আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও কূটনীতির আজব ঘটনাপ্রবাহে যেন আর বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। কারণ, একের পর এক উদ্ভট ঘটনা ঘটেই চলেছে। সেই ধারাবাহিকতায় এবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দিয়েছেন।

গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর চলমান গণহত্যায় যিনি নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সেই লোক এখন এমন এক ব্যক্তিকে শান্তির জন্য বিশ্বের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারের প্রার্থী করছেন, যিনি কিনা এই গণহত্যার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।

গত মার্চে ট্রাম্প ঘোষণা দিয়েছিলেন, তিনি ইসরায়েলকে ‘গাজায় কাজ শেষ করতে যা কিছু দরকার’ তার জন্য সবকিছু পাঠাবেন। সেই ‘সবকিছুর’ মধ্যে রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের মারাত্মক অস্ত্র ও অন্যান্য সহায়তা। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত গাজার এই ছোট্ট ভূখণ্ডে শুধু আনুষ্ঠানিক নথিপত্রের হিসাবমতে, প্রায় ৬০ হাজার ফিলিস্তিনিকে হত্যা করা হয়েছে। এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে কত মানুষ চাপা পড়ে আছেন, তার কোনো হিসাব নেই।  

বিভিন্ন গণমাধ্যম কীভাবে ট্রাম্পের শান্তির নোবেল পুরস্কারের মনোনয়ন নিয়ে গম্ভীর মুখে সিরিয়াস ভঙ্গিতে খবর পরিবেশন করতে পারছে, সেটিই সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সিএনএন তাদের খবরে বলেছে, এই পুরস্কার এখন ট্রাম্পের একধরনের চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষায় পরিণত হয়েছে। তিনি মনে করেন, সারা পৃথিবীতে সংঘাত বন্ধে তাঁর প্রচেষ্টার জন্য তিনি এই পুরস্কারের যোগ্য।

গত সোমবার ট্রাম্পকে জানানো হয়, তিনি নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। ওই দিনই নেতানিয়াহু হোয়াইট হাউসে নৈশভোজে অংশ নিতে হাজির হন। এটি ছিল ২০২৫ সালে তাঁর ওয়াশিংটনে তৃতীয় সফর। নেতানিয়াহুকে ধন্যবাদ জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, ‘বাহ্‌…বিশেষ করে আপনার কাছ থেকে আসায় এটি সত্যিই অনেক অর্থবহ হলো।’

নেতানিয়াহু যখন ট্রাম্পকে নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন দেন এবং সেটিকে যখন ট্রাম্প ‘অর্থবহ’ বলে উল্লেখ করেন, তখন তা শুনে হাসি পায়। কারণ, যিনি যুদ্ধ আর গণহত্যায় জড়িত, তাঁকে শান্তির জন্য পুরস্কার দেওয়ার কথা বলা—এটা এতটাই অবাস্তব আর মিথ্যা যে ‘অর্থবহ’ শব্দ দিয়ে সেই হাস্যকর বাস্তবতাকে বোঝানো যায় না। 

ট্রাম্প যখন ইরানে চালানো বড় হামলার বিষয়ে কথা বলছিলেন, (যা তাঁকে শান্তির পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দিয়েছে) তখন তিনি এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ হত্যা করা হামলার সঙ্গে প্রশংসাসূচকভাবে তুলনা করেছেন। 

২০০৯ সালে এই সম্মানজনক পুরস্কার দেওয়া হয়েছিল সদ্য দায়িত্ব নেওয়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকে, যিনি পরে ‘আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে’ আফগানিস্তান, পাকিস্তান, লিবিয়া, ইয়েমেন, সোমালিয়া, ইরাক ও সিরিয়াতে বোমাবর্ষণ করেছিলেন। 

নোবেল শান্তি পুরস্কার যাঁদের দেওয়া হয়েছে, তাঁদের মধ্যে আরেকজন ছিলেন কলম্বিয়ার ডানপন্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট হুয়ান মানুয়েল সান্তোস। 

২০১৩ সালে ইসরায়েলি পত্রিকা হারেৎজ জানায়, সান্তোস গর্ব করে বলেছিলেন, তাঁর দেশকে ‘লাতিন আমেরিকার ইসরায়েল’ বলা হলে তিনি খুশি হন। অথচ সান্তোসের নাম জড়িয়ে আছে বহুল আলোচিত ‘ফলস পজিটিভ’ কেলেঙ্কারির সঙ্গে, যেখানে কলম্বিয়ার সেনারা প্রায় ১০ হাজার বেসামরিক মানুষকে হত্যা করে তাঁদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চালিয়ে দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুনট্রাম্পের নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়ার সম্ভাবনা কতটা১১ জুলাই ২০২৫

নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া আরেকজন হলেন প্রয়াত ইসরায়েলি রাজনীতিক শিমন পেরেজ। ১৯৯৪ সালে তিনি এই পুরস্কার যৌথভাবে পেয়েছিলেন। অথচ এই ঘটনার মাত্র দুই বছর পর, ১৯৯৬ সালে তিনি লেবাননের কানা শহরে জাতিসংঘের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থানরত ১০৬ শরণার্থীকে হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন। 

