় না। তদুপরি, ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়োগের কারণে একদিকে দুদকে সরকারের নিয়ন্ত্রণ বাড়তে থাকে, অন্যদিকে দুদককেও বিশেষায়িত সংস্থা হিসেবে গড়ে তোলা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
সাধারণ আমলা নয়, দুদকের প্রয়োজন তদন্তের কাজ জানা বিশেষজ্ঞ, ফরেনসিক অডিট বিশেষজ্ঞ, মানি লন্ডারিং বিশেষজ্ঞ, ব‍্যাংকিং বিশেষজ্ঞ, অর্থ ব‍্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, প্রকল্প ব‍্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ, সরকারি ক্রয়বিধি জানা বিশেষজ্ঞ, গোয়েন্দাগিরি এবং নজরদারি করতে জানা বিশেষজ্ঞ; সর্বোপরি দুর্নীতির আইন জানা বিশেষজ্ঞ। দুদকের আইনে নিজস্ব আইন কর্মকর্তা গড়ে তোলার কথা থাকলেও অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিস ও চুক্তিভিত্তিক আইন কর্মকর্তা দিয়েই প্রসিকিউশনের কাজ চলছে। 

দুদককে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগের ব‍্যবস্থা এবং নিজস্ব ক‍্যাডার সৃষ্টি করতে হবে। বিধিবিধান প্রণয়নের ক্ষমতা দুদকে হস্তান্তর করা না হলে সংস্থাটি কখনোই স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। ২০০৮ সালের শেষ দিকে দুদকের তখনকার চেয়ারম‍্যান জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরী সরকারের কাছে এমন প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৯ সালে পট পরিবর্তনে আমলারা সবকিছু উল্টে দেন।

ছ. সরকারি দপ্তরে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা
দুদকের গণসচেতনতামূলক ও প্রচারধর্মী কার্যক্রম দুর্নীতি হ্রাসে তেমন ভূমিকা রাখছে বলে মনে হয় না। দুর্নীতি প্রতিরোধের একটি প্রধান অস্ত্র হতে পারে সরকারি দপ্তরে দুর্নীতির সুযোগগুলো বন্ধ এবং নাগরিকদের তথ্য সরবরাহের মাধ্যমে সরকারি কাজের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা। সরকারি দপ্তর, বিশেষত জনসেবামূলক প্রতিষ্ঠানে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা। সরকারি সেবাগুলো অনলাইনে মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছানো গেলে দুর্নীতি প্রতিরোধ বেশি কার্যকর হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ইউটিলিটি সার্ভিস ও সামাজিক নিরাপত্তা খাতের সব সেবা অনলাইন বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে নির্বাহ করা গেলে সরকারি খাতের দুর্নীতি বহুলাংশে হ্রাস পেতে বাধ্য।

উপসংহার
দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে দুদকের কৌশল, স্বাধীনতা এবং সক্ষমতা– সবকিছুতেই যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দুদকে একজন যোগ‍্য চেয়ারম‍্যান নিয়োগ দিয়েছে। ইতোমধ‍্যে বেশ কিছু ইতিবাচক ও উদ্ভাবনী পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। তবে রাজনৈতিক সরকারের সময় পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে এখনই বলা যাচ্ছে না। মূল কথা, রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা ও সমর্থন ছাড়া দুদকের পক্ষে প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে, বিশেষত ক্ষমতাসীন দল-সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দুরূহ।

ফিরোজ আহমেদ: সদস‍্য, জনপ্রশাসন সংস্কার কমিশন; সাবেক কর্মকর্তা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক‍
firozlxp@gmail.com

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: স শ সন কর মকর ত প রক র য় সরক র র স থ বর যবস থ র সময় তদন ত দ দকক ক ষমত

এছাড়াও পড়ুন:

নিউইয়র্ক ছাড়িয়ে জাতীয় মুখ মামদানি

ডেমোক্র্যাট ভোটার লিয়া অ্যাশ বহু বছর ধরে কোনো রাজনীতিককে নিয়ে আশাবাদী অনুভব করেননি। তবে সম্প্রতি সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। তিনি বলেন, ‘এ বছর আমার জন্য তিনিই একমাত্র আলোর দিশা। তিনি সত্যিই মানুষের কথা শুনতে চান—যাঁদের তিনি মেয়র হতে যাচ্ছেন।’

২৬ বছর বয়সী অ্যাশ যে ব্যক্তির কথা বলছেন, তিনি হলেন জোহরান মামদানি, যিনি নিউইয়র্ক সিটির মেয়র পদে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী।

