ছেলের পাকা দালানের পাশে ঝুপড়িঘরে মা, ‘অযত্নের’ অভিযোগ নিয়ে থানায় মেয়েরা
Published: 7th, May 2025 GMT
ছৈয়দা খাতুনের খাটের দৈর্ঘ্য-প্রস্থের চেয়ে মাটির ঘরটি সামান্য বড়। খাটের ওপর তেল চিটচিটে একটি তোশক। দুটি বালিশও রয়েছে। এক প্রান্তে সারিবদ্ধ প্লাস্টিকের বস্তায় কিছু কাপড়, একটি ব্যাগ ও একটি ট্রাংক। খাটের একদিকে ছোটমতো একটি টেবিল। তাতে ছড়ানো-ছিটানো বাসনপত্রসহ মালামাল এবং অপর প্রান্তে একটি র্যাকে কিছু জিনিসিপত্র।
ঘরের ৪ ফুট বাই ১০ ফুট দৈর্ঘ্যের বারান্দার দুই প্রান্তেও কিছু মালামাল। মাঝের ফাঁকা অংশটি দিয়েই ঘরে যাতায়াত ছৈয়দার। তবে আলো চলাচলের যেন জায়গা নেই। প্রায় অন্ধকার ঘরের মাথার ওপর বাঁশের সঙ্গে ঝুলছে একটি অনিরাপদ টেবিল ফ্যান। জীবনসায়াহ্নে এই ঘরেই শুয়ে-বসে কাটছে তাঁর।
ছৈয়দার মাটির ঘরটির সঙ্গে লাগোয়া গোলাপি ও আকাশি রঙের একটি দ্বিতল ভবন। ভবনের নিচতলায় একটি বারান্দাও রয়েছে। এই ভবনেই স্ত্রী-সন্তান নিয়ে বসবাস করছেন ছৈয়দার একমাত্র ছেলেসন্তান সাজ্জাদ হোসেন (জুয়েল)। দিনের বেশির ভাগ সময় ঘরের প্রবেশপথে বসে থাকেন ছৈয়দা। ছেলে, পুত্রবধূ আর নাতনির হাঁটাচলা দেখেন। কিন্তু মুখ থেকে কথা বেরোয় না ছৈয়দার।
ছৈয়দা খাতুনের বাড়ি দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার পুনট্টি ইউনিয়নের খেড়কাটি গ্রামে। জাতীয় পরিচয়পত্রে জন্মসাল লেখা ১৯৪৫। সেই হিসাবে বয়স ৮০ বছর। যদিও ছৈয়দার দাবি, তাঁর বয়স ১০০ বছর পার হয়েছে। হাত-মুখের চামড়া কুঁচকে গেছে। হাঁটুর ব্যথায় কাতর হয়ে পড়েছেন। লাঠিতে ভর দিয়ে চলছেন। তবে চোখে সবকিছু পরিষ্কার দেখেন। সেই চোখে যেন ঘুরপাক খাচ্ছে অব্যক্ত কথার পঙ্ক্তিমালা।
ব্যক্তিজীবনে আট মেয়ে ও এক ছেলেসন্তানের জননী ছৈয়দা। মেয়েদের সবাই বিবাহিত, স্বামীর বাড়িতে আছেন তাঁরা। ছৈয়দার স্বামী একামউদ্দিন শাহ দরজির কাজ করতেন। পাশাপাশি কৃষিকাজও করতেন। ২০১২ সালে মারা যান একামউদ্দিন শাহ। স্বামীর মৃত্যুর পর একমাত্র ছেলে সাজ্জাদ কিছুদিন দেখভাল করেছেন। পরবর্তী সময়ে ছেলে ও পুত্রবধূর সঙ্গে মনোমালিন্যের কারণে পৃথক খাওয়া শুরু করেন। রান্না থেকে শুরু করে নিজের যাবতীয় কাজ একাই করতেন। বয়সের ভারে এখন শরীর চলে না তাঁর। এই বয়সে ছৈয়দার প্রতি একমাত্র ছেলের অযত্ন ও অবহেলার অভিযোগ এনে ২৬ এপ্রিল চিরিরবন্দর থানায় একটি লিখিত অভিযোগ করেছেন তাঁর ছোট মেয়ে কমলা খাতুন।
