ভারতের উত্তর–পূর্বের আসাম রাজ্যের বিজেপিদলীয় মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মার একটি মন্তব্যকে ঘিরে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে রাজ্যের বাঙালি অধ্যুষিত বরাক উপত্যকাজুড়ে।

এই বরাক উপত্যকার চারটি জেলা করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দি, কাছাড় ও হোজাই বাঙালি অধ্যুষিত। এ ছাড়া পাশের ধুবরি ও গোয়ালপাড়াও বাঙালি অধ্যুষিত। এই সব জেলার বাসিন্দারা সুদীর্ঘকাল ধরে মাতৃভাষা বাংলা হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। বরাক উপত্যকার জেলাগুলোতে বাংলা ভাষাকে সরকারি কাজে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিল আসাম সরকার।

এরই মধ্যে গত বৃহস্পতিবার আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ভারতের আগামী জনগণনা বা আদমশুমারিতে আসাম রাজ্যের কোনো বাসিন্দা বাংলা ভাষাকে নিজের মাতৃভাষা হিসেবে উল্লেখ করলে তাঁদের ‘বিদেশি’ বলে চিহ্নিত করা হবে। তিনি আরও বলেছেন, আর তা থেকে বোঝা যাবে এই রাজ্যে বিদেশির সংখ্যা কত?

আসামের মুখ্যমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর গর্জে উঠেছে গোটা বরাক উপত্যকাসহ ধুবরি, গোয়ালপাড়া ও হোজাই জেলার মানুষ। আজ শনিবার গোয়ালপাড়া ও ধুবরিতে বিক্ষোভ করেছেন স্থানীয় বাঙালিরা। তাঁরা ঘোষণা দেন, আসন্ন আদমশুমারিতে তাঁরা নিজেদের বাঙালি হিসেবে পরিচয় দেবেন। মাতৃভাষার পরিচয় হবে বাংলা। কখনো নিজেদের অসমিয়া হিসেবে আদমশুমারিতে অন্তর্ভুক্ত করবেন না। এ জন্য যদি তাঁদের জীবন দিতে হয় তবে তাঁরা জীবন দিতেও কুণ্ঠিত হবেন না।

আসামের ‘আমরা বাঙালি’ সংঠনের রাজ্যসচিব সাধন পুরকায়স্থ আজ শনিবার সকালে প্রথম আলোকে টেলিফোনে বলেছেন, সরকার মাতৃভাষা নির্ধারণের কে? এটা বলতে পারেন না রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। মাতৃভাষা তার জন্মগত ফসল ও অধিকার। এই অধিকারকে কেউ কেড়ে  নিতে পারে না। আমরা বাঙালিরা নিজেদের কখনো মাতৃভাষা হিসেবে অসমিয়া হিসেবে মেনে নেব না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা।

বরাকের ৮০ শতাংশ মানুষ বাংলায় কথা বলেন।এখানে প্রচুরসংখ্যক মুসলিম রয়েছেন। বরাক উপত্যকায় বাংলাভাষার দাবিতে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বাংলাদেশের ১৯৫২–এর ভাষা আন্দোলনের ধাঁচে বাংলা ভাষার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন হয়েছিল। সেই আন্দোলনে সেদিন শিলচর স্টেশনে ১১ আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন। সেই আন্দোলনের জেরে আসামের বরাক উপত্যকার জেলাসমূহে সরকারি কাজে বাংলা ভাষাকে রাজ্য ভাষার স্বীকৃতি দিয়েছিল।

সাধন পুরকায়স্থ বলেন, ‘আমরা বাংলায় কথা বলি। বরাক উপত্যকায় আমাদের সরকারি অফিসের কাজকর্ম বাংলায় করি। তাই মুখ্যমন্ত্রীর চাপের কাছে আমরা মাথা নত করব না। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। আদমশুমারিতে সেই বাংলাকেই আমরা আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে উল্লেখ করব। আর এই ভাষার দাবি নিয়ে আমরা আবার আন্দোলন শুরু করব বরাক উপত্যকাসহ আসামজুড়ে।  

আসামের রাজ্য বিধানসভার নির্বাচন আগামী বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। একই সঙ্গে ভারত সরকার জনগণনা বা আদমশুমারির কাজও শুরু করছে।

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র ম খ যমন ত র আস ম র আম দ র সরক র

এছাড়াও পড়ুন:

আদমশুমারিতে মাতৃভাষা বাংলা লিখলে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে: আসামের মুখ্যমন্ত্রী

ভারতের পরবর্তী আদমশুমারিতে আসাম রাজ্যের কোনো বাসিন্দা বাংলাকে নিজের মাতৃভাষা উল্লেখ করলে তাঁকে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে। সেই তথ্য দিয়ে আসামের মোট বিদেশির সংখ্যা নির্ধারণ করা যাবে। আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা গতকাল বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের এ কথা বলেন।

বিশ্বশর্মা বলেন, আদমশুমারিতে কেউ যদি নিজেকে বাঙালি হিসেবে চিহ্নিত করেন, তা থেকে ‘এটা বোঝা সম্ভব হবে যে রাজ্যে বিদেশির সংখ্যা কত।’

বিদেশি বলতে নির্দিষ্টভাবে বাংলাদেশিদেরই বুঝিয়েছেন হিমন্ত বিশ্বশর্মা। কারণ, বর্তমানে ভারতে বিশেষত পূর্ব ভারতে বাঙালিদের মধ্যে কারা বাংলাদেশি, তা নিয়ে বিতর্ক চরমে উঠেছে।