মামদানি তাঁর নির্বাচনী প্রচারে জীবনযাত্রার ব্যয় কমানোর বিষয়টি প্রাধান্য দিচ্ছেন। এ কারণেই অ্যাশ নিঃসংকোচে মামদানিকে ভোট দিতে চান। তবে তিনি মামদানিকে ভোট দিতে পারছেন না। কারণ, তিনি থাকেন নিউইয়র্ক থেকে প্রায় ১ হাজার ২০০ মাইল দূরে, মিসিসিপির গালফপোর্ট শহরে।

অ্যাশ বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করতে চাই, কোনো একদিন গালফপোর্ট, মিসিসিপিতেও এক জোহরান মামদানি আসবেন।’

জাতীয় পর্যায়ে আলোচিত মুখ

মাত্র কয়েক মাসের মধ্যেই ৩৪ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট মামদানি এক প্রান্তিক প্রার্থী থেকে জাতীয় পর্যায়ের আলোচিত মুখে পরিণত হয়েছেন। গত জুন মাসের দলীয় নির্বাচনে তিনি অপ্রত্যাশিতভাবে বিজয়ী হন। ওই নির্বাচনে ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সীদের ভোটার উপস্থিতি ছিল সবচেয়ে বেশি।

আগামীকাল মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে মেয়র নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এর আগের সব জরিপেই দেখা গেছে, নিউইয়র্ক শহরের সাবেক মেয়র অ্যান্ড্রু কুমোর চেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মামদানি এগিয়ে রয়েছেন। মামদানি আশা করছেন, আগেরবারের মতো এবারও তরুণ ভোটাররা তাঁর পাশে থাকবেন। তবে শুধু নিউইয়র্কের মধ্যেই নয়, জীবনযাত্রার ক্রমবর্ধমান ব্যয় মোকাবিলার তাঁর অঙ্গীকার পুরো দেশের তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও সাড়া ফেলেছে। অনেক জেন–জি ও মিলেনিয়ালস প্রজন্মের মানুষ বলছেন, তাঁদের সবচেয়ে বড় উদ্বেগের জায়গায় হাত রেখেছেন মামদানি। তরুণ প্রজন্ম যখন রাজনীতিকদের প্রতি আশা হারিয়ে ফেলেছেন এবং প্রচলিত নিয়ম ভেঙে নতুন কণ্ঠস্বরের অপেক্ষায় আছেন, তখনই মামদানির উত্থান।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সার্কেলে তরুণ ভোটারদের নিয়ে গবেষণা করেন রুবি বেল বুথ। তিনি বলেন, ‘যখন কোনো প্রার্থী জনগণের উদ্বেগ নিয়ে কথা বলেন এবং সেই উদ্বেগকে স্বীকৃতি দেন, তখন সেটি বিশাল প্রভাব ফেলে, বিশেষ করে তরুণ ভোটারদের ক্ষেত্রে।’

রুবি বেল বুথ আরও বলেন, ‘তরুণেরা যখন সত্যিই অনুভব করেন যে তাঁদের কথা শোনা হচ্ছে, তাঁদের প্রতি সম্মান দেখানো হচ্ছে, তখন যেকোনো প্রার্থী সফল হতে পারেন। তবে এখন সেটি করছেন মামদানি। আর এর আগে হয়তো সেটা করেছিলেন ট্রাম্প।’

রক্ষণশীলদের মধ্যেও জনপ্রিয়

রক্ষণশীল রাজ্য মিসিসিপিতে বসবাস করলেও লিয়া অ্যাশ সব সময়ই ডেমোক্র্যাট প্রার্থীদের ভোট দিয়ে আসছেন। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তিনি রাজনৈতিক নেতাদের ওপর হতাশ ও উপেক্ষিত বোধ করছেন। এই অনুভূতি আরও তীব্র হয়েছে তাঁর অর্থনৈতিক বাস্তবতা থেকে। অন্যদিকে অ্যান্ড্রু টেইট ভার্জিনিয়ার এক গ্রামীণ এলাকায় একটি ছোট খামারে তাঁর সঙ্গী ও সন্তানদের নিয়ে থাকেন এবং স্থানীয় একটি কারখানায় কাজ করেন। তিনিও মূল্যস্ফীতি ও পরিবারের আর্থিক ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন।
অ্যাশ বলেন, ‘দেশের অন্যতম দরিদ্র রাজ্য হয়েও মিসিসিপিতে বাড়ির দাম বেড়েই চলেছে। এটা সত্যিই মন খারাপ করে দেয়।’ তবু অ্যাশ আশা করছেন, যদি মামদানি নির্বাচনে জয়ী হন, তাহলে সেটি দেশের অন্যান্য শহরের ডেমোক্র্যাট নেতাদের জন্য একটি বার্তা হয়ে যাবে।