অভিযোগে বলা হয়েছে, সাজ্জাদ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী বিভিন্ন সময় ছৈয়দা বেগম ও তাঁর মেয়েদের নির্যাতন করেন। মায়ের ভরণপোষণ দেন না। থাকার জায়গাও দেন না। বাড়িতে ঢুকতে না দেওয়ায় মেয়েরা তাঁর মাকে দেখতেও যেতে পারছেন না। স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পাঠিয়ে মাকে বাড়ির বাইরে এনে সাক্ষাৎ করতে হয় মেয়েদের। ছৈয়দাকে গোসলখানাসহ পানি ব্যবহার করতে দেন না। শৌচকাজ করতে হয় বাড়ির বাইরে গিয়ে। মায়ের খাওয়ার জন্য বাইরে হোটেল ঠিক করে দিয়েছেন মেয়েরা।
গত শনিবার সকালে ছৈয়দার খোঁজ নিতে খেড়কাটি গ্রামে গিয়ে কথা হয় ছৈয়দা খাতুনের সঙ্গে। কেমন আছেন জানতে চাইলে এক চিলতে হাসিমুখে বললেন, ‘ভালো’। তারপর মাটির ঘরের বারান্দায় বসলেন। গল্প শুরু হলো। বয়স কত হয়েছে, সকালে কী খেয়েছেন? এসব প্রশ্ন করলে দোতলা ভবনের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকা নাতনির দিকে তাকান ছৈয়দা। খানিকটা ভেবেচিন্তে উত্তর দিলেন, বয়স ১০০ পার হবে মনে হয়। সকালে ভাত খেয়েছেন। মেয়েরা কেন থানায় অভিযোগ করল? প্রশ্ন করতেই দাদির আগে নাতনি উত্তর দেন, ‘না, উনি জানেন না। আপনারা যে ভিডিও করতেছেন অনুমতি নিয়েছেন?’ বাইরে থেকে কেউ খাবার দিয়ে যায় কি না এমন প্রশ্নে ছৈয়দা বলেন, ‘আগে দিছিল, এখন দেয় না।’
ছৈয়দার চার মেয়ের সঙ্গে কথা হয় প্রথম আলোর। ভাই-ভাবি বাড়িতে ঢুকতে দেন না দেখে প্রায় আট মাস মায়ের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ হয়নি বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। লায়ারজু সিদ্দিকা বলেন, ‘বাবাও অসুস্থ ছিল। তার দেখভাল করত না ভাই। বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই আমরা বোনেরা মায়ের দেখভাল করি। বোনেরা কেউ এক মাস, কেউ দুই মাস মাকে আমাদের সঙ্গে রাখতাম। কিন্তু কিছুদিন থাকার পরেই মা ছেলেকে দেখার জন্য অস্থির হয়ে যায়। আবার বাড়িতে রেখে আসি। টয়লেট ব্যবহার করা তো দূরের কথা, ভাবি বাড়ির টিউবওয়েলের পানিটা পর্যন্ত মাকে ব্যবহার করতে দেয় না।’
কমলা খাতুন বলেন, ‘থানায় অভিযোগ করার পর ২৮ এপ্রিল বাসায় পুলিশ আসছিল। মায়ের সঙ্গে ওই দিন দেখা করার সুযোগ হয়। পুলিশ তাদের মতো করে বলে গেছে। পরের দিন থেকে হোটেল থেকে খাবার পাঠানো বন্ধ আছে। শুনতেছি এখন মাকে খাবার দেয়। কিন্তু আমরা তো জানতে পারছি না। কারণ, ওই বাড়িতে আমাদের ঢুকতেই দেয় না।’ কমলা বলেন, ‘আমাদের একটাই চাওয়া, শেষ বয়সে মা একটু সেবাযত্ন পাক। ঘরটা একটু মেরামত করে দিক।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ছৈয়দার স্বামী একামউদ্দিনের ১২-১৪ বিঘা জমি ছিল। মৃত্যুর আগে মেয়েদের চার শতক করে লিখে দিয়ে অবশিষ্ট সব জমি দিয়েছেন ছেলের নামে। স্ত্রীর নামে দিয়েছেন ১৫ কাঠা। বাবার মৃত্যুর পরে সাজ্জাদ বোনদের কাছে সম্পত্তি ওছিয়ত করে যাওয়ার বিষয়টি জানান।
