অবসরোত্তর ছুটি (পিআরএল) শেষে আনুতোষিক পাওয়ার জন্য সহকারী জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ও একজন কর্মচারীকে এক লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন খুলনার দিঘলিয়া উপজেলার বাসিন্দা বিনয় কৃষ্ণ বিশ্বাস। কিন্তু টাকা নেওয়ার পরও কোনো কাজ হয়নি। ২৫ দিন আগে তিনি মারা গেছেন। রোববার দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) খুলনায় আয়োজিত গণশুনানিতে এমন অভিযোগ করেন তাঁর স্ত্রী রত্না বিশ্বাস। মঞ্চে উঠে কথা বলতে গিয়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।

অভিযোগকারী, সাক্ষী এবং অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সব পক্ষের কথা শুনে দুদক কমিশনার বিষয়টি অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। সেই সঙ্গে অভিযুক্তের উৎস–বহির্ভূত সম্পদেরও অনুসন্ধান হবে বলে গণশুনানিতে জানানো হয়।

খুলনা জেলা শিল্পকলা মিলনায়তনে দুদকের এই গণশুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে তারুণ্যের একতা, গড়বো আগামীর শুদ্ধতা’ স্লোগান নিয়ে আয়োজিত গণশুনানিতে সরকারি–বেসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সেবামূলক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে হয়রানি, দুর্নীতি, অনিয়ম, ঘুষ নেওয়াসহ নানা অভিযোগের তোলেন সেবাগ্রহীতারা।

সকাল সাড়ে ৯টা থেকে শুরু হয় দুদকের ওই গণশুনানি চলে বিকেল পর্যন্ত। বিভিন্ন দপ্তরের বিরুদ্ধে জমা পড়া ১৭২টি অভিযোগের মধ্যে দুদক আইনে উপস্থাপনযোগ্য ৫৯টি নিয়ে শুনানি হয়। অধিকাংশ অভিযোগ তাৎক্ষণিক সমাধান করা হয়। আর কয়েকটি অভিযোগ অনুসন্ধান করতে দুদককে নির্দেশনা দেওয়া হয়।

গণশুনানিতে হাফেজ মাওলানা জহুরুল ইসলাম খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালের সেবা নিয়ে অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, হাসপাতালের একজন সুইপার তাঁর ছেলের ড্রেসিং করেন। এ বাবদ তিনি টাকা নিয়েছেন। প্রাইভেট ক্লিনিকের মতো প্রত্যেকবার টাকা দিতে হয়েছে।

এ ছাড়া খুমেক হাসপাতালে দালাল চক্রের দৌরাত্ম্য, অনুমোদনহীন অ্যাম্বুলেন্সে রোগী পরিবহন, রোগী ভাগিয়ে বেসরকারি ক্লিনিকে পাঠানো, নির্দিষ্ট ডায়াগনস্টিক সেন্টারে পরীক্ষা করাতে বাধ্য করা, শয্যা পাইয়ে দিতে অনিয়ম, খাবারের নিম্নমানসহ একাধিক অভিযোগ তোলেন ভুক্তভোগীরা। হাসপাতালের এসব অভিযোগ শুনানির সময় উপস্থিত মানুষ হাসপাতালের সেবা নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

অভিযোগ শোনার পর দুদক কমিশনার বলেন, এখানে একজনও কিন্তু খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সেবা নিয়ে খুশি না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আপনারা কথা দেন, আজ থেকে আপনারা অনিয়ম দূর করার চেষ্টা করবেন।

সাবেক পুলিশ পরিদর্শক মো.

সোলাইমান হোসেন অভিযোগ করেন বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের (ডিসিএ) কার্যালয়ের বিরুদ্ধে। তিনি বলেন, ‘২০১৫ সালে আমি অবসর গ্রহণ করি। কয়েক বছর আগে আমার স্ট্রোক হয়। আমার পেনশন বই হারিয়ে যায়। আমি ডিসিএ অফিসে গিয়ে একটা নতুন বইয়ের জন্য বলি। তাঁরা আমাকে যেভাবে বলেছিলেন, সেভাবেই আবেদন করি। গত ১০ মাস হয়ে গেলেও বিষয়টির সুরাহা হয়নি।’ অভিযোগের শুনানি শেষে অনুষ্ঠানস্থলেই তাঁকে পেনশন বই দেওয়া হয়। সেই সঙ্গে যেসব কর্মকর্তার গাফিলতির কারণে তাঁকে হয়রানি হতে হয়েছে, তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা জানানো হয়।

