অভিযোগটা গুরুতর। সৌদি আরবে স্প্যানিশ সুপার কাপের সেমিফাইনাল দেখতে গিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন মায়োর্কার খেলোয়াড়দের পরিবারের সদস্যরা। গত বৃহস্পতিবার দ্বিতীয় সেমিফাইনালে রিয়াল মাদ্রিদের কাছে ৩-০ গোলে হারে মায়োর্কা। জেদ্দায় এই ম্যাচের পর স্থানীয় সমর্থকদের বিরুদ্ধে উত্ত্যক্ত করার অভিযোগ করেছেন মায়োর্কার দুই খেলোয়াড়ের স্ত্রীরা।

আরও পড়ুনটানা ২৪ বছরে গোলের রেকর্ড রোনালদোর, মেসি কি ছুঁতে পারবেন১৮ ঘণ্টা আগে

মায়োর্কার মিডফিল্ডার দানি রদ্রিগেজের স্ত্রী ক্রিস্টিনা পালভারা স্পেনের টিভি সাংবাদিকের কাছে এই অভিযোগ করেছেন। ম্যাচ শেষে কিং আবদুল্লাহ স্টেডিয়াম ছাড়ার সময় তিনি এবং মায়োর্কার গোলকিপার ডমিনিক গ্রিফের স্ত্রীকে হয়রানি করেন স্থানীয় কিছু পুরুষ সমর্থক।

স্প্যানিশ টিভি চ্যানেল এসপোর্তস আইবি৩-কে পালভারা বলেছেন, ‘(স্টেডিয়াম থেকে) বের হওয়াটা ছিল বেশ জটিল। আমরা সন্তানদের নিয়ে একা ছিলাম এবং কোনো নিরাপত্তা ছিল না। সত্যিটা হলো এই দেশের কিছু পুরুষ খুব কাছ থেকে আমাদের ছবি তোলা শুরু করে এবং হয়রানিও করেছে।’ পালভারা এরপর আরও বলেছেন, ‘ডমিনিক গ্রিয়েফের স্ত্রী নাতালির সঙ্গেও একই ঘটনা ঘটেছে। আমার মেয়ে তখন ঘুমিয়ে পড়েছিল। খুবই অস্বস্তি লেগেছে আমাদের। আমাদের রক্ষা করার মতো কেউ ছিল না। বের হওয়াটা ছিল খুবই বাজে।’

গ্রিয়েফের স্ত্রী নাতালিয়া কালুজোভা এ নিয়ে কথা বলেছেন স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যম মার্কার সঙ্গে। তাঁর ভাষায়, কিছু পুরুষ ‘আমাদের ভিডিও করেছে, ধাক্কা দিয়েছে, অযাচিতভাবে ছুঁয়েছে, আমাদের মুখের ওপর ফোন ধরেছে এবং ভিডিও করেছে।’

আরও পড়ুনমেসি–সুয়ারেজের সঙ্গে নেইমারের পুনর্মিলনী ‘অসম্ভব’, জানালেন মাচেরানো১২ ঘণ্টা আগে

মায়োর্কার ক্লাব অফিশিয়ালদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, স্টেডিয়াম থেকে বের হওয়ার সময় প্রায় ২৫০ জন হয়রানির শিকার হয়েছেন। বার্তা সংস্থা অ্যাসোসিয়েটেড প্রেস (এপি) জানিয়েছে, মায়োর্কার অন্য সব সমর্থক এবং অন্যান্য স্প্যানিশ সংবাদমাধ্যমও একই অভিযোগ করেছে। মোবাইল ফোনে তোলা একটি ভিডিও প্রকাশ করেছে মার্কা। তাতে দেখা গেছে, মায়োর্কার সমর্থকেরা হেঁটে চার্টার্ড বাসে ওঠার সময় রিয়াল মাদ্রিদের জার্সি পরা কিছু পুরুষ সমর্থক ভিডিও এবং হাসাহাসি করছেন।

সেমিফাইনালে রিয়ালের জয়ের ম্যাচে ভিনিসিয়ুসের সামনে মায়োর্কার দানি রদ্রিগেজ (১৪ নম্বর জার্সি).

