সম্প্রতি ফেসবুকে দুটি ভিডিও ক্লিপ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। দুটি ভিডিওর বিষয়বস্তু একেবারেই বিপরীতধর্মী, তবে একটি জায়গায় দুটি ক্লিপের মিল রয়েছে। দুটি ভিডিওর কেন্দ্রীয় চরিত্র একজন মা।
প্রথমটি মা দিবস উপলক্ষে হিন্দি ভাষায় নির্মিত একটি পণ্যের বিজ্ঞাপন। যেখানে দেখা যাচ্ছে, একজন মা স্কুলের অধ্যক্ষের কাছে একটি ছোট্ট মেয়েকে নিয়ে হাজির। তাঁর অভিযোগ, স্কুলের কিছু দুষ্টু ছেলেমেয়ে মেয়েটিকে নানাভাবে হেনস্তা করে। আজ নিজের চোখে তিনি সেটা দেখেছেন। এ বিষয়ে একটি শিশুর নাম উল্লেখ করে কয়েকজনের বিরুদ্ধে নালিশ জানালেন সেই মা।
অধ্যক্ষ তাৎক্ষণিক সেই ছেলে ও তার বন্ধুদের ডেকে পাঠালেন। আর এখানেই কাহিনির টুইস্ট। দেখা গেল, যে মা এই অভিযোগ করেছেন, তিনি আসলে অভিযুক্ত শিশুটির মা। নিজের ছেলের অন্যায় আচরণের বিরুদ্ধে অধ্যক্ষের কাছে নালিশ করতে এসেছেন। এখানে যে বার্তাটি আমরা পাই, নিজের সন্তান কোনো অন্যায় করলেও তার বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে। এটাই মা দিবসের শিক্ষা।
আর দ্বিতীয় ভিডিওটি কোনো বানোয়াট কাহিনি নয়। এই দেশের, এই সমাজের একটি বাস্তব ঘটনা, যেটা ঘুম থেকে উঠেই সকাল সকাল দেখলাম।
সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, মুন্সিগঞ্জের একটি লঞ্চে একজন অপ্রাপ্তবয়স্ক নারীকে বেদম প্রহার করছে একটি ছেলে, যাকে পরে পুলিশ আটকও করেছে। যে ভিডিওর কথা আমি এখানে বলছি, তাতে দেখা গেছে, ঘটনার হোতা সেই ছেলেটির মা দাবি করছেন, তার সন্তান ‘ভালো কাজ’ করেছে। মেয়েটিকে সে ‘জনরোষ থেকে বাঁচাতে’ মারধর করেছে।
একটি জনাকীর্ণ লঞ্চঘাটে জনসমক্ষে একটি মেয়েকে বেদম পিটুনির ঘটনাকে যে মা ‘ভালো কাজ’ বলে অভিহিত করতে পারেন, তাঁর কাছ থেকে আমরা আর কী আশা করতে পারি! সেই মায়ের সন্তানের পক্ষে কি কখনোই এই বোধ জাগ্রত হওয়া সম্ভব যে নারীদের হেনস্তা করাটাও একটা বড় অপরাধ?
আমরা কেমন মা চাই? সন্তানের অন্যায়ের দায় স্বীকার করে তাকে সঠিক পথ দেখাবেন, নাকি নিজের সন্তানের দোষগুলো আড়াল করে ‘ভালো কাজ’ করার সার্টিফিকেট দিয়ে তাকে উৎসাহিত করবেন?আজকের দিনে আমাদের চারপাশে নারীদের হেনস্তা করা, নারীর প্রতি সহিংসতা, পদে পদে তাঁদের অসম্মান আর অপদস্থ করার যে ঘটনাগুলো আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তার একটি সরলরৈখিক কারণ বা এর পেছনের মনস্তত্ত্ব বোঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে হয়তো সম্ভব নয়।
সমাজের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ নারীদের প্রতি এমন বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব নিয়ে বেড়ে উঠছে, সেই প্রশ্নের পূর্ণাঙ্গ জবাবটা না পেলেও উল্লেখিত ভিডিওটি থেকে এর পেছনের একটা অন্যতম কারণ হয়তো আমরা বুঝতে পারছি।
প্রশ্ন হচ্ছে, প্রতিনিয়ত অসম্মান, অপদস্থ হওয়া বা হেনস্তার শিকার হওয়ার সমস্যাটি কি শুধু নারীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য? এই অস্থির সমাজে আসলে ক্রমেই সামগ্রিকভাবে মানুষের প্রতি মানুষের সম্মানবোধ, পারস্পরিক সহমর্মিতা ও সৌজন্য কমতে কমতে তলানিতে এসে ঠেকেছে।
