সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই যখন প্রয়োজন
Published: 27th, March 2025 GMT
এ সময়ে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি বিতর্ক আমাদের চিন্তাধারাকে খানিকটা আচ্ছন্ন করে রেখেছে। ‘সংস্কার ছাড়া নির্বাচন নয়’ বনাম ‘নির্বাচনে দেরি হলে সংস্কার নয়’– এই বিতর্কে সব রাজনৈতিক দল এতটাই জড়িয়ে পড়েছে যে, রাষ্ট্র কাঠামোর বিভিন্ন স্তরে যেসব জরুরি সংস্কার এখনই প্রয়োজন, সেগুলো থেকে তাদের নজর অন্যদিকে সরে যাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, আমাদের সংস্কার এবং জাতীয় নির্বাচন– দুটোই প্রয়োজন। ২০২৫ সালের ডিসেম্বর বা ২০২৬ সালের জুনের মধ্যেই তা অবশ্যই করা সম্ভব।
বাংলাদেশের জনগণ চায়, সংস্কারের এই সুবর্ণ সুযোগ যেন হাতছাড়া না হয়। তবে দেশের মানুষ বর্তমান জটিল পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন এবং তাদের এই মুহূর্তে অগ্রাধিকার হচ্ছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি।
যেসব রাজনৈতিক দল নির্বাচনকে সংস্কারের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ মনে করছেন, তারা সংস্কারের অপরিহার্যতাকে খাটো করে দেখছেন। তারা হয়তো ভুলে যাচ্ছেন যে, বাকশাল প্রবর্তন, দু’বারের সামরিক শাসন, ১৯৯১ সালে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পর থেকে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক ব্যবস্থার বিকাশ এবং দীর্ঘ ১৫ বছরের স্বৈরাচারী শাসন কেবল এই দেশের বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, পুলিশসহ সব ক্ষেত্রে নিয়মিত ইতিবাচক সংস্কারের পথই রুদ্ধ করেনি, বরং শাসন ব্যবস্থাকে জনসেবামূলক, গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক করার পরিবর্তে শাসকদের অস্ত্রে পরিণত করেছে। কাজেই সংস্কারের গুরুত্ব নিয়ে কোনো সংশয়ের অবকাশ নেই।
অন্যদিকে, যারা সংস্কারকে নির্বাচনের ওপরে স্থান দিচ্ছেন, তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের গুরুত্ব এবং দ্রুত জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের প্রয়োজনীয়তা যথাযথভাবে অনুধাবন করছেন না। কেননা, গত তিনটি নির্বাচনে ভোটারদের ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। দেশে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার ও সংসদ ফিরিয়ে আনা অত্যন্ত জরুরি। জাতীয় নির্বাচন জনগণকে সেই অধিকার ফিরিয়ে দেবে, যেখানে তারা সুচিন্তিতভাবে সুষ্ঠু ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণ করতে পারবে কে বা কোন দল দেশের নতুন শাসনভার পাবে।
শেখ হাসিনার শাসনামলে লাগামহীন দুর্নীতি ও অপশাসনের মধ্যেও সবচেয়ে বেশি জনরোষ সৃষ্টি করেছিল তার কারসাজিমূলক খারাপ নির্বাচনগুলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের জনপ্রিয়তা ও প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড.
আমাদের এটি মনে রাখতে হবে যে, একটি সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কেবল সরকার গঠন করে না, বরং ক্ষমতাসীনদের জবাবদিহিও নিশ্চিত করে। আমাদের শাসন ব্যবস্থায় সম্ভবত সবচেয়ে উপেক্ষিত শব্দ হচ্ছে ‘জবাবদিহি’। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীরা নাগরিকদের করের টাকায় বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা ভোগ করলেও তাদের কোনো জবাবদিহি নেই। আমাদের পুলিশ, গোয়েন্দা সংস্থা ও নিরাপত্তা বাহিনীগুলো জনগণকে দমন করার ক্ষমতা রাখে; অথচ এটা জিজ্ঞাসা করার অধিকার জনগণের নেই যে, তারা আদৌ নিয়মতান্ত্রিকভাবে ও আইন মেনে তাদের দায়িত্ব পালন করছে কিনা।
এর বাইরেও প্রতিটি পেশায় অল্প কিছু মানুষ সিস্টেমের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজেদের সততা ও পেশাদারিত্ব ধরে রেখেছেন এবং প্রতিনিয়ত তারা নানা অনিয়ম ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, আমাদের প্রশাসনিক ব্যবস্থা বা আমলাতন্ত্র ভেতর থেকে পুরোপুরি পচে গেছে। সমাজে পচন ধরলে রাষ্ট্র কাঠামোতে পচন ধরবেই।
এটি সত্য যে, রাজনৈতিক নেতাদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন কার্যকর উপায়। অতীতে এটিকে কার্যকরভাবে ব্যবহার করা হয়নি। তবে সংস্কার কমিশনগুলোর প্রস্তাবিত সুপারিশগুলো ঠিকঠাকভাবে বাস্তবায়িত হলে ভবিষ্যতে দেশের শাসন ব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে।
অন্তর্বর্তী সরকার সময়োপযোগী উদ্যোগ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলোতে সংস্কার কমিশন গঠন করায় প্রশংসার দাবি রাখে। সাতটি কমিশন ইতোমধ্যেই তাদের সুপারিশ জমা দিয়েছে। ঐকমত্য কমিশন এসব সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপও শুরু করেছে। সংবিধান, জনপ্রশাসন, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ ও দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুপারিশ ইতোমধ্যে জনগণের সামনে এসেছে। এখন এসব সুপারিশমালা নিয়ে জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে ব্যাপক আলাপ-আলোচনা প্রয়োজন।
গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সংস্কার প্রস্তাবগুলো এখন সরকারের হাতে। আমরা মনে করি, সংস্কার শুরু করা যেতে পারে পুলিশ বিভাগ দিয়ে; এ বিষয়ে ইতোমধ্যেই সবার সম্মতি পাওয়া গেছে। আমরা চাই, পুলিশ শাসক দলের ‘লাঠিয়াল বাহিনী’ না হয়ে আইন ও ন্যায় বিচারের বাহক হয়ে উঠুক এবং তাদের এই ইতিবাচক পরিবর্তন হতে হবে স্থায়ী। জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুলিশের উচিত ন্যায় বিচারের প্রতিনিধিত্ব করা, নিপীড়নের নয়। পুলিশ সংস্কারের যে সুপারিশগুলো দেওয়া হয়েছে, তার অধিকাংশই সময়োপযোগী, যথাযথ ও প্রাসঙ্গিক। সংস্কার প্রক্রিয়া পুলিশের মধ্য দিয়েই শুরু করা যেতে পারে এবং এই প্রক্রিয়া অন্যান্য বিষয়ে সংস্কারের জন্য দৃষ্টান্ত হতে পারে।
জনপ্রশাসন সংস্কারও জরুরি। আমাদের প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের সেবায় নিয়োজিত থাকে এবং বলাই বাহুল্য, রাজনৈতিক দলবাজির মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে। তবে এখানে নীতিবান কর্মকর্তাও রয়েছেন, যদিও তারা সংখ্যায় অতি নগণ্য। অধিকাংশ কর্মকর্তাই দুর্নীতিগ্রস্ত, অদক্ষ ও জবাবদিহির বাইরে। এই খাতে সংস্কার সবচেয়ে বেশি বাধার মুখে পড়বে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। তাই সরকারকে জনপ্রশাসন সংস্কারে হতে হবে আরও দৃঢ়সংকল্প।
এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি জরুরি হলো নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। অন্য সব বিষয়ের আগে ও দ্রুততম সময়ে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার শেষ করতে হবে। পুরো সংস্কার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে গতিশীল করতে হবে। সংস্কার প্রস্তাবগুলো কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটি রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুধাবন করতে হবে। তাহলেই কেবল সরকার আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে এগুলো বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে।
এই সরকারের হাতে প্রায় এক বছর সময় আছে। যদি এই সময়টুকু দক্ষতা, নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে কাজে লাগানো যায় এবং অপ্রয়োজনীয় বিষয়ে না জড়িয়ে জরুরি কাজে মনোযোগী হওয়া যায়, তাহলে কাঙ্ক্ষিত সময়সীমার মধ্যেই ইতিবাচক সংস্কার ও নির্বাচন– দুটোই সম্ভব হবে।
আমরা জানি, দ্রুত নির্বাচন হলে কেউ বাড়তি সুবিধা পাবে, আবার কেউ পাবে না। তবে রাজনৈতিক স্বার্থ বিবেচনায় না রেখে জনগণের স্বার্থকে সবার ওপরে রাখতে হবে। গণতন্ত্র, সাম্য, ন্যায়বিচার ও কল্যাণ রাষ্ট্র গঠনের পথে এগিয়ে যাওয়ার এই সুযোগ কোনোভাবেই হাতছাড়া করা যাবে না।
