এ সময় মায়া মায়া/ এ হাওয়া ঝিরি ঝিরি/...ষাটের দশকের ‘দর্শন’ চলচ্চিত্রের মোট আটটি গানের সব কটিই ছিল মানুষের মুখে মুখে। আর গানের আয়োজনের সঙ্গে হুট করেই যুক্ত হয়েছিলেন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী, সুরকার বশির আহমেদ। ঘনিষ্ঠ বন্ধু অভিনেতা রহমানের সঙ্গে আগের দিন রাত পর্যন্ত আড্ডাতেও বশির আহমেদ জানতেন না তিনি ‘দর্শন’–এর সংগীত পরিচালক। পরদিন পত্রিকায় দেখেছিলেন সিনেমাটির সংগীত পরিচালক হিসেবে নিজের নাম। উর্দু গানটি বাংলায় গেয়েছিলেন সাবিনা ইয়াসমীন। শুক্রবার বশির আহমেদের কন্যা হুমায়রা বশির বাবার এ গান পরিবেশনের আগে এই স্মৃতিচারণা করেন। ততক্ষণে বশির আহমেদের সুর ও কণ্ঠে গাওয়া বেশ কয়েকটি গানের পরিবেশন হয়ে গেছে। সেই প্রজন্মের দর্শকেরা গানের মধ্যে স্মৃতি হাতড়ে ফিরছিলেন। আর নতুনেরা মুগ্ধ হচ্ছিলেন কথা-সুরে।

প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী বশির আহমেদকে ঘিরে এই আয়োজন করেছিল ‘মোহাম্মদপুর ডায়েরিস’ নামের একটি উদ্যোগ। মূলত মোহাম্মদপুরের সংস্কৃতি, স্মৃতি সংরক্ষণের তাগিদ থেকেই মোহাম্মদপুর ডায়েরিস যাত্রা শুরু নূরজাহান রোডের মীর মঞ্জিলকে কেন্দ্র করে। ১৯৭২ সালে নির্মিত বাড়িটি মোহাম্মদপুরের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও পরিবর্তনের সাক্ষী। শিল্পী বশির আহমেদ ছিলেন মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লার বাসিন্দা। তাঁকে ঘিরে মীর মঞ্জিলে আয়োজন করা হয় মোহাম্মদপুর ডায়েরিসের দ্বিতীয় পর্ব। এই আয়োজনে গান পরিবেশন করেন বশির আহমেদের মেয়ে হুমায়রা বশির ও ছেলে রাজা বশির।

অনুষ্ঠানের শুরুতে মীর মঞ্জিলের সংস্কার নিয়ে নির্মিত তথ্যচিত্র দেখানো হয়। স্থাপত্যকাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য তা ‘আইএবি অ্যাওয়ার্ড ২০২৩’ অর্জন করেছে।

অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন মাহবুব উর রহমান। মীর মঞ্জিল তাঁর নানাবাড়ি। তিনি বলেন, নানা মীর রজ্জব আলী অবসরের সময় পাওয়া অর্থ দিয়ে বাড়িটি নির্মাণ করেন। পুরোনো হয়ে যাওয়া বাড়িটি ভবন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের কাছে দেওয়ার বিষয়ে স্বজনেরা যখন একমত হন, তখন তিনি এটাকে যেমন আছে তেমনটি রাখতে উদ্যোগ নেন। মীর মঞ্জিলের মূল স্থাপত্যকাঠামো অক্ষত রেখে এতে সংস্কার আনা হয়েছে। এই বাড়ি এখনো তাঁদের পুরোনো সব স্মৃতি হাজির করে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে মুক্তিযুদ্ধ—৭৮ বছরের গৌরবময় ইতিহাসের অংশীদার মোহাম্মদপুর। সময়ে–সময়ে সেসব স্মৃতি কথা উঠে আসবে মোহাম্মদপুর ডায়েরিস নামে মীর মঞ্জিলের এই বাড়িতে।

