বিস্কুট, পাউরুটি, কেকের প্যাকেট ছোট হচ্ছে, কষ্টে শ্রমজীবী মানুষ
Published: 16th, May 2025 GMT
রাজধানীর কারওয়ান বাজারে ফুটপাতের চায়ের দোকানে পাউরুটি ডুবিয়ে চা খাচ্ছিলেন রিকশাচালক মোখলেছ। কথায় কথায় তিনি জানালেন, আগে একটি পাউরুটি খেয়ে কিছুটা পেট ভরত, এখন আর পেট ভরে না। কারণ, পাউরুটি আকারে ছোট হয়ে এসেছে।
দোকানি আকরাম হোসেনের কথা, শুধু পাউরুটি নয়, কেক-বিস্কুট—সব ধরনের মোড়কজাত খাদ্যপণ্য দিন দিন পরিমাণে কমিয়ে দিচ্ছে কোম্পানিগুলো। কাঁচামালের দাম বাড়লে বা শুল্ক-কর বাড়ালে কোম্পানিগুলো হয় দাম বাড়িয়ে দেয়, নয়তো পরিমাণে কমিয়ে দেয়।
একদিকে মূল্য সংযোজন কর বা ভ্যাটের চাপ, অন্যদিকে কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধি—এ দুয়ের চাপে ছোট হচ্ছে বিস্কুট-কেক-পাউরুটির মতো খাদ্যপণ্যের প্যাকেট। এ প্রবণতা কয়েক বছর ধরেই চলছে। এতে ভোগান্তিতে পড়ছেন দেশের খেটে খাওয়া শ্রমজীবী মানুষ।
ভাতের বিকল্প সস্তা ও পেট ভরানো খাবারের মধ্যে বিস্কুট, কলা, পরোটা, ডিম এগিয়ে আছে। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় বিস্কুট।
কারওয়ান বাজারের সেই দোকানি আকরাম হোসেন বলছিলেন, ‘এহন অনেক কাস্টমার দোকানে আইসা প্যাকেট হাতায়। তহন বুঝি, চায়ের সঙ্গে কাস্টমার আসলে কী খাইতে চায়, কী খাইলে তার একটু পেট ভরব। কিন্তু হেরা সিদ্ধান্ত নিতে পারে না।’
ফুড অ্যান্ড বেভারেজ প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কাঁচামাল বা ভ্যাট বাড়লে তাদের হয় দাম বাড়াতে হয়, অথবা পণ্যের পরিমাণ কমিয়ে দিতে হয়। অবশ্য জানুয়ারি মাসে কেক-বিস্কুটের ওপর ভ্যাট বাড়ানোর পর পণ্যের পরিমাণ কমানো হয়নি বলে দাবি তাঁদের।
যদিও দোকানিদের কথা ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, বিস্কুট-পাউরুটি-কেকের পরিমাণ কম দেওয়ার প্রবণতা চলেছে ধারাবাহিকভাবে।
অর্থনীতিতে এই পরিস্থিতিতে বলা হয় ‘শ্রিংকফ্লেশন’। মার্কিন অর্থনীতিবিদ পিপা ম্যামগ্রেন এই প্রত্যয় প্রথম ব্যবহার করেন। এটি অর্থনৈতিক বা ব্যবসায়িক কৌশল, যেখানে একটি পণ্যের ওজন বা পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়, কিন্তু মূল্য অপরিবর্তিত রাখা হয় অথবা সামান্য বাড়ানো হয়।
পাউরুটি বিস্কুট কেকের মতো পণ্যে শুল্ক-কর বসানো হলে তা মূলত ওই সব খেটে খাওয়া গরিব মানুষের কাছ থেকে আদায় করা হয়। কারণ, শ্রমজীবী ও নিম্ন আয়ের মানুষের বিশাল অংশ দিনের বেলায় ভাতের সস্তা বিকল্প হিসেবে এসব খাবারের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে। কেক-বিস্কুট ও পাউরুটির মতো খাবার গরিব মানুষের নিত্যদিনের রসদ। এসবের ওপর বারবার শুল্ক-কর বসিয়ে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির কৌশল সামাজিক ন্যায়ের পরিপন্থী বলে মনে করেন অনেকে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও অর্থনীতিবিদ হোসেন জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, রাজস্ব বাড়ানোর পরিকল্পনা এলেই দরিদ্র মানুষের পণ্যের ওপর নজর পড়ে। এ থেকে বর্তমানের নীতিনির্ধারকেরাও বের হতে পারছেন না। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গি গরিববিরোধী। রাজস্ব বাড়াতে হবে বুঝলাম, কিন্তু এই পথে কেন? এর প্রভাব মানুষের পুষ্টি ও জীবনমানের ওপর পড়তে বাধ্য।
