দেশের যাবতীয় সংকট দূর করতে নির্বাচিত সরকার দরকার: আসাদুজ্জামান রিপন
Published: 14th, January 2025 GMT
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রিপন বলেছেন, ‘বাংলাদেশ নির্বাচনকেন্দ্রিক একটি সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক স্বাভাবিক হতে পারছে না। ভারতের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা নানা ধরনের অসহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব দেখতে পাচ্ছি। শুধু ভারত ইস্যুই নয়, জাতীয় নিরাপত্তা থেকে শুরু করে দেশের যাবতীয় সংকট দূর করতে একটি নির্বাচিত সরকার দরকার।’
আজ মঙ্গলবার দুপুরে মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ এলাকায় শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে আসাদুজ্জামান এ কথা বলেন।
কম্বল বিতরণ অনুষ্ঠানে লৌহজং উপজেলা কৃষক দলের সভাপতি শাহজাহান ব্যাপারীর সভাপতিত্বে ও উপজেলা যুবদলের সদস্য আলামিন দেওয়ানের সঞ্চালনায় উপস্থিত ছিলেন উপজেলা বিএনপির সদস্য মোশাররফ হোসেন ও জেলা যুবদলের যুগ্ম সম্পাদক আতাউর রহমান খান।
আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘সরকার গঠন করার জন্য যত দ্রুত সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দরকার। সেটি অবশ্যই এ বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই সম্পন্ন করতে হবে। আমরা আগেই বলেছি, ২০২৫ সালের মধ্যে আমরা নির্বাচন চাই। এটি দেশের জন্য ভালো, জনগণের জন্য ভালো, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের জন্য ভালো। আর নির্বাচন করার জন্য একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন করারও প্রয়োজন হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানও ড.
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে ভারতের সেনাপ্রধানের বক্তব্য প্রসঙ্গে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ভারতের সেনাপ্রধান বলেছেন, বাংলাদেশে নির্বাচিত সরকার এলে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা হবে। ভারত গত ১৫ বছর কোন নির্বাচিত সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করছে? বাংলাদেশে তো গত ১৫ বছর কোনো নির্বাচিত সরকার ছিল না। শেখ হাসিনা বাংলাদেশে কখনো নির্বাচিত সরকার ছিল না।
বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান বলেন, ‘তারা (ভারত) নির্বাচিত সরকার বলতে যদি শেখ হাসিনার সরকারকে বুঝিয়ে থাকে, তাহলে বলতে চাই, হাসিনা ভোট ডাকাতির সরকার ছিলেন। তিনি (শেখ হাসিনা) দিনের ভোট রাতে দিয়ে প্রতারণার মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেছিলেন। আমি ভারতের কাছে প্রশ্ন রাখতে চাই, ভারত কি অনির্বাচিত সরকার এবং জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করে ক্ষমতার দখল করেছিল, সেই ধরনের সরকারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী কি না। যদি এমনটা হয়, তাহলে তাদের আমরা জানিয়ে দিতে চাই, হাসিনা এ দেশে আর আসবেন না। ভারতকে বাংলাদেশের জনগণের সরকারের সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে হবে। বর্তমানে অধ্যাপক ইউনূসের নেতৃত্বে যে সরকারটি আছে, সেটি নির্বাচিত সরকার না হলেও এটা আপামর জনগণের সমর্থিত সরকার। সুতরাং ভারতে এ সরকারের সঙ্গেই দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করতে হবে।’
