১৫ মে ছিল নাকবা বা মহাবিপর্যয় দিবস। ৭৭ বছর আগে ফিলিস্তিনেদের ওপর নেমে আসা মহাবিপর্যয় ও তাদের ঘর হারানোর দিন এটা। সেই দুঃসহ স্মৃতি আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন ফিলিস্তিনিরা। নাকবা দিবসের ৭৭তম বর্ষপূর্তিরতে গতকাল বৃহস্পতিবার ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকাজুড়ে জোরদার হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। এসব হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ১১৫ জন। 

স্থানীয় কর্মকর্তারা জানান, গাজার দক্ষিণাঞ্চলের খান ইউনিস এলাকায় গতকাল ভোরের দিকে চালানো হামলায় নিহত হয়েছেন অন্তত ৬১ জন। উত্তরাঞ্চলের জাবালিয়ায় আল–তাওবাহ চিকিৎসাকেন্দ্রে ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ গেছে আরও অন্তত ১৫ জনের। হামলায় বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন। হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে।

ইসরায়েলি বাহিনীর হামলার জেরে গাজাজুড়ে অন্তত তিনটি হাসপাতালের কার্যক্রম সাময়িক বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এগুলো হলো—জাবালিয়ার আল–আওদা হাসপাতাল, খান ইউনিসের ইন্দোনেশিয়ান হাসপাতাল এবং ইউরোপীয়ান হাসপাতাল।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাস ইসরায়েলের মাটিতে হামলা চালায়। এতে আনুমানিক ১ হাজার ১৩৯ জন নিহত হন এবং ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে গাজায় নিয়ে যাওয়া হয়। জবাবে সেদিন থেকেই গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল।

হামাস নিয়ন্ত্রিত গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুসারে, উপত্যকাটিতে ইসরায়েলি হামলায় এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ৫৩ হাজার ১০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতের বেশিরভাগই নারী ও শিশু। আহত হয়েছেন ১ লাখ ১৯ হাজার ৯১৯ জন। সূত্র: আল-জাজিরা

.

উৎস: Samakal

কীওয়ার্ড: ইসর য় ল ন হত ইসর য় ল

এছাড়াও পড়ুন:

বাঙালির পবিত্র সফর

হজ ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি। তবে বাঙালি মুসলমানদের জন্য হজ পালন একটি পবিত্র স্বপ্ন। তবে তিন-চার দশক আগেও হজযাত্রা ছিল অত্যন্ত কঠিন, দীর্ঘ ও বিপৎসংকুল। বাঙালিরা সমুদ্রপথে জাহাজে বা স্থলপথে দীর্ঘ যাত্রা করে মক্কা-মদিনার পথে রওনা হতেন, রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর স্মৃতি খুঁজতে এবং কাবা শরিফ ও হাজরে আসওয়াদের স্পর্শে নিজেকে পবিত্র করতে। এ নিবন্ধে সেকালের বাঙালির হজযাত্রার প্রেক্ষাপট, চ্যালেঞ্জ ও সামাজিক তাৎপর্য তুলে ধরা হলো।

সেকালের হজযাত্রার পটভূমি

তিন-চার দশক আগে হজযাত্রা ছিল একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। প্রস্তুতির জন্য বছরের পর বছর লেগে যেত। তখন হজযাত্রীরা ইহজীবনের সব দায়িত্ব থেকে মুক্ত হয়ে হজের উদ্দেশে রওনা হতেন। উল্লেখযোগ্য হলো ছেলেমেয়ের বিয়েশাদি সম্পন্ন করা, সম্পত্তির ভাগ-বাঁটোয়ারা ও আর্থিক লেনদেনের পাট চুকানো এবং পারিবারিক ও সামাজিক দায়িত্ব পালন ইত্যাদি।

অধিকাংশ বয়স্ক লোকই হজযাত্রী ছিলেন। কারণ, যুবকেরা সাধারণত হজে যেতেন না। এর কারণগুলোর অন্যতম ছিল দীর্ঘ ও বিপৎসংকুল যাত্রার ভয়, রোগাক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর আশঙ্কা, সমুদ্রঝড় বা পথে হারিয়ে যাওয়া। তখন অনেকে পথেই মারা যেতেন। অনেকে হজকে জীবনের শেষ ভ্রমণ হিসেবে বিবেচনা করতেন। কেউ কেউ মক্কা বা মদিনায় মৃত্যুর প্রত্যাশা করতেন, আবার কেউ হজের পর দুনিয়াদারি ত্যাগ করার পরিকল্পনা করতেন। এ ছাড়া বাংলার সংস্কৃতিতে বয়স্করা হজে যাওয়াকে বেশি গ্রহণযোগ্য মনে করা হতো। এটি মালয়েশিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার মতো দেশের থেকে ভিন্ন, যেখানে তরুণেরা বিয়ের পরপরই হজে যান।

