চট্টগ্রাম বন্দরে কনটেইনার জট, কাস্টমসে স্থবিরতা
Published: 26th, May 2025 GMT
একের পর এক কর্মসূচি ও আন্দোলনের কারণে মারাত্মক অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে। প্রতিদিন অন্তত দুইশ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা এই প্রতিষ্ঠানে গতকাল রোবাবর দিনভর ছিল অচলাবস্থা। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ছিল স্ববিরতা। কাস্টম কর্মকর্তারা অফিসে থাকলেও করেননি শুল্কায়নের কোনো কাজ। পাঁচটার পরে সীমিত পরিসরে শুল্কায়নের কিছু কাজ করেছেন তারা। এদিকে এনবিআর কর্মকর্তাদের আন্দোলনের এ প্রভাব পড়েছে দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরেও।
প্রতিদিন গড়ে চার হাজার কনটেইনার খালাস করা চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর থেকেও খালাস হয়নি প্রত্যাশার অর্ধেক পণ্য। এজন্য দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরে তৈরি হয়েছে কনটেইনার জট। গতকাল পর্যন্ত এই বন্দরে জমেছিল ৪৩ হাজার কনটেইনার। পণ্য খালাস করার পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় কনটেইনার বোঝাই আরও ১৮ টি জাহাজ ভাসছে বন্দর সীমাতে। ঈদের আগে এমন অচলাবস্থা তৈরি হওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে আমদানিকারক ও রপ্তানিকারকরা। এই অবস্তা চলতে থাকলে ঈদের আগে পড়ে পণ্য রপ্তানি করতে গিয়ে তারা ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বেন বলে মন্তব্য করেছেন।
ইন্টারন্যাশানাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর সাবেক সহ-সভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ঈদের আগে এমন কর্মসূচি ক্ষতিগ্রস্ত করছে আমাদের। কারখানায় কাঁচামাল নিতে পারছি না সময়মতো। এজন্য ব্যাহত হবে উৎপাদন। আর উৎপাদন ব্যাহত হলে সময়মতো পণ্য রপ্তানি করতে পারবো না। অথচ আমাদের মাথার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বর্ধিত শুল্ক হার হুমকি হয়ে আছে এখনও।
বন্দরের সচিব ওমর ফারুক জানান, শুল্কায়ন, পরীক্ষণসহ আমদানি কার্যক্রম না হলে বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস করা যায় না। কনটেইনার খালাস না হলে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর কার্যক্রমেও ধীরগতি দেখা দেয়। এটির প্রভাব পড়ে বন্দরে। তিনি জানান, এনবিআর ইস্যুতে কর্মবিরতি শুরুর আগে বন্দরে কনটেইনার ছিল ৩৭ হাজার একক। শনিবার সেটি ছিল ৪৩ হাজার। খালাসের অপেক্ষায় পণ্য নিয়ে আরও জাহাজ ভাসছে সাগরে। কাস্টমসের কেউ স্বনামে এ বিষয়ে কথা বলতে সন্মত হননি। কেন্দ্রীয় কর্মসূচীর অংশ হিসেবে তারা এটি পালন করছেন বলে জানান সমকালকে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বিলুপ্তির প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ১৪ মে থেকে শুল্কায়ন, পরীক্ষাসহ সব ধরনের কাস্টমস কার্যক্রম বন্ধ রেখে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি পালন করছেন। এর ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে প্রায় ৪৩ হাজার টিইইউস (২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক) কনটেইনার জমে গেছে। অথচ বন্দরের অপারেশনাল কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখতে সর্বোচ্চ ৪৫ হাজার টিইইউস কনটেইনার রাখা যায়। এই কর্মসূচি অব্যাহত থাকলে কয়েককদিনের মধ্যে কনটেইনার রাখার আর কোনো জায়গা থাকবে না বন্দর ইয়ার্ডে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, বন্দরের ইয়ার্ড মোট ধারণক্ষমতা ৫৩ হাজার টিইইউস হলেও কার্যক্রম পরিচালনার স্বার্থে ৮ হাজার টিইইউস খালি রাখতে হয়। ফলে ব্যভহার উপযোগী ধারণক্ষমতা আছে ৪৫ হাজার টিইইউস। সাধারণ সময়ে বন্দরে গড়ে ৩০ থেকে ৩৩ হাজার কনটেইনার থাকে। কিন্তু গত তিন মাসে কনটেইনারবাহী যান চালক ও শ্রমিকদের একাধিক কর্মসূচির কারণে বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে। সর্বশেষ গত ১৫ মে শ্রমিকদের কর্মসূচির প্রভাবে কনটেইনার খালাসে ধীরগতি দেখা দেয়। কনটেইনার সংখ্যা তখনই ৩৬ হাজার ছাড়িয়ে যায়। ১৪ মে থেকে কাস্টম কর্মকর্তাদের কর্মসূচী শুরু হলে এই সংখ্যা ধীরে ধীরে ৪৩ হাজারে পৌঁছে যায়।
