অন্তর্বর্তী সরকারের কাজেও স্বচ্ছতার অভাব দেখছেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য
Published: 27th, May 2025 GMT
বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, ‘সরকার বদল হলেও বাজেটের কাজের প্রক্রিয়া বদল হয়নি। বৈষম্য কমাতে, কর্মসংস্থান বাড়াতে সরকারের কোনো পরিকল্পনা দেখছি না। বিগত স্বৈরাচারী সরকারের মতোই অন্তর্বর্তী সরকারের কাজেও স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে।’
দেশের ব্যবসায়ী–শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই ও বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল এনটিভির যৌথ আয়োজনে ‘কেমন বাজেট চাই’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে এ কথা বলেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে আজ মঙ্গলবার রাতে এনটিভির স্টুডিওতে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে আরও অতিথি ছিলেন অর্থ মন্ত্রণালয়ে নিযুক্ত প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী, বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী আবদুল মঈন খান, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান, এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো.
অনুষ্ঠানে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘সরকার বদল হলো, কিন্তু প্রক্রিয়া তো বদল হলো না। সরকার এখনো পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। আমরা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন করেছি, কিন্তু বৈষম্য কমানোর উদ্যোগ দেখি না। কর্মসংস্থানের কোনো পরিকল্পনা দেখি না। বাজেট নিয়ে আবার সেই তথাকথিত পুরোনো আলোচনা চলছে। এই আলোচনা যদি দুই বছর আগে হতো, একই রকম লাগত। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে, এই সরকারের সময়ে ২৭ লাখ মানুষ আরও দরিদ্র হয়েছে; তাদের মধ্যে ১৮ লাখ নারী। তাহলে নতুন সরকার কী বৈষম্যবিরোধিতা শেখাচ্ছে? এই সরকারকে আসছে বাজেটে বলতে হবে, গত সরকারের চেয়ে তারা ভিন্ন কী করল। এখানে দুই টাকা বাড়িয়েছি, ওখানে দুই টাকা কমিয়েছি, এমন আলোচনায় মন ভরবে না।’
অন্তর্বর্তী সরকারের কাজে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, ‘আপনারা (অন্তর্বর্তী সরকার) যে বাজেট নিয়ে কাজ করছেন, তা তো পতিত সরকারের বাজেট। এই বাজেটে কাঠামোগত কী পরিবর্তন করলেন? আপনাদের কাজে স্বৈরাচারী সরকারের মতো স্বচ্ছতার অভাব দেখেছি। তারা (বিগত সরকার) যেভাবে সবাইকে থামিয়ে দিয়েছে, একই কাজ একইভাবে আপনারা করলেন। পতিত সরকারের যে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) ছিল, সেটি থেকে কীভাবে ব্যয় কমানো হলো? যেসব অতিমূল্যায়িত বৃহৎ প্রকল্প (মেগা প্রজেক্ট) ছিল, সেগুলো থেকে কোথায় টাকা কমিয়েছেন, তা জানি না। আমি তো মেগা প্রকল্পে আবারও অর্থের বরাদ্দ দেখতে পাচ্ছি।’
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, আলাপ–আলোচনার উন্মুক্ততা না থাকলে ঠিক কাজও বেঠিক হয়ে যায়। আলোচনার সুযোগ না থাকলে স্বৈরাচারী সরকারের পতনের পর কী পরিবর্তন হলো, সে প্রশ্ন তোলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে এনবিআরকে ভাগ করার উদাহরণ দেন তিনি। দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, এনবিআরকে দুই ভাগ করা একটি সঠিক উদ্যোগ। শ্বেতপত্রেও এটির কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এনবিআর ভাগের ক্ষেত্রে আলাপ–আলোচনা না করায় এখন দুঃখজনক পরিণতি হয়েছে। এটি হওয়ারই কথা ছিল। কারণ, ঠিক কাজও আলাপ–আলোচনা ছাড়া করলে এ রকম পরিণতি হবে। একই উদাহরণ দেওয়া যায় শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে। আইসিইউতে থাকা শেয়ারবাজার চালুর জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু সেটিও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া বিএসইসির পক্ষে একা কোনো দিনও করা সম্ভব নয়।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য আরও বলেন, ‘এই সরকার নিঃসন্দেহে বৈধ সরকার; কিন্তু নির্বাচিত সরকার তো নয়। ফলে সরকারের সীমাবদ্ধতা থাকবে। তবে এতগুলো সংস্কারের কর্মসূচি হয়েছে; সবাই সংস্কারের, নির্বাচনের, বিচারের পথরেখা চায়। আমি জানতে চাই, অর্থনীতির পথরেখা কোথায়?’
দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়িয়েছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী আনিসুজ্জামান চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘যাঁরা বলেন, দেশের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়ায়নি, আমি তাঁদের সঙ্গে ভিন্ন মত দিতে চাই। দেশের অর্থনীতি আইসিইউতে চলে গিয়েছিল। লাইফ সাপোর্টের জন্য বিগত সরকার আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কর্মসূচিতে যুক্ত হয়েছিল। আইএমএফের কর্মসূচি অন্তত তিন–চার বছর স্থায়ী হয়। কিন্তু আমরা আইএমএফের দ্বিতীয় কিস্তির পর্যালোচনা পর্বেই আইসিইউ থেকে বের হয়ে গেছি। এটা অনেক বড় অর্জন।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বাজেটটিও অন্তর্বর্তী বাজেট; সত্যিকার বাজেট নয়। কারণ, এই বাজেট কেমন হবে, সেটি গত ৯ মাসে একবারও দেশের মানুষের সঙ্গে আলাপ করেনি সরকার। সরকার প্রায় ১৫টির মতো সংস্কার কমিশন করেছে। এ জন্য সবার সঙ্গে আলোচনা করছে। তাহলে বাজেটের ক্ষেত্রেও এমন কেন করা হয়নি? এটা তো কোনো ঔপনিবেশিক সরকার নয় যে আলোচনা করবে না।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান বলেন, ‘গত বছরের চেয়ে রাজস্ব সংগ্রহে আমরা এগিয়ে রয়েছি। এবারের বাজেটে রাজস্ব আরও বাড়ানোর চেষ্টা থাকবে। পাশাপাশি ব্যবসা সহজ করার জন্য বিদ্যমান যেসব বাধা আছে, সেগুলো যতটা সম্ভব দূর করার চেষ্টা আমরা করব। তবে কর অব্যাহতির যে সংস্কৃতি আছে, সেখানে থেকে আমরা বের হতে চাই। নতুন করে কর অব্যাহতি দেওয়া হবে না।’
বিকেএমইএর সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে বাজেটের আগে যেসব পরামর্শ দিতাম, তার তেমন প্রতিফলন বাজেটে দেখা যেত না। তবে এ বছর আমরা আশাবাদী যে এনবিআর যৌক্তিকভাবে বেশ কিছু পরামর্শ আমলে নেবে।’
মোহাম্মদ হাতেম আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার আসার পরে বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে অর্থনীতি অনেকটা চাঙা হয়েছে। তবে বাংলাদেশের শিল্প খাত অধিকাংশ ক্ষেত্রে আইসিইউতেই রয়েছে বলা যায়। আইসিইউ থেকে বের করতে হলে এখনো কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা প্রয়োজন।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র র ক ত সরক র র গত সরক র অন ষ ঠ ন ব গত স
এছাড়াও পড়ুন:
রোজার আগেই নির্বাচন, এরপর আগের কাজে ফিরে যাবেন
অন্তর্বর্তী সরকার সময়মতো ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন আয়োজনের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ বলে উল্লেখ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, আগামী ফেব্রুয়ারিতে পবিত্র রমজানের আগেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনের পর তিনি তাঁর আগের কাজে ফিরে যাবেন।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে এসব কথা বলেছেন প্রধান উপদেষ্টা। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ওয়াশিংটন থেকে ভিডিও ফোনকলে অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে কথা বলেন জর্জিয়েভা।
এ সময় তাঁরা বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংস্কার, আঞ্চলিক পরিস্থিতি এবং আগামী ফেব্রুয়ারিতে সাধারণ নির্বাচনের পূর্ববর্তী চ্যালেঞ্জ নিয়ে আলোচনা করেন।
আলোচনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা। তিনি বলেন, অধ্যাপক ইউনূস দায়িত্ব গ্রহণের পর বাংলাদেশের অর্থনীতি উল্লেখযোগ্যভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে এবং এই কৃতিত্ব তাঁর নিজের।
অর্থনীতির সংকটকালীন পরিস্থিতি স্মরণ করে আইএমএফ প্রধান বলেন, ‘আপনার অর্জন আমাকে মুগ্ধ করেছে। অল্প সময়ে আপনি অনেক কিছু করেছেন। যখন অবনতির ঝুঁকি অত্যন্ত বেশি ছিল, তখন আপনি দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন। আপনি সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তি।’
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বিশেষভাবে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতা এবং রিজার্ভ পুনরুদ্ধারের জন্য সরকারের সাহসী পদক্ষেপ, বাজারভিত্তিক বিনিময় হার প্রবর্তনের প্রশংসা করেন।
অধ্যাপক ইউনূস বাংলাদেশের এক সংকটময় সময়ে আইএমএফ প্রধানের অবিচল সহায়তার জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বলেন, ‘চমৎকার সহায়তার জন্য ধন্যবাদ।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, গত বছর নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে তাঁদের প্রথম সাক্ষাৎ বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথ সুগম করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল।
কথোপকথনে আইএমএফ প্রধান অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয় বৃদ্ধি এবং ব্যাংকিং খাতে গভীর সংস্কার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, ‘শক্ত অবস্থানে থাকতে হলে সংস্কার অনিবার্য। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসের এক অমূল্য মুহূর্ত।’
অধ্যাপক ইউনূস জানান, তাঁর সরকার ইতিমধ্যে ব্যাংকিং খাত পুনর্গঠন এবং রাজস্ব সংগ্রহ জোরদারের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, ‘আমরা এক বিধ্বস্ত ও সম্পূর্ণ ভেঙে পড়া অর্থনীতি উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছি। কিছু ব্যক্তি আক্ষরিক অর্থে ব্যাগভর্তি টাকা ব্যাংক থেকে নিয়ে পালিয়ে গেছে।’
এ ছাড়া আঞ্চলিক পরিস্থিতি নিয়েও আলোচনা হয়। এর মধ্যে ছিল নেপালে চলমান যুব আন্দোলন এবং আসিয়ানভুক্তির জন্য বাংলাদেশের আকাঙ্ক্ষা। অধ্যাপক ইউনূস আঞ্চলিক কানেক্টিভিটি জোরদারের লক্ষ্যে ঢাকার বৃহৎ অবকাঠামো উদ্যোগ—যেমন নতুন বন্দর ও টার্মিনাল প্রকল্প—সম্পর্কেও অবহিত করেন।
আলোচনাকালে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এবং অর্থসচিব খায়রুজ্জামান মজুমদার উপস্থিত ছিলেন।