ভারতীয় নাগরিককে এনআইডি দেওয়ার অভিযোগে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
Published: 13th, May 2025 GMT
জালিয়াতির মাধ্যমে ভারতীয় নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) দেওয়ার অভিযোগে বাগেরহাটে নির্বাচন কর্মকর্তাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মঙ্গলবার দুদকের সহকারী পরিচালক (এডি) মো. সাইদুর রহমান বাদী হয়ে দুদকের বাগেরহাট জেলা কার্যালয়ে মামলাটি করেন।
দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনে করা মামলায় পারস্পরিক যোগসাজশে এবং ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে এনআইডি তৈরির অভিযোগ করা হয়। আসামিরা হলেন বাগেরহাট সদর উপজেলার তৎকালীন নির্বাচন কর্মকর্তা ও বর্তমানে বরিশাল আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের অতিরিক্ত আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার হাওলাদার (৪৭), চিতলমারী উপজেলার সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন (৬৫) ও চিতলমারী উপজেলার আড়ুয়াবর্নি গ্রামের বাসিন্দা সাবেক সেনাসদস্য মো.
মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়েছে, বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস না করা সত্ত্বেও ফণীভূষণ ওরফে মনি মণ্ডল এবং প্রতুল চন্দ্র মণ্ডলের নামের দুই সহোদরকে চিতলমারী থেকে জন্মনিবন্ধন সনদ ও তা ব্যবহার করে একজনকে এনআইডি তৈরি করে দেওয়া হয়। ওই দুজন ভারতীয় নাগরিক হলেও আড়ুয়াবর্নি গ্রামে থাকা তাঁদের পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রির জন্য স্থানীয় মোশাররফ হোসেন মোল্লা তাঁদের দেশে নিয়ে আসেন এবং ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর ইউনিয়ন পরিষদে জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদন করান।
দুদক সূত্র বলছে, আবেদনের নির্ধারিত ফরমে ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারিতে ফণীভূষণ মণ্ডল এবং ১৯৫৩ সালের ৪ এপ্রিল প্রতুল মণ্ডলের জন্মতারিখ উল্লেখ করা হয়। আবেদনের চার দিন পর তাঁদের দুই ভাইকে জন্মনিবন্ধন দেন চেয়ারম্যান শেখ নিজাম উদ্দিন। এরপর ওই জন্মনিবন্ধন দিয়ে এনআইডির জন্য নির্বাচন কর্মকর্তার কাছে তাঁরা আবেদন করেন। যার পরিপ্রেক্ষিতে বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাচন কার্যালয় থেকে ফণীভূষণের নামে এনআইডি (নম্বর: ১৯৪৮০১২০৮০০০০০০০১) ইস্যু করা হয়।
অনুসন্ধানকালে ফণীভূষণ নামে তৈরি করা এনআইডি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, তাঁর জন্ম তারিখ ১ জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল। কিন্তু তাঁর এনআইডি তৈরি করা হয় ২০১৭ সালে, যা তাঁর জন্মের ৬৯ বছর পর। ভোটার তালিকা থেকে বাদ পড়ার কারণ হিসেবে ভোটার নিবন্ধন ফরমের ৩২ নম্বর ঘরে উল্লেখ করা হয়, চিকিৎসার জন্য এলাকার বাইরে থাকা। ফণীভূষণের বাবার নাম মৃত শশধর মণ্ডল দেওয়া হলেও তৈরি করা এনআইডিতে বাবার নাম মৃত রবীন্দ্রনাথ মণ্ডল। ভোটার নিবন্ধন ফরমের ৭ নম্বর ঘরে বাবার মৃত্যু হয়েছে ১৯৪৪ সালে। সেই অনুযায়ী, বাবার মৃত্যুর চার বছর পরে ফণীভূষণের জন্ম। ফরমে শনাক্তকারী হিসেবে সুষেন মণ্ডল নামের একজনের এনআইডি নম্বর ব্যবহার করে তাঁর স্বাক্ষর জাল করে শনাক্তকারী হিসেবে দেখানো হয়। ফণীভূষণের বর্তমান ঠিকানা দেওয়া হয় বাগেরহাট পৌরসভার সোনাতলা গ্রাম। তবে তদন্তকালে দুদক ওই এলাকায় সেই ব্যক্তির কোনো অস্তিত্ব পায়নি। এমন আরও অনেক জাল–জালিয়াতি হয়েছে এবং ওই এনআইডি ব্যবহার করে ফণীভূষণকে দাতা দেখিয়ে সম্পত্তি বিক্রি করা হয়েছে।