উৎস: Prothomalo

এছাড়াও পড়ুন:

বুদ্ধিজীবী নিধনের রাজনীতি

বাংলাদেশে শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে সংখ্যাতত্ত্ব, হত্যাকারীদের রাজনৈতিক পরিচয় নিয়ে বিতর্ক এবং নানা ধরনের জনপ্রিয় ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জালে ঘুরপাক খাচ্ছে। এসব তর্কবিতর্কের একাংশকে অনেক সময়ই নিতান্ত দলীয় রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা কিংবা অপরাধসংশ্লিষ্টতা আড়ালের কৌশল হিসেবে দেখা যায়। একাত্তরের বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নানা ঘটনাপ্রবাহ নিয়ে সন্দেহ, অবিশ্বাস আর অস্বীকারের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে নানা কারণে। একাত্তর বা স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে যথেষ্ট পরিমাণ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার অভাবে বুদ্ধিজীবী নিধনের মতো গুরুতর অপরাধ বিষয়ে সমাজ নির্ভরযোগ্য তথ্য পাননি, গবেষকেরা কাজ করার মতো যথেষ্ট উপাত্ত পায়নি আর রাষ্ট্র বিচারিক প্রক্রিয়াকে কখনো বিতর্কমুক্ত রাখতে পারেনি। স্মৃতিকথাগুলো এখনো তাই প্রধান অবলম্বন।

তবে যেটিকে মনে হতো একদম সাধারণ জ্ঞান ও সবল জনস্মৃতির বিষয়, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলা এখন সহজ হয়ে গেছে। প্রশ্ন তোলার বিষয়টিও অবশ্য নতুন নয়। মূলত একাত্তরের ডিসেম্বরের অবিশ্বাস্য হত্যাকাণ্ডের ঘটনা জনপরিসরে প্রকাশিত হওয়ার পর থেকেই এই তর্কবিতর্ক ও সন্দেহের সূত্রপাত হয়েছিল। অবশ্য বলে রাখা প্রয়োজন, ২৫ মার্চের রাত থেকে প্রায় ৯ মাসজুড়েই বিভিন্ন সময়ে অনেক বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন।

এই হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্দোলনও বাহাত্তরেই শুরু করতে হয়েছিল সরকারের পক্ষ থেকে আলাদা করে তদন্ত ও বিচারিক উদ্যোগের অভাব দেখে। সেই আন্দোলনের নেতৃত্বকেই পরবর্তী সময়ে গণহত্যা বিচার আন্দোলনের পুরোভাগে দেখা গেছে। শহীদ হিসেবে স্বীকৃত বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী মূলত কমিউনিস্ট ভাবধারার এবং যথেষ্ট পরিমাণ আওয়ামী লীগ–বিরোধী হওয়া সত্ত্বেও স্বাধীনতার পর নানা ঘটনা পরিক্রমায় তাঁদের পরিবারের কোনো কোনো সদস্যকে আওয়ামী লীগ আত্তীকৃত করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৯০-এর দশকে এ আন্দোলন নানা কারণে আওয়ামী লীগের ওপরই আস্থা রেখেছিল। ফলে দলটি পুরো বিষয়টির ওপর একচ্ছত্র আধিপত্য তৈরির সুযোগ লাভ করে। কাজেই গণহত্যার বিচার আন্দোলনের যে দলীয় রূপ আমরা দেখতে পাই, তা কোনো কাকতালীয় ঘটনা নয়। মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে অস্বীকার-অসম্মানের রাজনীতি যারা করেছে আর বিভিন্ন সময়ে তাদের রাজনৈতিক মিত্র হয়েছে, তারা এর জন্য দায়ী। যে আলবদর বাহিনীকে বুদ্ধিজীবী নিধনের জন্য প্রধানত দায়ী করা হয়, তাদের নেতা ও অনুসারীরাও রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। এসব ঘটনাচক্রে শেষ বিচারে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নিরপেক্ষ তদন্তপ্রয়াস, ইতিহাস-গবেষণা ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ।

