প্রেমের কাঙাল পিকে যে ডালে বাঁধেন বাসা, ভাঙে সেই ডাল
Published: 26th, April 2025 GMT
২০১০ বিশ্বকাপে গান গাইতে গিয়ে পপ তারকা শাকিরার সঙ্গে পরিচয় হয় পিকের। এরপর কলম্বিয়ান গায়িকার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়িয়ে এক ছাদের নিচে বসবাস শুরু করেন স্প্যানিশ ফুটবলার। ১২ বছরের সম্পর্ককে বিয়েতে রূপ না দিলেও এর মধ্যে মিলান ও সাশা নামের দুই সন্তানের মা–বাবা হন তাঁরা।
তবে পিকে-শাকিরার সুখের সংসারে ভাঙন ধরে তৃতীয় একজনের আগমনে। শুরুতে গুঞ্জন হিসেবে শোনা গেলেও পরে সেটিই সত্যি হয়। সেই ঘটনার জেরে অবিশ্বস্ততার অভিযোগ এনে পিকের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দেন শাকিরা। ২০২২ সালের ৪ জুন এক বিবৃতিতে পিকের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার কথা জানান এই গায়িকা।
যে নারীর কারণে শাকিরাকে পিকে ছেড়ে দিয়েছিলেন, তাঁর নাম ক্লারা চিয়া মার্তি। ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে নতুন এই প্রেমিকার ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন সাবেক এই বার্সেলোনা ডিফেন্ডার।
আরও পড়ুনএবার নতুন প্রেমিকাকে প্রকাশ্যে আনলেন পিকে২৬ জানুয়ারি ২০২৩কিন্তু শাকিরাকে ছেড়ে নতুন করে গড়া সম্পর্ক তিন বছরও টেকাতে পারেননি পিকে। ক্লারার সঙ্গেও নাকি বিচ্ছেদ হয়ে গেছে পিকের। এ যেন বিখ্যাত সেই বাংলা সিনেমার গানের মতো—প্রেমের কাঙাল পিকে যে ডালে বাঁধেন বাসা, ভাঙে সেই ডাল!
শাকিরা ও পিকে; যথন তাঁদের সুসময়.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নারী সংস্কার কমিশনের সুপারিশ, প্রতিবাদ ও আকাঙ্ক্ষা
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মোট ১১টি সংস্কার কমিশন গঠন করে। এগুলোর মধ্যে ২০২৪ সালের ১৮ নভেম্বর নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের গেজেট প্রকাশিত হয়; শিরীন পারভীন হকের নেতৃত্বাধীন ১০ সদস্যের কমিশন ২ ডিসেম্বর থেকে কাজ শুরু করে। তারা ৪২৩টি সুপারিশসহ ৩১৮ পৃষ্ঠার বিস্তারিত প্রতিবেদন ১৯ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে উপস্থাপন করেছে।
কমিশন তিন পর্যায়ে সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রস্তাব করে। প্রথমত, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদে বাস্তবায়নযোগ্য। দ্বিতীয়ত, পরবর্তী নির্বাচিত সরকারের মেয়াদকালে পাঁচ বছরের মধ্যে বাস্তবায়নযোগ্য এবং তৃতীয়ত, দীর্ঘ মেয়াদে নারী আন্দোলনের স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন করা। প্রধান উপদেষ্টা সেদিন কমিশন সদস্যদের বলেন, যে প্রস্তাবগুলো দ্রুত কার্যকর করা সম্ভব, তা তাড়াতাড়ি করা হবে। অন্যদিকে সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশ নিয়ে প্রতিবাদ ওঠে। বিশেষত অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে সব ধরনের নারীর সমান অধিকার, উত্তরাধিকার আইন ও শ্রম আইনে যৌনকর্মীদের স্বীকৃতি দেওয়ার সুপারিশের বিরুদ্ধে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলো তীব্র আপত্তি জানায়।
কমিশনের পক্ষ থেকে স্পষ্ট বলা হয়– নারীর জন্য সমতা, সুরক্ষা, অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ, সম্পদের অধিকার, নিরাপদ অভিবাসন ও জনপ্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবার লক্ষ্যে এই সুপারিশগুলো দীর্ঘ মেয়াদে দেশের নারীর জীবনমান ও মর্যাদা নিশ্চিত করবে। এদিকে ৩ মে, ২০২৫ রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মহাসমাবেশে হেফাজতে ইসলাম অন্যান্য দাবির পাশাপাশি পুরো নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনই বাতিলের দাবি তুলেছে। সমাবেশে হেফাজত নেতৃবৃন্দ ঘোষণা করেন, নারীর ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে তিন মাসের মধ্যে বিভাগীয় সম্মেলন এবং আগামী ২৩ মে বাদ জুমা চার দফা আদায়ে বিক্ষোভ মিছিল করা হবে। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের কয়েকটি সুপারিশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে এরই মধ্যে রিটও হয়েছে।
অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত মোট ১১টি সংস্কার কমিশনের অধিকাংশই প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। তবে আর কোনো কমিশনের সুপারিশ নিয়ে এমন প্রতিবাদ হয়নি কিংবা পুরো কমিশন বাতিলের দাবিও ওঠেনি। কমিশন সুপারিশ করেছে মাত্র; আলাপ-আলোচনা হতে পারে– যে কোনো যৌক্তিক মীমাংসা অবশ্যই সম্ভব; কিন্তু সবকিছুর আগেই আস্ত কমিশন বাতিলের দাবি থেকে বোঝা যায়, এর গোড়াতেই রয়েছে দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য, সংশয়, অবিশ্বাস ও আশঙ্কা। হেফাজতে ইসলাম নেতৃবৃন্দ নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন বাতিল করে আলেমদের সমন্বয়ে নতুন কমিশন গঠনের দাবিও তুলেছেন।
২.