প্রচলিত আইন অনুসারে ভারতের যেকোনো রাজ্যের মানুষ যেকোনো ভাষাকে তাঁর মাতৃভাষা বলে চিহ্নিত করতে পারেন। কিন্তু প্রতিবারের মতো এবারও বিধানসভা নির্বাচনে আসামে ভাষাভিত্তিক পরিচয় প্রধান বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০২৬ সালের গোড়ার দিকে আসামে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

কেন এই মন্তব্য করলেন বিশ্বশর্মা

আসন্ন আদমশুমারিতে এই রাজ্যের বাঙালিদের মাতৃভাষা অসমিয়া না লিখে বাংলা লেখা উচিত বলে গত বুধবার মন্তব্য করেছেন আসামের বোড়োল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদের সংখ্যালঘু ছাত্র সংসদের নেতা মইনুদ্দিন আলী।

মইনুদ্দিন বলেন, ‘আমরা বাঙালি বংশোদ্ভূত মুসলিম। আমরা স্পষ্টভাবে বলতে চাই, আমরা এই আদমশুমারিতে অসমিয়াকে আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে লিখব না। আমরা অসমিয়া ভাষা প্রত্যাখ্যান করব।’

মইনুদ্দিন আলীর মন্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতেই বৃহস্পতিবার পাল্টা মন্তব্য করেন আসামের মুখ্যমন্ত্রী বিশ্বশর্মা। তিনি বলেন, ‘প্রতি আদমশুমারির আগে কোনো ভাষাকে তালিকাভুক্ত করা বা না করার হুমকির দ্বারা কেউ প্রভাবিত হয় না। মানুষকে এটা বিশ্বাস করানোর চেষ্টা করা হয় যে আরও বেশি লোক অসমিয়া না বললে ভাষাটি অবলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু অসমিয়া ভাষা যেখানে আছে, সেখানেই থাকবে।’ আদমশুমারিতে মিথ্যা তথ্য প্রদান অপরাধ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

ভারতে সর্বশেষ আদমশুমারি হয়েছিল ২০১১ সালে। এরপর তা হওয়ার কথা ছিল ২০২১ সালে। কিন্তু বিজেপি নেতৃত্বাধীন কেন্দ্রীয় সরকার তা ধারাবাহিকভাবে পিছিয়েছে। অবশেষে গত জুনের গোড়ায় ২০২৭ সালে নতুন আদমশুমারি শেষ করার ঘোষণা দেওয়া হয়।

কিন্তু আদমশুমারি কবে শুরু হবে এবং কী প্রক্রিয়ায় হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কারণ, ভারতে নাগরিকত্ব নিয়ে নানা ধরনের বিতর্ক, আইন ও মোকদ্দমা চলছে। এই অবস্থায় শুরু হতে চলেছে পরবর্তী আদমশুমারি।

মইনুদ্দিন আলীর মন্তব্যের প্রভাব

মইনুদ্দিন আলীর মন্তব্য ঘিরে আসামে প্রবল বিতর্ক শুরু হয়েছে। আসামের দুটি প্রভাবশালী সংগঠন আসাম সাহিত্য সভা এবং অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন (আসু) আলীর মন্তব্যকে ‘লিঙ্গুইস্টিক ব্ল্যাকমেলিং’ বা ভাষাভিত্তিক চাপ সৃষ্টির চেষ্টা বলে অভিহিত করেছে। বোড়োল্যান্ড আঞ্চলিক পরিষদের ছাত্র সংসদ এরই মধ্যে তাঁকে বরখাস্ত করেছে। তাঁর বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়েছে।

আসামের পর্যবেক্ষকদের একাংশের মতে, মইনুদ্দিন আলীর মন্তব্যকে ঘিরে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, তা আসামের আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যে ক্ষমতাসীন বিজেপি এবং হিমন্ত বিশ্বশর্মার জন্য সুবিধা করে দেবে। তাঁর বক্তব্যের কারণে অসমিয়ারা  এককাট্টা হয়ে বিজেপিকে ভোট দিতে পারেন। এই রাজ্যে ২০১৬ সাল থেকে বিজেপির বিশ্বশর্মা মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।

বাঙালি-বাংলাদেশি বিতর্ক

চলতি বছরের মে মাস থেকে আসাম থেকে একাধিক ব্যক্তিকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের অনেকেরই বক্তব্য, তাঁরা ভারতের নাগরিক। ৯ জুন আসামের মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন, রাজ্যে বিদেশি নির্ধারণের জন্য গঠিত আদালতের নির্দেশে ৩৩০ জনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানো হয়েছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে আবার রাজ্যে ফিরেও এসেছেন।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে এভাবে বাঙালিদের বাংলাদেশি বলে চিহ্নিত করে বিভিন্ন রাজ্য থেকে পশ্চিমবঙ্গে ফেরানো হচ্ছে, অনেক সময় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর চেষ্টা হচ্ছে বা পাঠানো হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে বৃহস্পতিবার মুখ খুলেছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও।

পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ব ভারতের প্রধান মানবাধিকার সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রাইটস (এপিডিআর) বিষয়টি নিয়ে আজ শুক্রবার উত্তর কলকাতায় প্রতিবাদ মিছিল ও সভা করেছে।

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • আদমশুমারিতে মাতৃভাষা বাংলা লিখলে বিদেশি বলে চিহ্নিত করা হবে: আসামের মুখ্যমন্ত্রী