Samakal:
2025-06-02@07:43:28 GMT

পরিত্যক্ত ফিল্মে জীবিকা

Published: 31st, May 2025 GMT

পরিত্যক্ত ফিল্মে জীবিকা

এক সময় যেসব এক্স-রে ফিল্ম ফেলে দেওয়া হতো ডাস্টবিনে, সেগুলোকেই এখন নতুন জীবন দিচ্ছে দেবিদ্বার উপজেলার প্রত্যন্ত এক গ্রামের মানুষ। কেউ ভাবেননি– এই রংহীন, ধোঁয়াটে চিত্রের পাতায় লেখা থাকতে পারে কর্মসংস্থানের গল্প।
ভৈষেরকোট গ্রামের দক্ষিণ পাড়ার পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি ছোট্ট ভবন। বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে সাধারণ কোনো ঘর। কিন্তু ভেতরে পা দিলেই দেখা মেলে এক ব্যতিক্রমী দুনিয়ার। যেখানে প্রতিদিন ঘষা হয় পুরোনো এক্স-রে ফিল্ম, ধুয়েমুছে তৈরি করা হয় নতুন পণ্য। প্রতিদিন সেখানে কাজ করেন স্থানীয় ২০-২২ জন শ্রমিক। তারা গড়ে তুলেছেন এমন এক উদ্যোগ, যেটি শুধু কাজ নয়, দিয়েছে আত্মমর্যাদা, দিয়েছে স্বপ্নের খোরাক।
এই স্বপ্নের বীজ বপন করেছিলেন ভৈষেরকোট গ্রামের সন্তান আবুল হোসেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পরিত্যক্ত এক্স-রে ফিল্ম সংগ্রহ করেন তিনি। সেগুলো পানিতে ভিজিয়ে ঘষে প্রিন্ট তুলে ফেলেন, ধুয়েমুছে বানিয়ে ফেলেন একদম নতুনের মতো। তারপর রোদে শুকিয়ে বিক্রি করেন ঢাকার একটি কারখানায়। সেখানে ফিল্মগুলো কেটে তৈরি হয় গার্মেন্টস অ্যাকসেসরিজ, যেমন– কলারের স্টিফনার, প্যাকেজিং মেটেরিয়াল।
শুরুতে আবুল হোসেনের এই কাজ নিয়ে উপহাস করতেন অনেকে। কেউ কেউ বলতেন, ফিল্ম ঘষে কেউ জীবিকা গড়তে পারে নাকি! কিন্তু তিনি দমে যাননি। পাশে পেয়েছেন ভাইয়ের ছেলে মনিরুল ইসলামকে, পেশায় শিক্ষানবিশ আইনজীবী। তাদের এই ক্ষুদ্র উদ্যোগ এখন রূপ নিয়েছে দুটি কারখানায়– একটি গ্রামে, অন্যটি ঢাকায়। কাজ পেয়েছেন প্রায় ৫০ জন নারী-পুরুষ। 
মনিরুল বলেন, পরিত্যক্ত ফিল্ম ঘষেও যে আয় করা যায়, শুরুতে কেউ বিশ্বাস করত না। কিন্তু এখন দেখুন, একজন শ্রমিক প্রতিদিন ৮০০-৯০০ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন, আর আমরা রপ্তানি উপযোগী পণ্য তৈরি করছি।
উদ্যোগ সম্প্রসারণে কুমিল্লা বিসিক অফিসে যোগাযোগ করেছেন মনিরুল ইসলাম। প্রতিষ্ঠানটির ডিজিএম মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘এটি ব্যতিক্রমধর্মী ও সম্ভাবনাময় একটি প্রকল্প। আমরা তাদের প্রশিক্ষণ, পরামর্শ ও স্বল্প সুদে ঋণের মাধ্যমে সহযোগিতা করব।’

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

বিরল বালুচাটার সন্ধানে

১৪ বছর আগের কথা। বিরল ও দুর্লভ পাখির প্রজনন প্রতিবেশ নিয়ে গবেষণার কাজে পঞ্চগড় এসেছি। বোদা, আটোয়ারী, দেবীগঞ্জ ও পঞ্চগড় সদরের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে গাঙটিটি, হলুদ লতিকা হট্টিটিসহ বেশ কিছু প্রজাতির পাখি দেখলাম। সবশেষে ভারত সীমান্তবর্তী তেঁতুলিয়ার কাজীপাড়া এসে ওদের সঙ্গে যোগ হলো অতি বিরল শেখ ফরিদ বা কালো তিতির। কিন্তু এসব পাখির মা ক্ষণে ক্ষণেই খুঁজছিলাম চড়ুই আকারের অতি বিরল আরেকটি পাখিকে। তেঁতুলিয়া শহরের রাস্তার পাশে এই পাখিকে ২০১০ সালে বন্য প্রাণী আলোকচিত্রী প্রয়াত মুনির আহমেদ খান ও তাঁর স্ত্রী পক্ষী আলোকচিত্রী তানিয়া খান দেখেছিলেন। এর পর থেকেই পাখিটিকে দেখার ইচ্ছা। কিন্তু মাত্র এক বছর পর জায়গামতো বারবার গিয়েও পাখিটির দেখা পেলাম না।