হজযাত্রার সামাজিক তাৎপর্য

সেকালে হজ পালন করা ছিল অর্থবিত্ত, শারীরিক সামর্থ্য, দৃঢ় মনোবল ও মজবুত ইমানের প্রতীক। হজযাত্রীর সংখ্যা ছিল কম, তবে সমাজে তাঁদের কদর ছিল অপরিসীম। একটি বংশে একজন হাজির উপস্থিতি সেই বংশের মর্যাদা কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিত। কিছু ক্ষেত্রে গ্রামের নাম পরিবর্তন হয়ে ‘হাজীপুর’, ‘হাজীগঞ্জ’, ‘হাজীপাড়া’ বা ‘হাজীবাগ’ হয়ে যেত, যা হজের সামাজিক প্রভাবের প্রমাণ।

হাজিরা সমাজে ধর্মীয় ও নৈতিক আদর্শের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হতেন। তাঁদের অভিজ্ঞতা ও গল্প গ্রামের মানুষের মধ্যে ধর্মীয় উৎসাহ জাগাত।

আরও পড়ুনসহজ ওমরাহ ৩০ জানুয়ারি ২০২৫

সেকালের হজযাত্রার পথ

সেকালে হজযাত্রার জন্য বিশ্বব্যাপী পাঁচটি প্রধান যাত্রাপথ ছিল:

১. ইরাকি রুট (দার্ব জুবায়েদা): কুফা ও বসরা থেকে শুরু হয়ে মক্কায় পৌঁছাত। ইরান, ইরাক ও মধ্য এশিয়ার হজযাত্রীরা এ পথ ব্যবহার করতেন। পথে পানি ও আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা ছিল।

২. সিরীয় রুট (দার্ব হাজ আল সামি): দামেস্ক, আম্মান, পেট্রা, তাবুক হয়ে মক্কা-মদিনা। এই পথে বেদুইনদের আক্রমণের ঝুঁকি ছিল বেশি।

৩. মিসরীয় রুট (দার্ব আল মিসরি): কায়রো থেকে সিনাই হয়ে মক্কা-মদিনা।

৪. ইয়েমেনি রুট (তিহামা হজপথ): এই পথে ২৬টি বিরতি স্থান ছিল এবং এটি ছিল অত্যন্ত বিপৎসংকুল।

৫. আফ্রিকান রুট: মালির টিম্বাকটু থেকে সাহারা মরুভূমি অতিক্রম করে কায়রো, তারপর সিনাই হয়ে মক্কা-মদিনা।

বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীরা প্রধানত দুটি পথ ব্যবহার করতেন:

স্থলপথ: চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, ইরাক হয়ে মক্কা। উদাহরণস্বরূপ, ১৭৯৯ সালে হাজি শরীয়তুল্লাহ, হাজি মুহম্মদ মুহসীন এবং মীর নিসার আলী তিতুমীর এ পথে হজে গিয়েছিলেন। এ পথ ছিল দীর্ঘ ও বিপজ্জনক, বিশেষ করে সাফায়িদ শিয়া জনগোষ্ঠীর আক্রমণের কারণে।

সমুদ্রপথ: বঙ্গোপসাগর, পক প্রণালি, লাক্ষা দ্বীপ উপসাগর, আরব সাগর, এডেন উপসাগর ও লোহিত সাগর হয়ে জেদ্দা। এ দূরত্ব ছিল প্রায় ৪ হাজার ৪০৯ নটিক্যাল মাইল। সমুদ্রপথ তুলনামূলকভাবে নিরাপদ হলেও সমুদ্রঝড়, রোগ ও জলদস্যুদের আক্রমণের ঝুঁকি ছিল। ষোড়শ শতকে লোহিত সাগর পর্তুগিজদের নিয়ন্ত্রণে ছিল এবং হজযাত্রীদের কার্তাজ নামের একটি পাস সংগ্রহ করতে হতো।

কিছু হজযাত্রী চট্টগ্রামের পতেঙ্গা থেকে জাহাজে সিংহল (শ্রীলঙ্কা)। এরপর পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ইরান, কুয়েত, ইরাক, জর্দান, মিসর হয়ে সৌদি আরব যেতেন। এ যাত্রার কিছু অংশ হেঁটে সম্পন্ন হতো, যা অত্যন্ত কঠিন ছিল।

আরও পড়ুন মসজিদে নববি ভ্রমণ করা যাবে ঘরে বসেই৩০ জানুয়ারি ২০২৩

মোগল আমলে হজযাত্রার ব্যবস্থা

মোগল শাসনামলে (১৫৭৬-১৮৫৭) হজযাত্রা কিছুটা সংগঠিত ছিল। মোগল সম্রাটরা হজযাত্রীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা করতেন।