যে কারণে আমরা দেখতে পাই, লঞ্চঘাটে একটি মেয়েকে যখন নির্মমভাবে পেটানো হচ্ছে, তখন সেখানে উপস্থিত জনতা উল্লাস নিয়ে সেটি দেখছেন ও ভিডিও করছেন। কেউ কেউ আওয়াজ তুলছেন, ‘ঠিক ঠিক’ বলে। এটা কোনো সুস্থ সমাজের চিত্র হতে পারে না। ‘ম্যাস হিস্টরিয়ার’ মতো আমরা সম্ভবত ‘ম্যাস পারভারশনে’ আক্রান্ত হচ্ছি।
সেদিন কারওয়ান বাজারে আম কেনার উদ্দেশ্যে এক বিক্রেতার সামনে দাঁড়িয়েছি। মৌসুমের প্রথম পাকা আম ক্রেতারা বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখছেন। সদ্য কৈশোর পেরোনো এক তরুণ সম্ভবত অপটু ক্রেতা, সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না, আমগুলোর মান কেমন হবে? এগুলো কেনা ঠিক হবে কি না? এই সময় তাঁর পাশে এক মধ্যবয়সী ক্রেতা এসে অভিজ্ঞ জহুরির মতো একটা একটা করে আম টিপে, গন্ধ শুকে বেছে নিচ্ছিলেন। অভিজ্ঞতার বিকল্প নেই, সেই ভাবনা থেকেই হয়তো তরুণ ক্রেতা মধ্যবয়সী লোকটির কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ‘ভাই, আমগুলো কেমন হবে?’ মধ্যবয়সী ক্রেতা যে জবাব দিলেন, তার জন্য তরুণটি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। মুখ শক্ত করে লোকটির জবাব, ‘ক্যান, আল্লাহ আপনের হাত, মুখ, চোখ দেয় নাই? নিজে দেইখা নিতে পারেন না?’
ঘটনাটি হয়তো খুবই সামান্য, ছোট বিষয়। কিন্তু এই ছোট একটি বিষয় থেকেই আমাদের সামগ্রিক চিত্রটা বোঝা যায়। দিন দিন সম্ভবত নিজের অজান্তেই আমরা ক্রমেই স্বার্থপর, অসহিষ্ণু, রূঢ় আর দুর্বিনীত হয়ে উঠছি। যার প্রতিফলন দেখা যাচ্ছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। নারীরাও তাই হরহামেশা পুরুষের এমন আচরণের শিকার হচ্ছেন।
ফিরে আসি শুরুর দুটি ভিডিওর ঘটনায়। এখানে আমরা দুজন মাকে পাই, যাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি একেবারেই আলাদা এবং যা থেকে পাওয়া যায় দুটি সমাজ বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। একটি সমাজ, যেখানে মা সন্তানকে ন্যায়বোধ শেখান। আরেকটি, যেখানে মা নিজেই অন্যায়ের পক্ষে সাফাই গাইতে দ্বিধা করেন না।
একটি শিশুর সবচেয়ে বড় বিদ্যাপীঠ তার পরিবার। বাক্যটি ক্লিশে মনে হলেও এটা যে কত বড় সত্য, তা সম্ভবত আমরা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।
একজন মায়ের ভূমিকা শুধু সন্তানের জন্মদান নয়, তিনি তাঁর সন্তানের নৈতিক চরিত্র, মূল্যবোধ, সহানুভূতি ও বিবেচনার বোধ তৈরিরও কারিগর। পরিবারে মায়ের ভূমিকা সন্তানের প্রতি শুধুই স্নেহ বা লালন–পালনে সীমাবদ্ধ নয়। একজন মা যদি নিজের সন্তানের অন্যায়ের প্রতিবাদ করেন, তবে সমাজে অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো মানুষের অভাব হবে না।
এমন বর্বর চিত্র আমাদের আর দেখতে হবে না, যেখানে নারীকে হেনস্তার দৃশ্য দেখে শত শত পুরুষ উল্লাসধ্বনি করছেন, সমর্থন করছেন।
আর যদি মা-ই অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, তাঁকে বৈধ করে তোলেন, তবে সেই সন্তান যে বড় হয়ে আরেকটি নির্যাতনকারীতে পরিণত হবে, এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
আমরা কেমন মা চাই? সন্তানের অন্যায়ের দায় স্বীকার করে তাকে সঠিক পথ দেখাবেন, নাকি নিজের সন্তানের দোষগুলো আড়াল করে ‘ভালো কাজ’ করার সার্টিফিকেট দিয়ে তাকে উৎসাহিত করবেন?