এরপর ২০১৭ সাল পর্যন্ত আরও তিনবার তেঁতুলিয়া গেলাম। কিন্তু ফলাফল একই। অবশ্য ২০২০ সালে একজন আলোকচিত্রী রাজশাহীর পদ্মার চরে পাখিটির দেখা পান। এরপর ২০২৩ সালে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার বেড়ামন গাঁও চরে বার কয়েক দেখা গেল। অনেকেই ছবি তুললেন। খবর পেয়ে ১১ নভেম্বর পাখিটির সন্ধানে পাখিপ্রেমী আমরা ১১ জন শীত শীত ভোরে ঢাকা থেকে রওনা হলাম। মাওয়ার পুরোনো ফেরিঘাটে নেমে জাকির মাঝির ইঞ্জিন নৌকায় চরের দিকে রওনা হলাম। পদ্মা সেতুর নিচ দিয়ে আমাদের নৌকা যাওয়ার সময় সেতুর সঙ্গে একটা ফটোসেশন হয়ে গেল।

ঠিক ৫০ মিনিট প্রমত্ত পদ্মার বুকে চলার পর নৌকা চরে ভিড়ল। চরের মাটিতে পা রাখতেই স্ত্রী পাখিটির দেখা পেয়ে গেলাম। যে পাখিকে দীর্ঘ সাত বছর ধরে খুঁজছি, আজ তাকে অতি সহজে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। স্ত্রী পাখিটির প্রথম ছবি তোলার ১১ মিনিট পর পুরুষটির দেখা পেলাম। কিন্তু ওর একটি ভালো ছবি তোলার জন্য প্রায় পৌনে দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো। পরে পাখিটিকে শেরপুরেও দেখা গেল।

এতক্ষণ বিরল যে পাখিটির গল্প বললাম, সেটি এ দেশের আবাসিক পাখি বালুচাটা বা ধুলচাটা। ইংরেজি নাম অ্যাশি-ক্রাউন্ড স্প্যারো-লার্ক বা ফিঞ্চ-লার্ক। অ্যালাইডিডি গোত্রের এই ভরত পাখিটির বৈজ্ঞানিক নাম Eremopterix grisea। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে বাস করে।

বালুচাটা চড়ুই আকারের কীটপতঙ্গভুক পাখি। দেহের দৈর্ঘ্য ১২ থেকে ১৪ সেন্টিমিটার। ওজন ১৪ থেকে ২০ গ্রাম। প্রাপ্তবয়স্ক স্ত্রী ও পুরুষের চেহারায় ভিন্নতা রয়েছে। পুরুষের মাথার চাঁদি ও ঘাড়ের পেছনটা ধূসর-বাদামি। চোখ বরাবর চওড়া কালো পট্টি। পিঠ বালু-বাদামি। ডানার পালক কালচে ছোপছাপে ভরা। গাল থেকে কান-ঢাকনি ও বুকের দুই পাশ ময়লা সাদা। গলার অর্ধেকটায় কালো রঙের ফিতে। বুক-পেট ও দেহের নিচ চকলেট কালো। অন্যদিকে স্ত্রী একবারেই সাদামাটা। পিঠ ও দেহতলের ওপরে কিছু সূক্ষ্ম লম্বালম্বি দাগসহ দেহ পুরোপুরি বালু-বাদামি। স্ত্রী-পুরুষনির্বিশেষে চঞ্চু খাটো ও ত্রিকোণাকার, রং হালকা, শিং-ধূসর। চোখ লালচে/হলদে-বাদামি। পা, পায়ের পাতা ও নখ মেটে-বাদামি। অপ্রাপ্তবয়স্ক পাখি দেখতে অনেকটা মায়ের মতো।

এ পর্যন্ত এদেরকে পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়া, মুন্সিগঞ্জের লৌহজং ও শেরপুরের চরাঞ্চলে দেখা গেছে। খোলামেলা শুষ্ক পাথুরে এলাকা, কণ্টকময় ঝোপঝাড় ও ঘাসে ঢাকা পরিত্যক্ত খেত, বালুময় নদীতট বা শুকনা জোয়ার–ভাটার কাদাচরে এরা বিচরণ করে। সচরাচর জোড়ায় বা ছোট দলে বালুমাটিতে ঘোরাঘুরি বা ধূলিস্নান করতে দেখা যায়। তবে শীতে বড় দলে থাকতে পারে। মাটিতে হেঁটে হেঁটে শুকনা ধূলিময় ভূমি ঠুকরে বিভিন্ন ধরনের বিচি, শক্ত খোলসযুক্ত পোকামাকড়, পিঁপড়া ও অন্যান্য কীটপতঙ্গ খায়। পুরুষ পাখি বৃত্তাকারে উড়ে উড়ে বাঁশির মতো ‘টুইল-ডিডল-ডিডল...’ স্বরে গান গায়।

বছরের যেকোনো সময় প্রজনন করতে পারে। মাটির প্রাকৃতিক খোদলে ঘাস, পালক ও চুল বিছিয়ে বাসা বানায়। বাসার চারদিকে নুড়ি পাথর দিয়ে বেষ্টনী দেয়। অল্প দূরত্বের মধ্যে একাধিক বাসা পাওয়া যায়। ডিম পাড়ে ২ থেকে ৩টি; রং ধূসর-সাদা বা ফিকে হলুদ, তাতে থাকে বেগুনি ও বাদামি ফুটকি ও ছোপ। ডিম ফোটে ১১ থেকে ১৪ দিনে। ১০ থেকে ১২ দিনে ছানারা উড়তে শেখে। মা-বাবা মিলেমিশে ডিমে তা দেওয়া এবং ছানাদের লালন পালন করে। আয়ুষ্কাল প্রায় চার বছর।

আ ন ম আমিনুর রহমান, পাখি ও বন্য প্রাণী প্রজনন ও চিকিৎসাবিশেষজ্ঞ

সম্পর্কিত নিবন্ধ