সরকারের গণপরিবহন ট্রেন ধীরে ধীরে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। অনলাইনভিত্তিক টিকিট বিক্রির বর্তমান যে ব্যবস্থা, তাতে দেশের মাত্র ৫২ লাখ মানুষ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারছে। কালোবাজারি বন্ধের কথা বলে টিকিট বিক্রি অনলাইনভিত্তিক করা হয়েছে। তবে এতে সবচেয়ে বেশি লাভ হয়েছে টিকিটি বিক্রির দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের। একটি টিকিট বিক্রির বিনিময়ে মাত্র ২৫ পয়সা নেওয়ার কথা বলে দায়িত্ব পাওয়া ঠিকাদার এখন পাচ্ছে সাড়ে ছয় টাকা।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, বিগত এক দশকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত রাজনীতিক ও রেলের কর্মকর্তারা শুধু আন্তনগর ট্রেন চালুতে জোর দিয়েছেন বেশি। বিপরীতে তাঁরা বন্ধ করে দিয়েছেন ৯৩টি লোকাল, মেইল ও কমিউটার ট্রেন। ফলে নিম্ন আয়ের এবং স্বল্প দূরত্বে যাতায়াতকারী মানুষের ট্রেনে চড়ার সুযোগ এমনিতেই কমে গেছে। ২০২৩ সাল থেকে টিকিট বিক্রির কার্যক্রম পুরোপুরি অনলাইনকেন্দ্রিক করে ফেলা হয়। এতে আরেক দফা অনলাইন সুবিধা না থাকা ব্যক্তিরা ট্রেনে চড়া থেকে অনেকটা দূরে সরে গেছেন।

আরও পড়ুনঈদে ট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু ১৪ মার্চ, স্টেশন-টার্মিনালে থাকবে সিসিটিভি০৯ মার্চ ২০২৫

রেলের হিসাবে, এখন প্রায় ৭১ শতাংশ টিকিট বিক্রি হয় অনলাইনে। বাকি যে ২৯ শতাংশ টিকিট কাউন্টারে বিক্রি হয়, এর প্রায় সবই কম গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ মাঝপথের কম গুরুত্বপূর্ণ এক স্টেশন থেকে আরেক স্টেশনে যাওয়ার টিকিটই বেশি বিক্রি হয় কাউন্টারে। এ ছাড়া কাউন্টারে টিকিট কাটার সময় মোবাইল ফোনে ওটিপি নম্বর আসে। গ্রাহক তা দেখালে টিকিট পান। এতে টিকিট কাটতে বেশ সময় লাগছে।

এসব ব্যবস্থা রাষ্ট্রীয় এই গণপরিবহন দেশের শিক্ষিত ও তথ্যপ্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন মানুষের বাহনে পরিণত হয়েছে কি না, সেই প্রশ্নও উঠেছে। সব মিলিয়ে অপেক্ষাকৃত কম আয়ের কিংবা গ্রামাঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের জন্য রেলের টিকিট কাটা কঠিন হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, অনলাইনে টিকিট বিক্রির উদ্যোগটি ভালো। এতে ইন্টারনেট ব্যবহারে দক্ষ ব্যক্তিরা সহজে টিকিট কাটতে পারছেন। তবে ভালো আসনের টিকিট দ্রুত কেন শেষ হয়ে যায়, দালালেরা ভালো টিকিট আগে থেকে কেটে রাখে কি না, ইন্টারনেট সুবিধাবিহীন মানুষ টিকিট পায় কি না, সে বিষয়গুলো দেখা উচিত; পর্যালোচনা করা উচিত।

