চোখ ভেজানো বিদায়: রাজীবের অন্তিম সংলাপ
Published: 17th, May 2025 GMT
গম্ভীর কণ্ঠস্বর, কপালের গাঢ় ভাঁজ, চোখে ভয়াল দৃষ্টি— এই তিন অস্ত্রে যখন পর্দায় হাজির হতেন, তখন পুরো সিনেমা হল নিস্তব্ধ হয়ে যেত। তিনি ওয়াসীমুল বারী রাজীব। ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অনেক খলনায়ক এসেছেন কিন্তু রাজীব ছিলেন অনন্য। শুধু পর্দায় নয়, দর্শকের মনে কেটেছেন স্থায়ী দাগ। তার প্রতিটি চরিত্র ছিল যেন সেলুলয়েডে খোদাই করা এক শিল্পকর্ম।
২০০৪ সাল। ক্যানসারে আক্রান্ত রাজীব তখন ঢাকার একটি হাসপাতালে শয্যাশায়ী। এক জীবনের অভিনয় শেষে তখন যেন জীবনের শেষ দৃশ্যের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অনেক সহকর্মী দেখতে গিয়েছিলেন তাকে, কিন্তু কেউ জানতেন না— এটাই হয়তো রাজীবের সঙ্গে শেষ দেখা।
সম্প্রতি ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে ধরা পড়ে তার অন্তিম সময়ের হৃদয়স্পর্শী মুহূর্ত। ভিডিওতে দেখা যায় রাজীব চোখের জল মুছতে মুছতে বলছেন, ‘‘আমি দীর্ঘদিন চলচ্চিত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কাজের সময় আপনাদের সঙ্গে খারাপ আচরণ করে থাকলে, কেউ যদি আঘাত পেয়ে থাকেন তাহলে আমাকে মাফ করে দেবেন। আমার জন্য সবাই আল্লাহর কাছে দোয়া করবেন, যাতে আমি শান্তিতে থাকতে পারি।”
এই কথাগুলো ছিল শুধু ক্ষমা চাওয়ার নয়, ছিল একজন শিল্পীর আত্মিক উপলব্ধির প্রকাশ। যিনি পর্দায় ছিলেন নির্মম খলচরিত্র, তিনি বাস্তব জীবনে ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। মৃত্যুর প্রাক্কালে সেই মানুষটি সব অহংকার, দম্ভ ঝেড়ে শুধু একজন অনুতপ্ত মানুষ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন সহকর্মীদের সামনে।
ভিডিওতে দেখা যায়, জনপ্রিয় অভিনেতা ইলিয়াস কাঞ্চন রাজীবের চোখের জল মুছে দিচ্ছেন। এটি এক মানবিক মুহূর্ত, যা শুধু সম্পর্ক নয়, শিল্পীর প্রতি শ্রদ্ধারও প্রতীক।
রাজীব আজ আর আমাদের মাঝে নেই। তবু যখন পুরোনো সিনেমাগুলোতে তার মুখ দেখা যায়, তখন তার অভিব্যক্তি, চোখের দৃষ্টি, হেঁটে যাওয়ার ভঙ্গি— সব নতুনের মতো ফিরে আসে। তিনি আজও জীবন্ত, প্রতিটি দর্শকের স্মৃতিতে। বর্তমান প্রজন্ম হয়তো তাকে নতুন সিনেমায় দেখবে না, কিন্তু যাদের স্মৃতিতে তিনি রয়েছেন, তারা জানেন এমন শিল্পী বারবার আসে না।
অভিনয় জীবনের শুরুটা ছিল নায়ক হিসেবে। কিন্তু তিনি বুঝেছিলেন তার সত্যিকার শক্তি অন্য জায়গায়। ধীরে ধীরে তিনি গড়েন এক নতুন সাম্রাজ্য— খলনায়কের। তবে এই খলনায়ক কখনো একমাত্রিক ছিলেন না। রাজীবের চরিত্রে ছিল গভীরতা, মনস্তত্ত্ব, আত্মসংঘাত। তিনি হয়ে উঠতেন প্রতিহিংসাময়, আবার কোথাও একজন নিঃস্ব পিতা, একাকী মানুষ বা বিদ্ধস্ত রাজনীতিক। দর্শক পর্দায় তার খলনায়কের অভিনয় দেখে ঘৃণা করতেন। কারণ চরিত্রের সঙ্গে তিনি সহজে মিশে যেতেন। দক্ষ অভিনেতা ছিলেন।
রাজীব জানতেন, সংলাপের বাইরেও এক ধরনের অভিনয় হয়— চোখ দিয়ে। তার চোখের দৃষ্টি যেন সংলাপের চেয়েও বলিষ্ঠ ছিল। দৃশ্যমান না হয়েও সেই চাহনি অনুভব করতেন দর্শক। তিনি ছিলেন এমন এক অভিনেতা, যিনি 'চোখের অভিনয়'কে এক নতুন স্তরে নিয়ে গিয়েছিলেন।
রাজীবের অভিনীত চলচ্চিত্রগুলোর তালিকা যেন ঢাকাই সিনেমার গৌরবময় এক অধ্যায়। ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’, ‘অন্তরে অন্তরে’, ‘হাঙর নদী গ্রেনেড’, ‘সত্যের মৃত্যু নেই’, ‘স্বপ্নের পৃথিবী’, ‘ভাত দে’, ‘আজকের সন্ত্রাসী’, ‘অনন্ত ভালোবাসা’, ‘মগের মুল্লুক’, ‘দাঙ্গা’, ‘ত্রাস’, ‘চাঁদাবাজ’, ‘খলনায়ক’, ‘স্বপ্নের বাসর’—এমন অসংখ্য সিনেমায় তিনি নিজেকে প্রতিবার নতুনভাবে উপস্থাপন করেছেন।
ঢাকা/রাহাত//
.উৎস: Risingbd
এছাড়াও পড়ুন:
মানবাধিকার কমিশনকে শক্তিশালী ও কার্যকর করতে নতুন অধ্যাদেশ অনুমোদন