মোহাম্মদপুর ডায়েরিসের আয়োজনে এসে বশির আহমেদের মেয়ে হুমায়রা বশির বলেন, ১৯৭১ সালের আগে বশির আহমেদ মোহাম্মদপুরের জহুরি মহল্লায় জমি কেনেন। আশির দশকের শুরুতে একটু একটু করে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। ভিত্তি গড়ার সময় স্ত্রী কণ্ঠশিল্পী মীনা বশির নিজের সোনার কানের দুল দিয়েছিলেন। অন্তিম দিন পর্যন্ত তাঁরা এই বাড়িতেই ছিলেন।

ছেলে রাজা বশির বলেন, এখানেই ছিল বশির আহমেদের গানের স্কুল ‘সারগাম’। যেটা ছিল তাঁর সাধনার জায়গা। তিনি সব সময় বলতেন, ‘আমি গান চর্চা করে যাব। যাদের ইচ্ছা আসুক।’ তিনি গান শেখানোর সময় গান রেকর্ড করা বা ছবি তুলতে দিতেন না।

বশির আহমেদ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৯ সালে কলকাতায়। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে গুলিস্তান সিনেমা হলের স্বত্বাধিকারীর আমন্ত্রণে তিনি ঢাকায় একটি গানের অনুষ্ঠানে আসেন। এই দেশের মানুষের ভালোবাসা ও প্রশংসায় আপ্লুত বশির আহমেদ পরে স্ত্রী মীনা বশিরকে নিয়ে পাকাপাকিভাবে ঢাকায় চলে আসার সিদ্ধান্ত নেন। ‘অনেক সাধের ময়না আমার’, ‘আমাকে পোড়াতে যদি এত লাগে ভালো’, ‘আমি সাত সাগর পাড়ি দিয়ে’—তাঁর এমন বহু গান জনপ্রিয়তা পায়। দেশের সংগীতশিল্পী তাৎপর্যপূর্ণ অবদানের জন্য তিনি ২০০৩ সালে জাতীয় পুরস্কার ও ২০০৫ সালে একুশে পদক পান। দীর্ঘদিন ধরে ক্যানসার ও হৃদ্‌রোগে ভোগার পর ২০১৪ সালের ১৯ এপ্রিল ৭৪ বছর বয়সে মোহাম্মদপুরের বাড়িতে মারা যান।

কথার ফাঁকে ফাঁকে দর্শকদের মধ্য থেকে একে একে গানের অনুরোধ আসতে থাকে। ভাই-বোন গান ধরেন খান আতাউর রহমানের কথা ও সুরে বশির আহমেদের গাওয়া তুমুল জনপ্রিয় গান ‘যারে যাবি যদি যা/ পিঞ্জর খুলে দিয়েছি/ যা কিছু কথা ছিল/ ভুলে গিয়েছি.

..।’ হুমায়রা বশির জানান, গানটি প্রথমে রেডিওতে প্রচারিত হয়েছিল। গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়েছিল, পরে তা ‘আপন পর’ চলচ্চিত্রে যুক্ত করা হয়। এরপর তাঁরা পরিবেশন করেন সৈয়দ শামসুল হকের লেখা ‘ময়নামতি’ সিনেমার ‘ডেকো না আমারে তুমি, কাছে ডেকো না...।’ দর্শক সারি থেকে আসা অনুরোধের তালিকা দীর্ঘ হতে থাকে।

প্রসঙ্গত, গত মাসে মোহাম্মদপুর ডায়েরিসের প্রথম পর্ব অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সেখানে মূল বক্তা ছিলেন স্থানীয়দের কাছে ‘ইকবাল মামা’ নামে পরিচিত আহমেদ ইকবাল হাসান। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক পরিচালক আহমেদ ইকবাল হাসান বর্তমানে আহমেদ ইকবাল হাসান সিকিউরিটি লিমিটেডের প্রধান।

