লক্ষ্মীপুর-২ আসনের সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নসহ জেলার চারজন আওয়ামী লীগ নেতার বাড়িতে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছে সংঘবদ্ধ একদল মানুষ।

বৃহস্পতিবার (৬ ফেব্রুয়ারি) বিকেলে এই চারজনের বাড়িতে হামলা শুরু হয়। উত্তেজিত দুই-তিনশ লোক শহরের উত্তর তেমুহনী থেকে মিছিল নিয়ে এসে আলাদা আলাদা দলে ভাগ হয়ে হাতুড়ি ও হ্যামার দিয়ে তাদের বাড়িতে ভাঙচুর শুরু করে। রাতে এই প্রতিবেদন লেখার পর্যন্ত বাড়িগুলোতে ভাঙচুর চলছিল।

নুর উদ্দিন চৌধুরী নয়নসহ লক্ষ্মীপুর জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপু, জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি চৌধুরী মাহমুদুন্নবী সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক রাকিব হোসেন লোটাসের বহুতল ভবনে ভাঙচুর চলছে। তাদের মধ্যে লোটাসের বাড়ি ছাড়া অন্য নেতাদের বাড়িতে ৪, ৫ ও ৬ আগস্ট দফায় দফায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়। ওই সময় মালামাল লুটপাট করা হয়।

আরো পড়ুন:

নরসিংদীর টেক্সটাইল কারখানার গোডাউনে লাগা আগুন নিয়ন্ত্রণে

গাজীপুরে মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে

ভাঙচুরের ঘটনা দেখতে উৎসুক জনতা বাড়িগুলোর আশপাশে ভিড় জমিয়েছে। ভাঙচুরে অংশগ্রহণকারীরা বিভিন্ন স্লোগান দিচ্ছে। ‘শেখ হাসিনার আস্তানা/ ভেঙে দাও, গুড়িয়ে দাও, শেখ হাসিনার ঠিকানা/ এই বাংলায় হবে না’ ধরনের স্লোগান দিতে শোনা যাচ্ছে।

ঢাকা/লিটন/রাসেল 

.

উৎস: Risingbd

কীওয়ার্ড: চ কর চ কর আওয় ম ল গ

এছাড়াও পড়ুন:

একটি সাদাকালো ছবি

আলতাফ আমার কাছে একটি সাদাকালো ছবির নাম, আর সেই ছবিটা জুড়ে একটি বড় ইতিহাস। শোষকের বিরুদ্ধে একজন শিল্পীর বিপ্লবী হওয়ার ইতিহাস। 

সেই ১৯৪৮ সাল থেকেই মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘তরুণ মাহফিল’ সংঘের সঙ্গে যুক্ত হয়ে নিজের পিতার বিরুদ্ধে স্লোগান দেওয়া ছেলে তুমি আলতাফ। কালো অশুভ ছায়ার সঙ্গে লড়াই করতে করতে তুমি একটি কাঁথা আর তোমার বেহালা নিয়ে চলে এসেছিলে ঢাকাতে। সেখানে ধূমকেতু শিল্পী সংঘের নিজামুল হকের সাহচর্যে তোমার গণসংগীতের সঙ্গে পথচলা শুরু। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের প্রথম গান ‘মৃত্যুকে যারা তুচ্ছ করেছে ভাষা বাঁচাবার তরে’ তোমাকে এই বিপ্লবী পথে সুরে সুরে শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিল তখন থেকেই। তোমার সুর করা প্রথম ভাষা আন্দোলনের গান ছিল এটি।

তখন থেকেই আসলে তুমি হয়ে উঠেছিলে একুশের মধ্যমণি। সারা বাংলাদেশ চষে বেড়িয়েছ চারণকবির মতো। গান লিখেছ, সুর করেছ, ছায়ানৃত্য তৈরি করেছ, গীতিনাট্য রচনা করেছ। পূর্ব পাকিস্তান শিল্পী সংসদ, যুবলীগ, যুক্তফ্রন্টের মঞ্চ বা কোনো সাহিত্য-সংস্কৃতির সম্মেলন বা অনুষ্ঠানে তোমার অংশগ্রহণ ছিল দ্বিধাহীন। এর মধ্যেই তুমি সুর করে ফেলেছিলে বাংলাদেশের জন্য তোমার শ্রেষ্ঠ উপহার। অমর একুশের গান। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো’ কবিতাটি তোমার সুরে হয়ে উঠেছিল শোক, ঘৃণা, প্রতিরোধ আর মুক্তির জন্য অনন্য এক সৃষ্টি। 

