বেসরকারি খাতের চেয়ে অপেক্ষাকৃত কম দামে যাতে ভোক্তারা তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস পেতে পারেন, সেই উদ্দেশ্যে সরকার এটি বিক্রি করে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) মাধ্যমে। বিপিসির চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান যথাক্রমে পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল) পরিবেশক নিয়োগ দেয়। বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, চার কোম্পানিতে এলপি গ্যাস পরিবেশকের সংখ্যা ৩ হাজার ১০১।
সরকারি উদ্যোগে কম দামে গ্যাস সরবরাহ করলেও এর সুফল পাচ্ছেন না ভোক্তারা। লাভের গুড় খেয়ে নিচ্ছেন পরিবেশকেরা। যেখানে ভোক্তাদের সাড়ে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার কেনার কথা ৮২৫ টাকায়, সেখানে তাঁরা কিনছেন ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। ৪ মে প্রকাশিত মূল্য সমন্বয়ক আদেশ অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে বেসরকারি খাতে এলপিজির ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ১ হাজার ৪৩১ টাকা। অন্যদিকে সরকারি কোম্পানির মূল স্থাপনা বা ডিপো থেকে পরিবেশকদের সিলিন্ডার কিনতে খরচ হচ্ছে ৭৮৪ টাকায় (১২ দশমিক ৫ কেজি)। এর সঙ্গে পরিবেশকদের স্থানীয় পরিবহন খরচ ২১ টাকা, পরিচালন খরচ যুক্ত হয় আরও ২০ টাকা। অর্থাৎ ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার হচ্ছে ৮২৫ টাকা। ৪ মের আগে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্যহার ছিল ৬৯০ টাকা। কিন্তু প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভোক্তাদের দিতে হচ্ছে অনেক বেশি। গত পাঁচ বছরে মোট এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৫২ হাজার ২৩০ টন বা ৫ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার কেজি।
বাড়তি দাম নেওয়ার কথা স্বীকার করে এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি বলেছে, বিপিসির চার কোম্পানি থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যায় না। ফলে নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি করে দোকানভাড়া, ট্রেড লাইসেন্স ফি, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্সের নবায়ন ফি তোলা সম্ভব হয় না। এ কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।
অন্যদিকে বিপিসির চেয়ারম্যান মো.
সরকার নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকেরা গ্যাস পাচ্ছেন কি না, তা তদারকির দায়িত্ব বিইআরসি ও বিপিসির। বাস্তবে তারা সেই দায়িত্ব পালন করছে না বলেই পরিবেশকেরা বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন। বিপিসির মাধ্যমে কম দামে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করায় সরকার মোটা অঙ্কের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনগণ এর সুবিধা পেলে কেউ আপত্তি করত না। কিন্তু ভোক্তাদের যখন বিপিসি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় সমান দামে গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে হচ্ছে, তখন প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে সরকার কেন এ ভর্তুকি দেবে?