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকে আরো শক্তিশালী ও কার্যকর করার লক্ষ্যে নতুন জাতীয় মানবাধিকার কমিশন অধ্যাদেশ অনুমোদন করেছে উপদেষ্টা পরিষদ।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত উপদেষ্টা পরিষদের সভায় অধ্যাদেশটির অনুমোদন দেওয়া হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। বৈঠক শেষে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল।
আরো পড়ুন:
নির্বাচন বানচালের যেকোনো ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে: প্রধান উপদেষ্টা
১৫ নভেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের প্রস্তুতি শেষ করার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমাদের আগে একটা মানবাধিকার কমিশন ছিল, কিন্তু সেটি কার্যত দন্তহীন একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। নিয়োগ পদ্ধতিতে ত্রুটি, এখতিয়ারে ঘাটতি এবং নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রতিষ্ঠানটি কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেনি। এবার সেটিকে সত্যিকারের এখতিয়ারসম্পন্ন, ক্ষমতাসম্পন্ন একটি প্রতিষ্ঠানে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে।”
তিনি জানান, নতুন অধ্যাদেশে মানবাধিকার কমিশনের কাঠামো, এখতিয়ার ও নিয়োগ প্রক্রিয়ায় মৌলিক পরিবর্তন আনা হয়েছে। কমিশন একজন চেয়ারম্যান ও চারজন সার্বক্ষণিক সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতা ও যোগ্যতা নিশ্চিত করতে আপিল বিভাগের একজন বিচারকের নেতৃত্বে সাত সদস্যের একটি বাছাই কমিটি গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে আবেদন আহ্বান করা হবে এবং প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বাছাই কমিটি সুপারিশ করবে।
আইন উপদেষ্টা বলেন, “আমরা নিয়োগ পদ্ধতিটা এমনভাবে করেছি যাতে অভিজ্ঞ, যোগ্য ও মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় মানুষরা কমিশনে জায়গা পান।”
তিনি আরো বলেন, “আমাদের সংবিধানের মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ কর্তৃক অনুসমর্থিত আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তি এবং প্রথাগত আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত মানবাধিকারগুলোকেও এই কমিশনের এখতিয়ারে আনা হয়েছে। এর ফলে কমিশন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুযায়ী কাজ করতে পারবে।”
অধ্যাদেশে কমিশনের এখতিয়ার বহুলাংশে বাড়ানো হয়েছে। এখন থেকে শৃঙ্খলা বাহিনীসহ রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতায় সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাতেও কমিশন তদন্ত করতে পারবে। আইন উপদেষ্টা বলেন, “আগের কমিশনের এখতিয়ারে গুরুতর সীমাবদ্ধতা ছিল, বিশেষ করে শৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে। এবার সেই সীমাবদ্ধতা দূর করা হয়েছে।”
এছাড়া, গুম প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ভুক্তভোগীদের সুরক্ষা আইনসহ মানবাধিকার সংরক্ষণমূলক যেকোনো আইনের বাস্তবায়নের দায়িত্ব মানবাধিকার কমিশনের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছে। আলাদা করে ‘গুম কমিশন’ গঠনের প্রয়োজন হবে না বলে তিনি জানান।
অধ্যাদেশে কমিশনের আদেশ প্রতিপালনকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। আইন উপদেষ্টা বলেন, “এখন থেকে কমিশনের সুপারিশ বা নির্দেশ উপেক্ষা করা যাবে না। এর বাধ্যবাধকতা আইনি কাঠামোয় যুক্ত করা হয়েছে।”
ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম ও উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার উপস্থিত ছিলেন। খবর বাসসের।
ঢাকা/এসবি