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

হাসলে কি অজু ভেঙে যায়

ইসলামি সংস্কৃতিতে একজন মুমিনের জীবনে শালীনতা, গাম্ভীর্য ও বিনয়কে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। হাসি-তামাশা মানুষের স্বভাবজাত হলেও এর আধিক্য বা মাত্রাতিরিক্ততা ইসলামে অপছন্দনীয়।

নামাজ ও অজুর মতো ইবাদতের ক্ষেত্রে এর প্রভাব কী, সেই বিষয়ে ইসলামি ফিকহের নির্দেশনা রয়েছে। মূলত, সাধারণ হাসি অজুর কোনো ক্ষতি করে না, তবে নামাজের ক্ষেত্রে এর পরিণতি সম্পূর্ণ ভিন্ন।

অজু ভঙ্গের কারণ হিসেবে হাসি

‘নাওয়াক্বিদ আল-অজু’ বা অজু ভঙ্গের কারণ হিসেবে হাসি সরাসরি উল্লিখিত নেই। অজু ভঙ্গের যে সুনির্দিষ্ট কারণগুলো কোরআন ও সহিহ হাদিসে বলা হয়েছে, হাসি তার অন্তর্ভুক্ত নয়। (ইবন কুদামা, আব্দুল্লাহ ইবন আহমাদ, আল-মুগনি, ১/২২১, দারুল কিতাব আল-আরাবি, বৈরুত, ২০০৬)

আরও পড়ুনঅজু করার নিয়ম কানুন১৯ ডিসেম্বর ২০২৩

তবে এখানে দুইটি সূক্ষ্ম বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। তা হল:

যদি প্রচণ্ড হাসির কারণে কোনো ব্যক্তির অজান্তে বায়ু নির্গত হয়, তবে সেই ক্ষেত্রে অজু ভেঙে যাবে। অর্থাৎ, প্রচণ্ড হাসি, যা আওয়াজ করে হয়, যদি এর কারণে অজুর মূল ভঙ্গকারী কোনো কারণ (যেমন: বায়ু নির্গত হওয়া) সংঘটিত হয়, তবে অজু ভেঙে যাবে।

হাসি নিজে অজুর কারণ নয়, বরং হাসির ফলে উদ্ভূত শারীরিক পরিবর্তন (বায়ু নির্গত হওয়া) অজু ভঙ্গের কারণ হবে। (সালেহ আল-ফাউজান, আল-মুল্লাখ্খাস আল-ফিকহি, ১/৫৮, দারুল আসনাহ, রিয়াদ, ২০০৪)

নামাজে উচ্চৈঃস্বরে হাসলে অজু ভেঙ্গে যাবে। তবে যদি হাসির শব্দ শুধু পাশের ব্যক্তিই শুনতে পেয়ে থাকে এবং তা এত জোরে না হয়ে থাকে যে, পিছনের কোনো মুসল্লি শুনতে পায়, তাহলে শুধু নামাজ পুনরায় পড়ে নেয়াই যথেষ্ট।

কারণ যে হাসির শব্দ পিছনের কাতারের মুসল্লি শুনতে পায় না তা দ্বারা অজু নষ্ট হয় না; অবশ্য আরো উঁচু শব্দে হেসে থাকলে অজু নষ্ট হয়ে যায়। (মাসিক আল-কাউসার, জুলাই ২০২০ সংখ্যা, প্রশ্ন ৫১৩৩; ইমাম আবু ইউসুফ, কিতাবুল আসার, বর্ণনা ১৩৫; রদ্দুল মুহতার ১/১৪৫)

নামাজ নষ্টের কারণ হিসেবে হাসি

অজুর বাইরে, নামাজের ক্ষেত্রে হাসির প্রভাব অত্যন্ত গুরুতর। নামাজের মধ্যে হাসলে তা নামাজকে বাতিল করে দেয়। কারণ, নামাজ হলো বিনয়, স্থিরতা এবং আল্লাহর প্রতি পূর্ণ মনোযোগের ইবাদত। নামাজের বাইরে অন্য যেকোনো কাজ, যা নামাজের অংশ নয়, তা নামাজকে নষ্ট করে দেয়।