এ ক্ষেত্রে বিপিসি দায় এড়াতে পারে না, সরকার নির্ধারিত দামে গ্যাস বিক্রি হচ্ছে কি না, সেটা তদারক করতে হবে তাদেরই। আর বিপিসি যদি সেটা না করতে পারে, তাহলে বেসরকারি খাতে পুরো গ্যাস সিলিন্ডারের বাজার ছেড়ে দেওয়া হোক। বিপিসির এলপি গ্যাস পরিবেশক নিয়োগ ও বিপণন নীতিমালাটি পুনর্মূল্যায়নের সুপারিশ করেছে তদন্ত কমিটি। অনেক সময় কমিটি গঠন করা হয়, তারা সুপারিশও করে। কিন্তু বাস্তবায়িত হয় না। বিপিসির পরিবেশক নীতিমালার ক্ষেত্রেও তেমনটি হবে না আশা করি।
উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: ব সরক র কম দ ম অন য য়
এছাড়াও পড়ুন:
বাংলাদেশে মানব উন্নয়নের বিকল্প নেই কেন
অতি সম্প্রতি ২০২৫ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। বাংলায় অনুবাদ করলে এর শিরোনাম দাঁড়ায়, ‘চয়নের একটি বিষয়: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে মানুষ এবং সম্ভাবনা’। বিষয়বস্তুর বিশ্লেষণ ভিন্ন হলেও এই প্রতিবেদনে ২০২৩ সালের বৈশ্বিকভাবে তুলনাযোগ্য উপাত্ত নিয়ে তৈরি করা মানব উন্নয়ন সূচকে ১৯৩ দেশ এবং ভূখণ্ডের মানব উন্নয়নের মান ও অবস্থান নির্ণয় করা হয়েছে।
বলা প্রয়োজন যে একটি দেশের প্রত্যাশিত গড় আয়ু, বিদ্যালয় শিক্ষার গড় ও প্রত্যাশিত বছর এবং মাথাপিছু আয়ের ভিত্তিতে একটি সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করা হয়। এ বছরের মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের মানব উন্নয়ন সূচকে গত দুই বছরের শীর্ষস্থানীয় দেশ সুইজারল্যান্ডকে হটিয়ে দিয়ে আইসল্যান্ড শীর্ষ স্থান দখল করেছে।
অন্যদিকে তালিকার শেষ প্রান্তের দেশ সোমালিয়া এক ধাপ ওপরে উঠে এসেছে। ফলে এখন মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার সর্বনিম্নে স্থান হয়েছে দক্ষিণ সুদানের।
আসলে নিজেদের মধ্যে অবস্থান পাল্টালেও মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার একেবারের ওপরের কিংবা একেবারে নিচের পাঁচটি দেশ মোটামুটি কিন্তু অপরিবর্তিতই থেকেছে।
২.
মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন এবং মানব উন্নয়ন সূচক বিষয়ে তিনটি পর্যবেক্ষণ অত্যন্ত জরুরি। প্রথমত, মনে রাখা দরকার যে কোনো তাত্ত্বিক ধারণাই তার প্রাসঙ্গিক পরিমাপের চেয়ে বড়। অন্য কথায়, কোনো পরিমাপ, তা যত সঠিকই হোক না কেন, সংশ্লিষ্ট ধারণার পুরোটাকে যথার্থভাবে ধরতে পারে না। মানব উন্নয়ন সূচকও মানব উন্নয়নের বিস্তৃত পরিব্যাপ্তির প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না।
দ্বিতীয়ত, একটি সুস্থ দীর্ঘ সৃষ্টিশীল জীবন, জ্ঞান, জীবনযাত্রার মানের মতো মানব উন্নয়নের অত্যন্ত মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে মানব উন্নয়ন সূচক তৈরি করা হয়। বাহ্যতই, জন অংশগ্রহণ, মানব নিরাপত্তা, পরিবেশ বজায় ক্ষমতার মতো মানব উন্নয়নের বৃহত্তর মাত্রিকতাগুলো এই সূচকে অন্তর্ভুক্ত হয়নি। সুতরাং মানব উন্নয়ন সূচক একটি দেশের মানব উন্নয়নের বৃহত্তর চালচিত্রকে ধারণ করে না।
তৃতীয়ত, এটা নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক যে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন প্রকাশিত হলেই সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম এবং সেই সঙ্গে দেশের সরকারসমূহের নজর ও মনোযোগ পড়ে থাকে মানব উন্নয়ন সূচকে বিভিন্ন দেশের অবস্থান কী রকম, সেদিকে। এই অনাকাঙ্ক্ষিত ঘোরের কারণে মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বিষয়বস্তুর যে যথার্থ বিশ্লেষণ ও নীতিমালার সুপারিশ থাকে, তা ‘অপাঙ্ক্তেয়’ হয়ে যায়।
আরও পড়ুনবাংলাদেশের সম্পদ, বাংলাদেশের সম্ভাবনা২৮ মার্চ ২০২৫কিন্তু বিপদ হচ্ছে যে মানব উন্নয়ন সূচকে দেশসমূহের অবস্থান বিষয়ে মাতামাতি অনেক সময়েই বিভ্রান্তমূলক উপসংহারের জন্ম দেয়। যেমন একটি দেশের মানব উন্নয়ন মান বাড়লেও, সূচক তালিকায় দেশটি নিচে নেমে যেতে পারে।
দুটি কারণে এটা হতে পারে। অন্য দেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান আরও বেশি করে বৃদ্ধি পেলে এবং যদি আরও দেশ মানব উন্নয়ন সূচক তালিকার অন্তর্ভুক্ত হয় কিংবা এ দুটি কারণের সম্মিলনে। কিন্তু এর ফলে যদি বলা হয় যে মানব উন্নয়ন সূচক তালিকায় নেমে যাওয়া সংশ্লিষ্ট দেশটির মানব উন্নয়নে অবনতি ঘটেছে, তবে সে উপসংহারটি হবে বিভ্রান্তমূলক।
৩.
বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতোই, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের দেশেও সব মনোযোগ আর নজর মানব উন্নয়ন সূচক তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে। এ বছরের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ০.৬৮৫, যা গত বছরের প্রতিবেদনে ছিল ০.৬৮০।
গত ৩৫ বছরে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচক ৭২ শতাংশ বেড়েছে। কিন্তু দেশে এসব ব্যাপারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সূচক অবস্থানে বাংলাদেশ কত ধাপ নামল বা উঠল কিংবা সেই অবস্থানে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের অবস্থান কোথায়?
তাই বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান আলোচনা ঘুরছে, ‘গত প্রতিবেদনে মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১২৯, এবার হয়েছে ১৩০। খুবই খারাপ খবর’ কিংবা ‘সূচক অবস্থানে আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কা ও মালদ্বীপ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক এগিয়ে আছে’।
আমার মনে হয়, সংখ্যা এবং সূচক অবস্থান থেকে বেরিয়ে এসে মানব উন্নয়ন সূচকের আলোচনাটি বাংলাদেশে আরেকটু ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হওয়া দরকার। মনোযোগ দেওয়া দরকার কিছু মৌলিক বিষয়ের ওপরে, যেখানে নীতিমালার প্রশ্নটি সম্পৃক্ত। প্রথমত, সাধারণ মানব উন্নয়ন সূচকে যখন অসমতাকে বিবেচনা করা হয়, তখন সাধারণ মানব উন্নয়ন সূচকের মান কমে যায়।
২০২৫ সালের বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে যখন আমরা অসমতা-সমন্বিত মানব উন্নয়ন সূচকের দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যে বাংলাদেশের প্রথাগত মানব উন্নয়ন সূচকের তুলনায় অসমতা-সমন্বিত সূচকের মান এখন ৩০ শতাংশ কম। অথচ দুই বছর আগে এটা ছিল ২৩ শতাংশ কম। এর মানে হচ্ছে যে বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন ফলাফলে অসমতা আরও বিস্তৃত হচ্ছে এবং বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের অর্জনগুলোকে ক্রমবর্ধমান অসমতা গ্রাস করছে।
তা ছাড়া বাংলাদেশে মানব উন্নয়ন ফলাফলের অসমতা হয়তো নিহিত আছে দেশের মানব উন্নয়ন সুযোগের বৈষম্যের মধ্যে। সুতরাং মানব উন্নয়ন সুযোগ এবং ফলাফলের অসমতার কারণগুলো শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় নীতিমালা এবং কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে যে একটি ‘মধ্যম আয়ের ফাঁদের’ মতো মানব উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ একটি ‘মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন ফাঁদে’ আটকা পড়ে আছে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান বৃদ্ধি পেয়েছে, তবু এক দশকের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ মধ্যম মানের মানব উন্নয়ন স্তরে আটকে আছে।