নিধনের দুই মডেল ও বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট

ইতিহাসে নানা বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনা নিয়ে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের জনপ্রিয়তাও বিশ্বজনীন। এমনকি হলোকস্টের মতো বিশ্বের সর্বাধিক গবেষণাকৃত গণহত্যা বা বুদ্ধিজীবী নিধনের ইতিহাসচর্চার বিপরীতেও অস্বীকারের রাজনীতি প্রবলভাবেই উপস্থিত রয়েছে। তবে এসব তর্কবিতর্কের বাইরেও একাত্তরজুড়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের বিষয়কে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষণের সুযোগ অবারিত। এসব পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বস্তুত একধরনের ‘জ্ঞানজাগতিক ধ্বংসযজ্ঞ’, যা ‘এপিস্টিমসাইড’-এর ধারণাকে প্রসারিত করে সাধারণ বিশ্লেষণাত্মক কাঠামো বিবেচনায় আলোচনা করা সম্ভব। জেনোসাইড অধ্যয়নের প্রেক্ষাপটে বলা যায়, এটি জাতির মননশীলতা, প্রজ্ঞা ও সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে স্থায়ীভাবে পঙ্গু করে দেওয়ার এক কৌশলগত প্রয়াস। এই অপরাধের লক্ষ্য কেবল শারীরিক বিনাশ নয়, বরং সামাজিক স্মৃতির ওপর সরাসরি আক্রমণ, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে জ্ঞানের সঞ্চরণ ও ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতাকে ব্যাহত করে।

ঔপনিবেশিক মডেলের মূল চালিকা শক্তি হলো ‘ভবিষ্যতের ভীতি’, যা বিজিত জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদে দুর্বল করে রাখার আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত।

দার্শনিক দৃষ্টিকোণ থেকে এই প্রক্রিয়া হলো ক্ষমতার ডিসকোর্সের বিপরীতে থাকা বুদ্ধিবৃত্তিক বহুমাত্রিকতাকে চিরতরে রুদ্ধ করে দেওয়া। ঐতিহাসিক পর্যালোচনায় এই নিধনযজ্ঞের পেছনে দুটি প্রধান ও স্বতন্ত্র তাত্ত্বিক কাঠামো বা বর্গ স্পষ্টত পরিলক্ষিত হয়: ১. ঔপনিবেশিক মডেল এবং ২. বিপ্লবী মডেল। লক্ষ্য অভিন্ন হলেও এই দুটি মডেলের আদর্শিক ভিত্তি, প্রেক্ষাপট, কার্যকারণ ও মনস্তাত্ত্বিক কৌশল সম্পূর্ণ ভিন্ন।

ঔপনিবেশিক মডেলের মূল চালিকা শক্তি হলো ‘ভবিষ্যতের ভীতি’, যা বিজিত জাতিকে দীর্ঘ মেয়াদে দুর্বল করে রাখার আকাঙ্ক্ষা থেকে উৎসারিত। এই মডেলে ঘাতক হলো একটি দখলদার বা ঔপনিবেশিক শক্তি, যার প্রাথমিক উদ্দেশ্য হলো বিজিত জাতির ওপর নিজেদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আধিপত্যকে কাঠামোগতভাবে ধরে রাখা। যখন শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করে যে তাদের সামরিক আধিপত্যের পতন আসন্ন এবং স্থানীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী প্রতিরোধ এক সুসংগঠিত বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব দ্বারা চালিত হচ্ছে, তখন তারা জাতির ‘মস্তিষ্ক’ বা সেই বুদ্ধিবৃত্তিক নেতৃত্ব প্রদানকারী অংশটিকে কৌশলগতভাবে নির্মূল করার পরিকল্পনা করে। এই কৌশল কোনো তাৎক্ষণিক প্রতিশোধ নয়, বরং সুদূরপ্রসারী কৌশলগত সামরিক ও রাজনৈতিক পদক্ষেপ, যা ‘পোড়ামাটি কৌশল’-এর বুদ্ধিবৃত্তিক সমান্তরাল হিসেবে কাজ করে। এই মডেলের প্রধান কৌশলগত উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যৎ স্বাধীন রাষ্ট্রের আত্মনির্ভরশীলতা এবং স্বশাসনের নৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ভিত্তিকে অঙ্কুরেই বিনাশ করা। সদ্যোজাত রাষ্ট্র যেন মেধার অভাবে দীর্ঘকাল ধরে ধুঁকতে থাকে এবং বহিরাগত শক্তির ওপর অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, যার মাধ্যমে উত্তর-ঔপনিবেশিক সময়ে আধিপত্য নিশ্চিত করা সম্ভব হয়।