একদিকে গরিবের ওপর ভ্যাটসহ শুল্ক-করের বোঝা বাড়ছে, অন্যদিকে দেশের সুপারশপগুলোতে ভ্যাট কমানো হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পোস্টার সাঁটিয়ে সুপারশপগুলো ভ্যাট কমার বিষয়টি প্রচার করে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছে। পণ্যের দামের মধ্যে ভ্যাট অন্তর্ভুক্ত আছে। কিন্তু পাড়ামহল্লার দোকানে পাউরুটি–বিস্কুট–কেকের মতো খাদ্যপণ্যের দাম এক টাকা বাড়লেও তা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষের ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলে।
এ বিষয়ে ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির ভূঁইয়া প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা বাজার পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, ভ্যাট আরোপের পর প্রতিটি কোম্পানি হয় প্যাকেটে পণ্যের পরিমাণ কমিয়েছে, নয়তো দাম বাড়িয়েছে। এ ব্যাপারে একাধিক কোম্পানিকে আমরা দাম কমানোর অনুরোধ করেছি। কিন্তু কোনো সাড়া পাইনি। গরিবের খাবারে এ রকম অতিরিক্ত করের বোঝা বড় অন্যায়।
তবে গত জানুয়ারি মাসে ভ্যাট বাড়ানোর পর প্যাকেটজাত কেক-বিস্কুটের দাম বাড়ানো হয়নি বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ বিস্কুট অ্যান্ড ব্রেড অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শফিকুর রহমান ভূঁইয়া। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা আগামী বাজেট পর্যন্ত অপেক্ষা করব। এর মধ্যে ভ্যাট কমানো বা প্রত্যাহার করা না হলে দাম বাড়ানো ছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবে না।’
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যানুযায়ী, গত এপ্রিল মাসে সার্বিক মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৮ দশমিক ৬৩ শতাংশ এবং খাদ্যবহির্ভূত খাতে এই হার ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ।
গবেষণা কী বলছেতরুণদের পরিচালিত গবেষণা সংস্থা ইয়ুথ পলিসি নেটওয়ার্কের এক গবেষণায় দেখা গেছে, মূল্যস্ফীতির চাপে চরম সংকটে পড়েছেন দেশের রিকশাচালক, দিনমজুর, শিক্ষার্থীসহ নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত নাগরিকেরা। তার পেছনে বড় একটি কারণ নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যে ভ্যাট বৃদ্ধি। এই করনীতি গরিবের জীবনে চাপ আরও বাড়াচ্ছে।
চলত বছরের মার্চে দেশের ১ হাজার ২২ জন মানুষের ওপর পরিচালিত এই জরিপে দেখা গেছে, ৯৯ শতাংশ উত্তরদাতা কোনো না কোনো সময় ভারী খাবার বাদ দিতে বাধ্য হয়েছেন কেবল অর্থাভাবে। বিকল্প হিসেবে পাউরুটি বা বিস্কুট-কলা খেয়েছেন। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের প্রায় ৬০ শতাংশ মাঝেমধ্যে সকালের নাশতা বাদ দেন। দুপুর বা বিকেলের খাবারও বাদ দিতে হয় অনেক সময়। কারণ, খাবার কেনার সামর্থ্য অনেক সময় তাঁদের থাকে না। তাঁদের অধিকাংশের আয় ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকার মধ্যে। তার নিচেও আয়ের সংখ্যা কম নয়।
জরিপে অংশ নেওায়া ৯০৪ জন বলেছেন, তাঁরা বোতলজাত পানি কিনতেই পারেন না। বোতলজাত পানিকে তাঁরা বিলাসদ্রব্য বিবেচনা করেন। ৮৯৭ জন মনে করেন, আগের বাজেট তাঁদের প্রয়োজনকে গুরুত্ব দেয়নি। ৭০১ জন সরাসরি বলেছেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্য বিবেচনায় ভ্যাটের হার অনেক বেশি। জরিপে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ৬০৫ জন বলেছেন, নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য কর কমানো উচিত। ১৯৫ জন বলছেন, ভর্তুকি ও সহায়তা বাড়ানো দরকার। ১৯৩ জন চান, ধনীদের ওপর কর বাড়ানো হোক।