দুদকের বাগেরহাট কার্যালয়ের এডি মো. সাইদুর রহমান বলেন, ফণীভূষণকে তৎকালীন বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা দিলীপ কুমার হাওলাদারের সময়ে এনআইডি দেওয়া হয়েছে। ওই কর্মকর্তা অসৎ উদ্দেশ্যে মোশাররফ হোসেন মোল্লার সঙ্গে পারস্পরিক যোগসাজশে ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিধিবহির্ভূতভাবে জাল–জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে এনআইডি করেছেন, যা দুদকের অনুসন্ধানে প্রাথমিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে। তাই দণ্ডবিধির ৪২০, ৪৬৭, ৪৬৮, ৪৭১, ১০৯ ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫ (২) ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাটি করা হয়েছে।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব যবহ র কর র জন ম র জন য উপজ ল
এছাড়াও পড়ুন:
ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয় সহজে
চট্টগ্রামের লোহাগাড়ার জেরিন আক্তারের জন্ম ১৯৯৬ সালে। জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) ভুলবশত তাঁর নাম ছাপা হয়ে আসে জেরীনা বেগম, জন্ম সাল ১৯৯৯। এনআইডিতে নাম ও জন্ম সাল ভুল থাকায় পাসপোর্ট করতে গিয়ে বিপত্তিতে পড়েন তিনি। ভুল সংশোধনীর জন্য অনলাইনে আবেদন করেন। নির্বাচন কমিশনের (ইসি) নির্দেশনা অনুযায়ীজমা দেন জন্ম সনদ, বিয়ের সনদ, মা-বাবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। আট মাসে নির্বাচন অফিসে অন্তত ১৫ বার ছোটাছুটিও করেছেন। তবু সংশোধন হয়নি তাঁর এনআইডি।
নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তাদের কাছে গেলে তাঁকে নয়ছয় বুঝ দেওয়া হয়। এর মধ্যে নির্বাচন অফিস থেকে বের হতেই দালালের চক্করে পড়েন জেরিন। দালালরা জেরিনকে বলেন, ‘৭০ হাজার টাকার মতো খরচ করলে কয়েক দিনের মধ্যেই কার্ড হাতে পেয়ে যাবেন।’ তিন ধাপে প্রায় ৭০ হাজার টাকা দেওয়ার চার দিনের মাথায় জেরিনের হাতে সংশোধিত পরিচয়পত্র তুলে দেয় তারা।
এনআইডি সংশোধনে এমন তিক্ত অভিজ্ঞতা শুধু জেরিনের নয়; তাঁর মতো আরও অনেক সেবাপ্রত্যাশী মাসের পর মাস ঘুরেও পাচ্ছেন না সংশোধিত পরিচয়পত্র। এসব কারণে এখন ভোগান্তির আরেক নাম চট্টগ্রামের নির্বাচন অফিস। তবে ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা ঘুষ দিলে এনআইডির জটিল সংশোধনও হয়ে যায় সহজে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, চট্টগ্রামের ১৫ উপজেলার প্রায় প্রতিটি নির্বাচন অফিসে চার থেকে পাঁচজন দালাল সক্রিয়। দালালের সঙ্গে সখ্য আছে চট্টগ্রাম ও ঢাকা কার্যালয়ের সব পর্যায়ের কর্মকর্তার। স্থানীয়ভাবে ও নির্বাচন অফিসের আশপাশের কম্পিউটার দোকানের লোকজনও এ কাজে জড়িত। অনেক সময় দালালের সঙ্গে সেবাপ্রত্যাশীর পরিচয় করিয়ে দেন কম্পিউটারের দোকানি। এনআইডি সংশোধন করাতে মোটা অংকের ঘুষের টাকা চার থেকে পাঁচ ভাগে দিতে হয়। ব্যাংক হিসাবের মাধ্যমেও ‘ঘুষ’ লেনদেন হয়। এর সঙ্গে নির্বাচন অফিসের কর্মকর্তারাও জড়িত। এর বেশ কিছু প্রমাণও পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