চট্টগ্রাম বন্দরে দিয়ে দেশের মোট আমদানি-রপ্তানির ৯৫ শতাংশ পণ্যের শুল্কায়ন হয়। আরএই শুল্কায়নে মূখ্য ভ’মিকা পালন করে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজ। কনটেইনার খালাসে ধীরগতির ফলে তৈরি পোশাক শিল্প, ওষুধ খাতসহ আমদানি নির্ভর শিল্পগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সবচেয়ে বেশি।
সিআ্যান্ডএফ এজেন্ট অ্যাসোসিয়েমনের সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘আমদানি পণ্য খালাস কার্যক্রম ব্যাহত হওয়াতে শিল্পের অনেক কাঁচামাল আটকে আছে। সময়মতো এগুলো কারখানাতে নিতে না পারলে উৎপাদন কার্যক্রমও পিছিয়ে যাবে। তখন ব্যাহত হবে রপ্তানী কার্যক্রমও।’ চট্টগ্রাম কাস্টম হাউজে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের বেশি আমদানি ও রপ্তানি নথি দাখিল করা হয় বলে জানান তিনি। গতকাল রোববার পুরো দিন অপেক্ষা করেও তারা পণ্যের শুল্কায়ন করতে পারেননি। পাঁচটার পর সীমিত পরিসরে কিছু পণ্যের শুল্কায়ন হলেও সেটি নগন্য বলে মন্তব্য করেন তিনি।
প্রসঙ্গত, সরকার গত ১২ মে একটি অধ্যাদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিলুপ্ত করে নতুন করে রাজস্ব নীতি বিভাগ ও রাজস্ব ব্যবস্থাপনা বিভাগ নামে দুটি নতুন বিভাগ গঠনের ঘোষণা দেয়। এর প্রতিবাদে ১৩ মে ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের’ ব্যানারে অবস্থান কর্মসূচি থেকে ১৪, ১৫, ১৭, ১৮ ও ১৯ মে পর্যন্ত কলম বিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়। পরে ২০ মে আলোচনার আশ্বাসে কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও ২১ মে থেকে পুনরায় পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ঘোষণা আসে। বর্তমানে এই কর্মসূচি চলছে এবং কবে নাগাদ এর সমাধান হবে, তার কোনো নিশ্চয়তাও নেই। উল্টো আন্তর্জাতিক যাত্রীসেবা এবং ওষুধ ও জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জামের আমদানি-রপ্তানি ছাড়া সোমবার থেকে কর, কাস্টমস ও ভ্যাট বিভাগের সব দপ্তরে পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতির ঘোষণা দেওয়া হয়েছে কেন্দ্র থেকে।
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: কর মকর ত ৪৩ হ জ র ক স টমস ক স টম ব য হত আমদ ন
এছাড়াও পড়ুন:
আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ লাখ টন পণ্যের জট
কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীর ১০ দিনের আন্দোলনে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০ লাখ টন পণ্যের জট লেগেছে। ঈদ সামনে রেখে আনা ভোগ্যপণ্যও এর মধ্যে রয়েছে। দেশের প্রধান এই সমুদ্রবন্দরে আসা ৬৭টি বড় জাহাজ পণ্য নিয়ে সাগরে ভাসছে। এর মধ্যে কার্গো পণ্যবোঝাই ৩৭টি, খাদ্যসামগ্রী বোঝাই ৭টি ও কনটেইনার বোঝাই জাহাজ আছে ২৫টি। এর বাইরে বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে আছে ৪৫ হাজার ৩৭৭ কনটেইনার। এসব কনটেইনারের প্রায় ৪০ হাজারই আমদানি ও রপ্তানি পণ্যবোঝাই। ২০ ফুট এককের একটি কনটেইনারে গড়ে ১৩ টন পণ্য লোড করা যায়।