জোহরান মামদানি তাঁর নির্বাচনী প্রচারণায় একাধিক অঙ্গীকার করেছেন, বিশেষ করে বাসস্থান নিয়ে। তাঁর লক্ষ্য শহরের খরচ কমানো। তবে সমালোচকেরা বলছেন, এসব পরিকল্পনা বাস্তবসম্মত নয়। আর রক্ষণশীলদের, বিশেষ করে ট্রাম্পের সমর্থকদের কাছে মামদানির দৃষ্টিভঙ্গি বিপজ্জনক। তবু এসব সতর্কতা তরুণ মার্কিন ভোটারদের খুব একটা বিচলিত করছে না। তাঁরা রাজনৈতিক দলের লেবেলের পরিবর্তে মামদানির বাস্তব জীবনের সমস্যা ও সমাধানমুখী বার্তাতেই বেশি আকৃষ্ট হচ্ছেন।

গবেষক বেলি বুথ বলেন, ‘মামদানিই এমন একজন প্রার্থী, যিনি প্রচলিত ব্যবস্থাকে নানা দিক থেকে চ্যালেঞ্জ করছেন।’

২৬ বছর বয়সী ডেমোক্র্যাট এমিলি উইলসনের মতে, জীবনযাত্রার ব্যয়ের সংকট দলীয় বিভাজনের ঊর্ধ্বে থাকা উচিত। ফ্লোরিডার সেন্ট পিটার্সবার্গে বসবাসরত এমিলি দূর থেকেই মামদানিকে সমর্থন করছেন। মিশিগানের অ্যান আরবারের কাছে এক ছোট শহরে বসবাসরত ২৫ বছর বয়সী ডেইজি লুপাও একইভাবে ভাবেন। তাঁর মতে, মামদানির প্রচারাভিযানটা নতুন এক দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিয়েছে। তাঁর অনেক প্রস্তাব গ্রামীণ আমেরিকাসহ নিজ সম্প্রদায়ের জন্যও কার্যকর হতে পারে। লুপা বলেন, ‘নিউইয়র্কে তিনি যেসব পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন, সেগুলোর অনেকটাই আমরা গ্রামীণ এলাকায় আরও বেশি করে চাই। কারণ, এখানে তো সেগুলোর অস্তিত্বই নেই।’
সতর্ক আশাবাদ

আরও পড়ুননিউইয়র্কের এত ইহুদি কেন জোহরান মামদানির পক্ষে প্রচার চালাচ্ছেন০১ নভেম্বর ২০২৫

তবে যাঁরা নিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন, তাঁদের কাছে মূল প্রশ্ন—মামদানি কি সত্যিই জীবনযাত্রার ব্যয়ের এই সংকট কাটাতে পারবেন? ৩২ বছর বয়সী ডিলন রবার্টসনের জন্য অর্থনৈতিক উদ্বেগ যেন জীবনের স্থায়ী সঙ্গী।  স্নাতক শেষে তাঁর শিক্ষাঋণ দাঁড়াবে প্রায় আড়াই লাখ ডলার। মামদানিকে সমর্থন করছেন রবার্টসন।

কারণ, তাঁর প্রস্তাবিত ব্যয় সাশ্রয়ী পরিকল্পনাগুলো জীবনকে কিছুটা সহজ করতে পারে। তবে একই সঙ্গে তিনি সংশয়ও প্রকাশ করেন। ডিলন বলেন, ‘মামদানি যা বলছেন, সবই শুনতে ভালো লাগে। কিন্তু আমি ভাবি, তিনি কি সত্যিই পারবেন? বাস্তবে কি তা সম্ভব? নাকি এটা যেন ফুটো জাহাজে শুধু ব্যান্ডেজ লাগানোর মতো?’
তবু ডিলন স্বীকার করেন. যদি বিকল্প হয়, আগের মতোই টেনে নেওয়া অথবা কিছু নতুন চেষ্টা করা, তাহলে তিনি নতুনটাকেই সুযোগ দিতে প্রস্তুত।

আরও পড়ুননিউইয়র্কের মেয়র নির্বাচনে রেকর্ডসংখ্যক আগাম ভোট, তরুণেরা কেন আগাম ভোট দিচ্ছেন১১ ঘণ্টা আগেআরও পড়ুননিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন: সর্বশেষ চার জরিপেও এগিয়ে জোহরান মামদানি৯ ঘণ্টা আগে

সম্পর্কিত নিবন্ধ