প্রশ্ন হচ্ছে যে এই ফাঁদ থেকে বাংলাদেশ কেন বের হতে পারছে না? আমরা যদি বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের উপাদানগুলোর দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাব যে ২০২১-২০২৩ সময়কালের মধ্যে বাংলাদেশের গড় আয়ু ২ বছর বেড়েছে, প্রত্যাশিত বিদ্যালয়-গমনের সময় একটুখানি বৃদ্ধি পেয়েছে, কিন্তু গড় বিদ্যালয়-গমনের সময় হ্রাস পেয়েছে। সেই সঙ্গে মাথাপিছু আয় যথেষ্ট পরিমাণে বাড়েনি।
সুতরাং বাংলাদেশকে যদি উচ্চ মানব উন্নয়ন স্তরে নিয়ে যেতে হয়, তাহলে অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে সঙ্গে নীতির অগ্রাধিকার দিতে হবে যে কী করে গড় বিদ্যালয়-গমনের সময় আরও বাড়ানো যায়, কেমন করে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করা যায়।
এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার দিকে একটু নজর ফেরানো যাক। দীর্ঘদিন ধরে শ্রীলঙ্কার অবস্থান উচ্চ মানব উন্নয়ন স্তরে। কিন্তু এটা সবারই জানা যে ২০২২ সালে দেশটি একটি রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছিল। কিন্তু এই সব বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে শ্রীলঙ্কা তার জনগণের প্রত্যাশিত গড় আয়ু দুই বছর বাড়িয়েছে, রোধ করতে পেরেছে তার মাথাপিছু আয়ের হ্রাস। ফলে দেশটির মানব উন্নয়ন সূচকের মান মাত্র ০.০০৬ কমেছে (২০২১ সালের ০.৭৮২ থেকে ২০২৩ সালে ০.৭৭৬)। এত সব বিপর্যয় সত্ত্বেও শ্রীলঙ্কা তার উচ্চ মানব উন্নয়ন মান ধরে রাখতে পেরেছে।
প্রশ্ন হচ্ছে যে বাংলাদেশের গত এক বছরের রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক পরিবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে ভবিষ্যৎ পথযাত্রায় বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে কী শিখতে পারে?
তৃতীয়ত, ভারত এখন বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মানকে ছুঁয়ে ফেলেছে। ২০২১ সালে বাংলাদেশের মানব উন্নয়ন সূচকের মান ছিল ০.৬৪১ আর ভারতের ০.৬৩৩। দুই বছর পরে ২০২৩ সালে দুটি দেশেরই মানব উন্নয়ন সূচকের মান হয়েছে ০.৬৮৫। ফলে ২০২১ সালে দুটি দেশের মধ্যে মানব উন্নয়ন সূচকের অবস্থানের যে তারতম্য ছিল (বাংলাদেশের অবস্থান ১২৯তম ও ভারতের ১৩২তম) তা এখন অন্তর্হিত হয়েছে।
মানব উন্নয়ন সূচক মানে দুটি দেশেরই অবস্থান এখন ১৩০তম। দুটি কারণে মানব উন্নয়ন সূচকে ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে ফারাকটা দূর করতে পেরেছে।
এক. জনগণের প্রত্যাশিত গড় আয়ু ভারত ৫ বছর বাড়াতে পেরেছে (২০২১ সালের ৬৭ বছর থেকে ২০২৩ সালে ৭২ বছর) এবং দুই. প্রত্যাশিত বিদ্যালয়-গমন বছর ১২ বছর থেকে ১৩ বছর বেড়েছে। ভারত কী করে তার মানব উন্নয়ন ফলাফল উন্নীত করল, সে অভিজ্ঞতা বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয় হতে পারে।
চতুর্থত, বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনে যে পরিসংখ্যান ব্যবহার করা হয়, তা বৈশ্বিকভাবে তুলনাযোগ্য। দেশজ উপাত্তকে সমভিত্তিক করে এ পরিসংখ্যান কাঠামো গড়ে তোলা হয়।
৪.
