প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে স্থানীয় সেবা
Published: 25th, May 2025 GMT
জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, জন্ম বা মৃত্যু নিবন্ধন, ওয়ারিশ সনদ কিংবা ট্রেড লাইসেন্স নাগরিক জীবনের এই সাধারণ সেবাগুলোই হয়ে ওঠে অসাধারণ জটিল, যখন এর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে দুর্নীতি ও দালালচক্রের অদৃশ্য জাল।
গত ১৩ মে রাজধানীর নগর ভবনের এমন এক অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেন বংশালের সাহেলা বেগম। তিনি বলেন, “মেয়ের জন্ম নিবন্ধনের বানান ভুল ছিল। তিনবার এসে ফিরে গেছি। শেষে দালালের মাধ্যমে দুই হাজার টাকা দিয়ে কাজ করেছি। তবেই কাজ হয়েছে।”
এ অভিজ্ঞতা শুধু সালেহার একার নয়। রাজধানীসহ সারা দেশের নাগরিকদের জন্য এ যেন এক নিরব চিত্র। তবে এবার সেই চিত্র পাল্টাতে চায় সরকার। স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে সমন্বিত ডিজিটাল সেবা প্ল্যাটফর্ম চালুর উদ্যোগ, যা নাগরিকদের কাছে সরকারি সেবা পৌঁছে দিতে পারে সরাসরি ও স্বচ্ছ পদ্ধতিতে।
আরো পড়ুন:
রাইজিংবিডিতে সংবাদ: ঢাবির সূর্যসেন হলের প্রাধ্যক্ষের পদত্যাগ
চ্যানেল টুয়েন্টিফোরের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে ওয়ালটনের শুভেচ্ছা
এ বিষয়ে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় এবং যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া বলেন, “আমরা এমন একটি প্ল্যাটফর্ম গড়তে চাই, যেখানে নাগরিক ঘরে বসেই আবেদন করতে পারবে, অগ্রগতি দেখতে পারবে, আর সেবা না পেলে সহজেই অভিযোগ জানাতে পারবে।”
তিনি বলেন,“ঘুষ নয়, থাকবে ডিজিটাল ট্রেইল। দালালের জায়গা নেবে তথ্যের স্বচ্ছতা।”
ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে যেসব সেবা
প্রথম ধাপে যেসব সেবা ধাপে ধাপে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হচ্ছে, তা হলো জন্ম, মৃত্যু ও বিবাহ নিবন্ধন, নাগরিক ও ওয়ারিশ সনদ, ট্রেড লাইসেন্স প্রদান ও নবায়ন, হোল্ডিং ট্যাক্স পরিশোধ, গ্রাম আদালতের নথি ও শুনানি, অভিযোগ গ্রহণ ও ট্র্যাকিং সিস্টেম।
প্রতিটি সিটি করপোরেশন, পৌরসভার প্রতিটি ওয়ার্ডে, ইউনিয়ন পরিষদে গড়ে তোলা হবে একটি করে ‘ডিজিটাল সেবা ডেস্ক’। যেখানে থাকবেন প্রশিক্ষিত আইটি কর্মকর্তা। এছাড়া নাগরিকরা চাইলে মোবাইল অ্যাপ, ওয়েবসাইট বা ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমেও আবেদন করতে পারবেন।
এ বিষয়ে তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্লেষক শাওন মাহমুদ বলেন, “ডিজিটাল রূপান্তর মানে শুধু একটি সফটওয়্যার নয়, এটি মানসিকতার পরিবর্তন। মাঠ পর্যায়ের লোকবলকে প্রশিক্ষিত করতে হবে, জনগণকেও প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহী ও সক্ষম করে তুলতে হবে।”
এ বিষয়ে সাবেক সচিব ও স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ ড.
