গত বুধবার হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসে আলো কমিয়ে দিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসাকে সামনে বসিয়ে একটি ভিডিও চালান ট্রাম্প। ভিডিওটি ছিল তথাকথিত ‘শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা’ নিয়ে। কিছুদিন আগে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে ডেকে অপদস্থ করার চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্প। এবার তিনি তাঁর অতিথি দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্টকে বিব্রত ও অপমান করতে চাইলেন। 

ভিডিও চালিয়ে দিয়ে ট্রাম্প খুশি মনে বললেন, ‘এটা এক ভয়ানক দৃশ্য, এমনটা আমি আগে কখনো দেখিনি।’ আর দাবি করলেন, এটি নাকি দক্ষিণ আফ্রিকায় শ্বেতাঙ্গদের ওপর গণহত্যার প্রমাণ। সবটাই মিথ্যা। ভিডিওতে যে ক্রুশগুলো দেখা যাচ্ছিল, তা কোনো কবরের চিহ্ন নয়। ২০২০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দুটি খুনের ঘটনার পর এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়েছিল। এই স্মৃতিস্তম্ভে বিগত বছরগুলোতে নিহত শ্বেতাঙ্গ কৃষকদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। কিন্তু একে ‘গণহত্যা’ বলা একেবারেই অসত্য। 

গত ১০ বছরে বহুবার এই দাবিকে মিথ্যা প্রমাণ করা হয়েছে। ট্রাম্পের নিজের পররাষ্ট্র দপ্তরই ২০২০ সালের শেষ দিকে এক প্রতিবেদনে জানায়, ২০১৮-১৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকায় মোট ২১ হাজার ২২টি হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর মধ্যে মাত্র ৪৭ জন কৃষক নিহত হয়েছেন; অর্থাৎ মাত্র শূন্য দশমিক ২ শতাংশ। 

এ রকম নাটকীয় দৃশ্য দেখা গিয়েছিল ২৮ ফেব্রুয়ারিতে। সেবার ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকেও একইভাবে অপমান করার চেষ্টা করেছিলেন ট্রাম্প। 

এসব থেকে কী বোঝা যায়? বোঝা যায় যে কী ভয়ংকর অদক্ষতা, কুসংস্কারাচ্ছন্নতা ও জ্ঞানের ঘাটতি নিয়ে ট্রাম্প বিশ্বকে পরিচালনা করছেন। এটি শুধু যুক্তরাষ্ট্র নয়, গোটা বিশ্বের জন্য বিপদের ইঙ্গিত। তাই রামাফোসাকে অপমান করা নিছক আকস্মিক ঘটনা নয়। এটি একটি বার্তা। এতে দেখা যায় যে ট্রাম্পের যুক্তরাষ্ট্র এখন বাস্তবতা ও বিজ্ঞানের চর্চাশূন্য, একটি নাটকীয় রিয়েলিটি টিভি অনুষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। এখানে সত্যের কোনো মূল্য নেই। মিথ্যাই রাজত্ব করছে।

আমি জন্মেছি দক্ষিণ আফ্রিকায়, ভয়ংকর বর্ণবাদী সমাজের মধ্যে। আমি এই বর্ণবাদ জানি। আমি তা প্রতিদিন অনুভব করেছি, সহ্য করেছি। আজকের স্বাধীন, অবর্ণবাদী, গণতান্ত্রিক দক্ষিণ আফ্রিকাকে কেউ যদি সেই সন্ত্রাসী ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করে, তাহলে আমার গা ঘিন ঘিন করে। অথচ ট্রাম্প ঠিক তা-ই করেছেন। ট্রাম্প শুধু দক্ষিণ আফ্রিকাকে অপমান করছেন না, তিনি মিথ্যা প্রচার করে যুক্তরাষ্ট্রের ভাবমূর্তিকেই কলুষিত করছেন। ট্রাম্পের এই কর্মকাণ্ড শুধু ভয়ংকর নয়, এই মুহূর্তে যা সবচেয়ে উদ্বেগজনক, তা হলো যুক্তরাষ্ট্রের জনমনে এসব ঘটনার বিরুদ্ধে এক নীরবতা বিরাজ করছে।