শ্রীনগরে থানা থেকে আসামি ছিনিয়ে নেওয়া প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, তারেক রহমানের নির্দেশ—দলের দুর্নাম হয়, দলের গঠনতন্ত্র ও আইনবিরোধী কাজ যে–ই করুক, তার বিরুদ্ধে দলীয় ও আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। দলের নেতা বা কর্মী হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হবে না। শ্রীনগরের ঘটনার সঙ্গে জড়িত মূল দায়ী যুবদল নেতা তরিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া সেদিন যাঁরা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
পুলিশের উদ্দেশে আসাদুজ্জামান রিপন বলেন, ‘পুলিশকে আমরা বাংলাদেশের জনগণের পুলিশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। পুলিশের মনোবল যেন ভেঙে না পড়ে, আমাদের দল নিঃসন্দেহে পুলিশের পাশে আছে। জনগণ তাদের পাশে আছে।’
উৎস: Prothomalo
এছাড়াও পড়ুন:
ভোটের আমেজ থেকে দূর হোক শোডাউনের সংস্কৃতি
দেশে এখন দুটি বাস্তবতা বিরাজ করছে। একদিকে রয়েছে কার্যক্রম নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের কর্মসূচি কেন্দ্র করে জ্বালাও-পোড়াও আতঙ্ক, অন্যদিকে আছে আসন্ন জাতীয় নির্বাচন কেন্দ্র করে মানুষের উৎসাহ ও উদ্দীপনা।
তবে এ দুই বাস্তবতার ভেতর নির্বাচন নিয়ে জনমনে উৎসবের পাল্লাটা ভারী। বেশ বড় ব্যবধানে ভারী। কারণ, গত বছর জুলাই–আগস্টে ক্ষমতাসীনদের রেখে যাওয়া ক্ষত এ দেশের বুকে এখনো দগদগে তাজা। নতুন করে কোনো নাশকতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আগ্রহ জনগণের নেই। বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিচার কেন্দ্র করে তো নয়ই।
এ ছাড়া বহু বছরের ডামি নির্বাচন আর ‘রাতের ভোটের’ অধ্যায় পেরিয়ে বাংলাদেশ এবার সত্যিই একটা বহুদলীয় নির্বাচনের সন্ধিক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছে। বিচার, সংস্কার ও জুলাই সনদ বাস্তবায়ন ঘিরে নির্বাচন নিয়ে অনেক ‘যদি কিন্তু’ ছিল। তবে সে ধোঁয়াশা কেটেছে। ১৩ নভেম্বর প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণার মধ্য দিয়ে অবসান হয়েছে সব ‘যদি’ আর ‘কিন্তু’র।
ইতিমধ্যে নির্বাচনী আসনগুলোয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে দেশের বড় দলগুলো। নতুন দলগুলোও বিতরণ শুরু করেছে মনোনয়নপত্র। সবাই উঠে পড়েছে নির্বাচনের ট্রেনে। আশা করি, এই ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে পড়বে না।
নির্বাচন কেন্দ্র করে জনমনে উচ্ছ্বাস যেমন আছে, তেমনি প্রার্থীদের শোডাউনের সংস্কৃতি নিয়ে আছে কিছু অস্বস্তিও। এ দেশে নির্বাচনী প্রার্থীদের ভেতর শোডাউনের সংস্কৃতি কেন টিকে আছে, তা অনুমান করা যায়। নির্বাচনের আগে ভোটার ও প্রতিপক্ষকে শক্তি ও সক্ষমতা জানান দেওয়ার এ এক সহজ কৌশল। এ ছাড়া গত ১৬ বছরে ওই অর্থে প্রকাশ্যে কার্যক্রমই চালাতে পারেনি বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। তাই হয়তো শোডাউনের জৌলুশটাও এবার বেশি।
কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় তখনই, যখন এই জৌলুশের জোশে প্রার্থী ও তাঁদের সমর্থকেরা নির্বাচনী আচরণবিধি থেকে শুরু করে কাণ্ডজ্ঞানও ভুলতে বসেন। নির্বাচনী আমেজে সারা দেশে চলছে নানা দলের হাজারো সভা-সেমিনার। প্রায়ই দেখা যাচ্ছে জনগণের চলাচলের পথ অবরুদ্ধ করে চালানো হচ্ছে এসব সভা।
ট্র্যাফিক আইন অমান্য করে হেলমেট ছাড়া মোটরসাইকেলের ধীরগতির বহর নিয়ে সড়কগুলোকে করা হচ্ছে একপ্রকার অবরুদ্ধ। জিম্মি করা হচ্ছে এ দেশের প্রকৃত মালিক, এ দেশের আপামর জনগণকে, যা কেবল কাণ্ডজ্ঞানই নয়, নির্বাচনী আচরণবিধিরও বিরোধী।