জরিপে অংশগ্রহণকারীদের দাবি, পণ্যের দাম কমানো, জনবান্ধব বাজেট, ভ্যাট হ্রাস এবং বাজারদর স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করাই যেন বাজেটের মূল লক্ষ্য হয়। তবে অনেকেই কোনো প্রত্যাশা করেননি সংশয় বা নিরাশার কারণে।
গবেষণায় বলা হয়েছে, নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর ভ্যাট দরিদ্রদের ওপর অসামঞ্জস্যভাবে চাপ সৃষ্টি করছে এবং তাদের সাশ্রয়ী খাবার পাওয়ার সুযোগ আরও সীমিত করে তুলছে। সরকারের উচিত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যপণ্যের ওপর থেকে ভ্যাট বাতিল করা অথবা সর্বোচ্চ ৫ শতাংশের মধ্যে সীমিত রাখা।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: খ দ যপণ য র শ ল ক কর র পর প ব কল প র ওপর প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
৬০ বছর বয়স হলেই পেনশনের জমার ৩০% টাকা তোলা যাবে
এখন থেকে পেনশন স্কিমে থাকা একজন চাঁদাদাতা ৬০ বছর বয়স হলেই জমাকৃত অর্থের ৩০ শতাংশ টাকা এককালীন তুলে নিতে পারবেন। এত দিন এককালীন টাকা তোলার সুযোগ ছিল না। আজ জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের পরিচালনা পর্ষদের দ্বিতীয় সভা অর্থ মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত হয়। ওই সভায় এই সিদ্ধান্ত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পেনশন পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা বলা হয়েছে।
এই সিদ্ধান্তের ফলে ৬০ বছর বয়স হলেই এই পেনশন স্কিমে চাঁদাদাতা ওই ব্যক্তি তাঁর জমা করা টাকার ৩০ শতাংশ তুলে নিতে পারবেন। নিয়ম অনুসারে বাকি সুবিধাও বজায় থাকবে।
জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের নির্বাহী চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘কেউ এককালীন ৩০ শতাংশ টাকা তুলে নিতে পারবেন। কেউ যদি এককালীন এই টাকা নিতে না চান, তবে মাসিক পেনশনের পরিমাণ সংগত কারণে বেশি হবে।’
আজকের সভায় যেসব সিদ্ধান্ত হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো এক, একজন চাঁদাদাতা পেনশনযোগ্য বয়সে উপনীত হওয়ার পর আগ্রহী হলে তাঁকে তাঁর মোট জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ এককালীন আর্থিক সুবিধা হিসেবে প্রদানের সুযোগ রাখা হবে। দুই, প্রবাস ও প্রগতি পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারী অনেকের মাসিক আয় তুলনামূলকভাবে অনেক কম হওয়ায় এ দুটি স্কিমে সর্বনিম্ন মাসিক চাঁদার হার দুই হাজার টাকার পরিবর্তে এক হাজার টাকা নির্ধারণ। এ ছাড়া প্রগতি পেনশন স্কিমে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে একটি অংশের মাসিক আয় বেসরকারি খাতের কর্মকর্তাদের গড় মাসিক আয়ের তুলনায় বেশি হওয়ায় মাসিক সর্বোচ্চ জমার পরিমাণ ১০ হাজার টাকার পরিবর্তে ১৫ হাজার টাকায় উন্নীত করা। তিন, আউটসোর্সিং প্রক্রিয়ায় সেবা চুক্তির আওতায় নিয়োজিত সেবাকর্মীদের প্রগতি পেনশন স্কিমে অন্তর্ভুক্ত করা। চার, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ ইন্টারন্যাশনাল সোশ্যাল সিকিউরিটি অ্যাসোসিয়েশনের (আইএসএসএ) সদস্যপদ গ্রহণের সিদ্ধান্ত। পাঁচ, সর্বজনীন পেনশন স্কিমের ইসলামিক ভার্সন চালুর বিষয়টি পরীক্ষা করে পরবর্তী সভায় উপস্থাপন করার সিদ্ধান্ত হয়।