‘একসময় সব ছিল, বাপের বাড়ি, স্বামীর বাড়ি। কোথাও কোনো অভাব দেখিনি। অবস্থা ভালো হওয়ায় কাজকর্ম করার কথা কল্পনাতেও আসত না। অল্প জমি আর স্বামীর আয়-রোজগারে আরাম-আয়েশে সংসার চলছিল।’ কথাগুলো বলতে বলতে দু’হাতে শাড়ির আঁচল উঠিয়ে মুখ ঢাকার চেষ্টা করলেন শাহানাজ বেগম। এ সময় আলতো ছোঁয়ায় দু’চোখের কোনা মুছে স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করলেন ৪০ বছর বয়সী এ নারী। 

শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের দক্ষিণ কদমতলায় বাড়ি দুই সন্তানের মা শাহানাজের। নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে আবার বলতে শুরু করেন, ২০০৭-০৮ সাল থেকে তাদের অবস্থা খারাপ হতে শুরু করে। দু’দফা দুর্ঘটনায় স্বামী মোতালেব হোসেনের বাক্সের সব মৌমাছি মারা গেলে ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিছুদিনের মধ্যে প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় আইলা তাদের মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয়নি। দুই সন্তানের এ মায়ের ভাষ্য, সামান্য কিছু জমি থাকলেও আইলার প্রভাবে দীর্ঘ সময় অনাবাদি ছিল। একই সময়ে এলাকায় কর্মসংস্থানের সংকট শুরু হয়। 
অব্যাহত নদীভাঙন তাদের জন্য ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দেখা দেয়। সংসার চালানোর তাগিদে জাল-দোড়া নিয়ে স্বামীর সঙ্গে নদীতে মাছ ধরতে নামেন। এরপর স্বামী অসুস্থ হয়ে পড়লে কয়েক বছর ধরে অনেকটা একাই সংসারের ঘানি টেনে চলেছেন। তাঁর ভাষ্য, একসময় আয়েশি জীবন কাটালেও এখন অন্যদের সঙ্গে পাশের মালঞ্চ নদী ও সুন্দরবনে মাছ-কাঁকড়া ধরে সংসার চালান। অসুস্থ হয়েও তাঁর স্বামী নামমাত্র মজুরিতে অন্যের মৌ-খামারে কাজ নিয়েছেন। 

উচ্চ মাধ্যমিক ও ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ুয়া দুই মেয়ে এ দম্পতির। তাদের ঘিরেই এখন সব স্বপ্ন আবর্তিত হয় বাবা-মায়ের। মোতালেব হোসেনের ভাষ্য, মাধ্যমিকের গণ্ডি পেরোতেই বিয়ের কারণে পড়ালেখা করা হয়নি শাহানাজের। সে অনুশোচনা থেকেই হয়তোবা নিজে কঠোর পরিশ্রম করে দুই মেয়েকে শিক্ষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। গৃহস্থালির কাজ, রান্নাবান্না, পানি টানার পাশাপাশি মাছ-কাঁকড়া শিকার করে সংসারের খরচ জুগিয়ে চলেছে। অনেক কিছু খুইয়েও দুই সন্তানকে মানুষ হিসেবে গড়ে তুলে ‘সুখ’ খুঁজে পেতে চাইছেন।
পাশের নদী ও বনের সঙ্গে সখ্য গড়ে উঠেছে শাহানাজ বেগমের। তিনি বলছিলেন, ‘প্রকৃতি আমাগো পথে বসিয়েছে। বারবার ভাঙন আর ভাগ্যের পরিহাসে সর্বস্ব হারিয়ে নদীর চর এখন ঠিকানা।’ দুই মেয়েকে শিক্ষিত করে অথই সাগরে তিনি ‘নুড়ি খোঁজা’র চেষ্টা করছেন বলে উল্লেখ করেন।

একাধিকবারের ভাঙনে বাড়িঘর ও জায়গাজমি হারিয়ে বাধ্য হয়ে নদীর পারে সরকারি জমিতে ঘর তৈরি করে বসবাস করছেন মোতালেব। স্বামী-স্ত্রী মিলে প্রায় ৪ লাখ টাকা ‘বরসা’ নামে আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রেখে প্রতারণার শিকার হয়েছেন। নিজে অসুস্থ হওয়ায় শাহানাজ চার সদস্যের সংসার চালানোর দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নিয়েছে বলে জানান তিনি।
স্থানীয় মুন্সিগঞ্জ ইউপির প্যানেল চেয়ারম্যান সিরাজুল ইসলামের ভাষ্য, প্রায় এক যুগ ধরে শাহানাজ বেগম সুন্দরবনের নদনদীতে মাছ-কাঁকড়া শিকারে যুক্ত। দুই নারী সহকর্মীর পাশাপাশি পুরুষদের সঙ্গেও শিকারে যান তিনি। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করে তিনি এলাকায় দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
সন্তানদের শিক্ষিত করার জন্য একজন মা কতটা গুরুত্বপূর্ণ, তার উদাহরণ শাহানাজ। এমন মন্তব্য করে উপজেলা নির্বাহী কর্ককর্তা (ইউএনও) রনী খাতুন বলেন, প্রতিকূলতাকে ছাপিয়ে তিনি যেভাবে সামনে এগিয়ে এসেছেন, তা প্রশংসার দাবি রাখে। প্রকৃতির সঙ্গে তাঁর অসম যুদ্ধ সবার জন্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
 

.