মাঠপর্যায়ের চিত্র
তবে বাস্তবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে এখনো কিছু বাঁধা রয়ে গেছে। অনেক ইউনিয়ন পরিষদে নেই ভালো ইন্টারনেট সংযোগ, নেই প্রশিক্ষিত জনবল বা আধুনিক অবকাঠামো।
সাভারের একজন ইউপি চেয়ারম্যান (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) বলেন, “ডিজিটাল হইলে মানুষ সরাসরি কাজ করতে পারবে। আমাদের কাছে আর আসবে না। এতে এলাকায় ভাবমূর্তি থাকলেও, লোকজন আর আমাদের সম্মান দিবে না।”
এই মনোভাবকেই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।কারণ প্রথাগত ক্ষমতা ও দৃষ্টিভঙ্গিই এখন বড় অন্তরায়। তবে আশার আলোও আছে। ডিজিটাল সিস্টেম চালু হওয়ার পর কাজ সহজ হয়েছে এমনটি জানিয়েছেন ঝালকাঠির সদর উপজেলার গাভা রামচন্দ্রপুর ইউপির সাবেক চেয়ারম্যান জাকির হোসেন লিটন।
তিনি বলেন, “প্রথমে ভয় পেয়েছিলাম, ডিজিটাল হলে জনপ্রতিনিধির গুরুত্ব কমে যাবে। কিন্তু এখন বুঝি, এটি বরং আমাদের কাজকে সহজ করেছে। মানুষ সরাসরি আবেদন করলে আমরা দ্রুত ব্যবস্থা নিতে পারি। এতে জনগণের আস্থা যেমন বাড়ে, তেমনি স্বচ্ছতাও নিশ্চিত হয়।”
গাভা ইউনিয়ন পরিষদের তিন নম্বর ওয়ার্ড মেম্বার রুহুল আমিন বলেন, “ডিজিটাল সিস্টেম চালু হওয়ার পর আমাদের কাজ সহজ হয়েছে। জনগণও খুশি, কারণ তারা এখন সরাসরি দেখতে পারে তাদের আবেদনের অবস্থা কোথায় আছে।”
পরিকল্পনা
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের অধীন স্থানীয় সরকার বিভাগ ইতোমধ্যে রূপান্তর প্রক্রিয়া। এর মধ্যে রয়েছে ইউনিয়ন ডিজিটাল সেন্টার (ইউডিসি)-এর সক্ষমতা বাড়ানো হচ্ছে। এলজিডি ড্যাশবোর্ড চালু হচ্ছে, যেখানে প্রতিটি প্রকল্প, বরাদ্দ ও অগ্রগতি দেখা যাবে। নাগরিকদের জন্য চালু হচ্ছে ওয়ান-স্টপ ডিজিটাল সার্ভিস পোর্টাল, যেখানে ঘরে বসেই মিলবে সনদ, আবেদন ও অভিযোগ জানানো সুযোগ।”
প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের জন্য ডিজিটাল প্রকল্প ট্র্যাকিং সিস্টেম চালু হবে, যেখানে স্থানীয় জনগণও দেখতে পারবে কোন প্রকল্পে কত টাকা বরাদ্দ হলো এবং তার অগ্রগতি কোথায়।
২০২৬ সালের মধ্যে দেশব্যাপী উদ্যোগ নেওয়া হবে। বর্তমানে পরীক্ষামূলকভাবে চালু রয়েছে দেশের ২০০টি ইউনিয়নে।মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ২০২৬ সালের মধ্যে দেশের ৪৫৭১টি ইউনিয়নেই ডিজিটাল সেবা চালুর পরিকল্পনা করা হয়েছে।
উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব বলেন, “আমরা এমন এক বাংলাদেশ গড়তে চাই, যেখানে সেবা পেতে কারও মুখ চিনতে হবে না। একজন নাগরিক হিসেবে অধিকার থাকলেই যথেষ্ট হবে।”
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) কর্মকর্তা মো. জাহিদ হাসান বলেন, “জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধার করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। তবে আন্তরিকভাবে বাস্তবায়ন হলে, এটি শুধু স্থানীয় সরকার নয়, গোটা প্রশাসনিক সংস্কৃতির রূপান্তরের উদাহরণ হয়ে উঠবে।”
ঢাকা/এএএম/এসবি
উৎস: Risingbd
কীওয়ার্ড: চ কর চ কর স থ ন য় সরক র প ল য টফর ম আম দ র
এছাড়াও পড়ুন:
বিদ্যুৎ বিভ্রাটে ‘নাকাল’ কুবির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
দেশের অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে আধুনিক অবকাঠামো ও নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা রয়েছে। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ১৮ বছর পরও বিদ্যুৎ বিভ্রাটে চরম ভোগান্তি পোহাচ্ছেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ে নেই নিজস্ব প্রধান সাব-স্টেশন অথবা কোনো কার্যকর জেনারেটর। ফলে বিদ্যুৎ বিভ্রাট কুবির প্রতিদিনের সঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শিক্ষা কার্যক্রম, গবেষণা, অনলাইন ক্লাস, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ইন্টারনেটসহ দৈনন্দিন কর্মকাণ্ডে বিঘ্ন ঘটছে। এমনকি বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতিও নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। স্বাভাবিক আবহাওয়াতেও দিনে সাত-আটবার বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।
আরো পড়ুন:
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নিয়োগে বয়সসীমা থাকছে না
