মোটরসাইকেলের ধাক্কা নিয়ে বহিরাগতদের সঙ্গে বিরোধের জেরে শাহরিয়ার আলম সাম্য খুন হয়েছেন, নাকি অন্য কারণও আছে, তা নিয়ে তদন্তে নেমেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। গ্রেপ্তার তিনজন ছাড়াও তৃতীয় কেউ এ হত্যায় জড়িত থাকতে পারে বলে প্রাথমিক আভাস পাওয়ার দাবি করছে পুলিশ। তবে আরও কিছু বিষয় খোলাসা হওয়ার আগে হত্যার কারণ ও জড়িতদের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসছেন না তদন্ত-সংশ্লিষ্টরা। গতকাল বৃহস্পতিবার পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।

সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থী ও হল শাখা ছাত্রদল নেতা সাম্য খুনের ঘটনায় এখন পর্যন্ত তিন যুবককে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। আলামত হিসেবে জব্দ করা হয়েছে খুনে অভিযুক্ত তিনজনের ব্যবহৃত একটি মোটরসাইকেল। মঙ্গলবার রাতে হত্যার পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ওই মোটরসাইকেল নিয়ে তামিম হাওলাদার ও সম্রাট মল্লিক পান্থপথের শমরিতা হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে যান। সেখান থেকে তাদের গ্রেপ্তার ও মোটরসাইকেল জব্দ করে পুলিশ।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশের কাছে গ্রেপ্তার তিনজন সাম্য হত্যায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে পুলিশ বলছে, হেফাজতে এনে তাদের বিশদ জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। শনিবার তাদের রিমান্ড শুনানি হওয়ার কথা রয়েছে। 

সাম্যের পরিবার শুরু থেকে বলছে, এই হত্যা পরিকল্পিত। সাম্যের ভাই বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় যে মামলা করেছেন, সেই এজাহারে বলা হয়, পূর্বপরিকল্পিতভাবে সাম্যকে হত্যা করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ জন এতে সম্পৃক্ত ছিল। 

গতকাল এক অনুষ্ঠানে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সাম্য হত্যার নেপথ্যে রাজনৈতিক কারণ আছে। সাম্য ছাত্রদলের এ এফ রহমান হলের একটি সম্পাদকীয় পদে রয়েছেন। পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে তিন ভবঘুরেকে। রাজনৈতিক কারণ না থাকলে সুদর্শন একটা ছেলেকে ভবঘুরেরা কেন হত্যা করবে? 
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক তৌফিক হাসান বলেন, মঙ্গলবার রাতে তিনজনকে গ্রেপ্তারের পর সাম্যের বন্ধুরা তাদের শনাক্ত করেছেন। গ্রেপ্তার তিনজন ঘটনাস্থলে ছিল বলে জানান তারা। পুলিশ সূত্র জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা প্রায়ই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যেত। সেখানে গিয়ে তারা মাদক সেবন করত কিনা, তাও খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আরও কেউ হত্যায় জড়িত কিনা, তা বের করার চেষ্টা চলছে।  তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত হত্যার কারণ নিয়ে পরিষ্কার কিছু বলা যাবে না। তবে প্রাথমিক তথ্য হলো, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বের হওয়ার সময় মোটরসাইকেলে ধাক্কা থেকে ঘটনার সূত্রপাত। নিহত সাম্যের ডান পায়ের ঊরুর পেছনে ধারালো অস্ত্রের গুরুতর জখমের চিহ্ন রয়েছে।   

স্থানীয় ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাম্য হত্যায় জড়িত সন্দেহে তামিম হাওলাদার, পলাশ সরদার ও সম্রাট মল্লিক নামে যে তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, তারা মাদারীপুরের বাসিন্দা। ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারে এক রুমের একটি বাসায় তিনজন থাকতেন। কাপড়ের ব্যবসা ও একই এলাকার বাসিন্দা হওয়ায় তাদের মধ্যে ভালো সম্পর্ক ছিল।   

