ঢাবি শিক্ষার্থী সাম্য হত্যা: কিছু প্রশ্ন ও প্রস্তাব
Published: 16th, May 2025 GMT
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়-সংলগ্ন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে মঙ্গলবার মধ্যরাতে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে নির্মমভাবে নিহত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের স্নাতকোত্তর শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য। সাম্য নামেই তাকে ডাকা হতো। ‘সাম্য’ শব্দের আভিধানিক অর্থ সমতা। সম্ভবত নিজের নামের সেই অর্থকে ধারণ করেই সাম্য ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্রদের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছে। জীবিত থাকলে হয়তো সাম্য হতে পারত দুর্দিনের রাজনীতিতে অনুসরণযোগ্য এক নেতা। হতে পারত একজন গুণী শিক্ষক কিংবা নিবেদিত সমাজকর্মী। কিন্তু আজ সে আরেক দুর্ভাগা তরুণ, যে অকার্যকর ও বিকৃত সিস্টেমের বলি। আবু বকর, আবরার কিংবা আরও অনেকের মতো সেও নাম লেখাল একটি বেদনাদায়ক তালিকায়। আজ সাম্য কেবলই ব্যথাতুর স্মৃতি।
অনেকে ইতোমধ্যে এ হত্যাকাণ্ডকে দুটি মোটরসাইকেলের মধ্যে সংঘর্ষজনিত একটি দুর্ঘটনা হিসেবে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু বিষয়টি কি এতটাই সরল? আমাদের অবশ্যই খুঁজে বের করতে হবে এ ঘটনার অন্তর্নিহিত ও গভীরতর কারণগুলো। দেখতে হবে সেই অদৃশ্য প্রেক্ষাপট, যা অনেক সময় চোখের আড়ালে থাকে। যেমনটি হয়ে থাকে একাডেমিক গবেষণার ক্ষেত্রে: জানা থেকে অজানার উদ্দেশ্যে অভিযাত্রার নামই গবেষণা। হয়তো সাম্যের প্রতিবাদী মনোভাব ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সোচ্চার অবস্থান কেউ কেউ তাদের ব্যক্তি বা গোষ্ঠীগত স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবে বিবেচনা করেছিল। সেটাই হতে পারে তার এই অকালমৃত্যুর পেছনে মূল কারণ। সাম্যকে যারা চিনতেন, তারা অনেকেই জানিয়েছেন, সে প্রায়ই অন্যায় ও অসামাজিক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে সরব ছিল। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে চলমান কিছু বেআইনি ও অসামাজিক কার্যকলাপের বিরুদ্ধেও সোচ্চার অবস্থান নিয়েছিল সে।
আমাদের সবারই জানা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে প্রতিদিন সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত মাদক ব্যবসা ও সেবন চলে প্রায় অবাধে। এখানে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে ভবঘুরে, সব ধরনের মানুষ মাদক সেবনের উদ্দেশ্যে জড়ো হয়। গাঁজা থেকে শুরু করে প্যাথেডিনসহ নানা ধরনের মাদক সহজলভ্য এখানে। সাম্য এই চিত্রের বিরুদ্ধে একাধিকবার প্রতিবাদ করেছিল। প্রশ্ন ওঠে, সেই প্রতিবাদই কি তার জীবনের কাল হয়ে দাঁড়াল?
একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির ব্যক্তিস্বাধীনতা থাকা স্বাভাবিক। কিন্তু সেই স্বাধীনতার নামে সমাজে ব্যাধি ছড়ানো এবং আইন ভঙ্গ করার বৈধতা নেই। অনেকেই এসব অন্যায়কে উপেক্ষা করে চলে; কেউ কেউ প্রতিবাদ করে। সাম্য ছিল সেই ‘সংখ্যালঘু’ প্রতিবাদীদের একজন। বাংলাদেশের ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক-সাংস্কৃতিক বাস্তবতা এবং সরকারের মাদকবিরোধী আইন অনুযায়ী এসব কর্মকাণ্ড স্পষ্টতই অপরাধ। আর এসব অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া সব সময়ই চ্যালেঞ্জিং ও বিপজ্জনক। বিশেষ করে যখন তার পেছনে থাকে প্রভাবশালী চক্র বা সিন্ডিকেট। সাম্যের এই প্রতিবাদী অবস্থান এবং তার পরিণতি আমাদের ভাবাচ্ছে। আমরা কোন সমাজে বাস করছি? ঠিক যেমন ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতের অন্ধকারে কক্সবাজারের টেকনাফে মেরিন ড্রাইভ সড়কে গুলিবিদ্ধ হয়ে মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পেছনে মাদক সিন্ডিকেটের জড়িত থাকার বিষয়টি অনেকেরই অনুমান।