আরও পড়ুনঘুমালে কেন অজু ভঙ্গ হয়০৬ অক্টোবর ২০২৫

নামাজ ভঙ্গের কারণ হিসেবে হাসি বা কথা বলার বিষয়টি সুস্পষ্ট:

উচ্চস্বরে হাসি: যদি নামাজের মধ্যে কেউ উচ্চস্বরে হেসে ওঠে, তবে তার নামাজ সঙ্গে সঙ্গে বাতিল হয়ে যায়। কারণ এটি নামাজের মূলভিত্তি খুশু (বিনয় ও মনোযোগ) থেকে নামাজকে মুক্ত করে দেয়। (আল-কাসানী, আলাউদ্দিন আবু বকর, বাদায়িউস সানায়ি, ১/২৩৫, দারুল কুতুব আল-ইলমিয়্যাহ, বৈরুত, ১৯৮৬)।

কথা বলা: নামাজের মধ্যে কোরআন তেলাওয়াত ছাড়া অন্য যেকোনো ধরনের কথা বলা বা শব্দ করা নামাজকে নষ্ট করে দেয়। হাসিও এক ধরনের শব্দ বা প্রতিক্রিয়া, যা নামাজের কাঠিন্য ও পবিত্রতার সাথে বেমানান।

অধিক হাসি থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা

ইসলামি শিষ্টাচারের অংশ হিসেবে একজন মুমিনকে হাসির আধিক্য থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করা হয়েছে। কারণ, অতিরিক্ত হাসি অন্তরের কোমলতা নষ্ট করে এবং তাকে কঠিন করে তোলে।

কোরআনে কঠোর হৃদয়ের পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করা হয়েছে, “কাজেই দুর্ভোগ তাদের জন্য, যাদের অন্তর আল্লাহর জিকির (স্মরণ) থেকে কঠিন হয়ে গেছে।” (সুরা যুমার, আয়াত: ২২)

রাসুলুল্লাহ (সা.) সাহাবিদের সঙ্গে কথা বলার সময় গাম্ভীর্য বজায় রাখতেন এবং তিনি নিজে কম হাসতেন। তিনি এমন এক কঠিন সত্যের প্রতি ইঙ্গিত করেছেন, যা মানুষকে হাসির পরিবর্তে ক্রন্দনে রত করে।

নবীজি (সা.) বলেন, “আমি যা জানি, তোমরা যদি তা জানতে, তাহলে তোমরা কম হাসতে এবং বেশি কাঁদতে।” (সহিহ বুখারি, হাদিস: ৬৪৮৫)

এই হাদিসের মাধ্যমে রাসুল (সা.) পরকালের ভয়াবহতা, আল্লাহর মহত্ত্ব এবং মানুষের জন্য নির্ধারিত পরীক্ষার কথা তুলে ধরেছেন। এই সত্য অনুধাবন করলে হৃদয় স্বাভাবিকভাবেই হাসির পরিবর্তে আল্লাহর দিকে মনোযোগী হয় এবং বিনয়ী হয়।

মুসলিম হিসেবে আমাদের উচিত, নিজেদের অন্তরকে সুস্থ ও সজীব রাখতে হাসির আধিক্য থেকে বিরত থাকা। নামাজের সময় খুশু-খুজু বা বিনয়কে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে, যেন ইবাদতের উদ্দেশ্য পূর্ণ হয় এবং তা আল্লাহর কাছে গ্রহণযোগ্য হয়।

আরও পড়ুনশীতে মোজা পরে অজু করার বিধান ও পদ্ধতি২১ জানুয়ারি ২০২২

সম্পর্কিত নিবন্ধ