মায়ের প্রতি এমন অবহেলার অভিযোগ বিষয়ে জানতে মুঠোফোনে কথা হয় ছেলে সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে। তিনি স্থানীয় গমীরহাট উচ্চবিদ্যালয়ের শিক্ষক। তাঁর স্ত্রীও শিক্ষকতা করেন। সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘এসব অভিযোগ মিথ্যা। আমার মা তো বাড়িতেই থাকে, আমি কি বের করে দিয়েছি? মায়ের জন্য একটা ঘর নির্মাণ করতেছি। সময় তো লাগবে। আমি তো নিচতলায় থাকি মায়ের দেখাশোনা করার জন্য। বোনেরা বাড়িতে এসে মাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে।’
আপনার স্ত্রী শাশুড়িকে দেখাশোনা করেন কি না জানতে চাইলে সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘কার স্ত্রী কার মাকে কতটুকু দেখবে, এটা কেউ গ্যারান্টি দিতে পারে? আমার মাকে আমি দেখব। আমার স্ত্রীর বিরুদ্ধে অভিযোগের কোনো আইন খাটে না।’
চিরিরবন্দর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুল ওয়াদুদ বলেন, ‘ছেলে মায়ের ভরণপোষণ ও সেবাযত্ন করেন না—এমন একটি অভিযোগ পেয়েছি। আমরা সেটি পারিবারিকভাবে মীমাংসা করে দিয়েছি। তারপরও ওই লোক বোনদের বাড়িতে ঢুকতে দেয় না, গালিগালাজ করে। সর্বশেষ ওই নারীর চার মেয়ে থানায় এসেছিল। আমরা বিষয়টি দেখতেছি।’
এ ব্যাপারে চিরিরবন্দর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফাতেমা তুজ জোহরা প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিষয়টি জানতে পেরে সাজ্জাদ হোসেনকে ডেকে কথা বলেছি। তিনি বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। বোনেরা তার পেছনে লেগে আছে—এমনটাই জানিয়েছেন। তবে আমি তাঁর বাসায় গিয়ে বিষয়টি অধিকতর তদন্ত করব।’
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
মহাসড়কের পাশে পড়ে ছিল পলিথিন, খুলতেই বের হলো কাটা হাত
নাটোরে পলিথিনে মোড়ানো মানুষের কাটা হাত উদ্ধার করেছে পুলিশ। বুধবার রাত ৮টার দিকে শহরতলীর দত্তপাড়া এলাকায় মহাসড়কের পাশে পড়ে থাকা পলিথিনে হাতের কাটা অংশ মোড়ানো ছিল।
এ তথ্য নিশ্চিত করেছে সদর থানার ওসি মাহাবুর রহমান। তিনি বলেন, উদ্ধার হওয়া হাতের কাটা অংশ কোনো যানবাহন থেকে নদীতে ছুড়ে ফেলার চেষ্টা করে দুর্বৃত্তরা। কিন্তু সেটি ছুড়ে ফেলার পর নদীতে না পৌঁছে মহাসড়কের ওপরে পড়ে যায়। পরে পলিথিনে মোড়ানো এ কাটা হাত দেখতে পেয়ে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দেন। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে হাতের কাটা অংশটি উদ্ধার করে। প্রাথমিকভাবে এটি কোনো বয়স্ক মানুষের হাত বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত চলছে। আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।