হয়তো একজন সচেতন ছাত্র হিসেবে সাম্য চাইত না তার কোনো বন্ধু বা সহপাঠী এসব অবৈধ ও অন্যায় পথে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাক। তার প্রতিবাদ, তার সততা চর্চা হয়তো কারও কাছে ‘বিরক্তির’ হয়ে উঠেছিল; এমনটাই এখন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে। খেয়াল রাখতে হবে, সাম্যদের প্রতিবাদের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতির শিকার যারা ছিল, তারাই এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিনা? কেননা, মুহূর্তের মধ্যে ধারালো ছুরি কোথা থেকে এলো উদ্যানের অভ্যন্তরে? আঘাতের ধরনে পেশাদারিত্বের লক্ষণ আছে কি? সময় এসেছে এ রকম প্রশ্নের পেশাদার উত্তর খোঁজা। থাকতে হবে সরকার ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে নিরপেক্ষ। উভয়কে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়ে হত্যার প্রকৃত কারণ, অপরাধী এবং দায়ী গোষ্ঠীকে চিহ্নিত করে চূড়ান্ত শাস্তির নিশ্চয়তাই হবে সাম্য হত্যার বিচারিক ‘সাম্য’ নিশ্চিতকরণ। তা না হলে সাম্যের আত্মার প্রতি হবে চরম অবিচার। এমনকি সাম্যের মতো আরও অনেকের মৃত্যু কেবল সময়ের ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কেবল প্রাতিষ্ঠানিক শোক পালনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না। এ দায়িত্ব পালনের পরিসর আরও বিস্তৃত। ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি সাধারণ শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রতিবাদ এবং বিচারের দাবিতে সক্রিয় ও সজাগ থাকা জরুরি। এই মুহূর্তে আমাদের সবার লক্ষ্য একটাই হওয়া উচিত– সুষ্ঠু তদন্ত; তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ নয় এবং নির্দোষ ব্যক্তিকে হয়রানি না করা। প্রকৃত হত্যাকারীদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনাই হবে সাম্যের আত্মার প্রতি সুবিচার। নিকট অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের মনে রাখতে হবে, বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে কেউই নিরাপদ নয়।
যদি এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে কোনো পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র থাকে, সেটিও জনসমক্ষে উন্মোচন করা গণদাবির অংশ হতে হবে। সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সার্বিক পরিবেশ শিক্ষার উপযোগী, মাদকমুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও নিরাপদ রাখতে হবে। সময়ের প্রেক্ষাপটে এটি আমাদের সবার দাবি হওয়া উচিত। কারণ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বর্তমান দুরবস্থা ও নিরাপত্তাহীনতার নিরসন না করে ‘নিরাপদ ক্যাম্পাস’-এর দাবি করা হবে এক ধরনের নির্মম পরিহাস ও তামাশা। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে সত্যিকার অর্থে ‘সবার উদ্যান’ হিসেবে রূপান্তরে বড় কোনো পদক্ষেপের প্রয়োজন নেই। পাশের রমনা পার্কের সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনা হতে পারে অনুকরণযোগ্য মডেল।
ড.
সিনেটর, রিভারাইন পিপল, বাংলাদেশ
sazzadhsiddiqui@du.ac.bd
উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: সমক ল ন প রসঙ গ হত য ক আম দ র অন য য়
এছাড়াও পড়ুন:
বান্দরবানে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জিপ পাহাড়ি খাদে, নিহত ১
বান্দরবানের আলীকদম উপজেলায় জিপ (চাঁদের গাড়ি) নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে প্রায় ৫০ ফুট নিচে পাহাড়ি খাদে পড়ে থংয়া ম্রো (২৫) নামে এক যুবক নিহত হয়েছে। এ দুর্ঘটনায় আরও ২০ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে নারী-পুরুষ ও শিশুও রয়েছে।
শুক্রবার (১৬ মে) বেলা ১১টার দিকে উপজেলার কলারঝিরি এলাকার জমিরাম পাড়া সংলগ্ন সড়কে এ দুর্ঘটনা ঘটে।
স্থানীয়রা জানান, সকালে আলীকদম-থানচি সড়কের ২৬ কিলোমিটার এলাকার মাংগু পাড়ার বাসিন্দারা একটি বিয়ের দাওয়াতে যোগ দিতে জিপ (চাঁদের গাড়ি) করে আলীকদম কলারঝিরি যাচ্ছিলেন। গাড়িটিতে থাকা সবাই ম্রো সম্প্রদায়ের এবং একই পাড়ার বাসিন্দা। গন্তব্যে পৌঁছার আগে জমিরাম পাড়ার পাশে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জিপটি প্রায় ৫০ ফুট নিচে পাহাড়ি খাদে পড়ে যায়। এতে ঘটনাস্থলেই থংয়া ম্রো নামে এক যুবকের মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনায় নারী-পুরুষ ও শিশুসহ অন্তত ২০ জন আহত হন। আহতদের মধ্যে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
আলীকদম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মির্জা জহির উদ্দিন বলেন, “জিপটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৫০ ফুট পাহাড়ি খাদে পড়ে ঘটনাস্থলেই একজন মারা যান বলে জেনেছি। পুলিশ ও ফায়ার সার্ভিস সদস্যরা ঘটনাস্থলে গেছে। তারা আসলে ঘটনার বিস্তারিত জানা যাবে।”
ঢাকা/চাই মং/টিপু