ফিলিস্তিনের গাজা থেকে সেখানকার বাসিন্দাদের বিতাড়ন এবং উপত্যকাটিতে যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বক্তব্য ঘিরে নিজ দলেই বিভক্তি দেখা দিয়েছে। ট্রাম্পের বক্তব্যে তাঁর কিছু রিপাবলিকান সহকর্মীর মধ্যে সন্দেহ-সংশয় দেখা দিয়েছে। অবশ্য অন্যরা তাঁর বক্তব্যকে ‘সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত’ অভিহিত করে সমর্থন জানিয়েছেন।

যুক্তরাষ্ট্র সফররত ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার হোয়াইট হাউসে যৌথ সংবাদ সম্মেলন করেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। এ সময় গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়ে সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানায় সমুদ্র উপকূলীয় অবকাশযাপন কেন্দ্র তৈরির প্রস্তাব দেন তিনি।

ট্রাম্পের এমন প্রস্তাবে বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় ওঠে। তাঁর দলের মধ্যেও মতপার্থক্য দেখা দেয়। ভিন্নমত জানানো ব্যক্তিদের মধ্যে ট্রাম্পের এমন সহকর্মীও রয়েছেন, যাঁরা তাঁর বিদেশি সহায়তা বন্ধ ও কেন্দ্রীয় সরকারের হাজারো কর্মী ছাঁটাইয়ের পদক্ষেপকে সমর্থন করেছেন।

ট্রাম্পের সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করা আইনপ্রণেতারা বলছেন, ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনিদের জন্য তাঁরা দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান সমর্থন করেন। মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে এটি যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের কূটনীতির ভিত্তি। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের অর্থ কিংবা সেনা পাঠানোর বিরুদ্ধে তাঁদের কেউ কেউ।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে রিপাবলিকান সিনেটর র‌্যান্ড পল বলেন, ‘আমার তো মনে হয় আমরা আমেরিকা ফার্স্টের জন্য ভোট দিয়েছি। আমাদের সম্পদ খরচ করে এবং আমাদের সেনাদের রক্ত ঝরিয়ে আরেকটি দখলদারত্বের কথা চিন্তা করা আমাদের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না।’

কংগ্রেসে সামান্য ব্যবধানে ডেমোক্র্যাটদের চেয়ে এগিয়ে আছে রিপাবলিকানরা। ডেমোক্র্যাটরা ট্রাম্পের প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। সিনেটর ক্রিস ভন হোলেন বলেন, এটি হলো অন্য নামে জাতিগত নিধন।

রিপাবলিকান সিনেটর জেরি মোরান বলেন, চাইলেই দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ধারণা ছুড়ে ফেলে দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, এটি এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার মতো কোনো বিষয় নয়।

অবশ্য ট্রাম্পের গাজা দখলের প্রস্তাবের প্রশংসা করেছেন কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার মাইক জনসন। তিনি বলেন, ওই অঞ্চলে শান্তি নিশ্চিতের চেষ্টায় এটি সাহসী ও বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ।

এদিকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিন্দার মুখে সুর কিছুটা নরম করেছে ট্রাম্প প্রশাসন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মার্কো রুবিও বলেছেন, পুনর্গঠন ও ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে ‘সাময়িক সময়ের’ জন্য গাজার বাসিন্দাদের অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।

গুয়াতেমালা সফররত রুবিও দেশটিতে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ‘তিনি (প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প) অত্যন্ত উদারভাবে যে প্রস্তাব করেছেন, সেটি হলো সেখানে (গাজায়) যুক্তরাষ্ট্রের যাওয়ার সামর্থ্য; ধ্বংসস্তূপ, অবিস্ফোরিত বোমা সরানোর কাজে সাহায্য করা; পুনর্গঠনে সাহায্য করা, ঘরবাড়ি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান পুনরায় নির্মাণে সহায়তা এবং এ ধরনের অন্যান্য কাজের প্রস্তাব করেছেন, যাতে তখন লোকজন ফিরতে পারেন।’

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে গাজায় জাতিগত নিধন এড়িয়ে যেতে বলেছেন জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। গত বুধবার জাতিসংঘের একটি বৈঠকে গুতেরেস বলেন, ‘সমাধান খুঁজতে গিয়ে আমাদের সমস্যা আরও খারাপ করে ফেলা যাবে না। আমাদের অবশ্যই দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধান নীতি (ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটে) সুনিশ্চিত করতে হবে।’