জাবিতে গাঁজা সেবনকালে সাবেক ছাত্রলীগ কর্মীসহ আটক ৪
বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক আবাসিক হল ও বিভাগ ঘুরে দেখা গেছে, বিদ্যুৎ না থাকায় পানি সংকট দেখা দেয়, বন্ধ হয়ে যায় ওয়াইফাই। এতে অনলাইন ক্লাস ও গবেষণার কাজ স্থবির হয়ে পড়ে।
এ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করে জানান, সামান্য বৃষ্টি বা বজ্রপাত হলেই বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এ সমস্যার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে শিক্ষকদের দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাকার্যক্রমে চরম ব্যাঘাত ঘটছে। তাদের দাবি দ্রুত সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ সমস্যা নিরসন করে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধা প্রদান করতে হবে।
বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন নিয়ে নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরানী হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মায়া ইসলাম বলেন, “প্রায় প্রতিদিন লোডশেডিং হয়। এতে খাবার পানি সংগ্রহ থেকে শুরু করে অনলাইন ক্লাসেও অংশ নিতে পারি না।”
শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের আবাসিক শিক্ষার্থী মো. আজহারুল ইসলাম বলেন, “প্রতিদিনই বিদ্যুৎ চলে যায়, ভোল্টেজ থাকে কম। এতে ইন্টারনেটও বারবার বিচ্ছিন্ন হয়। ক্লাস, টিউশনি শেষে হলে ফিরে পড়াশোনায় মনোযোগ দিতে পারি না।”
শুধু শিক্ষার্থীরাই নন, শিক্ষকরাও এ সমস্যায় ভুগছেন। ক্লাস চলাকালে বিদ্যুৎ চলে গেলে মাল্টিমিডিয়া সরঞ্জাম অচল হয়ে যায়। এতে পাঠদান ব্যাহত হয়।
প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও বিজয়-২৪ হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাছান খান বলেন, “কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে অ্যাকাডেমিক ও প্রশাসনিক কার্যক্রমে নানা প্রতিবন্ধকতা তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে আবাসিক হলগুলোতে বিদ্যুৎ না থাকায় পানি সংকটের পাশাপাশি ইন্টারনেট সংযোগে সমস্যা দেখা দিচ্ছে, যা শিক্ষার্থীদের দৈনন্দিন জীবন ও শিক্ষাচর্চায় মারাত্মক প্রভাব ফেলছে।”
বিদ্যুৎ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের দাবিতে শিক্ষার্থীরা গত বৃহস্পতিবার (২২ মে) উপাচার্য বরাবর স্মারকলিপি দেন। এরপর শনিবার (২৪ মে) রাত সাড়ে ১২টার দিকে উপাচার্যের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ করেন।
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যুৎ আসে কোটবাড়ি সাব-স্টেশন থেকে। সেখান থেকে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে সরবরাহ করা হয়। ফলে যেকোনো মেরামত বা দুর্যোগে একযোগে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে প্রতিষ্ঠানগুলো।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৌশল দপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (বৈদ্যুতিক) মো. জাকির হোসেন বলেন, “হলগুলোতে শিক্ষার্থীরা রাইস কুকার, হিটার, ইলেকট্রিক চুলা ব্যবহার করেন, যা নির্ধারিত ক্ষমতার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ টানে। এ অতিরিক্ত লোডের কারণে সার্কিট পুড়ে যায় এবং লাইন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।”
এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী বলেন, “আমরা সিন্ডিকেট সভায় বিষয়টি তুলেছি। লাইনটি বনজঙ্গল ঘেরা এলাকায় হওয়ায় সামান্য ঝড়বৃষ্টিতেই সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো আন্ডারগ্রাউন্ড ক্যাবলিংয়ের উদ্যোগ নিচ্ছি।”
তবে জেনারেটর স্থাপন নিয়ে তিনি বলেন, “বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) মতো জেনারেটর স্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল ও সময়সাপেক্ষ। বিষয়টি আপাতত বিবেচনায় নেই।”
কোটবাড়ি সাব-স্টেশনের উপ-সহকারী প্রকৌশলী মো. পিন্টু বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদা অনুযায়ী বিদ্যুৎ সরবরাহ করছি। তবে নিজস্ব প্রধান সাব-স্টেশন স্থাপন করতে হলে কর্তৃপক্ষকে বিদ্যুৎ চাহিদা উল্লেখ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। এটি তাদের সিদ্ধান্তের বিষয়।”
ঢাকা/মেহেদী