এখন যখন ফিলিস্তিনে গণহত্যাকেও প্রায় স্বাভাবিক করে ফেলা হয়েছে, ট্রাম্প তখন প্রস্তাব করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র যেন গাজা ভূখণ্ড দখল করে নেয়, সেখানে থাকা ফিলিস্তিনি জনগণকে জোরপূর্বক উৎখাত করে এবং পুরো বিধ্বস্ত অঞ্চলটিকে নতুন করে গড়ে তোলে একেবারে ‘মধ্যপ্রাচ্যের রিভিয়েরা’ (বিলাসবহুল পর্যটনকেন্দ্র) হিসেবে। অর্থাৎ ট্রাম্পের কাছে এই রকম চিন্তা করাও যেন শান্তির নোবেল পুরস্কারের যোগ্যতা। 

ওয়াশিংটনে নেতানিয়াহু ও ট্রাম্পের বৈঠক নিয়ে দ্য টাইমস অব ইসরায়েল ‘নেতানিয়াহুর চমক: ট্রাম্পকে নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন, দুই নেতার গাজাবাসীকে উৎখাতের আলোচনা’ শিরোনামে খবর ছেপেছে।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইরানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সামরিক হামলা ‘মধ্যপ্রাচ্যের চেহারা বদলে দিয়েছে’ এবং এর ফলে ‘আব্রাহাম চুক্তি’ আরও সম্প্রসারিত করার সুযোগ তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত ফিলিস্তিন নামক দেশটিকে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই হয়তো ‘জাতির মধ্যে ভ্রাতৃত্ব’ প্রতিষ্ঠা করার অর্থ হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

ট্রাম্প যখন ইরানে চালানো বড় হামলার বিষয়ে কথা বলছিলেন, (যা তাঁকে শান্তির পুরস্কারের মনোনয়ন এনে দিয়েছে) তখন তিনি এটিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় মার্কিন প্রেসিডেন্ট হ্যারি ট্রুম্যানের জাপানের হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে কয়েক লাখ বেসামরিক মানুষ হত্যা করা হামলার সঙ্গে প্রশংসাসূচকভাবে তুলনা করেছেন। 

এটি না বললেও বোঝা যায় যে কেউ যদি কয়েক লাখ নিরীহ মানুষের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলার ঘটনার প্রশংসা করেন, তাহলে তিনি কোনোভাবেই শান্তির মতো কোনো গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারের যোগ্য হতে পারেন না। কিন্তু আজকের এমন এক বিশ্বে, যেখানে ‘শান্তি প্রতিষ্ঠার’ অজুহাতে বারবার যুদ্ধ চালানো হয়, সেখানে ট্রাম্পের এই মনোনয়ন হয়তো তাদের ভাষায় ‘খুব বাস্তব’ ও ‘যথার্থ’। 

বেলেন ফার্নান্দেজ সাংবাদিক ও লেখক

আল-জাজিরা থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনুবাদ: সারফুদ্দিন আহমেদ

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ন ব ল প রস ক র র য ক তর ষ ট র ত র জন য ইসর য় ল গণহত য কর ছ ন

এছাড়াও পড়ুন:

জুলাই গণহত্যার দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন চৌধুরী মামুন

জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় স্বীকার করেছেন সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন। ট্রাইব্যুনালে তিনি বলেছেন, ‘আমি জুলাই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত।’

জুলাই গণহত্যা চলাকালীন পুলিশ প্রধানের দায়িত্ব পালন করা চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘এই মামলায় আমি রাজসাক্ষী হতে চাই।’

আজ বৃহস্পতিবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ বক্তব্য দেন তিনি।

এর আগে জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ (চার্জ) গঠন করেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনাল। বিচারপতি মো গোলাম মোর্তোজা মজুমদারের নেতৃত্বে তিন সদস্যের ট্রাইবুনাল আজ এ অভিযোগ গঠন করেন। 

অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে পুনর্গঠিত ট্রাইব্যুনালে দাখিল করা হাসিনার বিরুদ্ধে প্রথম কোনো মামলার বিচার শুরু হল। পাশাপাশি এ মামলার সব সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য আগামী ৩ আগস্ট দিন ধার্য করেন ট্রাইবুনাল। 

মামলার অপর দুই আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও কারাগারে থাকা সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন। অভিযোগ গঠনের সময় মামুন ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত ছিলেন। 

ট্রাইব্যুনালের অপর দুই সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদ ও বিচারক মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। 

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • গাজায় নিহতের সংখ্যা ৫৭ হাজার ৮০০ ছাড়াল
  • ইসরায়েল–যুক্তরাষ্ট্রের গাজা নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার কে এই আলবানিজ
  • সংস্কার ছাড়া নির্বাচন হলে নতুন ফ্যাসিবাদের জন্ম হবে: মামুনুল হক
  • বিবৃতিদাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের শাস্তি দাবি সাদা দলের
  • জুলাই গণহত্যা: শেখ হাসিনাসহ ৩ জনের আনুষ্ঠানিক বিচার শুরু
  • জুলাই গণহত্যার দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন সাবেক আইজিপি চৌধুরী মামুন
  • জুলাই গণহত্যার দায় স্বীকার করে রাজসাক্ষী হলেন চৌধুরী মামুন
  • ইসরায়েলের সমালোচনা করায় জাতিসংঘ প্রতিনিধির ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা