আমরা তিন ভাইবোন। আমি সবার বড়। আমার চার বছরের ছোট আলফাজ হোসেন– ডাকনাম বাবুল। আমার কোনো ডাকনাম রাখা হয়নি। দুই ভাইয়ের পর আমাদের একটা মাত্র বোন। বয়সে সে আমার চেয়ে ২০ বছরের ছোট। বোনের নাম রুমানা আফরোজ। তাকে রুমানা, রুমা, উমা– এসব নামে সবাই ডাকে। আমি তাকে ছোটবেলা থেকে আদর করে ‘মনা’ ডাকি। সে স্বামীসহ থাকত আমেরিকায়। তাদের একটা সন্তান হলো। কিছুদিন পর আম্মাকে তারা নিয়ে গেল, কিছুদিন তাদের সঙ্গে থাকবে বলে। আম্মা গেলেন। শুনি আম্মাকে নিয়ে তারা প্রায়ই এখানে-ওখানে বেড়াতে যায়, শপিংমলে কেনাকাটা, পার্কে হাঁটা, একসঙ্গে বাজার করতে যাওয়া– এসবের ছবি পাঠানো হয়, দেখি।
আমরা আম্মাকে মিস করি কিন্তু ছবিতে দেখি, তিনি খুব উপভোগ করছেন সময়গুলো। তিনি রান্না করতে ভালোবাসেন, ছবিতে দেখি মেয়ে জামাইয়ের বাড়িতে গিয়েও তাদের জন্য রান্না করেন। ফোনে কথা হয়। বলেন, ওখানে রান্না করায় আলাদা আনন্দ পান। কারণ সব উপাদানই হাতের কাছে রাখা থাকে। একটাই অসুবিধা তাঁর, দাঁড়িয়েই সব করতে হয়।
আম্মাকে কোনোদিন বাজার করতে হয়নি। স্বপন একদিন জানায়, মাকে বাজারে নিয়ে যাই আমরা– আম্মা পছন্দ করে বাজার করেন। এটা আম্মার জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। শুনি, রোজ নাতনি সুনিভার সঙ্গে খেলেন। সুনিভাকে লুডো খেলা শেখানো হয়েছে। নাতনি খুব মজা পায়, নানিকে যখন হারাতে পারে। নানির গল্প ফোনে শুনি, লুডোতে হেরে গেলে তিনি নাকি মন খারাপ করেন।
সব ফেলে হুট করে আম্মা একদিন চলে এলেন ঢাকায়। আমেরিকা নাকি লম্বা সময় ধরে থাকার জন্য ভালো জায়গা নয়। কয়েক বছর পর মেয়ে জামাই-নাতনিও ওখান থেকে সব গুটিয়ে দেশে চলে আসে। আমরা অবাক, লোকজনকে বিদেশে চলে যাওয়ার জন্য আগ্রহী দেখি। যেতে পারলে আর ফিরে আসার কথা কেউ ভাবে না আর গোছানো সংসার ফেলে ওরা চলে এলো!
স্বপন, রুমা বা মনা বলে– দাদাভাই, আম্মা চলে আসার পর আমাদের মোটেও ভালো লাগত না। বিশেষ করে সুনিভার কথা ভাবতে শুরু করি আমরা। মেয়েটা কি চমৎকার সময় কাটাত। খুবই হাসি-খুশি দেখতাম। একসময় মনে হতে থাকে, মেয়েটা তো এখানে একা একা বড় হবে কিন্তু দরকার তো পরিবারের মধ্যে, অনেকের সঙ্গে বড় হওয়া।
আম্মা খুবই খুশি, একমাত্র কন্যা রুমাকে সবসময় দেখতে পাবেন, কাছে থাকবে– মেয়ের জামাই, নাতনি। দুই ছেলে, তাদের পরিবার– সবাইকে নিয়ে থাকার চেয়ে আনন্দ আর কীসে আছে! আম্মা প্রায়ই বলতেন, বড় হয়েছি অনেকে একসঙ্গে। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে এসে দেখি, তোদের তিন দাদা আর সবার বাচ্চারা মিলে অনেক বড় একটা পরিবার। সে পরিবারে বড়রা ভালোবেসেছে, একদল ছোটও ছিল– তারা ছিল বলে দ্রুত দুঃখ ঘুচে গিয়েছিল, অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার যে কষ্ট তা সহজে ভুলে যেতে পেরেছিলাম।
আম্মা বলতেন, একসঙ্গে অনেকে থাকা মানে মনে সংকীর্ণতা জমতে পারে না। অনেক মানুষ, বিচিত্র ভাব অনুভবের মধ্যে কাটানো খুবই আনন্দের। অনেক রকমের সম্পর্কের মধ্যে কাটাতে পারা মানে মন বহু রকমের সুবিধা-অসুবিধা গ্রহণ করতে শেখে।
আমরা দুই ভাই একসঙ্গে থাকতাম। তার বিয়ের পরও থেকেছি একসঙ্গে। আম্মা একদিন বললেন, তোদের একসঙ্গে থাকাটা পছন্দ করি আবার এটাও জরুরি, বাবুল এ রকম ভাই-ভাবির সংসারে থাকলে সংসার কী জিনিস বুঝতে পারবে না। সেটি বোঝা খুব জরুরি। আরও বলেছিলেন, ছোট বউটার দিকটাও ভাবতে হয়– শীলা তোদের সংসারে ছোট ভাইয়ের বউ হয়ে থাকল, তাও ঠিক নয়। সে একটা মেয়ে, নিজের মতো করে একটা সংসার হবে, এমন ইচ্ছা মনে থাকা খুবই স্বাভাবিক।
শীলা আর বাবুলের আলাদা সংসার হলো। চার-পাঁচ মিনিটের দূরত্বে থাকি আমরা। ওদের দুটো মেয়ে– নির্ভনা আর নির্জনা। বোনটার এখন দুটো মেয়ে– সুনিভা আর আরিমা। আরাফ ও ঈমান আমাদের দুই ছেলের নাম। আমরা ছিলাম তিন ভাই বোন– এখন আমরা ১২ জন। এই ১২ জনের কেন্দ্র ছিলেন আম্মা। একদিন হাসতে হাসতে বড় বউ তাজীনকে বলেছিলেন, বড়কে একটু বেশি ভার বহন করতে হয়। আমি বড় বউ হয়ে একটা বড় সংসারে ঢুকেছিলাম। নিজের মা-বাবার সংসারে আমি ছিলাম বড় মেয়ে। ছিলাম আদরের ধন– কুটো নেড়ে খেতে হয়নি। আমার রাগ বেশি ছিল, ধৈর্য ছিল কম। সংসার করতে এসে বুঝি– ধৈর্য বাড়াতে হবে, রাগ কমাতে হবে।
আম্মাকে ঘিরে বসা, কথা বলা, শোনা– সবার জন্য আনন্দের ছিল। বড়দের অভিজ্ঞতার কথা শোনাও দরকারি। বই আমাদের সব শেখায় না, মানুষকে পড়তে হয়, দুনিয়াও আমাদের রোজ কতকিছু শেখায়। আম্মা বলতেন, যেদিন দেখবে শুনতে ইচ্ছা করে না, বুঝতে হবে শেখায় আগ্রহ কমছে। তখনই সাবধান হয়ে যাওয়া উচিত– সামনে অনেক কিছুর প্রতি মনোযোগ আগের মতো থাকবে না, অনেক কিছুতে অনীহা বাড়বে। এটা বিপজ্জনক। সারাজীবন সংসারই করেছেন তিনি, মনপ্রাণ ঢেলে। একটু অবসর যখন মিলেছে, তখন আব্বা যে নেই, সেই কষ্টটা তাঁর মনে চেপে বসে। তাঁর মনে হতো, আব্বা একটু বেশি আগেই তাঁকে ছেড়ে গেছেন।
যতদিন আম্মা বেঁচেছিলেন, সপ্তাহে অন্তত একদিন আমরা তিন ভাইবোন সবার বাচ্চাসহ আম্মার সঙ্গে কাটাতাম। আম্মা খুশি হতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, এটা দরকার। এ ব্যবস্থায় বিশেষ করে বাচ্চারা খুব ভালো থাকে। আম্মা নেই। আমরা এখনও আম্মার চাওয়া অনুযায়ী একসঙ্গে হওয়ার নিয়মটা চালু রেখেছি। আম্মা গ্রামের বাড়িতে যাওয়া-আসা করতেন। একসময় তাঁর স্বাস্থ্যগত কারণে আমরা গ্রামে যেতে দিতাম না। রাগ হয়ে যেতেন তিনি। বলতেন, তোরা আমাকে যতই আদর যত্নে রাখিস, আমার আনন্দ, আমার সংসার পারুলিয়াতেই। সেখানে তাঁর ঘরবাড়ি, সংসার মানে একটা বড় উঠানের চারদিকে ঘর। সংসার সামলানোর পুরোনো লোকজন, খোঁজখবর নিতে, গল্প করতে আসা গ্রামের মানুষজন আর আম্মার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা, উপভোগের জায়গা রান্নাঘর।
আম্মাকে আমরা গ্রামে যেতে দিতে চাইতাম না। এখন তিনি সেখানেই আছেন। আব্বার পাশাপাশি, মাটিতে। মাটির ওপরে আমাদের সুন্দর বাড়ি। সব সুন্দর আনন্দের নয়, অনেক সুন্দরের ভেতরে থাকে অনন্ত দীর্ঘশ্বাস। আমাদের সব আছে। আব্বা নেই, আম্মা নেই। দু’জন না থাকা অনেক কিছু না থাকার সমান। আম্মা বলতেন, তোরা একত্রে থাকিস, তাতে মনে হবে আমরাও আছি তোদের সঙ্গে। v
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: একসঙ গ আম ম র আম ম ক আম দ র পর ব র একদ ন আনন দ বলত ন
এছাড়াও পড়ুন:
এক ফ্রেমে দুই প্রজন্মের শীর্ষ অভিনেতা
আফজাল হোসেন ও শাকিব খান– দুই সময়ের সেরা দুই তারকা। প্রথমজন এখন অভিনয়ে অনিয়মিত, পরেরজনের এখন ব্যস্ত সময়। একজনের অভিনয়জীবন ৪৭ বছরের, আরেকজনের ২৪ বছরের। উভয়েই একে অপরের প্রতি মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন আগেই। যদিও দু’জনের সামনা-সামনি দেখা খুব বেশি দিনের নয়। সেটি ২০২১ সালে। সে বছরের ১২ নভেম্বর ভোরে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর বোর্ডিং পয়েন্টে প্রথম দেখা। এরপর একসঙ্গে নিউইয়র্ক যাত্রা। মাঝে কেটে গেছে লম্বা সময়। এক সময় শাকিব খানকে নিয়ে মুগ্ধতার কথা জানিয়েছেন আফজাল হোসেন। সে সময় তিনি বলেছিলেন, এটি কারও অস্বীকার করার উপায় নেই, শাকিব একটি চমৎকার অবস্থান তৈরি করেছে। তার বিশাল এক দর্শক শ্রেণি আছে। সে শুধু বাংলাদেশি ফিল্মের হিরো, তা-ও নয়। যখন সে ভারতের বাংলা সিনেমায় অভিনয় করেছে, আমি দেখেছি, একজন কনটেম্পোরারি হিরোর যা কিছু থাকা লাগে, তার মধ্যে সবই আছে। তার মধ্যে দারুণ একটা পাওয়ার আছে।
শাকিব খানও জানিয়েছিলেন, ছোটবেলা থেকেই আফজাল হোসেনের অভিনয় ও স্টাইলে মুগ্ধ তিনি। এই দুই সেরা তারকা এবার একসঙ্গে একই সিনেমায় অভিনয় করছেন। সেটি ‘তাণ্ডব’। রায়হান রাফী পরিচালিত সিনেমাটির ৭০ শতাংশ শুটিং ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। এর আগে শাকিব খানকে নিয়ে এ নির্মাতার ‘তুফান’ দারুণ প্রশংসিত হয়। নির্মাতা রায়হান রাফী জানিয়েছেন, ‘তুফান’-এর তুলনায় এবার অনেক বেশি চ্যালেঞ্জ নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এবার তাঁর নির্মাণে এক হচ্ছেন দুই সময়ের শীর্ষ এ দু’জন। তাদের একসঙ্গে কাজ করার বিষয়টি এখনও অফিসিয়ালি কিছু জানায়নি পরিচালক ও প্রযোজনা সংস্থা। সূত্রের বরাতে নিশ্চিত হওয়া গেছে বিষয়টি। জানা গেছে, সিনেমায় পুলিশের স্পেশাল ফোর্স ‘সোয়াট’-এর প্রধানের ভূমিকায় দেখা যাবে আফজাল হোসেনকে।
‘তাণ্ডব’ মুক্তি পাবে আগামী ঈদুল আজহায়। এতে শাকিব খানের বিপরীতে বড়পর্দায় অভিষেক হতে যাচ্ছে সাবিলা নূরের। ইতোমধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ছবির বেশ কিছু লুক ভাইরাল হয়েছে। প্রথমে বেশ গোপনীয়তার সঙ্গে শুটিং শুরু করলেও শেষ রক্ষা হয়নি। একাধিক ভিডিও ও স্থিরচিত্রে সেটি প্রকাশ্যে আসে। রাজধানীর এফডিসি ছাড়াও রাজশাহীর বিভিন্ন লোকেশনে শুটিং করছেন শিল্পীরা। সিনেমাটিতে বিদেশি ফাইট ডিরেক্টর ও টেকনিশিয়ানদের যুক্ত করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন নির্মাতা রাফী। তিনি বলেন, ‘এখনই কিছু বলতে চাই না। আগে কাজটা শেষ হোক। অনেক চমক থাকছে সিনেমাটিতে।’ এ ছবির একটি বিশেষ চরিত্রে থাকছেন দুই বাংলার জনপ্রিয় অভিনেত্রী জয়া আহসান। বিভিন্ন চরিত্রে এতে দেখা যাবে শহীদুজ্জামান সেলিম, ফজলুর রহমান বাবু, এফএস নাঈমসহ অনেককেই।
এদিকে আফজাল হোসেনকে সর্বশেষ দেখা গেছে ‘কোনো একদিন’ নামে একটি নাটকে। যে নাটকটি ফারিয়া হোসেনের লেখা ঈদের জন্য নির্মাণ করেন চয়নিকা চৌধুরী। এতে আফজাল হোসেনের সঙ্গে অভিনয় করেন সাদিয়া ইসলাম মৌ। তার আগে ওটিটিতে কনটেন্ট কারাগার সিরিজেও ছিল তাঁর দারুণ উপস্থিতি। সিনেমা নির্মাণেও হাত দিয়েছেন এ অভিনেতা। তাঁর পরিচালিত ডকু-ফিকশন সিনেমা ‘মানিকের লাল কাঁকড়া’। এর আগে নাটক ও বিজ্ঞাপনচিত্র পরিচালনা করলেও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র এটিই তাঁর প্রথম।