এদিকে বিশ্বজুড়ে নিন্দা সত্ত্বেও গাজার নিয়ন্ত্রণ নেওয়া নিয়ে নিজেদের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ট্রুথ সোশ্যালে দেওয়া পোস্টে তিনি বলেছেন, ‘যুদ্ধ শেষে ইসরায়েল গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তর করবে।’ সেখানে উন্নয়ন কর্মকাণ্ড চালানোর কথা জানিয়ে ট্রাম্প বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের কোনো সেনা পাঠানোর প্রয়োজন হবে না। এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা ফিরে আসবে।

অন্যদিকে ট্রাম্পের বক্তব্যের পর গাজা থেকে বাসিন্দাদের ‘স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রস্তুতি নিতে ইসরায়েলের সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। গতকাল বৃহস্পতিবার ইসরায়েলের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইসরায়েল কাৎজ এ নির্দেশ দেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে কাৎজ বলেন, ‘প্রেসিডেন্টে ট্রাম্পের সাহসী পরিকল্পনাকে আমি স্বাগত জানাই। গাজার বাসিন্দাদের এলাকাটি ত্যাগ করা ও অভিবাসী হওয়ার স্বাধীনতা দেওয়া উচিত। সারা বিশ্বে এ ধরনের চর্চা আছে।’

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র প বল ক ন ইসর য় ল কর ছ ন আম দ র

এছাড়াও পড়ুন:

হতাশায় ডুবে থাকলে সম্ভাবনা দেখা যায় না

দৃঢ় মনোবল আর প্রচেষ্টা থাকলে কোনো বাধা পেরোনোই কঠিন নয়। দরকার ইচ্ছাশক্তি, আত্মবিশ্বাস আর কঠোর পরিশ্রম। আমাদের আশপাশে এমন অনেকেই আছেন, যাঁরা বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও নিজেদের জীবনগাথায় লিখে চলেছেন অদম্য জয়ের গল্প। তাঁদের সেই সাফল্য ব্যক্তিগত অর্জনের সীমানা পেরিয়ে সমাজের নানাবিধ প্রতিবন্ধকতাকেও চ্যালেঞ্জ করেছে। তেমনই কয়েকজনের গল্প নিয়ে ধারাবাহিক এ আয়োজন। আজ জানব ময়মনসিংহের অজপাড়াগাঁয়ের বাসিন্দা মাজিদা বেগম–এর জীবনগল্প।

আমি মাজিদা বেগম। আমার জন্ম ময়মনসিংহের একটি অজপাড়ায়। দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। সংসারে অভাব থাকলেও মা-বাবা আমার লেখাপড়া বন্ধ করেননি। মাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর প্রতিবেশীরা আমার বাবাকে বলেছিলেন, ‘মেয়ের বিয়ে দিয়ে দেন।’ বাবা শোনেননি তাঁদের কথা।

এরপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় পাস করার পর পড়শিরা আমাকে উৎসাহ দেওয়া তো দূরে থাক, উল্টো আমার বাবাকে নানা নেতিবাচক কথা বলতে শুরু করেন। যেমন মেয়েদের এত লেখাপড়া করে কী হবে? এখনই বিয়ের উপযুক্ত সময়, মেয়ের বিয়ে দিয়ে ভারমুক্ত থাকেন ইত্যাদি। তবে এসব কথায় বাবা কখনো দমে যাননি। সবাইকে তিনি শুধু একটা কথাই বলতেন, ‘মেয়েরাও অনেক দূর যেতে পারে। যতটুকু সামর্থ্য হয়, আমি আমার মেয়েকে লেখাপড়া করাব।’

আমি ময়মনসিংহের গৌরিপুর সরকারি কলেজ থেকে ব্যাচেলর ডিগ্রি লাভ করি। রেজাল্ট ভালোই হয়। কিন্তু লেখাপড়া শেষ করে কোনো চাকরি পাচ্ছিলাম না। পরিবার থেকে হাতখরচ নিতে ইচ্ছা করত না। তাই স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য টিউশনি শুরু করি। এরই মধ্যে আমার বিয়ে হয়।

জীবনের নতুন অধ্যায়ের আড়ালেও আমি স্বপ্ন দেখতে ভুলিনি। কিছু একটা করার সংকল্পে সব সময় বিভোর থাকতাম। কিন্তু কোনো উপায় খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সত্যি বলতে, মফস্‌সল এলাকায় নারীদের কর্মসংস্থানের সুযোগ অনেক কম। নানা রকম হতাশা এসে ভিড় করে। আমি বিকল্প পথের সন্ধানে সচেষ্ট থাকি। অবশেষে স্বামীর কর্মসূত্রে গাজীপুর চলে আসি। এখানেও চাকরির সুযোগ খুঁজি, পাই না।