হেফাজতে ইসলামের শনিবারের মহাসমাবেশের মঞ্চে যে ভাষায় ও ভঙ্গিতে বক্তব্য প্রদান করা হলো, তা যথেষ্ট উদ্বেগ ও বিতর্কের বিষয়। সংগঠনটির যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হক বলেছেন, ‘নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশন মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা দেখতে চাই।’ আমার দেশ পত্রিকার সম্পাদক মাহমুদুর রহমান বলেছেন, ‘নারী কমিশন করার জন্য জুলাই বিপ্লবে তরুণেরা জীবন দেননি। শুধু সেই সংস্কারগুলোই করা দরকার, যার মাধ্যমে দেশে ফ্যাসিবাদের পুনরুত্থানের পথ বন্ধ করা যাবে’ (প্রথম আলো, ৪ মে, ২০২৫)। সমাবেশে একাধিক নেতা নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সদস্যদের সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করেন। একই মঞ্চে বক্তব্য দেন গণঅভ্যুত্থানের ছাত্রনেতা ও এনসিপি নেতা হাসনাত আবদুল্লাহ। এনসিপিও কি তবে নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে? তাদের নেতৃবৃন্দকে এ বিষয়ে স্পষ্ট অবস্থান জানাতে হবে।
যে অভূতপূর্ব গণঅভ্যুত্থানে দেড় দশকের দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একনায়ক শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী সরকারের পতন, তার অন্যতম কুশীলব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা। ১৪ জুলাই সংবাদ সম্মেলনে শেখ হাসিনার দাম্ভিক উক্তি– ‘চাকরি মুক্তিযোদ্ধার সন্তানরা পাবে, নাকি রাজাকারের সন্তানরা পাবে?’ এই কথার উত্তরে মধ্যরাতে বিশ্ববিদ্যালয় হল থেকে হাজার হাজার ছাত্রীর বজ্রকণ্ঠ উচ্চারণ স্বৈরাচারের ভিত কাঁপিয়ে তোলে– ‘তুমি কে আমি কে?/ রাজাকার, রাজাকার/ কে বলেছে? কে বলেছে?/ স্বৈরাচার/ স্বৈরাচার।’ সেই প্রথম দুঃশাসককে সরাসরি ‘স্বৈরাচার’ হিসেবে শনাক্ত করবার স্পর্ধা দেখায় এ দেশের ছাত্রীরা; তথা নারীরা। তারপর ৫ আগস্ট পর্যন্ত গণআন্দোলনে সম্মুখসারিতে ছিলেন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা; তখন কারও মনে বা মাথায় আসেনি, কে হিজাব পরে মিছিলে আছে কিংবা কে টপস আর জিন্স পরে স্লোগান দিচ্ছে? নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একাকার সেই মিছিলে সকলে সম্মিলিত প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর! কেবল ২০২৪-এর গণঅভ্যুত্থান নয়, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ থেকে এর আগের পরের সকল গণআন্দোলনে নারীর ভূমিকা সবসময় অগ্রগণ্যই শুধু নয়, ত্যাগ ও মহত্ত্বে বরাবর তা অতুলনীয়। দেশের আর্থসামাজিক অবকাঠামো নির্মাণে সব শ্রেণি-পেশার নারী শ্রম, সময় ও অংশগ্রহণের মাধ্যমে অসামান্য ভূমিকা রাখছেন।
