গত ২২ এপ্রিল কাশ্মীরের পেহেলগামে সন্ত্রাসী হামলায় ২৬ পর্যটক নিহত হওয়ার পর থেকেই ভারত ও পাকিস্তান সীমান্তে উত্তেজনা বিরাজ করছিল। ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী হামলায় মদদ দেওয়ার অভিযোগ এনে ১৯৬২ সালে সই হওয়া সিন্ধু পানিচুক্তি স্থগিত করে। দুই দেশই সীমান্ত বন্ধ করার পাশাপাশি নিজ নিজ আকাশসীমায় প্রতিপক্ষের বিমান চলাচল বন্ধ করে দেয়।
এখানেই শেষ নয়। হামলার ১৫ দিনের মাথায় পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের ৯টি জায়গায় ভারত বিমান হামলা চালায়। ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিক্রম মিশ্রি বলেছেন, সন্ত্রাসীদের ৯়টি ঘাঁটি লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারতের ৩টি যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে পাকিস্তান। ভারতের হামলায় অন্তত ২৬ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হওয়ার কথা জানিয়েছে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ। অন্যদিকে ভারতশাসিত কাশ্মীরে পাকিস্তানের পাল্টা হামলায় অন্তত ১৫ জন নিহত ও ৪০ জন আহত হয়েছেন। ভারতের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সামরিক বা বেসামরিক স্থাপনায় হামলার কথা অস্বীকার করা হলেও একটি জলবিদ্যুৎকেন্দ্রের আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে পাকিস্তান দাবি করেছে। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, ভারতের হামলার জবাবে নিজস্ব সময়, স্থান ও পদ্ধতিতে প্রতিক্রিয়া জানানোর অধিকার তাদের আছে।
পাকিস্তানে ভারতের হামলা ও পাকিস্তানের পাল্টা হামলার ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহল গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছেন। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসও উভয় দেশকে কোনো ধরনের সামরিক উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়ে সর্বোচ্চ ধৈর্যের পরিচয় দেওয়ার কথা বলেছেন। উদ্বেগ জানিয়েছেন জাপান, চীন, ফ্রান্সসহ অনেক দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান। একই সঙ্গে তাঁরা সন্ত্রাসী হামলারও নিন্দা জানিয়েছেন।
পারমাণবিক শক্তিধর দুই প্রতিবেশীর সংঘাতের প্রতিক্রিয়া ইতিমধ্যে এ অঞ্চলে পড়তে শুরু করেছে। এক দেশের আকাশসীমা ব্যবহার করে অপর দেশের বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় যাত্রী ও পরিবহন খরচ বেড়েছে। দুই দেশের শেয়ারবাজারে ধস নেমেছে। ভারতীয় মুদ্রা রুপির দামও কমেছে। শেয়ারবাজারে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে গত ৭৮ বছরে কয়েক দফা যুদ্ধ হলেও কেউ লাভবান হয়নি। বরং সমাধান খুঁজতে হয়েছে আলোচনার মাধ্যমে। ১৯৭২ সালে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সই হওয়া সিমলা চুক্তিতে ভারত পাকিস্তান লাইন অব কন্ট্রোল বা এলওসি মেনে নেওয়া ও বলপ্রয়োগ থেকে বিরত থাকার সুস্পষ্ট অঙ্গীকার ছিল। এ পটভূমিতে বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের সঙ্গে আমরাও একাত্ম হয়ে বলতে চাই, অবিলম্বে অভিযান বন্ধ হোক। পাকিস্তান ও ভারত সীমান্তে শান্তি বজায় থাকুক। সেই সঙ্গে কাশ্মীরে সন্ত্রাসী হামলারও সুষ্ঠু তদন্ত ও দায়ী ব্যক্তিদের বিচারের আওতায় আনতে হবে।
উপমহাদেশের একটি দেশ হিসেবে বাংলাদেশও এ পরিস্থিতিতে নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারে না। দুই দেশের সঙ্গেই আমাদের ব্যবসা–বাণিজ্য আছে। এরই মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকার দুই দেশকে সংযত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। আমরা মনে করি, হামলা চালিয়ে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা কিংবা রণক্ষেত্রে শক্তি পরীক্ষা না করে আলোচনার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা জরুরি। যুদ্ধ শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষের জীবনেই বিপর্যয় ডেকে আনে। যুদ্ধের ভয়াবহ নেতিবাচক প্রভাব শুধু দুই দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, গোটা বিশ্বেই তা ছড়িয়ে পড়ে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ তার জীবন্ত দৃষ্টান্ত। আমরা আশা করি, ভারত–পাকিস্তানের নেতৃত্বের মধ্যে শুভবুদ্ধির উদয় হবে।
.উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
নির্বাচনে জোট গঠনে সতর্ক থাকার পরামর্শ হেফাজত আমিরের
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোট গঠনের ক্ষেত্রে সঙ্গে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী।
মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেছেন, আগামী নির্বাচনে এমন কোনো দলের সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চিন্তা করা যাবে না, যাদের ভ্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কে বুজুর্গানে দ্বীন ও পূর্বপুরুষেরা আগেই সতর্ক করেছেন।
আজ বৃহস্পতিবার সকালে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে ‘জাতীয় উলামা মাশায়েখ সম্মেলন ২০২৫’–এ লিখিত বক্তব্যে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী এ কথা বলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন হেফাজত আমির শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী। অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থ থাকায় তিনি কথা বলেননি। তাঁর লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা তোফাজ্জল হক আজিজ।
ইসলামের মূলধারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত না নিতে দলগুলোকে অনুরোধ জানিয়ে লিখিত বক্তব্যে হেফাজত আমির বলেন, সহিহ আকিদার সব ইসলামি দলকে এক হওয়ার জন্য আগেও তিনি আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর আহ্বানে সাড়া দেওয়ার মতো তেমন পরিবেশ এখনো তৈরি হয়নি। যা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যজনক।
শাহ মুহিবুল্লাহ বাবুনগরী বলেন, একদিকে যেমন ইসলাম ও মুসলিম উম্মাহর বিরুদ্ধে বিভিন্ন প্রকার ষড়যন্ত্র চলছে, অন্যদিকে তেমনি দেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্বের বিরুদ্ধে বহু রকম চক্রান্ত লক্ষ করা যাচ্ছে। গণ–অভ্যুত্থান–পরবর্তী বাংলাদেশে এ রকম পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে, তা তিনি কল্পনাও করেননি।
অন্তর্বর্তী সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোকে উদ্দেশ করে বাবুনগরী বলেন, ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অফিস স্থাপনের চুক্তি দেশের স্বাধীনতার অখণ্ডতার জন্য এবং ধর্মীয় কৃষ্টির জন্য এক অশনিসংকেত। এ চুক্তির তীব্র নিন্দা জানিয়ে তা বাতিল করার দাবিও জানান তিনি।
সম্মেলনে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন হাটহাজারী মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাওলানা খলিল আহমদ কুরাইশী। দেশের সার্বিক পরিস্থিতির বিষয়ে তিনি বলেন, সামনে কালো তুফান দেখা যাচ্ছে। কালো তুফানের সঙ্গে মোলাকাত নয়, মোকাবিলা করতে হবে। জনগণকে ওলামাদের নেতৃত্ব কবুল করতে হবে। তখনই তুফানকে মোকাবিলা করা সম্ভব হবে।
জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সহসভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেন, যারা ফ্যাসিবাদী আমলে পাখা দিয়ে নৌকাকে বাতাস করেছে, তাদের সঙ্গে কোনো ঐক্য হবে না। জুলাই আন্দোলন ছিল ভোটের অধিকার বাস্তবায়নের জন্য। সামনে নির্বাচন। সেই নির্বাচন বানচালের পাঁয়তারা শুরু হয়েছে। সেই পাঁয়তারা রুখে দিতে হবে।
হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেন, ইসলামের বিষয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে আলেমদের মতামত উপেক্ষা করলে হাসিনার মতো পরিণতি হবে।
সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় সভাপতি মাওলানা উবায়দুল্লাহ ফারুক। এ সময় আরও বক্তব্য দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা আলেম এবং ওলামারা।
১৫ দফা প্রস্তাবনা
সম্মেলনে জমিয়তে উলামায়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ১৫ দফা প্রস্তাবনা পেশ করা হয়। প্রস্তাবনা পাঠ করেন সংগঠনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা বাহাউদ্দিন জাকারিয়া।
১৫ দফার মধ্যে আছে—ঢাকায় জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের কার্যালয় স্থাপনের চুক্তি বাতিল করা, জুলাই সনদের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা, জাতীয় শিক্ষাব্যবস্থায় ধর্মশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা এবং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সংগীতের শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত বাতিল করা, ঘোষিত সময়ে নির্বাচন আয়োজনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা; নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির মহড়া বন্ধ করে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নিশ্চিত করা; বিতর্কিত নারী কমিশনের সুপারিশ বাতিল ও শরিয়ার সীমারেখার আলোকে নারীদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।