রোহিঙ্গাদের সাগরে ফেলার অভিযোগ জাতিসংঘের র্যাপোর্টিয়ারের, আইনজীবীর আবেদন শুনলেন না ভারতের আদালত
Published: 17th, May 2025 GMT
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে বসবাসকারী ৪৩ জন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে জবরদস্তি মিয়ানমারের কাছে সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘের মানবাধিকার–সংক্রান্ত হাইকমিশনের অফিস (ওএইচসিএইচআর) ১৫ মে এক বিজ্ঞপ্তিতে এমন তথ্য জানিয়েছে। এ নিয়ে ভারতের সুপ্রিম কোর্টে একটি আবেদন করা হয়েছে।
তবে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট এই আবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন না। এ–সংক্রান্ত এক আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিস্ময় প্রকাশ করে ভারতের সর্বোচ্চ আদালত নানা প্রশ্ন উত্থাপন করে বলেছেন, আবেদন মেনে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দেওয়া সম্ভব নয়।
বিচারপতি সূর্যকান্ত ও বিচারপতি এন কোটিশ্বর সিং জরুরি শুনানির আবেদন নাকচ করে গতকাল শুক্রবার বলেছেন, সুপ্রিম কোর্টের যে বেঞ্চ রোহিঙ্গা–সংক্রান্ত মামলা শুনছে এবং যার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য হয়েছে ৩১ জুলাই, সেখানেই এই আবেদন করতে হবে।
বিচারপতি সুর্যকান্ত ও বিচারপতি এন কোটিশ্বর সিং বলেন, আবেদন ভাসা–ভাসা। তার সমর্থনে কোনো যুক্তিগ্রাহ্য তথ্য–প্রমাণও নেই। যে ধরনের অভিযোগ করা হয়েছে, তার সমর্থনে গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য–প্রমাণও দাখিল করা হয়নি। আবেদনকারীর উদ্দেশে বিচারপতিরা বলেন, দেশ যখন এক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখনই আপনারা এই ধরনের বিষয়ের অবতারণা করছেন।
রোহিঙ্গাদের জবরদস্তি বিতাড়ন এবং মাঝ সমুদ্রে তাঁদের নামিয়ে দেওয়ার অভিযোগে জরুরি ভিত্তিতে এই রিট আবেদন শোনার আরজি জানিয়েছিলেন প্রবীন মানবাধিকার আইনজীবী কলিন গনসালভেস। তিনি আদালতকে জানান, জাতিসংঘের মানবাধিকার দপ্তর বিষয়টি নিয়ে তদন্ত করছে।
জবাবে বিচারপতিরা বলেন, আবেদনে যেসব ফোনকলের কথা বলা হয়েছে, সেগুলো যাচাই করাই হয়নি। এর আগে এমন ঘটনাও আদালতের নজরে এসেছে যে ঝাড়খন্ডের জামতাড়া থেকে ফোন করা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার নম্বর ব্যবহার করে। এখানে কি যাচাই করা হয়েছে যে ওই সব ফোনকল মিয়ানমার থেকেই করা হয়েছে?
সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিরা আবেদনকারীর উদ্দেশে বলেন, অভিযোগগুলো স্রেফ অভিযোগ হয়েই রয়েছে। উপযুক্ত প্রমাণ ছাড়া এ ক্ষেত্রে আগের বৃহত্তর বেঞ্চের দেওয়া রায় নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি না। তাঁরা বলেন, উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে এই আবেদন চমৎকার ভাষায় রচিত এক গল্পগাথা ছাড়া আর কিছু নয়।
সলিসিটর জেনারেল ও অ্যাটর্নি জেনারেলকে এই আবেদনের কপি পেশের নির্দেশ দিয়ে ডিভিশন বেঞ্চ জানান, ৩১ জুলাই এই আবেদন তিন সদস্যের বৃহত্তর বেঞ্চে শোনা হবে।
ওএইচসিএইচআরের বিজ্ঞপ্তির উল্লেখ করে গতকাল শুক্রবার সুপ্রিম কোর্টে দাখিল করা এই আবেদনে বলা হয়, নয়াদিল্লিতে শরণার্থী হিসেবে বাস করা ৪৩ জন রোহিঙ্গাকে বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহের কথা বলে গত ৬ মে এক স্থানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তারপর ৮ মে তাঁদের আন্দামানে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে নৌবাহিনীর জাহাজে তাঁদের মিয়ানমারের আন্তর্জাতিক জলসীমানায় নিয়ে গিয়ে লাইফ জ্যাকেট পরিয়ে জবরদস্তি সমুদ্রে নামিয়ে দেওয়া হয়।