সেই নারীদের জীবনমান উন্নয়ন ও পুরুষদের সমান্তরালে সমান অধিকার প্রসঙ্গে সুপারিশ করলে তা ধর্মদ্রোহী হয়ে ওঠে; তাদের পোশাক, তাদের কথা-বিবেচনা, তাদের সমান হিস্যার দাবি আক্রমণের বিষয় হয় কোন বিবেচনায়– তা বিস্ময়ের উদ্রেক করে। বলা হচ্ছে, নারীবিষয়ক সংস্কার কমিটিতে কেন কোনো আলেম রাখা হয়নি? কেন কোনো পুরুষ নেই? সংবিধান সংস্কার কমিটিতেও কোনো নারী নেই; সেটি নিয়ে কথা ওঠেনি। আর কোনো সংস্কার কমিটিতেই ধর্মীয় পণ্ডিত রাখা হয়নি। এই দেশ নিশ্চয়ই শরিয়া আইনে চলছে না; চলবেও না বলেই আমাদের প্রত্যাশা। যতক্ষণ পর্যন্ত দেশে একটি সংবিধান আছে, সেই অনুযায়ী সব আইনকানুন-সংস্কার হবে এবং হতে হবে। অভিন্ন পারিবারিক আইনের মাধ্যমে নারীর সমান অধিকার নিশ্চিত করবার সুপারিশ দেশের বর্তমান সংবিধানসম্মত। সব ধর্মের নারীই এক আইনে একই ধরনের সুবিধা পাবেন। অবশ্য কমিশন এ-ও সুপারিশ করেছে, যে বা যারা নিজ নিজ ধর্মীয় আইনে তাদের সম্পত্তি ও অধিকার বণ্টন করতে চাইবেন, অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক আইন যারা চাইছেন, তারা সেই আইন অনুসরণ করবেন। আর যারা দেওয়ানি আইন অনুসরণ করতে চান, তাদের জন্য অভিন্ন পারিবারিক আইন। উত্তরাধিকার আইনের ক্ষেত্রেও একই। অর্থাৎ ধর্মভিত্তিক আইন ও দেওয়ানি আইন যুগপৎ কার্যকর থাকবে। যার যেটি পছন্দ, তিনি সেটি চর্চা করবেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে কাউকে কোনো নির্দিষ্ট আইন মানতে বাধ্য করা হবে না।
৩.
এত সরল নয় নারী-পুরুষের সমান অধিকারের বিষয়; সামাজিক মূল্যবোধ ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য নানা পরম্পরা আঁকড়ে ধরে রাখে। যারা দায়িত্বে থাকেন, সংস্কার বাস্তবায়ন করতে চান; তাদের উচিত এগুলোকে সংবেদনশীলনতার সঙ্গে বুঝে সকলের মধ্যে সম্মিলিত ‘স্পেস’ বা ‘নিঃশ্বাস নেবার জায়গা’ বের করা। চাপিয়ে না দিয়ে বরং আলোচনা ও যুক্তির মাধ্যমে বিরোধ মীমাংসা করতে হবে।
এ দেশের নব্বই ভাগের বেশি মানুষ ধর্মপ্রাণ মুসলমান, জন্ম থেকেই তারা মুসলিম; সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষদের জন্য তাই আর বাড়তি ‘রাষ্ট্রীয়’ ইসলামের পৃষ্ঠপোষকতার প্রয়োজন পড়ে না। বরং সকলে যাতে সমান অধিকার পায়– ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষে, সেই দিকেই রাষ্ট্রের দৃষ্টি রাখা সংগত। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেহেতু রাজনৈতিক সরকারের মতো ভোটের রাজনীতি করে না, তাই আমজনতাকে নিয়ে রাজনীতি করবার চেয়ে বিবেক-যুক্তি ও সময়ের প্রয়োজনকে তারা বেশি গুরুত্ব দেবে বলে প্রত্যাশা করি। আর ড. মুহাম্মদ ইউনূস– তাঁর দীর্ঘ ও সফল জীবনের বেশির ভাগ সময় দেশের তৃণমূলের নারীর জীবনমান উন্নয়নে কাজ করেছেন, বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। নারীবিষয়ক সংস্কার কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নে তাঁর ইতিবাচক ভূমিকা দেখবার অপেক্ষায় তাই সমগ্র জাতি।
মাহবুব আজীজ: উপসম্পাদক, সমকাল; সাহিত্যিক
mahbubaziz01@gmail.com