২০২২ সাল থেকে রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্বে আছে যৌথভাবে সহজ ডটকম-সিনেসিস-ভিনসেন। প্রতি টিকিট বিক্রির বিনিময়ে তারা ২৫ পয়সা নেবে—এই শর্তে দায়িত্ব পায়। আর অনলাইনে টিকিট বিক্রির জন্য তাদের চার্জ হিসেবে সাড়ে ছয় টাকা পাওয়ার কথা ছিল আগের নিয়ম অনুযায়ী। সহজ দায়িত্ব নেওয়ার আগে ২০ শতাংশ টিকিট অনলাইনে বিক্রি হতো। এখন অনলাইনে টিকিট বিক্রি বেড়ে যাওয়ায় সাধারণভাবে টিকিটপ্রতি ২৫ পয়সার পাশাপাশি অনলাইন মাশুলের পরিমাণ বেড়ে গেছে।

রেলপথ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে বিক্রির শুরুতেই সব টিকিটি শেষ—এমন অভিযোগ আছে। তিনি বিষয়টি খতিয়ে দেখছেন। মানুষ কীভাবে সহজে টিকিট পাবে, সেটা নিয়ে একটা বিশেষজ্ঞ দল কাজ করছে। অনলাইনে টিকিট কাটার ক্ষেত্রে বাড়তি টাকা ঠিকাদারের পকেটে যাওয়ার বিষয়ে উপদেষ্টা বলেন, বিষয়টি তিনি দেখবেন।

আরও পড়ুনসচিব–কর্মকর্তার ফোনে ট্রেনের টিকিট রাখা যাবে না: ফাওজুল কবির খান২৯ অক্টোবর ২০২৪৩ শতাংশ মানুষ টিকিট পাবেন

রেলের টিকিট বিক্রির ব্যবস্থাটির নাম বাংলাদেশ রেলওয়ে ইন্টিগ্রেটেড টিকেটিং সিস্টেম (বিআরআইটিএস)। এই ব্যবস্থা চালুর পর ট্রেনের টিকিট পেতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে প্রথমে নিবন্ধন করতে হয়। এরপরই অনলাইনে (মোবাইল অ্যাপ ও ওয়েবসাইট) টিকিট কাটা যায়।

রেলের সূত্র জানায়, টিকিট পেতে গত অক্টোবর পর্যন্ত ৫২ লাখ ৫৫ হাজার ৯১০ জন নিবন্ধন করেছেন। সর্বশেষ জনশুমারি অনুসারে, দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। এ হিসাবে, দেশের মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র ৩ দশমিক শূন্য ৯ শতাংশ মানুষ ট্রেনের টিকিট কাটতে পারবেন। একজন ব্যক্তি একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটতে পারেন। এ সুযোগ নিলে আরও কিছু মানুষ ট্রেনের টিকিটের আওতায় আসে। এরপরও বিপুল সংখ্যায় মানুষ ট্রেনসেবার আওতার বাইরে রয়ে গেছেন।

টিকিটের নিবন্ধন করতে হলে জাতীয় পরিচয়পত্রের নম্বর ও জন্মতারিখ দিয়ে রেলসেবা অ্যাপ বা রেলের ওয়েবসাইটে নানা তথ্য জমা করতে হয়। এ ক্ষেত্রে ইন্টারনেট সেবা থাকা এবং এই বিষয়ে জ্ঞান থাকা জরুরি। এ ছাড়া মুঠোফোনে জাতীয় পরিচয়পত্র ও জন্মতারিখ দিয়ে এসএমএস করেও নিবন্ধন করা যায়। এ ক্ষেত্রেও মুঠোফোন থাকা এবং তা দিয়ে নিবন্ধনের নিয়ম জানতে হবে। রেলের পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তেমন প্রচারণাও চালানো হয়নি।

আরও পড়ুনট্রেনের টিকিট শেষ দুই মিনিটেই, এ কেমন ডিজিটাল সমাধান?২৫ জানুয়ারি ২০২৫

নিবন্ধনের পর আগ্রহী ব্যক্তির স্মার্টফোন বা কম্পিউটার জাতীয় ডিভাইস থাকতে হবে। তারপর এতে থাকতে হবে ইন্টারনেট সংযোগ। এ ছাড়া অনলাইনে টিকিট কাটার টাকা পরিশোধ করার জন্য ব্যাংকের কার্ড ও মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট থাকতে হবে। কারণ, টাকা পরিশোধ করতে হয় অনলাইনে।