ঔপনিবেশিক মডেলের অধীন সংঘটিত দুটি ঘটনা এই কৌশলকে আরও স্পষ্ট করে তোলে। সেগুলো হলো ১৯৪০ সালে স্তালিনের সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক পোল্যান্ডে সংঘটিত ‘ক্যাটিন ম্যাসাকার’ এবং ১৯৩৯ সালে নাৎসি জার্মানি কর্তৃক পরিচালিত ‘বুদ্ধিজীবী অভিযান’ (Intelligenzaktion বা আইনটেলিগেন্সাকশন)। ক্যাটিনে সোভিয়েত গোপন পুলিশ সংস্থা এনকেভিডি প্রায় ২২ হাজার পোলিশ অফিসার, যাঁদের মধ্যে বহুসংখ্যক শিক্ষক, প্রকৌশলী ও আইনজীবী ছিলেন, তাঁদের বন্দিশিবির থেকে বের করে এনে ক্যাটিন বন ও অন্যান্য গোপন স্থানে মাথার পেছন দিকে গুলি করে হত্যা করে। এর যুক্তি ছিল—এই শ্রেণিই পোলিশ জাতীয় চেতনার ধারক। একইভাবে নাৎসি জার্মানির এসএস ও আইনজাটজগ্রুপেন (Einsatzgruppen) পোল্যান্ড দখলের পর শিক্ষক, পুরোহিত, চিকিৎসকদের তালিকা ধরে ধরে আটক ও ফায়ারিং স্কোয়াডে হত্যা করে। উভয় ক্ষেত্রেই নিধনের লক্ষ্য ছিল পোলিশ এলিট শ্রেণিকে দাস শ্রমিকে পরিণত করা এবং তাদের ভবিষ্যতের প্রতিরোধক্ষমতাকে চিরতরে মুছে ফেলা। ঔপনিবেশিক শাসনকে দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা দেওয়াই ছিল এর মূল লক্ষ্য।

অন্যদিকে বিপ্লবী মডেলের ঘাতক কোনো ভিনদেশি শক্তি নয়, বরং নিজ দেশেরই উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী এক শাসকগোষ্ঠী। এই মডেলের মূল চালিকা শক্তি হলো মতাদর্শগত ‘শুদ্ধীকরণ’ এবং একটি ইউটোপীয় সমাজ গঠনের আকাঙ্ক্ষা। এই দর্শনে সমাজকে আমূল পাল্টে দেওয়ার জন্য পুরোনো বুর্জোয়া বা সামন্ত চিন্তাধারাকে সম্পূর্ণরূপে মুছে ফেলে সম্পূর্ণ নতুন এক কাঠামো গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। এ প্রক্রিয়ায় বিদ্যমান বুদ্ধিজীবী শ্রেণিকে প্রায়ই ‘দূষিত রক্ত’, ‘শ্রেণিশত্রু’ বা প্রগতির পথে প্রধান বাধা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। শাসক মনে করে, এরা অতীত সমাজের স্মৃতি বহন করে এবং নতুন ব্যবস্থার প্রতি অনুগত নয়, তাই এদের অস্তিত্ব নতুন বিপ্লবের জন্য সরাসরি আদর্শিক হুমকি। কম্বোডিয়ার খেমার রুজ বা পল পটের শাসনামল (১৯৭৫-১৯৭৯) এই বিপ্লবী মডেলের সবচেয়ে ভয়াবহ ও চরমপন্থী দৃষ্টান্ত। পল পট চেয়েছিলেন কম্বোডিয়াকে ‘শূন্য সাল’ বা ‘ইয়ার জিরো’ থেকে শুরু করতে, যেখানে আধুনিক শিক্ষা, বিজ্ঞান বা দর্শনের কোনো স্থান থাকবে না। ফলে খেমার রুজের অধীন বুদ্ধিজীবী নিধন কেবল রাজনৈতিক বিরোধীদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এটি আধুনিকতা, শহুরে জীবন ও প্রজ্ঞার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল। খেমার রুজ নেতা পল পট কর্তৃক চিহ্নিত ‘শত্রু’ বা বুদ্ধিজীবীদের সংজ্ঞা ছিল চরম পর্যায়ের অযৌক্তিক। চশমা পরা, ফরাসি বা অন্য বিদেশি ভাষা জানা, নরম হাত বা এমনকি স্কুলশিক্ষকদের মতো সামান্যতম চিহ্নও পুরোনো ‘বুর্জোয়া’ বা ‘পরজীবী’ সমাজের অংশ হিসেবে বিবেচিত হতো। শহরের সব মানুষকে বাধ্যতামূলকভাবে গ্রামাঞ্চলে নির্বাসন দেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ায় অসংখ্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও শিল্পী হয় অনাহারে বা অত্যধিক পরিশ্রমে মারা যান অথবা কুখ্যাত টুওল স্লেং (S-21) কারাগারে নিয়ে গিয়ে তাঁদের নির্যাতন ও হত্যা করা হয়। এটি ছিল জ্ঞানসমাজের ওপর পরিচালিত একটি চরম ফ্যাসিবাদী আক্রমণ, যার মূল কথা ছিল—প্রশ্ন নয়, অন্ধ আনুগত্যই সমাজের ভিত্তি।