দেশজ উপাত্ত হচ্ছে সব উপাত্তের মূল। বিভিন্ন দেশের জাতীয় পরিসংখ্যান সংস্থা যদি বিশ্বাসযোগ্য ও মানসম্পন্ন উপাত্ত সংগ্রহের সক্ষমতা বাড়ায় এবং বৈশ্বিক পর্যায়ে যেসব জাতিসংঘ সংস্থা মানব উন্নয়ন উপাত্ত কাঠামো গড়ে তোলার দায়িত্বে নিয়োজিত, তাদের কাছে দ্রুত এবং সময়মতো দেশজ উপাত্ত লভ্য করে দেয়, তাহলে বৈশ্বিক মানব উন্নয়ন প্রতিবেদনের তথ্য-উপাত্ত অনেক বেশি উন্নত হবে। জাতীয় নীতিমালার উচিত হবে এ প্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত করা।
পঞ্চমত, বাংলাদেশের নারী ও পুরুষের বিভাজিত মানব উন্নয়ন সূচক থেকে এটা সুস্পষ্ট যে সেখানে উল্লেখযোগ্য বৈষম্য রয়েছে। আমাদের দেশে নারীর মানব উন্নয়ন সূচক ০.৬৫০। পুরুষের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ০.৭০৮।
শুধু জৈবিক সুবিধার কারণে নারীর প্রত্যাশিত গড় আয়ু পুরুষের চেয়ে বেশি; ৭৬ বছর বনাম ৭৩ বছর। অন্যদিকে গড় বিদ্যালয়–গমনের সময়, মাথাপিছু আয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের নারীরা পুরুষদের চেয়ে পিছিয়ে আছে।
পুরুষের গড় বিদ্যালয়-গমন সময় যেখানে ৭.৩ বছর, নারীদের ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে ৬.২ বছর। বাংলাদেশের নারীদের মাথাপিছু আয় পুরুষদের মাথাপিছু আয়ের অর্ধেক। শুধু প্রত্যাশিত বিদ্যালয়–গমন সময়ের ক্ষেত্রে নারীদের সময় যেখানে ১২.৪ বছর, পুরুষদের ক্ষেত্রে তা হচ্ছে ১১.৯ বছর।
সুতরাং প্রাসঙ্গিক প্রশ্ন হচ্ছে, মানব উন্নয়ন ফলাফলে বৈষম্য কমানোর জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে?
বাংলাদেশের আগামীর উন্নয়ন পথযাত্রায় দেশটি নানা রকম দেশজ ও বৈশ্বিক অন্তরায়ের সম্মুখীন হবে। সেসব সমস্যা বাংলাদেশের মানব উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে। দেশজ বলয়ে অর্থনৈতিক শ্লথতা, উচ্চ মূল্যস্ফীতি ও বেকারত্বের হার, ব্যাংকিং এবং বহিঃ খাতের নাজুকতা ও ভঙ্গুরতা বাংলাদেশের মানব উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক বলয়ে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ, বৈশ্বিক শুল্কযুদ্ধ, বিশ্বের নানান অংশে চলমান সংঘাত বাংলাদেশের মানব উন্নয়নকে প্রভাবিত করবে।
মানবসম্পদ হচ্ছে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় সম্পদ। সুতরাং বাংলাদেশের উন্নয়ন দেশের মানব উন্নয়নের ওপর উল্লেখযোগ্যভাবে নির্ভর করে। এর জন্য দেশের মানব উন্নয়নের পথের প্রতিবন্ধকতাসমূহ চিহ্নিত করতে হবে, সমস্যাগুলোর বিশ্লেষণ করা প্রয়োজন এবং সেসব সমস্যা সমাধানের জন্য কৌশল প্রণয়ন করা দরকার।
আমরা অর্থনীতির সমস্যাগুলো ঠিক করতে পারি, সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে পারি, ভৌত অবকাঠামো গড়ে তুলতে পারি; কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে, আমাদেরকে মানব উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতেই হবে। কারণ, বাংলাদেশে মানব উন্নয়নের কোনো বিকল্প নেই।
ড. সেলিম জাহান জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগের ভূতপূর্ব পরিচালক।
মতামত লেখকের নিজস্ব