জনশুমারি অনুসারে, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩১ শতাংশ। পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, দেশে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ নাগরিক কম্পিউটার ব্যবহার করেন, ল্যাপটপ ব্যবহারকারীর সংখ্যা ২ দশমিক ৯ শতাংশ, আর মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ। কিন্তু এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ ফিচার ফোন ব্যবহারকারী।

এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক বি এম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, দেশের অর্ধেক মানুষ ইন্টারনেট ব্যবহার করেন না। স্মার্টফোনের ব্যবহার এখনো কম। ডিজিটাল বৈষম্য এখানে অনেক থাকার পরও একটি সেবাকে পুরোপুরি অনলাইনে করে সাধারণ মানুষদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। রেলের টিকিট একবারের জন্য নয়। এটা প্রতিনিয়তই লাগে। অনলাইন সেবা অবশ্যই থাকতে হবে। কিন্তু যাঁরা পিছিয়ে আছেন, তাঁদের জন্যও বিকল্প ব্যবস্থা রেখে এ ধরনের সেবা চালু করতে হতো। যাঁরা ডিজিটাল সেবা গ্রহণে পিছিয়ে আছেন, তাঁদের জন্য রেলের বিকল্প ব্যবস্থা কী, সে বিষয়ে ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

বর্তমানে প্রতিদিন আন্তনগর ট্রেনের প্রায় ৩০ হাজার টিকিট বিক্রি হয়। একই সময়ে অনলাইন ও কাউন্টারে টিকিট ছাড়া হয়। স্বভাবতই প্রথম ঘণ্টাতেই অনলাইনে প্রায় সব টিকিট বিক্রি হয়ে যায়।

রেলের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে টিকিট বিক্রি বৃদ্ধির পর কালোবাজারি বন্ধ হয়নি। দক্ষ কালোবাজারিরা সাধারণ যাত্রীদের চেয়ে দ্রুত টিকিট কাটার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে পারে। তাই অনলাইনে ‘এক মিনিটে টিকিট শেষ’—এমন অভিযোগ সর্বত্র।

আরও পড়ুনট্রেনের টিকিট নতুন পদ্ধতিতে যেভাবে কাটা যাবে০১ মার্চ ২০২৩লাভ হলো সহজের

২০০৭ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত টানা ১৫ বছর ট্রেনের টিকিট বিক্রি করে কম্পিউটার নেটওয়ার্ক সিস্টেম (সিএনএস)। এর আগেও তারা এই দায়িত্ব পালন করে। সিএনএস প্রতি টিকিটে ২ টাকা ৯৯ পয়সা নিত। আর অনলাইনে টিকিট বিক্রি করলে পেত সাড়ে ছয় টাকা। অবশ্য তখন ২০ শতাংশের মতো টিকিট অনলাইনে বিক্রি হতো।

টিকিট বিক্রির জন্য ঠিকাদার নিয়োগে ২০২০ সালে দরপত্র আহ্বান করে রেলওয়ে। সহজ ডটকম পাঁচ বছরে ৩০ কোটি ২৫ লাখ টাকায় ২০ কোটি টিকিট বিক্রি করে দেওয়ার প্রস্তাব করে। তবে তাদের প্রস্তাবটি ছিল কিছুটা ভিন্ন। তারা রেলের কাছ থেকে মাত্র ৫ কোটি টাকা নেবে বলে উল্লেখ করে। বাকিটা বিজ্ঞাপন থেকে আয় করার কথা। এ হিসাবে প্রতিটি টিকিট বিক্রির জন্য সরাসরি মাত্র ২৫ পয়সা পায় তারা। অন্যদিকে সিএনএস ২৪ কোটি টাকায় ২০ কোটি টিকিট বিক্রির প্রস্তাব দেয়। অর্থাৎ প্রতি টিকিটের জন্য তাদের প্রস্তাবিত মাশুল ছিল ১ টাকা ২০ পয়সা।