একইভাবে চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লব (১৯৬৬-১৯৭৬) বিপ্লবী মডেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ রূপ দেখায়। মাও সে–তুংয়ের বিপ্লবে বুদ্ধিজীবীদের দৈহিকভাবে হত্যার চেয়ে তাঁদের ‘সামাজিক ও মনস্তাত্ত্বিকভাবে’ দমন করার প্রবণতা বেশি ছিল। এই মনস্তাত্ত্বিক বিনাশের প্রধান প্রক্রিয়া ছিল ‘সংগ্রাম অধিবেশনে’ অধ্যাপক, শিল্পী ও শিক্ষাবিদদের জনসমক্ষে অপমান করা এবং তাঁদের জোরপূর্বক ‘গ্রামাঞ্চলে প্রেরণ আন্দোলনের’ মাধ্যমে কৃষিকাজ করানো। এই দমনযজ্ঞের প্রধান ঘাতক ছিল মাওয়ের অনুগত রেড গার্ডস—ছাত্র ও তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী। তারা পুরোনো সংস্কৃতি, পুরোনো ধ্যানধারণা, পুরোনো অভ্যাস ও পুরোনো রীতিনীতি (ফোর ওল্ডস বা চার পুরোনো) ধ্বংসের নামে শিক্ষকদের মারধর করত, পাবলিক লাইব্রেরি পুড়িয়ে দিত এবং ঐতিহ্যবাহী শিল্পকর্ম নষ্ট করত। এই ‘পুনঃশিক্ষণ’ প্রক্রিয়ার লক্ষ্য ছিল তাঁদের চিন্তাজগৎকে দুমড়েমুচড়ে দেওয়া। বিপ্লবী শাসকেরা বুঝতে পেরেছিলেন যে বুদ্ধিজীবীরা হলেন পুরোনো সমাজের স্মৃতি বা ‘মেমোরি চিপ’। নতুন সমাজ গড়তে হলে এই মেমোরি চিপকে হয় ধ্বংস করতে হবে, না হয় সেটির তথ্য মুছে দিয়ে নতুন তথ্য প্রবেশ করাতে হবে।

বিপ্লবী মডেলের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হলো ১৯৩০-এর দশকে স্তালিনের অধীন সোভিয়েত ইউনিয়নে সংঘটিত ‘দ্য গ্রেট পার্জ’ বা ‘মহাশোধন’। যদিও এই শুদ্ধীকরণে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব প্রধান লক্ষ্য ছিল, তবে পুরোনো আমলের শিক্ষাবিদ, বিজ্ঞানী ও ‘বুর্জোয়া বিশেষজ্ঞ’ হিসেবে চিহ্নিত বুদ্ধিজীবীদেরও নির্মূল করা হয়েছিল। স্তালিন তাঁর আদর্শগত নিয়ন্ত্রণকে সম্পন্ন করতে পুরোনো আমলের সেই বুদ্ধিজীবীদের লক্ষ্য করেন, যাঁরা বলশেভিক বিপ্লবের পূর্ববর্তী লিবারেল বা এমনকি মেনশেভিক চিন্তাভাবনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ‘পেশাদার বিশেষজ্ঞ’ এবং ইতিহাস ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে ‘বিপ্লব-পূর্ব ইতিহাসবিদ’ বা ‘অ-সোভিয়েত সাহিত্যিক’দের আটক করা হয়। ঘাতক বাহিনী এনকেভিডি তাঁদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত করে সাইবেরিয়ার গুলাগ ক্যাম্পে প্রেরণ করে, যেখানে তাঁরা অনেকেই মারা যান, অথবা দ্রুত বিচার শেষে তাঁদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। এ প্রক্রিয়া নিশ্চিত করেছিল যে সোভিয়েত রাষ্ট্রে জ্ঞান ও উৎপাদনের প্রতিটি ক্ষেত্র যেন কমিউনিস্ট পার্টির অনুমোদিত মতাদর্শের অধীনই কাজ করে।