গাজীপুর এলাকায় অনেক রপ্তানিমুখী পোশাকের কারখানা। স্বামীসহ অনেকেই আমাকে গার্মেন্টসের কাজে যোগ দিতে বলে। আমি রাজি হইনি। এত দূর লেখাপড়া করে গার্মেন্টসে চাকরি করব? মন থেকে মেনে নিতে পারছিলাম না। এ ছাড়া এই সেক্টর নিয়ে আমার কোনো ধারণা ছিল না।

তৈরি পোশাক কারখানায় নারীদের জন্য সেলাই ছাড়াও যে বৈচিত্র্যময় নানা কাজ আছে, তা আমার জানা ছিল না। শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমি আইরিশ গার্মেন্টস লিমিটেডে ‘কোয়ালিটি ইন্সপেক্টর’ হিসেবে যোগদান করি।

কিছুদিন যাওয়ার পরই আমি কাজটাকে ভালোবাসতে শুরু করি। কোয়ালিটি বিভাগের দায়িত্ব বুঝতে শুরু করি। একটি পোশাক রপ্তানির পেছনে অনেক ধাপ কাজ করে। প্রতিটি ধাপে কোয়ালিটি চেক জরুরি, যেখানে দেশ ও প্রতিষ্ঠানের সুনাম জড়িত। ধীরে ধীরে কাজের প্রতি আমার মনোযোগ বাড়তে থাকে।

কিন্তু আবার ভেতরে ভেতরে পরিবর্তনের পথও খুঁজতে থাকি। বিষয়টা আমার সিনিয়রদের নজরে আসে। অবশেষে আলোর বার্তা এল। ব্র্যাকের ‘লিডারশিপ অ্যান্ড সফট স্কিলস প্রোগ্রামে’ প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচিত হলাম। তখনো আমি এই প্রশিক্ষণ বিষয়ে কিছুই জানতাম না। কিন্তু কয়েকটা সেশন যাওয়ার পর আমার ভেতর বিশাল পরিবর্তন এল। যেন নিজেকে খুঁজে পেলাম। নিজের হারানো কণ্ঠস্বর ফিরে পেলাম। নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে শিখলাম। আমি কাজের বা দায়িত্বের নতুন ভাষা শিখলাম। আমার সব সংকোচ আর জড়তা কেটে গেল। সহকর্মীদের সঙ্গে অনেক সহমর্মিতা নিয়ে কথা বলতে লাগলাম।

আমাদের কাজে ডেডলাইনের (সময়সীমা) কারণে অনেক চাপ থাকে। কিন্তু কীভাবে নিজেকে শান্ত রেখে চাপমুক্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম এবং কাজের ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করা শুরু করলাম। কর্মক্ষেত্রে চাপমুক্ত থাকতে শ্বাসপ্রশ্বাসের ব্যায়াম শেখানো হয়। রেগে গেলে কীভাবে নিজেকে শান্ত রাখতে হয়, তা শিখলাম। অনেক সময় অনেকগুলো কাজ চলে আসে, কিন্তু কোনটা আগে গুরুত্ব দেব, তা বুঝতে পারতাম না। এখন সহজেই বুঝি।

সিনিয়রদের সঙ্গে কথা বলতে ভয় লাগত, সেটিও এখন কেটে গেছে। সহকর্মীদের সঙ্গেও কথা গুছিয়ে বলতে পারতাম না। প্রশিক্ষণের পর সেটাও পারলাম। বুঝলাম, স্পষ্ট করে কথা বলা একজন মানুষের অনেক বড় শক্তি। সহকর্মীদের সঙ্গে একটু দরদ দিয়ে কথা বললে ফলাফল অনেক ভালো হয়। সব মিলিয়ে ব্র্যাক থেকে নেওয়া প্রশিক্ষণ আমার মধ্যে জাদুর মতো কাজ করল, বলতে গেলে আমার জীবন বদলে দিল।

একসময় প্রমোশন পেয়ে আমি ‘কোয়ালিটি অডিটর’ হই। হারিয়ে যাওয়া আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। আমার সহকর্মী আর সিনিয়রদের সঙ্গে আগের চেয়ে পেশাগত সম্পর্ক অনেক মজবুত হয়, যা আমার পারিবারিক জীবনেও প্রভাব ফেলে। এখন সংসারটাকে আগের চেয়ে অনেক গুছিয়ে রাখার চেষ্টা করি।

মাজিদা বেগম এখন গাজীপুরের আইরিশ গার্মেন্টস লিমিটেডে কোয়ালিটি অডিটর হিসেবে কাজ করছেন

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • হতাশায় ডুবে থাকলে সম্ভাবনা দেখা যায় না