এ সময় দুদক কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী ডিসিএ কার্যালয়ের কর্মকর্তাকে উদ্দেশে বলেন, ‘জেলার সর্বোচ্চ বিচারক থাকার পরও অবসরের পর আমি নিজেও অনুভব করেছিলাম অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের কী পরিমাণ দুর্দশা। আপনারা এতটা অবজ্ঞা করিয়েন না। আমি পুরোপুরি ভুক্তভোগী। আজকের পাবলিক পারসেপশান তো শুনলেন। প্লিজ একটু সহমর্মী হোন।’

যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কার্যালয়, মাধ্যমিক শিক্ষা কার্যালয়, খুলনা সিটি করপোরেশন (কেসিসি), সড়ক ও জনপদ বিভাগ, জেলা পরিষদ, বিভাগীয় হিসাব নিয়ন্ত্রকের (ডিসিএ) কার্যালয়, ওজোপাডিকো, বাংলাদেশ স্মার্ট ইলেকট্রিক্যাল কোম্পানি লিমিটেড।

গণশুনানির প্রথম পর্বে প্রধান অতিথির বক্তব্যে দুদক কমিশনার (তদন্ত) মিঞা মুহাম্মদ আলি আকবার আজিজী বলেন, ‘জনগণের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন হয়। যাঁদের টাকায় আমাদের বেতন হয়, আমরাই আবার তাঁদের প্রভু সেজে যাই। সরকারি কর্মচারীরা আল্লাহর দেওয়া যোগ্যতার সম্পূর্ণ ব্যবহার করে ইমানদারির সঙ্গে নাগরিকদের সেবা দিতে দায়বদ্ধ। যে সৃষ্টিকর্তাকে ভয় করে, সে জ্ঞানত অন্যায় করতে পারে না।’

কমিশনার আরও বলেন, ‘আমরা নিজ নিজ অবস্থানে প্রত্যেকেই বিচারক। যদি আমরা আমাদের পরিবারে নিজের আয়ের চেয়ে বেশি উপহার বা তৈজসপত্র দিই, তবে সন্তানদের সামনে কীভাবে জবাবদিহি করব। আমরা নিজে সৎ থাকব এবং পরিবারবর্গকে সৎপথে রাখব। আমরা সবাই দুর্নীতি বন্ধে প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, একই সঙ্গে মানসম্মত সেবা প্রদানের নিশ্চয়তাও দিতে হবে।’

অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি দুদক কমিশনার (অনুসন্ধান) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) হাফিজ আহসান ফরিদ বলেন, ‘শুনতে খারাপ লাগলেও এটা বাস্তব যে একে অপরের হক মেরে খাওয়ার কুসংস্কৃতি বাংলাদেশের মতো পৃথিবীর আর কোথাও নেই। আমরা শোষিত হই আমাদের নিজেদের দ্বারা। দুর্নীতি এখন রাজনৈতিক নেতা–কর্মী,  সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, স্থানীয় মাস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, দুর্নীতি এখন ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় সমস্ত জায়গাব্যাপী। গত ১৬ বছর দুর্নীতির চাষাবাদ হয়েছে এই দেশে।’

খুলনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামের সভাপতিত্বে গণশুনানিতে খুলনা বিভাগীয় কমিশনার মো. ফিরোজ সরকার, দুদকের মহাপরিচালক (প্রতিরোধ) মো. আক্তার হোসেন, খুলনা সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপপরিচালক মো. আবদুল ওয়াদুদ, পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি মো. রেজাউল হক, মহানগর পুলিশ কমিশনার মো. জুলফিকার আলী হায়দার, পুলিশ সুপার টি এম মোশাররফ হোসেনসহ বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা ও প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: গণশ ন ন ত কর মকর ত সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

শতবর্ষের মাইলফলক পেরোলেন মাহাথির

শতবর্ষের মাইলফলক পেরোলেন আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার হিসেবে পরিচিত মাহাথির মোহাম্মদ। আজ বৃহস্পতিবার ছিল তাঁর শততম জন্মদিন। দীর্ঘ এই জীবনে সারা বিশ্বের মানুষের কাছে তিনি সাফল্যের এক অনুপ্রেরণা। শততম জন্মদিনেও তাই থামতে নারাজ মালয়েশিয়ার সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তাঁর মতে—‘অবসর মানে আপনি কিছুই করছেন না।’