তাই এখন নতুন করে অপ্রয়োজনীয় কোনো বিতর্কে না জড়িয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করতে হবে। তারপর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের দিকে সরকারকে সম্পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে। এতে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা পাবে। পারস্পরিক বিভেদ ভুলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি সব রাজনৈতিক দলের সর্বাত্মক সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে করে তারা নিষ্ঠা ও স্বচ্ছতার সঙ্গে সংস্কার ও নির্বাচন আয়োজনের দুটি লক্ষ্যই সফলভাবে পূরণ করতে পারে।
শেখ নাহিদ নিয়াজী; সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ
nahidneazy@yahoo.com
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: র প রস ত ব ব যবস থ র জনগণ র আম দ র জনপ র সবচ য় সরক র
এছাড়াও পড়ুন:
এনসিপির কাছে প্রত্যাশা
সচেতন জনগণ দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগ ও বিএনপির বিকল্প দল খুঁজছে। বিগত সরকারের আমলে ড. কামাল হোসেনের গণফোরাম এবং মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্য কিছুটা এগিয়ে জনগণের মনে আশার সঞ্চার করলেও আওয়ামী লীগের কারণে তা ভেস্তে যায়। এর পর কোনো দলকে ফ্যাসিস্ট সরকার বিকল্প গড়তে দেয়নি। চব্বিশের আন্দোলনে বিজয়ী ছাত্রদের নতুন দল নিয়ে আবার জনগণের মধ্যে আশার সঞ্চার হয়েছে। আশার দিক হচ্ছে, ছাত্রদের দল জনগণের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ করে জনবান্ধব কর্মসূচির মাধ্যমে এগিয়ে যাবে এবং এক সময় ক্ষমতায় গিয়ে স্বাধীনতার অধরা স্বপ্ন বাস্তবায়ন করবে। যেখানে থাকবে না বসবাসে আকাশসম বৈষম্য; থাকবে না কথা বলার ভয়। সংখ্যালঘুরা নিজেদের দেশ নিয়ে গর্ব করবে। থাকবে নারী স্বাধীনতা ও ভোটাধিকার।
স্বাধীনতার পর থেকে আমরা দেখে আসছি আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে দেশ-বিদেশে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। অথচ সংখ্যালঘুরা তাদের দ্বারাই বেশি নির্যাতিত হয়েছে বলে আমরা জানি। তাই নতুন দল ‘এনসিপি’কে প্রকৃত অর্থেই একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসেবে গড়ে উঠতে হবে। ভুললে চলবে না– একাত্তর আমাদের শিকড়। গাছ যেমন শিকড় বিনা বাঁচতে পারে না, তেমনি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব ও আকাঙ্ক্ষা ধারণ ব্যতীত কোনো দল সামনে এগোতে পারবে না। তাই প্রত্যাশা, এনসিপি মধ্য বাম দল হিসেবে গড়ে উঠবে এবং ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’-এর পরিবর্তে উচ্চারিত হবে ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হোক’। গতানুগতিক বা মধ্যপন্থি দল বিএনপি তো রয়েছে, যাকে একই পন্থায় এনসিপি অতিক্রম করতে পারবে না। অন্যদিকে এনসিপি সংবিধান সংস্কার কমিশনের সঙ্গে ২৯টিতে ভিন্নমত পোষণ করলেও ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ মতবাদ বাদ দেওয়া এবং ‘বহুত্ববাদ’ গ্রহণে ঐকমত্য পোষণ করেছে। কিন্তু ‘বহুত্ববাদ’ একটি অস্পষ্ট ধারণা, যা দ্বারা অনির্দিষ্ট অনেক কিছুকে বোঝায়। আবার যেখানে সংবিধানে রাষ্ট্রের নিজস্ব ধর্ম রয়েছে, সেখানে বহুত্ববাদের গুরুত্ব আর থাকে না। এনসিপিকে দ্রুত এগোতে হলে প্রকৃতই স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে হবে, যেন দলনিরপেক্ষ উদারমনা জনতা ও সংখ্যালঘুরা এর নিচে আশ্রয় নিতে পারে। এনসিপির মূল বা শিকড় হতে হবে স্বাধীনতার নেতৃত্ব দেওয়া সব নেতার অবদানের মূল্যায়ন এবং স্বাধীনতার চেতনাকে ধারণ করা।
এ সরকারের মন্দ কাজের জোরালো সমালোচনা করতে হবে। মনে রাখতে হবে– সরকারঘেঁষা কোনো দল সহজে জনপ্রিয় হয় না। ‘এনসিপি’কে বুঝতে হবে আধুনিক দুনিয়ায় কোনো চরম পন্থার স্থান নেই এবং যারা
চরম ডান বা চরম বামের রাজনীতি করছেন, তাদেরকেও ভবিষ্যতে সাচ্চা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতিতে ফিরে আসতে হবে। আশা করি, এনসিপির গঠনতন্ত্রে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারা দেখতে পাব।
নুরুল আমিন: নিবন্ধকার, ঢাকা
cuzamanctg@gmail