প্রায় এক বছর ঘুরেও বাবার নামের ছোট একটি সংশোধনী করতে পারেননি কর্নেলহাটের বাসিন্দা শিমুল কুমার। এনআইডিতে ‘ম’-এর স্থলে ‘শ’ বসাতেই গলদ্ঘর্ম হতে হচ্ছে তাঁকে। যৌক্তিক কারণ ছাড়া নির্বাচন কর্মকর্তা আবেদন নাকচ করার পাশাপাশি অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের প্রস্তাব দেন। এ ব্যাপারে নির্বাচন অফিসে একটি লিখিত অভিযোগও করেছেন শিমুল কুমার। তিনি বলেন, ‘নির্বাচন অফিসে গিয়ে কয়েকবার দালালের খপ্পরে পড়েছি। ৫০ হাজার টাকা দিলে তিন দিনের মধ্যে এনআইডি সংশোধন করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন দালালরা।’ শিমুলের মতো এনআইডি সংশোধন করতে গিয়ে দালালের খপ্পরে পড়ার কথা আরও বেশ কয়েক সেবাপ্রত্যাশী সমকালের কাছে স্বীকার করেছেন।
এ ব্যাপারে দুদক-চট্টগ্রাম মেট্রো কার্যালয়ের সহকারী পরিচালক এমরান হোসেন বলেন, ‘এনআইডি সংশোধনে ঘুষ আদায়, হয়রানি, দালালদের দৌরাত্ম্য বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। একটা এনআইডি সংশোধনে কর্মকর্তারা দালালের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকার ওপরে নিয়ে থাকেন। দুই প্রধান কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আছে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে দালালদের একটা সংযোগ আছে। এ বিষয়ে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হচ্ছে। যাচাই-বাছাই করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
দুদকের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘কর্মকর্তা-কর্মচারীর সহযোগিতা ছাড়া ঘুষ দিয়ে এনআইডি সংশোধন করা অসম্ভব। এই কাজে প্রধান অফিসের লোকজনও জড়িত।’
দালাল সক্রিয় থাকার কথা স্বীকার করে সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বশির আহমেদ বলেন, ‘অনেক আগে থেকেই এখানে দালালের উৎপাত ছিল। এটাকে ভাঙার চেষ্টা করায় অনেকে আমার পেছনে লেগেছিল। জানুয়ারিতে দায়িত্ব নেওয়ার সময় ৩২ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। এখন সেটি অনেক কমেছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘ভেতরের কয়েকজনের সংশ্লিষ্টতা তো আছে। প্রতিটা উপজেলায়ও দালাল চক্র আছে।’
আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস সূত্রে জানা গেছে, গত ডিসেম্বর থেকে চার ক্যাটেগরিতে প্রায় ৫৩ হাজার সংশোধনীর আবেদন অনিষ্পন্ন ছিল। নির্বাচন কমিশন ৩০ জুনের মধ্যে সব সংশোধনী নিষ্পত্তির নির্দেশনা দেওয়ায় এখন পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন কর্মকর্তারা। সরকারি বন্ধের দিনেও নিষ্পত্তির কাজ চলায় মাত্র দুই সপ্তাহে অনিষ্পন্ন আবেদনের সংখ্যা ১০ হাজারের নিচে নেমে এসেছে।
এদিকে, ইসি নির্দেশনা দেওয়ায় জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধনের ক্রাশ প্রোগ্রামের আওতায় গত ৬ মাসে সাড়ে ৪৫ হাজার আবেদন সংশোধন করা হয়েছে বলে দাবি করেছে চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন কার্যালয়। গতকাল সোমবার দুপুরে নগরের আঞ্চলিক নির্বাচন কার্যালয়ের সভাকক্ষে আয়োজিত সভায় এ তথ্য জানান সিনিয়র জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা বশির আহমেদ।