আরও পড়ুনশোডাউন আর গাড়িবহরের রাজনীতিই কি চলবে২৫ মার্চ ২০২৫সর্বশেষ ২০২৩ সালের অক্টোবরে সংশোধিত জাতীয় সংসদ নির্বাচন আচরণ বিধিমালার ৬ অনুচ্ছেদের (ঘ) ধারায় স্পষ্ট উল্লেখ আছে, প্রার্থীরা ‘জনগণের চলাচলের বিঘ্ন সৃষ্টি করিতে পারে, এমন কোনো সড়কে জনসভা কিংবা পথসভা করিতে পারিবে না এবং তাহাদের পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তিও অনুরূপভাবে জনসভা বা পথসভা ইত্যাদি করিতে পারিবে না’।
বিধিমালার ১০ অনুচ্ছেদের (ক) ধারায় উল্লেখ রয়েছে, প্রার্থীরা ‘নির্বাচনী প্রচারণায় কোনো গেইট বা তোরণ নির্মাণ করিতে পারিবেন না কিংবা চলাচলের পথে কোনো প্রকার প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করিতে পারিবেন না’।
গণ-অভ্যুত্থানের পর জনমনে এক আশার সঞ্চার হয়েছিল। বিশেষ করে শ্রমজীবী ও তরুণ প্রজন্ম আশা করেছিল, রাজনৈতিক শক্তিগুলো ‘গায়ের জোর’ দেখানোর সংস্কৃতি থেকে অন্তত বের হয়ে আসবে। এর আগের ১৫ বছরে ক্ষমতাসীনদের নানা আয়োজনে যথেষ্ট ‘গায়ের জোর’ সহ্য করেছে তারা। সারা রাত বাধ্য হয়ে ভাষণ শোনা থেকে শুরু করে অপ্রাসঙ্গিক একেকটা ‘দলীয় দিবসে’ জনতা জিম্মি ছিল ক্ষমতাসীনদের শোডাউনের কাছে। তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলটা জনবিচ্ছিন্ন দলে পরিণত হওয়ার পেছনে ওই সব কর্মসূচির ভূমিকা কম ছিল না। দলটির পতন হয়েছে গণ-অভ্যুত্থানে। জনগণ আশা করেছিল, দলোগুলোর ক্ষমতা প্রদর্শনের খেলায় বাধ্য দর্শকের ভূমিকায় তাদের আর থাকতে হবে না।
আমরা কি এমন জনপ্রতিনিধি চাই, যাঁরা কেবল নিয়ম রক্ষার্থে মৌসুমি আইনের অনুগত? নাকি আমরা চাইব এমন জনপ্রতিনিধি, যাঁরা যেকোনো বাস্তবতাতেই জনমানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল? নয়তো আমরা এই নিশ্চয়তা কীভাবে পাব যে এই প্রার্থীরা আইনপ্রণেতা হয়ে খোদ আইনের তোয়াক্কা করাই বন্ধ করে দেবেন না? এ নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না।কিন্তু বাস্তবতা কি তা বলে? বলে না। রোজই দেশের কোথাও না কোথাও রোগীবাহী অ্যাম্বুলেন্স থেকে শুরু করে জরুরি সেবায় নিয়োজিত বহু মানুষ প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে। প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে স্কুলফেরত শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক নাগরিকেরা। যানজটের জন্য এমনিতেই দেশের প্রধান শহরগুলো দুনিয়াতে কুখ্যাত; এর ওপর যখন যুক্ত হয় শোডাউনের বাড়তি জট, তখন সীমিত পরিমাণে হলেও এর সরাসরি প্রভাব পড়ে জাতীয় অর্থনীতিতে। জনগণের জন্য যা কাটা ঘায়ে নুনের ছিটার চেয়ে কম কিছু নয়।
অনেকে বলতে পারেন, বিধিমালা তো নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে কার্যকর হয়। এর আগে বিধিমালা মানার তো কোনো দায় নেই। হ্যাঁ, সেটাই সত্যি।
আরও পড়ুনরাজনীতিবিদদের আচরণ কি পাল্টেছে১০ জানুয়ারি ২০২৫কিন্তু আমরা কি এমন জনপ্রতিনিধি চাই, যাঁরা কেবল নিয়ম রক্ষার্থে মৌসুমি আইনের অনুগত? নাকি আমরা চাইব এমন জনপ্রতিনিধি, যাঁরা যেকোনো বাস্তবতাতেই জনমানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল? নয়তো আমরা এই নিশ্চয়তা কীভাবে পাব যে এই প্রার্থীরা আইনপ্রণেতা হয়ে খোদ আইনের তোয়াক্কা করাই বন্ধ করে দেবেন না? এ নিশ্চয়তা কেউই দিতে পারে না।
তবে প্রার্থীরা অন্তত আমাদের আশ্বস্ত করতে পারেন, জনগণকে ভোগানোর যেকোনো আয়োজন থেকে তাঁরা বিরত থাকবেন। আশ্বস্ত করার সবচেয়ে সহজ উপায় হতে পারে জনগণের প্রতি এখন থেকেই সহানুভূতিশীল থাকা, নির্বাচনের আচরণ বিধিমালা মেনে চলা, নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার আগেই। জনগণ একটু শান্তিতে থাকলে কারও যেহেতু ক্ষতি নেই।
• সৈকত আমীন প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক
* মতামত লেখকের নিজস্ব