তুমি মানুষকে কখনো ‘ওরে বাঙালি তোরা ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ দিয়ে কাঁদিয়েছ, আবার ‘আমি মানুষের ভাই স্পার্টাকাস’ দিয়ে উদ্বেলিত করেছ। ১৯৭০-এর ভয়াবহ বন্যায় তুমি গেয়ে উঠেছ ‘এই ঝঞ্ঝা মোরা রুখব, এই বন্যা মোরা রুখব’, পথে পথে অর্থ সংগ্রহ করেছ। একটি শিল্প কখন যে বিপ্লবে পরিণত হয়, সেটা তোমার জীবনের পথে যাত্রী না হলে বুঝে ওঠা মুশকিল।

একাত্তরের ২৫ মার্চ নিরীহ বাঙালি নিধনের যে পৈশাচিক যজ্ঞ শুরু করেছিল পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী, তার চাক্ষুষ সাক্ষী ছিলে তুমি। আবদুল লতিফ, তোমার ছায়াসঙ্গী হাফিজ, রাজা হোসেন প্রমুখকে নিয়ে দিনরাত আচ্ছন্নের মধ্যে গান লিখেছ, সুর করেছ। গানগুলো সবার অগোচরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে পৌঁছে দিতে তুমি, যেন বেতারে প্রচারিত গানগুলো উজ্জীবিত করে মুক্তিযোদ্ধাদের।

ওই সময়ে কলা, সবজি, কাগজের ফেরিওয়ালাদের আনাগোনা বেড়ে গিয়েছিল তোমার ৩৭০ নম্বর আউটার সার্কুলার রোডে। এসব ফেরিওয়ালার সঙ্গে তোমার দীর্ঘক্ষণের আলাপচারিতা মাকে বিস্মিত করত। মা পরে বুঝতে পেরেছিল ওরা সবাই ছদ্মবেশী মুক্তিযোদ্ধা—ঢাকার খবর সীমান্তের ওপারে মেলাঘরে পৌঁছে দেয়। এই অতিথিদের মাধ্যমে তুমি ওখানে টাকা পাঠাতে, তোমার গান পাঠাতে আর নিজের কাছে গড়ে তুলতে হালকা গোলাবারুদের মজুত।

ধীরে ধীরে তোমার ৩৭০ নম্বর বাড়িটি দুর্গে পরিণত হলো। ঢাকার গেরিলা আক্রমণের সূচনা তোমার হাত ধরে, তোমার ছায়াসঙ্গী যন্ত্রসংগীতশিল্পী শহীদ হাফিজের মতিঝিলে পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক লক্ষ্য করে গ্রেনেড নিক্ষেপের মধ্য দিয়ে। এর পর থেকেই ক্র্যাক প্লাটুন ও অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের আস্তানা ও অস্ত্রাগার হিসেবে তোমার বাসা হয়ে উঠেছিল অন্যতম। তুমি ধারণা করতে শিল্পীদের কেউ শত্রু মনে করে না। একাত্তরে সুরে সুরে তোমার সক্রিয় ভূমিকা ছিল অবরুদ্ধ ঢাকা শহরে গেরিলা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে।

একাত্তরের আগস্টের ৩০ তারিখ দুই ট্রাংক অস্ত্রসহ ভোরবেলা তোমাকে পাকিস্তানি বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। সঙ্গে ছিল তোমার শ্যালক, প্রতিবেশী, আশ্রয় নেওয়া মুক্তিযোদ্ধা। শত অত্যাচারেও কারও নাম বলোনি। উর্দুতে পারদর্শী আলতাফ একটি উর্দু শব্দ উচ্চারণ করোনি। তোমার সঙ্গের বন্দীদের জীবন দান করে গেছ তুমি।

আলতাফ, তোমার এই তিরোধান বাংলাদেশের ইতিহাসের একটি অংশ। তোমার লড়াই বাংলাদেশের একটি বিপ্লব। তোমার উন্নত শির এই স্বেচ্ছামৃত্যু একটি বীরগাথা। আলতাফ একটি দীর্ঘ পথের নাম, যেখানে আছে শুধু ‘স্বদেশ, স্বদেশ, স্বদেশ মোদের ঘর রে’।

প্রথম আলো, ১৪ ডিসেম্বর ২০১৩

লেখক: শহীদ আলতাফ মাহমুদের মেয়ে

সম্পর্কিত নিবন্ধ