আজ মা দিবস আমাদের সেই প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে।
গোলাম কিবরিয়া, লেখক, গণমাধ্যম বিশ্লেষক, উন্নয়নকর্মী
[email protected]
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: অন য য় র র অন য য় একজন ম আম দ র ভ ড ওর র একট করছ ন
এছাড়াও পড়ুন:
রত্নগর্ভা মায়েরা পেলেন সম্মাননা
নিজ জীবনের সব কষ্টকে এক দিকে রেখে সন্তানের মুখে হাসি ফোটানোর নিরন্তর প্রচেষ্টা থাকে একজন মায়ের। দিন শেষে সেই সন্তানের কোনো ভালো কাজ দেখে আনন্দটুকুতেই একজন মায়ের যেন তৃপ্তি। সেই তৃপ্তিকেই সম্মান জানিয়ে ৩৫ মাকে সম্মাননা দিয়েছে আজাদ প্রোডাক্টস।
২০০৩ সাল থেকে আজাদ প্রোডাক্টস এই সম্মাননা দিয়ে আসছে। গতকাল রোববার ঢাকা ক্লাবের স্যামসন এইচ চৌধুরী মিলনায়তনে ‘রত্নগর্ভা মা ২০২৩-২৪’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এ বছর মোট ৩৫ নারীকে রত্নগর্ভা মা অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়। ২৫ নারীকে সাধারণ ক্যাটেগরি ও ১০ নারীকে বিশেষ ক্যাটেগরিতে এই সম্মাননা দেওয়া হয়। ‘আমার মা, আমার ভালোবাসা’ স্লোগানে অনুষ্ঠান শুরু হয় জেমসের বিখ্যাত ‘মা’ গানটি দিয়ে।
সাধারণ ক্যাটেগরিতে সম্মানিত মায়েরা হলেন– মারতুজা নুসরাত, ফরিদা বেগম, রাশিদা বেগম, নাসিমা মান্নান চৌধুরী, বিবি মরিয়ম, রোকেয়া খানম, পিয়ারা বেগম, আফরোজা পারুল, রোকসানা আক্তার, হাসিনা আক্তার, সালেহা করিম, ফাতিমা নার্গিস, আঞ্জুমান আরা বেগম, সালমা আলম, জোবেদা খানম, রাজিয়া বেগম, মোছাম্মৎ মাহমুদা বেগম, কিশোয়ার জাহান, ফাতেমা বেগম, সুরাইয়া চৌধুরী, রাবেয়া পারভীন বানু, আদরিনী সরকার, হাছিনা আক্তার, মনোয়ারা বেগম ও অ্যাডভোকেট হালিমা আক্তার।
বিশেষ ক্যাটেগরিতে সম্মানিত মায়েরা হলেন– শাহানা সিরাজ, মুসলিমা খানম রানা, স্মৃতি কণা বড়ুয়া, খাদিজা খন্দকার, ফাতেমা আলম শাহানা, সাহানা আকতার চৌধুরী, অলকা ঘোষ, শামছুন্নাহার হোসেন, ফরিদা বেগম ও সৈয়দা দিলরুবা খানম। এ ছাড়া মাই ড্যাড ওয়ান্ডারফুল ক্যাটেগরিতে কথাসাহিত্যিক আরেফিন বাদল সম্মানিত হয়েছেন।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের এডাস্ট স্কিল ডেভেলপমেন্ট ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. আ ন ম এহসানুল হক মিলন। বিশেষে অতিথি ছিলেন চ্যানেল আইর পরিচালক ও বার্তাপ্রধান শাইখ সিরাজ, অভিনেতা আবুল হায়াত প্রমুখ।
অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্যে আজাদ প্রোডাক্টসের স্বত্বাধিকারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, মা একজন মহান শিল্পী। সুসন্তান গড়ার ক্ষেত্রে নিপুণ কারিগর।
এদিকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রাখা ১২ জনের মাকে সম্মাননা দিয়েছে ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। বিশ্ব মা দিবস উপলক্ষে গতকাল ঢাকার মহাখালীর রাওয়া ক্লাবে ‘গরবিনী মা-২০২৫’ সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
সম্মাননা পাওয়া মায়েরা হলেন– জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান নাসরীন আফরোজের মা মনোয়ারা বেগম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর বিচারক মোহাম্মদ রেজাউল করিমের মা রেজিয়া বেগম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ তানজীম উদ্দিন খানের মা মোছাম্মৎ রেজিয়া খাতুন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখার মা আয়েশা আক্তার, ডিএমপির উপকমিশনার কাজী নুসরাত এদীব লুনার মা ফরিদা আফরোজা, ল্যাপারোস্কপিক সার্জন সরদার এ নাঈমের মা রাজিয়া কাদের, প্রকৌশলী এ কে এম সাইফুল বারির মা মোছাম্মৎ হাজেরা বেগম, বাংলাভিশনের ডেপুটি হেড অব নিউজ মাহফুজুর রহমানের মা রাজিয়া খাতুন, সংগীতশিল্পী দিলশাদ নাহার কনার মা লুৎফুন্নাহার লুৎফা, মডেল সুমাইয়া শিমুর মা লায়লা রহমান, অভিনেতা আব্দুন নূর সজলের মা কানিজ ফাতেমা এবং অদম্য মেধাবী বর্ষা রানী বীণার মা শৈল বালা।
অনুষ্ঠানে নৌপরিবহন উপদেষ্টা এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, মায়ের ঋণ কোনো সন্তানই শোধ করতে পারে না।