কম দর প্রস্তাব করে সহজ ডটকম টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পায়।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, দরপত্রে পাঁচ বছরে ৮ কোটি টিকিট অনলাইনে এবং ১২ কোটি কাউন্টারে বিক্রি হবে—এমন প্রক্ষেপণ করা হয়েছিল। কিন্তু সহজকে দায়িত্ব দেওয়ার পর প্রথমে ঈদে শতভাগ টিকিট অনলাইনে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেয় রেলপথ মন্ত্রণালয়। পরে অনলাইনে বিক্রির বিষয়টিই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। এতে প্রায় ২০ কোটি টিকিটের ৭০ শতাংশই অনলাইনে বিক্রি করার সুযোগ পাচ্ছে সহজ।

সহজ অনলাইন কিংবা কাউন্টার—সব টিকিট থেকেই প্রথমে পাচ্ছে ২৫ পয়সা। আবার শুধু অনলাইনে বিক্রি করা প্রতিটি টিকিটের জন্য পাচ্ছে বাড়তি সাড়ে ছয় টাকা। একজন ব্যক্তি একসঙ্গে সর্বোচ্চ চারটি টিকিট কাটতে পারে। অনলাইনে তা চারটি হিসাবেই গণ্য করে সহজকে বিল দেওয়া হয়। একটি টিকিট কাটার জন্য সফটওয়্যারের যে ব্যবহার, চারটির জন্য একই ব্যবহার হলেও বিল পাচ্ছে বাড়তি।

রেলওয়ে সূত্র বলছে, চুক্তি অনুসারে পাঁচ বছরে সহজ টিকিট বিক্রি ও বিজ্ঞাপন সব মিলিয়ে ৩০ কোটি টাকা পেত। অনলাইনে বেশি টিকিট বিক্রি হওয়ার কারণে বিজ্ঞাপনের আয় ছাড়াই তারা ৯২ কোটি টাকা বাড়তি আয়ের সুযোগ পাচ্ছে।

অনলাইনে কেনা টিকিটের জন্য গ্রাহকের কাছ থেকে বাড়তি ২০ টাকা নেওয়া হয়। এর মধ্যে সহজ পাচ্ছে সাড়ে ছয় টাকা। আরও সাড়ে ছয় টাকা যায় যে ব্যাংকিং গেটওয়ের মাধ্যমে দাম পরিশোধ করা হয়, সেই প্রতিষ্ঠানে। সরকার ভ্যাট হিসেবে পায় তিন টাকা। বাকি চার টাকা রেলওয়ে কল্যাণ ট্রাস্টের।

অনলাইনে টিকিট বিক্রির ফলে বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিষয়ে সহজ ডটকমের প্রশাসন বিভাগের প্রধান ও প্রধান যোগাযোগ কর্মকর্তা আমিনুল হক প্রথম আলোকে বলেন, অনলাইনে টিকিট বিক্রিতে অনেক খরচ। ফলে বেশি সুবিধা পাওয়ার বিষয়টি ঠিক নয়।

প্রতিষ্ঠানটির অপারেশন বিভাগের প্রধান সন্দ্বীপ দেবনাথও দাবি করেন, অনলাইনে টিকিট বিক্রিতে তাঁদের আয় বেশি হলেও খরচও অনেক। কারণ, পুরো ব্যবস্থাটি তাঁদের পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণ করতে হয়।

আরও পড়ুনট্রেনের অগ্রিম টিকিট বিক্রি শুরু, প্রথম আধা ঘণ্টায় ৬০ লাখ ‘হিট’০২ জুন ২০২৪চুক্তি অনুযায়ী অনেক কিছুই হয়নি