এনবিআর বিলুপ্তির প্রতিবাদে চট্টগ্রামে কাস্টমস কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ১৪ থেকে ২৫ মে পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যান। গত রোববার রাতে এই কর্মসূচি আপাতত স্থগিত করেন তারা। তবে কয়েকদিনের আন্দোলনের প্রভাব পড়ে বন্দরের আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে। খালাস কার্যক্রম এখন স্বাভাবিক থাকলেও জট খুলতে অন্তত এক সপ্তাহ সময় লাগবে বলে মনে করছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। এর মধ্যে সামনে টানা ১০ দিন ঈদের ছুটি। বিশেষ ব্যবস্থায় আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম চালু রাখার ঘোষণা দেওয়া হলেও সেটি খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারবে না সার্বিক কাজে। কারণ ঈদের বন্ধে মহাসড়কে কাভার্ডভ্যানের মতো বড় যান চলাচলে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। তাই বন্দরে জট লাগা পণ্য নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন ব্যবসায়ীরা।
ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরামের চেয়ারম্যান ও বিজিএমইএর সাবেক সহসভাপতি এস এম আবু তৈয়ব বলেন, ‘ঈদের আগে এনবিআর কর্মকর্তাদের কর্মসূচি আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। ৯ দিন আগে আমার সাত কনটেইনার পণ্য বন্দরে আসে। এগুলোতে আছে কারখানার কাঁচামাল। পাঁচটি কনটেইানর খালাস করতে সাত দিন লেগেছে আমার। এখনও দুটি কনটেইনার পড়ে আছে। সময়মতো কাঁচামাল খালাস করতে না পারায় প্রভাব পড়বে উৎপাদনেও।’
জে কে শার্টের স্বত্বাধিকারী কায়কোবাদ বলেন, ‘১২ দিন আগে আমার ছয় কনটেইনার ফেব্রিকস আসে। আন্দোলন স্থগিত হলেও জটের মধ্যে পড়ে এখনও সেই পণ্য খালাস করতে পারিনি। অথচ প্রতিদিন ৯৮ ডলার ডেমারেজ দিতে হচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষকে। ঈদের ছুটি শুরুর আগে যদি এসব পণ্য কারখানায় আনতে না পারি, তাহলে বিপুল ক্ষতি হবে।’
একের পর এক কর্মসূচি ও আন্দোলনের কারণে মারাত্মক অচলাবস্থা দেখা দিয়েছে দেশের সবচেয়ে বেশি রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে। প্রতিদিন অন্তত ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় করা এই প্রতিষ্ঠানে ১০ দিন ধরে ছিল অচলাবস্থা। আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে ছিল স্থবিরতা। কাস্টমস কর্মকর্তারা অফিসে থাকলেও করেননি শুল্কায়নের কাজ। ৫টার পর সীমিত পরিসরে শুল্কায়নের কিছু কাজ করেছেন তারা। প্রতিদিন গড়ে চার হাজার কনটেইনার খালাস করা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গত ১০ দিনে খালাস হয়নি প্রত্যাশার অর্ধেক পণ্যও।
গতকাল মঙ্গলবার সকাল ৮টা পর্যন্ত বন্দরের বিভিন্ন ইয়ার্ডে জমেছিল ২০ ফুট দৈর্ঘ্যের একক (টিইইউস) ৪৫ হাজার ৩৭৭ কনটেইনার। এর মধ্যে একই আমদানিকারকের পণ্য ভর্তি এফসিএল (ফুল কনটেইনার লোডেড) কনটেইনার ছিল ৩৬ হাজার ৮২১। আর একাধিক আমদানিকারকের পণ্যবোঝাই এলসিএল (লুজ কনটেইনার লোডেড) কনটেইনার ছিল ৮৩৬ টিইইউস। খালি কনটেইনার আছে ৫ হাজার ৭০৮ টিইইউস। গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত বন্দরে পণ্যবোঝাই রপ্তানি কনটেইনার ছিল ১ হাজার ৪২৬ টিইইউস। পানিতে থাকা ২৪টি কনটেইনার পণ্যবোঝাই জাহাজের মধ্যে জেটিতে নোঙর করা অবস্থায় ছিল ১২টি। আর বহির্নোঙরে ছিল ১২টি। বহির্নোঙরে থাকা জাহাজে পণ্য ভর্তি কনটেইনার আছে ১৫ হাজার ৭০৩ টিইইউস। কনটেইনার জাহাজের বাইরে বন্দরে জেনারেল কার্গো পণ্যবোঝাই জাহাজ আছে ৩৭টি। খাদ্য পণ্যবোঝাই জাহাজ আছে ৭টি। এ ছাড়া সারবোঝাই দুটি, সিমেন্ট ক্লিংকার বোঝাই ২৫টি, চিনিবোঝাই একটি ও ওয়েল ট্যাঙ্কার আছে ৮টি। সব মিলিয়ে ১২৫ জাহাজ বন্দরসীমায় থাকলেও পণ্য খালাসের কার্যক্রম চলা জাহাজ গতকাল ছিল ৬৭টি।
চট্টগ্রাম বন্দরের মুখপাত্র মো. নাসির উদ্দিন বলেন, ‘শুল্কায়ন, পরীক্ষণসহ আমদানি কার্যক্রম না হলে বন্দর থেকে কনটেইনার খালাস করা যায় না। খালাস না হলে জাহাজ থেকে কনটেইনার নামানোর কার্যক্রমেও ধীরগতি দেখা দেয়। এটির প্রভাব পড়ে বন্দরে। এনবিআর ইস্যুতে কর্মবিরতি আপাতত স্থগিত হলেও এর রেশ থাকবে আরও অন্তত এক সপ্তাহ। এর মধ্যে সামনে ঈদের
ছুটি। বন্দর ও কাস্টম খোলা থাকলেও তখন আসলে পণ্য খালাস কার্যক্রম নেমে আসে এক-তৃতীয়াংশে। বন্দরের জট খুলতে তাই কিছু দিন সময় লাগতে পারে।’