কাজী নজরুল ইসলাম জীবদ্দশায় নিজেকে দেখে গেছেন ডাকটিকিটে। এমন রাজকীয় সমাদর জগতের খুব কম মনীষীর জুটেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী এ কবি কত না চিঠি পাঠিয়েছেন খামের ওপর ব্রিটিশরাজের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিট এঁটে! কিন্তু নিজের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিট নজরুল তাঁর কোনো চিঠির খামের ওপর সেঁটেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাকিস্তান ডাক বিভাগ ১৯৬৮ সালের ২৫ জুন নজরুলকে নিয়ে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। অবিকল নকশায় ১৫ ও ৫০ পয়সা মূল্যের ডাকটিকিট দুটি প্রকাশ করার কথা ছিল ১৯৬৮ সালের ২৫ মে কবির ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে। সেই মোতাবেক ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে ১৭ মে একটি ঘোষণা আসে এবং পরের দিন জাতীয় দৈনিকে ঘোষণাটি প্রকাশিত হয়। তবে মুদ্রণের পর ডাকটিকিটে দেখা গেল মস্তবড় ভুল—কবির জন্মবর্ষ ১০ বছর পিছিয়ে লেখা হয়েছে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ। অল্প সময়ের মধ্যে নতুন ডাকটিকিট প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না, তাই প্রকাশের তারিখ গেল পিছিয়ে। ভুল সংশোধন করে এক মাস পর ২৫ জুন প্রকাশ করা হলো নজরুলের কাঙ্ক্ষিত সেই ডাকটিকিট। ভুল তবু রয়েই গেল, এবার কবিতায়। ডাকটিকিটে ছাপা হলো—‘গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে নাহি কিছু বড়/ নাহি কিছু মহীয়ান।’ কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার এই অংশে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী নকশাকার ফজল করিম। কবিতায় আছে—‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,/ নহে কিছু মহীয়ান।’ ডাক বিভাগ দ্বিতীয়বার ভুল সংশোধনীতে গেল না।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবার স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং এ দেশের মাটিতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখে দুটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৭ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত ৪০ পয়সা ও ২ টাকা ২৫ পয়সা মূল্যের সেই ডাকটিকিটগুলোতে দেখা যায়, কবির প্রতিকৃতিসহ তাঁর রচিত বাংলাদেশের রণসংগীতের চারটি চরণ—‘ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,/ আমরা টুটাব তিমির রাত,/ বাধার বিন্ধ্যাচল’ এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি চরণ— ‘বল বীর—/ চির উন্নত মম শির!’
পরবর্তীকালে কবির জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আরও একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ছয় টাকা মূল্যমানের ওই টিকিটে পুনরাবৃত্তি হয়েছে ‘মানুষ’ কবিতার অংশবিশেষ। ভারতের ডাক বিভাগও কাজী নজরুল ইসলামের শততম জন্মবর্ষ স্মরণীয় করে রাখে তিন রুপি মূল্যমানের একটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
২০০৪ সালের ৩ জুন ‘ইরান-বাংলাদেশ মৈত্রী স্মারক’ শিরোনামে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ১০ টাকা মূল্যের দুটি আলাদা ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছেন ফার্সি ভাষার কবি হাফিজ সিরাজী ও বাংলা ভাষার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবি’ খেতাব জুটেছিল তাঁর তুমুল আলোচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য। কবিতাটি তিনি লিখেছেন ১৯২১ সালের শেষ দিকে। বিদ্রোহী কবিতা রচনার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০১১ সালে নজরুলের চারটি ডাকটিকিটসহ একটি সু৵ভেনির শিট প্রকাশ করে।
সু৵ভেনির শিটে বিদ্রোহী কবিতার প্রথম কয়েকটি চরণ মুদ্রিত হয়, ‘বল বীর—/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি’ আমারি,/ নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/ বল বীর—/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/ বল বীর—/ আমি চির-উন্নত শির!’