রেলওয়ে সূত্র জানায়, সিএনএসের সঙ্গে পরোক্ষভাবে ছিলেন সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তৎকালীন রেলমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন আওয়ামী লীগের আইনজীবী নেতা ছিলেন। আইন অঙ্গনে দুজনের মধ্যে বিরোধ ছিল। সুজন রেলমন্ত্রী হয়ে যেকোনো মূল্যে সিএনএসকে বাদ দেওয়ার উদ্যোগ নেন। অবশ্য সিএনএসের বিরুদ্ধেও অভিযোগ ছিল যে তারা প্রভাব খাটিয়ে একাধিকবার রেলের টিকিট বিক্রির দায়িত্ব পেয়ে নানা অজুহাতে বাড়তি টাকা তুলে নিয়েছে। সহজ ডটকম বেসরকারি বাসের টিকিট অনলাইনে বিক্রি করার মধ্য দিয়ে এই ব্যবসায় এসেছে।

সহজের সঙ্গে করা চুক্তি অনুসারে, রেলের গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনগুলোতে বড় ৬০টি মনিটর স্থাপন করার কথা। এসব মনিটরে ট্রেন গমনাগমন, কোচের সিরিয়াল নম্বর, ট্রেনের অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের কথা। ট্রেনের বর্তমান অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ঠিকাদারের পক্ষ থেকে রেলের প্রতিটি ইঞ্জিনে জিপিএস ট্র্যাকার স্থাপন এবং তা রক্ষণাবেক্ষণ করার কথা। তবে এর অনেক কিছুই হয়নি। এ ছাড়া বহনযোগ্য যন্ত্রের মাধ্যমে (পিওএস) টিকিট বিক্রির কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে কাউন্টারে দীর্ঘ লাইন ভোগান্তি এড়াতে যন্ত্রের ব্যবহারের কথা হয়। তা–ও কার্যকর নেই বলে রেলের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

এই বিষয়ে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহন–বিশেষজ্ঞ সামছুল হক প্রথম আলোকে বলেন, রেলে যে পরিমাণ বিনিয়োগ হয়েছে, সে হারে যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা বাড়েনি। কেন বাড়েনি এই জবাবদিহি করতে হবে। সক্ষমতা বাড়ালে কালোবাজারি বন্ধে এত কিছুর দরকার হবে না। তিনি আরও বলেন, অনলাইনে টিকিট কাটতে খরচ কম হওয়ার কথা। বাড়তি টাকা নেওয়া হলে তা অবশ্যই অনিয়ম।

আরও পড়ুনট্রেনের টিকিট পুরোটা অনলাইনে দেওয়া কতটা যৌক্তিক০৬ এপ্রিল ২০২৩.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: ট ক ট র জন য প রথম আল ক কর মকর ত র র জন য ব যবস থ ব যবহ র পর বহন ছয় ট ক অন স র র বহন অবশ য র লওয় ব ষয়ট দশম ক

এছাড়াও পড়ুন:

ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত

“সারা দিন খাবারের রাজ্যে থাকি। কিন্তু ক্ষুধা লাগলে সময় মতো খাবার খাওয়ার সুযোগ হয় না প্রায়ই। আমরা এই ঢাকার অভিজাত শ্রেণির মানুষের কাছে সুস্বাদু, দামি খাবার কাছে পৌঁছে দেই ঠিকই কিন্তু মন চাইলেও তা খেতে পারি না টাকার জন্য।”

কথাগুলো একজন ফুড ‘ডেলিভারি ম্যান’ আরিফ হাসানের।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে দিন দিন জনপ্রিয় হয়ে ওঠা বাসা-বাড়িতে গিয়ে খাবার সরবরাহের নতুন ব্যবস্থায় অপরিহার্য কর্মী এই ডেলিভারি ম্যানরা। বাংলায় ‘খাবার সরবরাহকারী’ না বলে একটু অভিজাত ইংরেজিধাঁচে তাদের ডাক হয় ‘ফুড ডেলিভারি ম্যান’ নামে। পিঠে ঝোলানো বড় ব্যাগে খাবার নিয়ে দিনরাত সাইকেলে ছুটতে দেখা যায় তাদের।

হাতেগোনা কয়েক বছর হলো চাকরি বা পেশা হিসেবে ‘ফুড ডেলিভারি ম্যান’ নামে কাজের সুযোগ তৈরি হয়েছে। অথচ নতুন এই পেশায় শুরু থেকেই জুড়ে গেছে কষ্ট আর অতৃপ্তির গল্প।