উৎস: Samakal

এছাড়াও পড়ুন:

সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’

পূর্ব সুন্দরবনের নিসর্গঘেরা অভয়ারণ্যে গড়ে তোলা হয়েছে নতুন পর্যটন কেন্দ্র ‘আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার’। সবুজ ম্যানগ্রোভ বনের বুক চিরে, নদীর নোনাজলে ভেসে, প্রকৃতির নীরব সৌন্দর্যে ঘেরা এই কেন্দ্রটি চলতি নভেম্বর মাস থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ভ্রমণ করতে পারবেন পর্যটকরা।

পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জের আওতাধীন আলী বান্দা এরইমধ্যে ভ্রমণপিপাসুদের দৃষ্টি কেড়েছে। শরণখোলা রেঞ্জ অফিস থেকে ট্রলারযোগে মাত্র ৪০ মিনিটের নৌপথ পেরিয়ে পৌঁছানো যায় সেখানে। 

যাত্রাপথে চোখে পড়ে বনের গভীর সবুজ গাছগাছালি, ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাওয়া পাখি, কচুরিপানায় ঢাকা জলাশয় এবং সুন্দরী-গেওয়া গাছের সারি যা পর্যটকদের মোহিত করে।

বন বিভাগ জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টারের অবকাঠামো নির্মাণকাজ শুরু হয়। এখানে তৈরি হয়েছে ছয়তলা ভবনের সমান উচ্চতার একটি ওয়াচ টাওয়ার, যেখান থেকে সুন্দরবনের বিস্তৃত সবুজাভ দৃশ্য চোখে ধরা পড়ে। 

রয়েছে দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ ফুট ট্রেইল (ওয়াকওয়ে)। পথের দুই পাশে ঘন বনের মাঝে হাঁটলে দেখা যায় প্রকৃতির আসল রূপ। এছাড়া রয়েছে মিষ্টি পানির পুকুর, হরিণ রাখার সেড, জেটি, বিশ্রামাগার, সুভেনিয়ার শপ এবং পর্যটকদের নিরাপত্তায় বনরক্ষী ও স্থানীয় গাইডের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান।

ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে আলীবান্দা বরিশাল বিভাগের জেলাগুলোর মানুষের জন্য সবচেয়ে সহজগম্য স্পট হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কম সময় ও কম ঝুঁকিতে সুন্দরবনের সৌন্দর্য উপভোগ করা যাবে এখানে। স্থানীয় পর্যটকরা এরইমধ্যে আগ্রহ দেখাতে শুরু করেছে।

স্থানীয় বাসিন্দা শাহিন বলেন, “আলীবান্দা ইকো-ট্যুরিজম সেন্টার চালু হলে স্থানীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এতে স্থানীয় গাইড, নৌযানচালক, হোটেল ব্যবসায়ী ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের কর্মসংস্থান বাড়বে। পাশাপাশি পরিবেশবান্ধব পর্যটনের মাধ্যমে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সচেতনতা বাড়বে।”

তবে পর্যটনকেন্দ্রে প্রবেশ ফি নিয়ে অসন্তোষ রয়েছে। আলীবান্দায় প্রবেশের ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৪৫ টাকা।

শরণখোলা ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক রাসেল বয়াতী বলেন, ‘‘আলীবান্দায় প্রবেশ ফি ৩৪৫ টাকা, অথচ একই বনের করমজল পর্যটন পয়েন্টে ফি মাত্র ৪৬ টাকা। অনেকেই আলীবান্দায় যেতে আগ্রহী, কিন্তু ফি বেশি হওয়ায় নিরুৎসাহিত হচ্ছেন।’’

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, “আলীবান্দা এখন প্রায় প্রস্তুত। চলতি মাসেই এখানে হরিণ আনা হবে। বর্তমানে পর্যটকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে স্পটটি। যেহেতু এটি ২০১৭ সালে ঘোষণা করা অভয়ারণ্য এলাকার অন্তর্ভুক্ত, তাই সাধারণ বনাঞ্চলের তুলনায় কিছু বিধিনিষেধ ও প্রবেশ ফি বেশি রাখা হয়েছে। তবে পর্যটকদের দাবির বিষয়টি আমরা সরকারের কাছে জানাব।’’

ঢাকা/শহিদুল/এস

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • একসময় ছিলেন রিয়াল মাদ্রিদের ভবিষ্যৎ তারকা, এখন ক্লাব খুঁজে বেড়াচ্ছেন
  • সুন্দরবনের নতুন পর্যটন স্পট ‘আলী বান্দা’
  • ভাসমান পথশিশুদের নিয়ে এলইইডিও-র অন্যরকম আয়োজন
  • সুন্দরবনের বড় গেছো প্যাঁচা