সম্রাট আকবর প্রথম মোগল শাসক যিনি সরকারি খরচে বা ভর্তুকি দিয়ে হজযাত্রার ব্যবস্থা করেন। তিনি গুজরাটের সুরাট বন্দরকে বাব আল মক্কা (মক্কার দ্বার) হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন এবং মক্কায় একটি সেবাদান কেন্দ্র নির্মাণ করেন। ১৫৭৫ সালে পর্তুগিজদের সঙ্গে নিরাপত্তা চুক্তির পর তিনি প্রতিবছর হজ নৌবহর পাঠানোর ঘোষণা দেন।

আকবর একজন জ্যেষ্ঠ সভাসদকে মীর হাজি (হজযাত্রীদের নেতা) নিযুক্ত করেন। উদাহরণস্বরূপ, আবদুর রহিম খানে খানা তিনটি জাহাজের (রহিম, করিম, সালারি) মালিক ছিলেন, যেগুলো ১ হাজার ৪০০ থেকে ১ হাজার ৬০০ টন ওজনের এবং ১ হাজার ৭০০ যাত্রী বহন করতে পারত।

সম্রাট জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের আমলেও এ ব্যবস্থা অব্যাহত ছিল। সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে প্রতিবছর দুটি রাজকীয় জাহাজ লোহিত সাগর পাড়ি দিত, যেখানে যাত্রীদের কোনো খরচ বহন করতে হতো না। মোগল হারেমের নারীরা এ জাহাজে যাত্রা করতেন। উদাহরণস্বরূপ, আওরঙ্গজেবের কন্যা জেবুন্নেসা হজযাত্রীদের সাহায্য করতেন।

উল্লেখযোগ্য ঘটনা

১৬১৩ সালে রহিম জাহাজ (মালিক মরিয়ম-উজ-জামানি, জাহাঙ্গীরের মা) পর্তুগিজদের আক্রমণের শিকার হন। এটি মোগল সম্রাটের জন্য অসম্মানজনক ছিল। ফলে জাহাঙ্গীর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে ভারতে ব্যবসার অনুমতি দেন।

আরেকটি ঘটনা হলো, সফি বিন ওয়ালী আল-কাজভিনি নামে একজন পণ্ডিত ১৬৭৬ সালে সালামাত রাস জাহাজে হজে যান এবং তাঁর যাত্রার বিবরণ নিয়ে ‘আনিসুল হজ ’ নামে একটি বই লেখেন। এ বই মুম্বাইয়ের প্রিন্স অব ওয়েলস জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।

বাঙালির হজযাত্রার চ্যালেঞ্জ

সেকালের হজযাত্রায় ছিল নানামুখী চ্যালেঞ্জ। সমুদ্রপথে জলদস্যু, সমুদ্রঝড় ও রোগের ঝুঁকি ছিল। স্থলপথে আক্রমণ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয় ছিল। হজের খরচ সাধারণ মানুষের জন্য প্রায় অসম্ভব ছিল। শুধু অর্থবান ব্যক্তিরাই হজে যেতে পারতেন। অনেকে ফিরে আসতে না পারার ভয়ে বা জীবনের শেষ ভ্রমণ হিসেবে হজকে বিবেচনা করতেন। এ ছাড়া সমুদ্রপথে পর্তুগিজদের কার্তাজ পাস সংগ্রহ করা ছিল একটি বড় চ্যালেঞ্জ।

সবকিছুর পরও সেকালের বাঙালির হজযাত্রা ছিল ধর্মীয় নিষ্ঠা, ত্যাগ, ও অধ্যবসায়ের একটি অসাধারণ উদাহরণ। দীর্ঘ, বিপৎসংকুল ও ব্যয়বহুল হলেও হজযাত্রীরা মক্কা-মদিনার পবিত্র মাটিতে পৌঁছানোর স্বপ্নে উদ্বুদ্ধ হতেন। মোগল শাসনামলে হজযাত্রা কিছুটা সংগঠিত হলেও সাধারণ মানুষের জন্য এটি ছিল একটি দুর্লভ সুযোগ। সমাজে হাজিদের মর্যাদা ও তাঁদের অভিজ্ঞতা বাঙালি মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। আধুনিক যুগে বিমানযাত্রা ও সরকারি ব্যবস্থাপনা হজকে সহজ করলেও সেকালের হজযাত্রার গল্প আমাদের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও ত্যাগের মহিমার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।

আরও পড়ুনকাবা শরিফ মার্বেল পাথরের অপূর্ব কাহিনি১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪

সম্পর্কিত নিবন্ধ