আবেদনে বলা হয়, এর আগে শরণার্থীদের জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁরা মিয়ানমার না ইন্দোনেশিয়া কোথায় যেতে চান। এই রোহিঙ্গারা জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর–এ নিবন্ধিত ছিলেন। তাঁরা ইন্দোনেশিয়ায় যেতে চাইলেও ১২ ঘণ্টা সমুদ্র সাঁতরে পাড়ে ওঠার পর তাঁরা বোঝেন, যে অঞ্চলে তাঁরা পৌঁছেছেন, তা মিয়ানমারের তানিনথারি এলাকা।
আবেদনে বলা হয়, ইউএনএইচসিআর ১৫ মে এই বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছিল। তারা বিষয়টি তদন্ত করছে। তা শুনে বিচারপতি সূর্যকান্ত সেই তদন্ত প্রতিবেদন পেশ করার নির্দেশ দিয়ে বলেন, এসব মানুষ দেশের বাইরে থেকে ভারতের সার্বভৌমত্ব চ্যালেঞ্জ করতে পারেন না।
আইনজীবী গনসালভেস রোহিঙ্গা বিতাড়নে স্থগিতাদেশ চেয়ে অন্তর্বর্তী নির্দেশ দিতে অনুরোধ করলে ডিভিশন বেঞ্চ তা অস্বীকার করেন। ভারত সরকার ১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশন বা ১৯৬৭ সালের প্রটোকল সই করেনি।
ওএইচসিএইচআরের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত সপ্তাহে ভারতীয় নৌবাহিনীর একটি জাহাজ থেকে আন্দামান সাগরে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নামিয়ে দেওয়ার বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন সামনে আসার পর জাতিসংঘের একজন বিশেষজ্ঞ এ ঘটনাকে ‘অমানবিক ও অগ্রহণযোগ্য’ উল্লেখ করে তদন্ত শুরু করেছেন। একই সঙ্গে তিনি ভারত সরকারকে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের প্রতি নিষ্ঠুর ও প্রাণঘাতী আচরণ থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন, বিশেষ করে তাদের মিয়ানমারের বিপজ্জনক অবস্থায় ফেরত পাঠানোর বিষয়ে।
মিয়ানমারের মানবাধিকার পরিস্থিতিবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোটিয়ার টম অ্যান্ড্রুজ বলেন, ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নৌবাহিনীর জাহাজ থেকে সমুদ্রে ফেলে দেওয়া হয়েছে-এই ধারণা একেবারেই ভয়াবহ ও অগ্রহণযোগ্য। আমি এসব ঘটনার বিষয়ে আরও তথ্য ও সাক্ষ্য সংগ্রহ করছি এবং ভারত সরকারকে আহ্বান জানাচ্ছি, এসব ঘটনার পূর্ণ বিবরণ প্রকাশ করুন।’
অ্যান্ড্রুজ বলেন, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের বিরুদ্ধে যেসব অমানবিক কাজ হয়েছে, ভারত সরকারকে অবশ্যই তাৎক্ষণিক ও স্পষ্টভাবে এর নিন্দা জানাতে হবে।
জাতিসংঘের বিশেষ র্যাপোর্টিয়ার আরও বলেন, ভারতকে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো পুরোপুরি বন্ধ করতে হবে এবং আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতার যেসব স্পষ্ট লঙ্ঘন ঘটেছে, তার জন্য দায়ী ব্যক্তিদের অবশ্যই জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে।
.উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: শরণ র থ দ র ব চ রপত তদন ত
এছাড়াও পড়ুন:
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিকের বিরুদ্ধে ৫০ কোটি ডলার ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ
ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক ও টেলিকম কর্মকর্তা বঙ্কিম ব্রহ্মভট্টের বিরুদ্ধে বড় ধরনের ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ উঠেছে। ওই জালিয়াতির তিনিই মূল পরিকল্পনাকারী বলে অভিযোগ করা হচ্ছে। এই কেলেঙ্কারির কারণে ব্ল্যাকরকের ঋণ শাখা এবং আরও কয়েকটি বৈশ্বিক বিনিয়োগকারী সংস্থার ৫০ কোটি কোটি ডলারের বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি করা হচ্ছে।
নিউইয়র্কভিত্তিক যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক বিশেষ প্রতিবেদনে এটিকে ‘বিস্ময়কর’ আর্থিক জালিয়াতির ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে।
কে এই বঙ্কিম ব্রহ্মভট্ট
ব্রহ্মভট্ট বৈশ্বিক টেলিকম-পরিষেবা শিল্পে অপেক্ষাকৃত অপরিচিত দুটি সংস্থা—ব্রডব্যান্ড টেলিকম ও ব্রিজভয়েসের সঙ্গে যুক্ত। দুটি সংস্থাই ব্যাঙ্কাই গ্রুপের অধীনে কাজ করে।
২০২৫ সালের জুলাই মাসে ব্যাঙ্কাই গ্রুপ এক্স (পূর্বের টুইটার)-এর একটি পোস্টে ব্রহ্মভট্টকে প্রেসিডেন্ট এবং সিইও হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
এক্সে দেওয়া ব্যাঙ্কাই গ্রুপের পরিচয় দেওয়া হয়েছে এভাবে—‘টেলিকমিউনিকেশন শিল্পে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নেতা, যারা টেলকো, অপারেটর এবং আরও অনেকের সঙ্গে টেলিকম প্রযুক্তি ও ক্যারিয়ার ব্যবসায়িক সৌহার্দ্যকে লালন করে।’
প্রতিষ্ঠানটির ওয়েবসাইট অনুসারে, ব্রহ্মভট্টের প্রতিষ্ঠান সারা বিশ্বের টেলিকম অপারেটরদের অবকাঠামো ও সংযোগের সরঞ্জাম সরবরাহ করে।
মনে হচ্ছে, ব্রহ্মভট্টের লিঙ্কডইন প্রোফাইলটি সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, কয়েক মাস আগেও ব্রহ্মভট্ট নিউইয়র্কের গার্ডেন সিটিতে অফিস চালাতেন।
জালিয়াতির ধরন
দ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫ সালের আগস্টে যুক্তরাষ্ট্রে করা মামলায় দাবি করা হয়েছে, ব্রহ্মভট্টের প্রতিষ্ঠানগুলোর ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ বকেয়া রয়েছে। ব্ল্যাকরকের এইচপিএস ইনভেস্টমেন্ট পার্টনার্সের নেতৃত্বে ঋণদাতারা তাঁর বিরুদ্ধে ভুয়া চালান ও ভুয়া পাওনা অ্যাকাউন্ট তৈরি করার অভিযোগ এনেছেন। বড় অঙ্কের ঋণের জন্য জামানত হিসেবে ওইসব অ্যাকাউন্ট বানানো হয়েছিল।
মামলায় অভিযোগ করা হয়েছে, ব্রহ্মভট্টের প্রতিষ্ঠানগুলোর তহবিল যখন ভারত ও মরিশাসে স্থানান্তর করা হয়েছিল, তখন তাদের নেটওয়ার্ক কাগজে-কলমে আর্থিক শক্তির একটি মায়াজাল তৈরি করা হয়েছিল।
তবে ব্রহ্মভট্টের আইনজীবী এই জালিয়াতির সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।
ঋণদাতারা দাবি করেছেন, ব্রহ্মভট্ট কারিওক্স ক্যাপিটাল ও বিবি ক্যাপিটাল এসপিভির মতো আর্থিক সংস্থার এক জটিল নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন, যা ব্ল্যাকরকের মতো কয়েকটি বেসরকারি ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে কোটি কোটি ডলার ঋণ নিয়েছিল।
মামলার অভিযোগ অনুযায়ী, ব্রহ্মভট্ট ভুয়া গ্রাহক চালান তৈরি করেন এবং সেই জাল কাগজপত্র দিয়ে জামানত তৈরি করে তার বিপরীতে ৫০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছেন। অভিযোগে আরও বলা হয়েছে, পরে তিনি ভারত ও মরিশাসে সম্পদ স্থানান্তর করেন। এখন তাঁর দুটি কোম্পানি এবং ব্রহ্মভট্ট নিজে দেউলিয়া হওয়ার আবেদন করেছেন।
গুরুতর অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও ব্রহ্মভট্টের আইনজীবী কোনো ধরনের অনিয়মের অভিযোগ অস্বীকার করে বলছেন, জালিয়াতির সব অভিযোগ ভিত্তিহীন।