যেমনটি বলছিলেন আরিফ হাসান। তারা ভাষায়, চোখের সামনে এত এত লোভনীয় খাবার দেখে মাঝেমধ্যে খেতে মন চাইলেও চড়া দামের কারণে তা হয়ে ওঠে না। অর্থাৎ ফুড ডেলিভারি করে যা আয় হয়, তা দিয়ে এই ধরনের দামি খাবার কেনার ধাক্কা কুলিয়ে উঠতে পারেন না তিনি।

রাজধানীর শ্রমব্যবস্থায় পেশা বেছে নেওয়ার স্বাধীনতা থাকলেও প্রয়োজনের তাড়ায় অনেককে পছন্দ না হলেও কিছু না কিছু করে টিকে থাকতে হয়। আরিফ হাসানও তাদের মতো একজন; তবে হার না-মানা এক তরুণ।

বুধবার (৩০ এপ্রিল) সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বেগম রোকেয়া হলে ফুড ডেলিভারি দিচ্ছিলেন আরিফ হাসান। সেখানে তার সঙ্গে কথা হয় রাইজিংবিডি ডটকমের।

আরিফ হাসান একটি বেসরকারি কলেজের সম্মান দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ। তার বাবা একজন কৃষক। ঢাকায় পড়াশোনা ও থাকা-খাওয়ার খরচ নিজেকেই জোগাড় করে নিতে হয়; বাড়িতে অসুস্থ মায়ের চিকিৎসার জন্য টাকা পাঠাতে হয় তাকে। তাই পড়াশোনা চালিয়ে কিছু একটা কাজ করে রোজগারের ইচ্ছাশক্তি থেকেই ফুড ডেলিভারিকে বেছে নেন তিনি।

রাইজিংবিডি ডটকমের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে আরিফ হাসানের চোখের কোণা ছলছল করে উঠতে দেখা যায়। পড়াশোনা, কাজ ও গ্রামে থাকা আপনজনদের নিয়ে তার একটি ছোট্ট জগতে এখন পদে পদে লড়াই। তার জীবনে টাকাটা এখন খুব জরুরি।

আরিফ হাসানের মনে হয়েছে, এই পৃথিবীতে সবার জীবন সমান নয়। এই ঢাকা শহরে যাদের টাকা আছে, তারা প্রয়োজন ছাড়া হাজার হাজার টাকা ব্যয় করে থাকেন।

“তবে আমার মতো যারা আছেন, তারা সামান্য দুমুঠো খাবার খেয়ে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন। আসলে আমাদের মতো যারা অসহায়, তাদের দেখার কেউ নেই। তাদের কষ্ট শোনারও কেউ নেই,” বলেন তিনি।

আরিফ হাসান রাজধানীর আজিমপুরে কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে একটি মেসে থাকেন। সকাল সকাল তিনি বেরিয়ে পড়েন জীবিকার সন্ধানে। ফুড ডেলিভারির অ্যাপ খুলে অপেক্ষা করেন অর্ডারের জন্য।

অর্ডার আসে, সাইকেলের প্যাডেল ঘুরিয়ে তিনি ছুটে যান ডেলিভারি দিতে। দিনে গড়ে ৩৫ থেকে ৪০কিলোমিটার সাইকেল চালাতে হয় তাকে, যে কারণে দিন শেষে ক্লান্তি তাকে পেয়ে বসে।

ফুড ডেলিভারি দিতে নিজের সাইকেল দরকার হয়; বলতে গেলে এই পেশায় এটি একটি বিনিয়োগ। আরিফ হাসানও সাইকেল নিয়েই কাজ শুরু করেছিলেন। তবে তার সেই প্রথম সাইকেলটি চুরি হয়ে যায়। তার রোজগারের অবলম্বনটি কেউ চুরি করার জন্য ওঁৎ পেতে আছে, তা তিনি ভাবতেও পারেননি।