আমি আজ দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতি অবিচার নিয়ে ক্ষুব্ধ নই। আমি দুঃখিত ও শোকাহত আমার নিজের জন্য। আমি দুঃখিত আমাদের মতো মানুষদের জন্য—যারা দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শাসনের মধ্যে বড় হয়ে বিশ্বাস করেছি যে যুক্তরাষ্ট্র সত্য ও ন্যায়ের পক্ষে থাকবে। কিন্তু আজ একজন প্রেসিডেন্ট আগের যুগের রাজার মতো সুপ্রিম কোর্টের আদেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান। সত্যের ধার না ধেরে সিদ্ধান্ত নেন। 

আজ যখন ছাত্রদের মুখে কাপড় বেঁধে গাড়িতে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন যুক্তরাষ্ট্র আর গণতন্ত্রের বাতিঘর থাকে না। সেটি হয়ে ওঠে আমার দেখা অতীতের বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা। যেখানে সামান্য একটু বিরুদ্ধ চিন্তাই ডেকে আনে গুম, নিখোঁজ বা মৃত্যু।

বুধবারের ঘটনায় আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত ছিল, যা ট্রাম্পের নৈতিক দেউলিয়াপনা উন্মোচন করে দেয়। এক সাংবাদিক ট্রাম্পকে প্রশ্ন করেন, তিনি কেন কাতারের কাছ থেকে ‘উপহার হিসেবে’ একটি বিমান নিচ্ছেন? এই বিমান যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্পের বিমান এয়ারফোর্স ওয়ান হিসেবে ব্যবহৃত হবে। 

ট্রাম্প প্রশ্নকারী সাংবাদিককে ‘বোকা’ ও ‘অজ্ঞ’ বলে গালাগাল দেন। বলেন, ‘একটা দেশ যদি মার্কিন বিমানবাহিনীকে বিমান দেয়, তাহলে সেটা তারা আমাদের সাহায্য করার জন্যই দিচ্ছে।’ 

এরপর রামাফোসা হেসে বলেছিলেন, ‘দুঃখিত, আমার কাছে এমন কোনো বিমান নেই, যা আপনাকে দিতে পারি।’ ট্রাম্প বোঝেননি, সেই কথায় রামাফোসার কী বিদ্রূপ লুকিয়ে ছিল; বরং তিনি নিজের দুর্নীতিপরায়ণতা আরও খোলাসা করে বললেন, ‘ইশ্‌, যদি থাকত! আপনি দিলে কিন্তু আমি সেটা নিয়ে নিতাম।’

এই তো ট্রাম্প! নগ্ন সম্রাট। এমন একজন নেতা, যিনি টাকাপয়সার পূজারি। যিনি জানেনই না নিজের কাজগুলো বিশ্বের চোখে কতটা অনৈতিক ও দুর্নীতিগ্রস্ত দেখায়। 

জাস্টিস মালালা রাজনীতি বিশ্লেষক ও লেখক 

দা গার্ডিয়ান থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ 

.

উৎস: Prothomalo

কীওয়ার্ড: র জন য

এছাড়াও পড়ুন:

‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’

সাপ্তাহিক ‘পঙক্তি’র দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নারীর সমান অধিকার, সাংস্কৃতিক জাগরণ ও মুক্তচিন্তার বিকাশ ছাড়া বৈষম্যহীন সমাজ গঠন সম্ভব নয় এমন মত প্রকাশ করেছেন বক্তারা।

শনিবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সাপ্তাহিক পঙক্তির দ্বিতীয় বর্ষপূর্তি উপলক্ষে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়।

আরো পড়ুন:

‘নো ওয়েজ বোর্ড, নো মিডিয়া’সহ ৩৮ দাবি সংবাদকর্মীদের 

‘সাম্য, মর্যাদা ও আলোকিত সমাজের স্বপ্নে ৭১ ও ২৪ এর তরুণরা’

অনুষ্ঠানে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি ও কালের কণ্ঠের সম্পাদক হাসান হাফিজ বলেন, “নারীরা অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও পুরুষতান্ত্রিক নানা বৈষম্য ও হেনস্তার শিকার হন। আমরা দেখছি, অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ও নারী ও শিশুরা লাঞ্ছিত, নিপীড়িত হচ্ছে, এটি লজ্জার বিষয়। আমরা এমন সমাজ চাই না। আমরা চাই একটি সত্যিকারের বৈষম্যমুক্ত সমাজ, যেখানে নারী–পুরুষের সমান অধিকার নিশ্চিত থাকবে।”