স্বৈরশাসকের বুদ্ধিবৃত্তিক ভীতি 

বুদ্ধিজীবী নিধনের এই দ্বিবিধ মডেলের মূল কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক শাসকগোষ্ঠীর এক গভীর ‘বুদ্ধিবৃত্তিক নিরাপত্তাহীনতা’ বা এপিস্টেমিক ভীতি। স্বৈরাচারী শাসক—তা সে ঔপনিবেশিক বা বিপ্লবী হোক না কেন—উভয়েই ‘একক সত্য’ বা ‘মনোলগ’-এ বিশ্বাসী। এই মনোলগ প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন হয় নানা ‘স্বর’ বা বহুমুখী আলোচনার উৎসকে নির্মূল করা। ফরাসি দার্শনিক মিশেল ফুকো তাঁর ক্ষমতা-জ্ঞান তত্ত্বে দেখিয়েছেন, জ্ঞান ও ক্ষমতা ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ক্ষমতা শুধু চাপিয়ে দেওয়া হয় না, বরং এটি সমাজের ডিসকার্সিভ গঠন এবং জ্ঞান উৎপাদন ও বিতরণের মাধ্যমে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। কাজেই স্বৈরাচারী শাসকগোষ্ঠী যখন বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে, তখন তারা কেবল ব্যক্তিকে হত্যা করে না; তারা একটি নির্দিষ্ট জ্ঞান উৎপাদনকারী কাঠামো এবং সমালোচনা করার প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতাকে ধ্বংস করে দেয়। ফুকোর দৃষ্টিতে বুদ্ধিজীবীরা হলেন সেই ব্যক্তি, যাঁরা বিদ্যমান ডিসকোর্সকে প্রশ্ন করেন এবং ক্ষমতার কাঠামোকে দৃশ্যমান করে তোলেন। এই ‘ডিসিপ্লিনারি ক্ষমতা’ প্রয়োগের মাধ্যমে শাসকগোষ্ঠী বুদ্ধিজীবীর কণ্ঠস্বর রুদ্ধ করে সমাজে একপ্রকার বুদ্ধিবৃত্তিক ‘অনুশাসন’ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। বুদ্ধিজীবীর ওপর শারীরিক শাস্তি হলো ‘শাস্তির ডিসকোর্সের’ চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ, যা সমাজের বাকি অংশের জন্য একটি ভয়াবহ দৃষ্টান্ত তৈরি করে।

অন্যদিকে হানা আরেন্ডট তাঁর সর্বাত্মকবাদ বা টোটালিটারিয়ানিজম তত্ত্বে দেখিয়েছেন, ফ্যাসিবাদী বা সর্বাত্মকবাদী শাসকেরা কেবল রাজনৈতিক বিরোধীদের হত্যা করে না, তারা বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা ও স্বাধীন বিচার-বিবেচনা করার ক্ষমতাকেও ধ্বংস করে দিতে চায়। বুদ্ধিজীবীর ধর্মই হলো প্রশ্ন করা এবং বস্তুনিরপেক্ষভাবে সত্যের সন্ধান করা, যা সর্বাত্মকবাদী শাসনের ‘সর্বাত্মক মিথ্যার’ বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় প্রতিরোধ। একজন বুদ্ধিজীবী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং মানুষের মধ্যে নৈতিক সচেতনতা জাগিয়ে তোলেন। এই ‘রাজনৈতিক ক্রিয়ার ক্ষমতা’কে স্তব্ধ করার জন্যই যুগে যুগে চিন্তাবিদদের প্রাণ দিতে হয়েছে। হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে শাসক একটি ‘কাল্পনিক বাস্তবতা’ প্রতিষ্ঠা করে, যেখানে একমাত্র শাসকের কথাই চূড়ান্ত সত্য বলে বিবেচিত হয় এবং অন্য কোনো সত্যের অন্টোলজিক্যাল মর্যাদা অস্বীকার করা হয়।