একই সঙ্গে কবীর চৌধুরীর অনুবাদে কবিতাটির ওই অংশের ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করা হয়। কবিতার পাশাপাশি একশ টাকা মূল্যমানের ওই সু৵ভেনিরে দেখা যায়, সৈনিক বেশে নজরুলের আলোকচিত্র ঘিরে রেখেছে চারটি স্মারক ডাকটিকিট এবং প্রতিটি টিকিটের বুকে রয়েছে কবির নানা বয়সের প্রতিকৃতি। প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে কবির প্রতিকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থাপত্য উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০২২ সালের ২৪ মে সর্বশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: নজর ল ইসল ম নজর ল র বল ব র
এছাড়াও পড়ুন:
ডাকটিকিটে নজরুল
কাজী নজরুল ইসলাম জীবদ্দশায় নিজেকে দেখে গেছেন ডাকটিকিটে। এমন রাজকীয় সমাদর জগতের খুব কম মনীষীর জুটেছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী এ কবি কত না চিঠি পাঠিয়েছেন খামের ওপর ব্রিটিশরাজের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিট এঁটে! কিন্তু নিজের প্রতিকৃতি-সংবলিত ডাকটিকিট নজরুল তাঁর কোনো চিঠির খামের ওপর সেঁটেছিলেন কি না, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পাকিস্তান ডাক বিভাগ ১৯৬৮ সালের ২৫ জুন নজরুলকে নিয়ে প্রথম ডাকটিকিট প্রকাশ করে। অবিকল নকশায় ১৫ ও ৫০ পয়সা মূল্যের ডাকটিকিট দুটি প্রকাশ করার কথা ছিল ১৯৬৮ সালের ২৫ মে কবির ৬৯তম জন্মবার্ষিকীতে। সেই মোতাবেক ডাক বিভাগের পক্ষ থেকে ১৭ মে একটি ঘোষণা আসে এবং পরের দিন জাতীয় দৈনিকে ঘোষণাটি প্রকাশিত হয়। তবে মুদ্রণের পর ডাকটিকিটে দেখা গেল মস্তবড় ভুল—কবির জন্মবর্ষ ১০ বছর পিছিয়ে লেখা হয়েছে ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দ। অল্প সময়ের মধ্যে নতুন ডাকটিকিট প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না, তাই প্রকাশের তারিখ গেল পিছিয়ে। ভুল সংশোধন করে এক মাস পর ২৫ জুন প্রকাশ করা হলো নজরুলের কাঙ্ক্ষিত সেই ডাকটিকিট। ভুল তবু রয়েই গেল, এবার কবিতায়। ডাকটিকিটে ছাপা হলো—‘গাহি সাম্যের গান—/ মানুষের চেয়ে নাহি কিছু বড়/ নাহি কিছু মহীয়ান।’ কিন্তু কাজী নজরুল ইসলামের ‘মানুষ’ কবিতার এই অংশে তালগোল পাকিয়ে ফেলেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের উর্দুভাষী নকশাকার ফজল করিম। কবিতায় আছে—‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই,/ নহে কিছু মহীয়ান।’ ডাক বিভাগ দ্বিতীয়বার ভুল সংশোধনীতে গেল না।
৯ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র থেকে পৃথক হয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অতঃপর ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে সপরিবার স্বাধীন বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয় এবং এ দেশের মাটিতেই ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। বাংলাদেশ ডাক বিভাগ কবির প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী স্মরণীয় করে রাখে দুটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে। ১৯৭৭ সালের ২৯ আগস্ট প্রকাশিত ৪০ পয়সা ও ২ টাকা ২৫ পয়সা মূল্যের সেই ডাকটিকিটগুলোতে দেখা যায়, কবির প্রতিকৃতিসহ তাঁর রচিত বাংলাদেশের রণসংগীতের চারটি চরণ—‘ঊষার দুয়ারে হানি’ আঘাত/ আমরা আনিব রাঙা প্রভাত,/ আমরা টুটাব তিমির রাত,/ বাধার বিন্ধ্যাচল’ এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতার দুটি চরণ— ‘বল বীর—/ চির উন্নত মম শির!’
পরবর্তীকালে কবির জন্মশতবার্ষিকী ঘিরে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ আরও একটি ডাকটিকিট প্রকাশ করে। ছয় টাকা মূল্যমানের ওই টিকিটে পুনরাবৃত্তি হয়েছে ‘মানুষ’ কবিতার অংশবিশেষ। ভারতের ডাক বিভাগও কাজী নজরুল ইসলামের শততম জন্মবর্ষ স্মরণীয় করে রাখে তিন রুপি মূল্যমানের একটি ডাকটিকিট প্রকাশের মধ্য দিয়ে।
২০০৪ সালের ৩ জুন ‘ইরান-বাংলাদেশ মৈত্রী স্মারক’ শিরোনামে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ১০ টাকা মূল্যের দুটি আলাদা ডাকটিকিটে স্থান পেয়েছেন ফার্সি ভাষার কবি হাফিজ সিরাজী ও বাংলা ভাষার কবি কাজী নজরুল ইসলাম।
নজরুলের ‘বিদ্রোহী কবি’ খেতাব জুটেছিল তাঁর তুমুল আলোচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার জন্য। কবিতাটি তিনি লিখেছেন ১৯২১ সালের শেষ দিকে। বিদ্রোহী কবিতা রচনার ৯০ বছর পূর্তিতে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০১১ সালে নজরুলের চারটি ডাকটিকিটসহ একটি সু৵ভেনির শিট প্রকাশ করে।
সু৵ভেনির শিটে বিদ্রোহী কবিতার প্রথম কয়েকটি চরণ মুদ্রিত হয়, ‘বল বীর—/ বল উন্নত মম শির!/ শির নেহারি’ আমারি,/ নত শির ওই শিখর হিমাদ্রির!/ বল বীর—/ বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি’/ চন্দ্র সূর্য গ্রহ তারা ছাড়ি’/ ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া,/ খোদার আসন ‘আরশ’ ছেদিয়া/ উঠিয়াছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর!/ মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর!/ বল বীর—/ আমি চির-উন্নত শির!’
একই সঙ্গে কবীর চৌধুরীর অনুবাদে কবিতাটির ওই অংশের ইংরেজি অনুবাদও যুক্ত করা হয়। কবিতার পাশাপাশি একশ টাকা মূল্যমানের ওই সু৵ভেনিরে দেখা যায়, সৈনিক বেশে নজরুলের আলোকচিত্র ঘিরে রেখেছে চারটি স্মারক ডাকটিকিট এবং প্রতিটি টিকিটের বুকে রয়েছে কবির নানা বয়সের প্রতিকৃতি। প্রতিটি ১০ টাকা মূল্যমানের ডাকটিকিটে কবির প্রতিকৃতি ছাড়াও বাংলাদেশে তাঁর স্মৃতিবিজড়িত স্থাপত্য উঠে এসেছে। কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে বাংলাদেশ ডাক বিভাগ ২০২২ সালের ২৪ মে সর্বশেষ ডাকটিকিট প্রকাশ করে।