মাহাথির ২৪ বছর মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। প্রথমে ১৯৮১ থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত—টানা ২২ বছর। পরের দুই বছর ছিল ২০১৮ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। মালয়েশিয়ার অর্থনীতিতে আমূল পরিবর্তন এনেছিলেন তিনি। অবকাঠামোগত নজিরবিহীন পরিবর্তন এসেছিল তাঁর হাত ধরে। তবে মাহাথিরের বিরোধী মত দমন, মানবাধিকার রক্ষা নিয়ে সীমিত অঙ্গীকার নিয়েও কম আলোচনা হয়নি।

মাহাথিরের জন্ম ১৯২৫ সালের ১০ জুলাই, মালয়েশিয়ার কেদাহ রাজ্যের প্রধান শহর আলোর সেতারে। তাঁর দাদা ভারতের কেরালা থেকে সেখানে অভিবাসী হন। বাবা মোহাম্মদ ইস্কান্দার ছিলেন একটি ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের প্রধান শিক্ষক। মাহাথির চল্লিশের দশকে সিঙ্গাপুরে চিকিৎসাশাস্ত্রে পড়াশোনা করেন। সেখানে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় সিতি হাসমাহর। পরিচয় থেকে পরিণয়। এরপর বিয়ে।

গাইনোকোলজিতে এমবিবিএস শেষ করে সরকারি চাকরিতে যোগ দেন মাহাথির। শুরু করেন চিকিৎসাসেবা। একসময় তাঁর মধ্যে ধারণা আসে, বিপুল মানুষের সেবা করতে হলে রাজনীতির বিকল্প নেই। সেই চিন্তা থেকে রাজনীতির ময়দানে পা রাখেন। ১৯৮১ সালে ইউনাইটেড মালয় ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (ইউএমএনও) থেকে মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন মাহথির মোহাম্মদ।

আশির দশকে ‘লুক ইস্ট পলিসি’ বা পূর্বকে অনুসরণ করার নীতি গ্রহণ করেন মাহাথির। অর্থনীতির পশ্চিমা মডেলের ওপর নির্ভরশীলতা কমান। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মাহাথিরের প্রথম ২২ বছরে মালয়েশিয়ায় পেট্রোনাস টুইন টাওয়ার, এক্সপ্রেসওয়ে, বিমানবন্দরসহ নানা অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে। ১৯৯৭ সালের অর্থনৈতিক সংকটও দক্ষতার সঙ্গে সামাল দেন তিনি।

শততম জন্মদিনেও শারীরিক ও মানসিকভাবে এখনো সক্রিয় মাহাথির। আজ মালয়েশিয়ার পুত্রজায়া শহরে নিজ অফিসে পরিচিত সাফারি স্যুট পরে সকাল সকাল হাজির হন তিনি। জন্মদিন উপলক্ষে এক পডকাস্টে মাহাথির বলেন, ‘আমি সব সময় কাজকর্মের মধ্যে থাকি। মানুষ কেন বিশ্রাম নিতে চায়, তা আমি বুঝি না। বলতে চাচ্ছি যে আপনি অবকাশের জন্য ছুটি নিতে চান, তার মানে আপনি কিছু করছেন। অবকাশযাপনও একটি কাজ। তবে কিছু মানুষ অবসর নিতে চান এবং বিশ্রাম করতে চান। বিশ্রামের অর্থ কী? আপনি কিছুই করছেন না।’

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • জোতার স্মৃতিকে ‘চিরস্থায়ী’ করতে অবসরে লিভারপুলের ২০ নম্বর জার্সি
  • দুই দেশের হয়ে টেস্ট খেলা পিটার মুরের অবসর
  • আরএসএসের প্রধান তবে কি ৭৫ বছরে মোদিকেও অবসরে যাওয়ার কথা বললেন
  • ১৮ জন বিচারককে বাধ্যতামূলক অবসরে পাঠাল সরকার
  • দুর্নীতির অভিযোগে ১৮ বিচারককে অবসরে পাঠাল সরকার
  • ১৮ বিচারককে অবসরে পাঠিয়েছে সরকার
  • শতবর্ষের মাইলফলক পেরোলেন মাহাথির
  • ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর মুখে হঠাৎ অবসরের কথা
  • দুদকের মামলায় সিলেট কারাগারে কাশিমপুরের সাবেক জেলসুপার