হত্যাযজ্ঞের ফল ও বাংলাদেশের কথা

বুদ্ধিজীবী নিধনের চূড়ান্ত ফল হিসেবে সমাজে যে গভীর ক্ষত তৈরি হয়, তা কেবল স্বজন হারানোর ব্যক্তিগত বেদনা নয়; এর ফলে সমাজে এক দীর্ঘস্থায়ী শূন্যতা তৈরি হয়। এই শূন্যতা তখন পূরণের চেষ্টা করে সুবিধাবাদী এক নতুন গোষ্ঠী, যারা শাসকের অন্যায়কে ন্যায় বলে প্রতিষ্ঠা করতে তৎপর থাকে। এই ‘সুবিধাবাদী এলিট’ সমাজের জ্ঞান ও নীতির মানকে নিম্নগামী করে তোলে। বলা যায়, গ্রামসির ‘অর্গানিক ইন্টেলেকচুয়াল’ বা জৈব বুদ্ধিজীবীদের মতোই তারা নির্দিষ্ট শ্রেণির সঙ্গে যুক্ত থেকে সেই শ্রেণির মতাদর্শকে বৈধতা দেয় এবং জনগণের সম্মতি তৈরি করে শাসকশ্রেণির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেন। ফলে সমাজ তার ‘স্ব–সংশোধন’ ও নৈতিক বিচারের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে, যা একটি জাতির ঐতিহাসিক বিকাশের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। বাংলাদেশ, পোল্যান্ড, কম্বোডিয়া ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো দেশগুলো এই হত্যাকাণ্ডগুলোর দীর্ঘমেয়াদি মূল্য দিয়েছে। ঔপনিবেশিক মডেল আমাদের দেখিয়েছে—কীভাবে একটি জাতিকে বহিরাগতভাবে পঙ্গু করতে হয়, আর বিপ্লবী মডেল দেখিয়েছে—কীভাবে মতাদর্শগত শুদ্ধীকরণের নামে একটি জাতির আত্মপরিচয় ও ঐতিহাসিক স্মৃতি মুছে ফেলতে হয়। একাত্তরে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী নিধনের ঘটনাকে এই দুই মডেলেরই মিশ্রণ হিসেবে দেখা যেতে পারে।

প্রশ্ন তোলা যায়, ঔপনিবেশিক মডেলের যে প্রসঙ্গ এল, ৫৪ বছর পরও কি তা প্রাসঙ্গিক? দেশে স্বাধীন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গঠন ও সবল বিদ্যাচর্চার আয়োজনে আমাদের ব্যর্থতাই কি দুর্বল নাগরিক সমাজের জন্য দায়ী নয়? তবে একাত্তরের বুদ্ধিজীবী নিধনের সেই ভয়াল স্মৃতি নাগরিক সমাজে যে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরি করেছে, তা নিয়ে আরও বিশ্লেষণের সুযোগ রয়েছে। কেননা এই অঞ্চলের বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায় একাত্তরেই প্রথম দেখতে পেয়েছেন রাষ্ট্রীয় অন্যায় বা কোনো মতাদর্শিক দল বা আধা সামরিক বাহিনীর বিপরীতে অবস্থান করলে গুম ও খুনের শিকার হতে হয়। যদি একাত্তরের অভিজ্ঞতা থেকে সত্যিই কিছু শেখা হতো, তাহলে একাত্তরের পর বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার পরিসর ক্রমে ছোট হয়ে আসত না। রাজনৈতিক কারণে রাষ্ট্রীয় মদদে গুম ও খুনের ঘটনারও বোধ করি এমন বিস্তার ঘটত না। শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসে তাই নিহত চিন্তাবিদদের স্মৃতি জাগরূক রেখে নিরন্তর প্রশ্ন করে যাওয়া এবং বহুমুখী বিতর্কের মাধ্যমে সমাজকে সজীব ও সজাগ রাখাই হোক আমাদের প্রধান প্রতিবাদের ভাষা। এটিই হোক শহীদদের প্রতি আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক অঙ্গীকার এবং সহিংসতার বিরুদ্ধে চূড়ান্ত মানবীয় প্রতিরোধ।

লেখক: খণ্ডকালীন শিক্ষক, আইইউবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