প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব ভূঁইয়া বলেন, “আমরা বর্তমানে একটি সাংস্কৃতিকভাবে খারাপ সময় পার করছি। একটি নতুন রাজনৈতিক আন্দোলন বারবার ব্যর্থ হয়ে যাচ্ছে। সর্বক্ষেত্রে যে অবক্ষয় দেখা দিয়েছে, তাতে একমাত্র একটি সাংস্কৃতিক বিপ্লবই আমাদের জাতিকে রক্ষা করতে পারে।”

কবি ও কলামিস্ট সোহরাব হাসান বলেন, “ফেসবুক–ইউটিউবের যুগে একটি সাহিত্য পত্রিকা টিকিয়ে রাখা অত্যন্ত কঠিন কাজ। বর্তমানে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এক ধরনের বৈরী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। আক্রান্ত হচ্ছে মাজার, দরগা, শিল্পী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক তৎপরতা। এই আক্রমণ জাতিসত্তার উপর আক্রমণ, আমাদের শিল্প–সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সুকুমার ভিত্তির উপর আঘাত। এর বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে হবে।”

সভাপতির বক্তব্যে সাপ্তাহিক পঙ্ক্তির সম্পাদক কবি জান্নাতুল ফেরদৌস পান্না ওরফে পান্না বেগম বলেন, “আজ আমি খুব আনন্দিত, উচ্ছ্বসিত। আমি একজন সফল নারী বলে নিজেকে সম্মান করি। আমি ২৬ বছর ধরে কাজ করি। কারোর মুখাপেক্ষী হইনি। একটি পত্রিকা কারোর সহযোগিতা ছাড়া নিয়মিত প্রকাশ করা এতোটা সহজ নয়। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে আজকের এই জায়গাটি তৈরি হয়েছে।”

বাংলাদেশের আলো পত্রিকার সম্পাদক ও প্রকাশক মফিজুর রহমান বাবু বলেন, “সাপ্তাহিক পঙ্ক্তি পত্রিকাটি নিয়ে প্রথম থেকেই আমার একটি চিন্তা ছিল। পত্রিকাটির নাম পঙ্ক্তি কেন? খুব চিন্তা করে এর দুইটি কারণ খুঁজে পেলাম। একটি হলো-এই পত্রিকাটির সম্পাদক একজন কবি ও সাংবাদিক। উনার কবিসত্তার চিন্তাধারা থেকে এই নামটি নির্ধারণ করেছেন। কারণ পঙ্ক্তি শব্দের অর্থ কবিতার লাইন বা সারি। আর দ্বিতীয়টি হলো- সম্পাদকের একমাত্র কন্যার নাম পঙ্ক্তি। সন্তানের প্রতি একজন মায়ের যে অসাধারণ ভালোবাসা, তারই বহিঃপ্রকাশ হলো সাপ্তাহিক পঙ্ক্তি।”

অনুষ্ঠানে আরো বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশ প্রতিদিন পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক মানিক মুনতাসির, কবি ও সাংবাদিক বজলুর রহমান, কবি মোশাররফ হোসেন ইউসূফ, বাংলানিউজের সাংবাদিক তুলনা আফরিন প্রমুখ।

ঢাকা/এসবি

সম্পর্কিত নিবন্ধ

  • শাহরুখ খান: গণহত্যার সময় বিলিয়নিয়ার হওয়ার অর্থ কী
  • ‘সাংস্কৃতিক জাগরণেই মুক্তি’
  • সুদানের এল-ফাশের শহরে ‘চরম বিপদে’ বাসিন্দারা: ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস
  • সুদানে গণহত্যার প্রতিবাদে জাবি ও জবিতে মানববন্ধন
  • জুলাইবিরোধী শক্তির শাস্তি দাবিতে ইবিতে বিক্ষোভ
  • সুদানে আরএসএফের গণহত্যায় আরব আমিরাত ইন্ধন দিচ্ছে কেন
  • সুদানে ‘গণহত্যা’ হয়েছে
  • একাত্তরের গণহত্যার জন্য জামায়াতকে নিষিদ্ধ করতে হবে: আলাল
  • জুলাই বিরোধিতা: ৩০ শিক্ষক-কর্মচারী ও ৩৩ ছাত্রলীগ নেতার ‘শাস্তি’
  • সুদানে কারা গণহত্যা চালাচ্ছে, আরব আমিরাতের ভূমিকা কী