আরিফ হাসান চুরির ঘটনার সেই বর্ণনা শোনালেন। একদিন তাড়াহুড়ায় সাইকেলে তালা না মেরে অর্ডার নিয়ে রেস্টুরেন্টে খাবারের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। তখনই চোর তার সাইকেলটি নিয়ে চম্পট দেয়। চোর তো জানত না যে, সেদিনই তার পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশনের তারিখ ছিল! জানলেও হয়তো চোর চুরিই করত।

নতুন সাইকেল কিনে সব খরচ জোগাড়ের চাপ ছিল আরিফ হাসানের। তাই পরীক্ষার রেজিস্ট্রেশন ফি দিতে পারেননি সেবার। শিক্ষাজীবন তার পিছিয়ে যায় এক বছর। কষ্টের দিনে যোগ হয় আরো কষ্ট! তাকে কাজ দেওয়া প্রতিষ্ঠানও শুনিয়ে দেয় কটূ কথা; অবহেলার জন্য দায় দেয় তার ঘাড়েই।

সেই ঘটনার কথা স্মরণ করে আরিফ হাসান বলেন, “সেদিনের কথা কখনো ভুলব না।”

ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানগুলো কোনো দায় নেয় না। আরেকবারের ঘটনা মনে পড়ে যায় তার। তিনি বলেন, একবার ডেলিভারি দিতে যাওয়ায় সময় বাসের সঙ্গে ধাক্কা লেগে মারাত্মক আহত হয়েছিলাম; অনেক দিন কাজ যেতে পারেননি।

কাজে থাকলে দুপুরে খাবারের কী ব্যবস্থা হয়, জানতে চাইলে আফসোস নিয়ে আরিফ হাসান বলেন, “আমি দুপুরে সেইভাবে খাই না। রাস্তার পাশের দোকান থেকে কলা-রুটি সিঙ্গাড়া খেয়ে নেই। তা ছাড়া খাওয়ার সময়ও হয়ে ওঠে না; অর্ডারের চাপ থাকে বেশি। ডেলিভারি করতে করতে সময় চলে যায়। রাতে মেসে ফিরে বন্ধুদের সঙ্গে ভাত খাই। মেসের খাবার কেমন, তা তো জানেনই ভাই।”

হোম ডেলিভারির খাবার নিয়ে অনেক অভিযোগের খবর রয়েছে। একটা চাইলে আরেকটা প্যাকেট করে পাঠিয়ে দেওয়া, মান ঠিক না থাকা, পচা-বাসি খাবার পাঠানো, দেরিতে পাঠানো- এমন অনেক অভিযোগ শোনা যায়। অভিযোগের ক্ষেত্রগুলোতে ডেলিভারিম্যানদের দায় না থাকলেও বাসার দরজায় পেয়ে ভুল-ত্রুটির জন্য তাদেরই কথা শুনিয়ে দেয় গ্রাহকরা।

আরিফ হাসান বলেন, “সবচেয়ে বেশি খারাপ লাগে তখন, যখন কাস্টমাররা আমাদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করেন। এমন অনেক কাস্টমার আছেন, সামান্য দেরি হলে বাজেভাবে অপমান করেন। অথচ কাস্টমারের খাবারটা তার লোকেশনে তার বিল্ডিংয়ের নিচে নিয়ে গেলে বলেন, পাঁচ তলায় আসেন, সাত তলায় আসেন, আট তলায় আসেন।”

“সাইকেল চালাতে চালাতে পায়ের বারোটা বেজে যায়; তখন সাত তলায়, আট তলায় ওঠাটা শরীরে কুলায় না। যদি বলি, অনেক টায়ার্ড আছি; আপনি একটু কাউকে পাঠান। তখন অনেক কাস্টমার তাদের সময় থাকলেও আমাদের কষ্ট দিয়ে তারা আনন্দ পায়। এসময় নিজেকে দুনিয়ার সবচেয়ে অসহায় মানুষ মনে হয়,” যোগ করেন আরিফ হাসান।