পূর্ব রাজাবাজারের যে ভাড়া বাসায় তারা বাস করতেন, সেখানে গতকাল দেখা যায়, পাঁচতলা ভবনের দোতলায় তাদের কক্ষে তালা ঝুলছে। ভবনের নিচতলায় বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক ইমরান হোসেনের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, মঙ্গলবার রাত ৪টার দিকে তামিমকে সঙ্গে নিয়ে বাসায় পুলিশ আসে। সোজা দোতলায় তাদের বাসায় গিয়ে পলাশকে নিয়ে বেরিয়ে যায় পুলিশ। ওই বাসা সম্রাট ও রাফি নামে দু’জন ভাড়া নেন। ভাড়া ঠিক করার সময় তারা জানান, রুমে তাদের দোকানের কয়েকজন কর্মচারী থাকবেন। তবে অগ্রিম টাকা দেওয়ার সময় রাফি ছাড়া আর কাউকে দেখেননি। বাসা ভাড়ার রসিদেও রাফি ও সম্রাটের নাম পাওয়া গেছে।

বাসার তত্ত্বাবধায়ক বলেন, পাঁচতলা ভবনে ১০টি ফ্ল্যাট রয়েছে। এর মধ্যে চারতলার দুই ফ্ল্যাটে শিক্ষার্থীরা ভাড়া থাকেন। আর দোতলার একটি ফ্ল্যাটের দুটি কক্ষে একজন দোকানি এবং একটি কক্ষে বাসার তত্ত্বাবধায়ক ইমরান, তাঁর সহযোগী শানারুল ইসলাম হিমেলসহ দু’জন থাকার কথা। তবে চলতি মাসে সেই কক্ষ রাফির কাছে ভাড়া দিয়ে বাসার চিলেকোঠায় থাকতেন তারা। 

সম্রাটদের সঙ্গে একই রুমে ভাড়া থাকতেন গোপালগঞ্জের তন্ময় রায় নামে আরেকজন। ঘটনার পর থেকে তিনিও বাসা ছেড়ে চলে গেছেন। তন্ময় গতকাল বলেন, মঙ্গলবার গভীর রাতে পলাশ বাসায় এলে তাকে দরজা খুলে দিই আমি। তার পর ভোরের দিকে তাকে ধরে নিয়ে যায় পুলিশ। এর পর আমিও বাসা ছেড়ে গাজীপুরে চলে আসি। ২০ এপ্রিল থেকে ফার্মগেট এলাকায় কাপড়ের ব্যবসা করছি। এর আগে পড়ালেখা করতাম। মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিষয়ে আমি কিছু জানি না।  

সাম্য হত্যায় মাদারীপুরের তিন যুবককে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়, গ্রেপ্তার আসামিরা ফার্মগেট এলাকায় ফুটপাতে গেঞ্জির ব্যবসা করেন। ১৫-২০ দিন আগে মাদারীপুর থেকে ঢাকায় আসেন। ঘটনার দিন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মাদক সেবনের জন্য গিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার একজন একসময় গাজীপুরে থাকতেন। সেখানে তিনি কাপড়ের ব্যবসা করতেন।  

গতকাল দুপুরের পর ফার্মগেট গোলচত্বরে ফোকাস কোচিং সেন্টারের সামনের ফুটপাতে একাধিক বিক্রেতার সঙ্গে কথা হয়। গ্রেপ্তার তিনজনের ছবি দেখানো ও নাম বলার পর একাধিক দোকানি তামিমকে চিনতে পারেন। সে প্রায়ই মোটরসাইকেল নিয়ে ফার্মগেটে আসত, চা খেয়ে আড্ডার পর চলে যেত। 

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট আরেকটি সূত্র জানায়, সাম্য হত্যার আদ্যোপান্ত বের করতে নানামাত্রিক তদন্ত চলছে। আশপাশ এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহের চেষ্টা করছে পুলিশ। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকেন্দ্রিক বৈধ ও অবৈধ কারবারে কারা কীভাবে জড়িত ছিল, তাদের নাম-পরিচয় বের করতে চান তদন্তসংশ্লিষ্টরা। ক’টি গ্রুপ কীভাবে উদ্যানে দোকানসহ অন্যান্য ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত, তা জানার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ঘটনাস্থল থেকে একটি মানিব্যাগ পাওয়া গেছে। আলামত হিসেবে তা জব্দ করা হয়েছে।  

সাম্যের ঘনিষ্ঠ বন্ধু নাজমুল ইসলাম সমকালকে বলেন, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে সাম্যসহ তিনজন গিয়েছিল মোটরসাইকেলে। আর আমি বাইসাইকেলে যাই। কাবাব খাওয়া শেষে আমি আগে চলে আসি। পরে শুনি, সাম্যকে ‘হিট’ করা হয়েছে। হাসপাতালে গিয়ে দেখি সাম্যের ঊরুতে জখম। আসলে রক্তক্ষরণে হাসপাতালে পৌঁছার আগে সে মারা গেছে। 

মাদারীপুরের স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার সম্রাট একসময় রাজমিস্ত্রি ও দিনমজুরের  কাজ করতেন। এলাকায় তিনি শ্রমিক দলের কমিটিতে ছিলেন। পরে ওই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়। আর পলাশ ও তামিম ঢাকায় ফুটপাতে ব্যবসা করতেন। 

মাদারীপুরের ডাসারের বাসিন্দা মাইনুল ইসলাম সমকালকে বলেন, ঢাকার ৩০০ ফিট, টিএসসিসহ  আশপাশে তারা একটি চক্রের সঙ্গে চাঁদাবাজি করত বলে শুনেছি। এলাকায় তেমন প্রভাব বিস্তার করতে না পারলেও মাদকের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল। ডাসার থানার ওসি শেখ এহতেশামুল ইসলাম বলেন, সম্রাটের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় তিনটি মাদক মামলা রয়েছে। 

মাদারীপুর সদর থানার ওসি আদিলুর রহমান বলেন, একসময় পলাশ ও তামিমের স্থানীয় নেতাকর্মীর সঙ্গে উঠবস ছিল। তামিমের বিরুদ্ধে গাজীপুরের গাছা থানায় অর্থ আত্মসাতের একটি মামলা আছে। 

(প্রতিবেদনে তথ্য দিয়েছেন মাদারীপুর প্রতিনিধি ফরিদ উদ্দিন মুপ্তি)

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: হত য গ র প ত র ত নজন স ম য হত য ল ইসল ম র ব যবস এল ক য় থ কত ন ব দ কর ত র কর হত য র করত ন র একট তদন ত গতক ল

এছাড়াও পড়ুন:

ইস্তাম্বুলে ‘শান্তি আলোচনা’য় বসছে রাশিয়া-ইউক্রেন

তিন বছরের মধ্যে এই প্রথম শান্তি আলোচনায় বসতে যাচ্ছে যুদ্ধরত দুই দেশ রাশিয়া ও ইউক্রেন। শুক্রবার (১৬ মে) তুরস্কের রাজধানী ইস্তাম্বুলে দুই দেশের প্রতিনিধিদল বৈঠক করবেন।

শান্তি আলোচনায় থাকবেন না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ও ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি। ক্রেমলিনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ভ্লাদিমির পুতিন এ আলোচনায় অংশ নেবেন না। তার অনুপস্থিতির প্রতিবাদে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিও এ আলোচনায় যোগ না দেওয়ার সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, শুক্রবার সকালে ইস্তাম্বুলে ব্রিটেন, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি ও ফ্রান্সের নিরাপত্তা উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছে ইউক্রেনের প্রতিনিধিদল। এ প্রতিনিধিদলে আছেন ইউক্রেনের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অ্যান্ড্রি ইয়েরমাক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্ড্রি সাইবিহা এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী রুস্টেম উমেরোভ।

এদিকে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও জানিয়েছেন, তুরস্কে অনুষ্ঠিতব্য ইউক্রেন-রাশিয়া শান্তি আলোচনায় বড় কোনো অগ্রগতি হবে বলে তিনি আশাবাদী নন। 

ঢাকা/রফিক

সম্পর্কিত নিবন্ধ