ডেলিভারিম্যানদের ক্যালরি খরচ নিয়ে ব্রিটিশ স্পোর্টস সায়েন্স ও ফিটনেস বিশেষজ্ঞ জেন ওয়েক
২০১৯ সালে ব্রিটেনের অনলাইন ফুড ডেলিভারি কোম্পানি ডেলিভারুর সাইকেল রাইডারদের ওপর একটি সমীক্ষা চালান।

সমীক্ষায় জেন ওয়েক দেখতে পান, ৭০ কেজি ওজনের একজন ফুড ডেলিভারির সাইকেল রাইডারকে প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার ৮০ ক্যালরি খরচ করতে হয়, যেটি অন্যান্য পেশার চেয়ে অনেক বেশি। এমন কী একই ওজনের অগ্নিনির্বাপণ-কর্মীদের ঘণ্টায় ব্যয় হয় ৮৪৫ ক্যালরি।

২০১৯ সালে ফোর্বস সাময়িকীতে সমীক্ষাটির ফলাফল নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। জেন ওয়েকের সেই ৭০ কেজি ওজনের ব্যক্তির ক্যালরি খরচকে ৬০ কেজির ব্যক্তির বেলায় রূপান্তর করলে সেটি হয় ঘণ্টায় ৯২৬ ক্যালরি।

ওই সমীক্ষায় ক্যালরি খরচের হিসাবে শুধু তাদের সাইকেল চালানোকেই ধরা হয়নি; জেন ওয়েক সেই সঙ্গে ফুড ডেলিভারির রাইডারকে যা যা করতে, তার প্রতিটি শারীরিক কর্মকাণ্ডকেই আমলে নেন।

ডেলিভারিম্যানদের সম্পর্কে জানতে রাইজিংবিডি ডটকম কথা বলে রাজধানীর ‘পিজ্জা অন টাইম’ নামে ডেলিভারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে।

প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজার ইন চিফ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, “সাধারণত অ্যাপের মাধ্যমে আমাদের এখানে বিক্রি হয়ে থাকে। যে ডেলিভারম্যানরা কাজের জন্য আসেন, তারা বেশিরভাগই তরুণ। কলেজপড়ুয়া শিক্ষার্থী বেশি। তাদের দেখলে মাঝেমধ্যে খুব খারাপ লাগে; তবে কিছু করার নেই আমাদের। তারা দুপুরের খাবারেরও সময় পায় না মাঝে মাঝে। তারা কঠোর পরিশ্রম করেন। আমরাও চাই, মানুষ তাদের শ্রমের ন্যায্য মূল্যটা দিক।”

ডেলিভারিম্যানদের অধিকার সুরক্ষা বিষয়ে জানতে চাইলে মানবাধিকারকর্মী আহমেদ স্বপন রাইজিংবিডি ডটকমকে বলেন, “আমাদের দেশের শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি নিশ্চিত করার জন্য সরকারি-বেসরকারি সব প্রতিষ্ঠানকে আইএলও (আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা) নির্ধারিত নিয়ম মেনে চলতে হবে এবং তারা তা করছে কিনা, সেটি সরকারকে তদারকি করতে হবে।”

“বাংলাদেশে বর্তমানে যে সব অনলাইন-ভিত্তিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আছে, সেগুলোর বেশিরভাগ শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকার বুঝিয়ে দেয় না। আবার শ্রমিকরাও আইনের মাধ্যমে তাদের অধিকার আদায় করে নেওয়ার ইচ্ছা দেখান না নানা ঝামেলার কারণে। তারা যদি আইনের পথে হাঁটতেন, তাহলে ভবিষ্যতে শ্রমিকদের জন্য ভালো হতো,” যোগ করেন আহমেদ স্বপন।

(আরিফ হাসান অনুমতি না দেওয়ায় তার ছবি প্রকাশ করেনি রাইজিংবিডি ডটকম।)

ঢাকা/রাসেল

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • ফুড ডেলিভারিম্যান: খাবারের রাজ্যে অতৃপ্ত দিনরাত
  • প্রযুক্তির দুনিয়ায় পা রাখলেন আরেক ‘গেটস’, বাবার মতো কি সফল হতে পারবেন