প্রথম পরিচয়
শিল্পী হামিদুজ্জামান খানের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় চারুকলায়। চারুকলা তখন ঢাকা আর্ট কলেজ। সালটা ১৯৭৪। উচ্চ মাধ্যমিক পাস করে তখন আর্ট কলেজে ভর্তি পরীক্ষা দিচ্ছি। হামিদুজ্জামান খান সেই পরীক্ষায় গার্ড দিচ্ছিলেন। আমি তাঁকে খুব একটা লক্ষ্য করিনি। কিন্তু তিনি যে লক্ষ্য করছিলেন আমাকে, তার প্রমাণ মিলেছে পরে।
পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হই। তখন চারুকলায় পাঠ আজকের দিনের মতো ছিল না। প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষে ছিল না আলাদা কোনো বিভাগ। সবাইকে সব বিষয় পড়তে হতো। তৃতীয় বর্ষে কোনো একটি বিশেষ বিষয় নেওয়া যেত। হামিদুজ্জামান খান ছিলেন ভাস্কর্যের শিক্ষক। যদিও তৃতীয় বর্ষের আগে আমি তাঁর ক্লাস পাইনি।
ভর্তি পরীক্ষায় আমি উত্তীর্ণ হবো কিনা তিনি জানতেন না। যখন আমাকে ক্যাম্পাসে দেখলেন, উচ্ছ্বসিত হলেন। তাঁর সঙ্গী ছিলেন আবদুর রাজ্জাক স্যার। আমাদের আরেক কিংবদন্তি। সেই সময়ে আমার প্রতি আগ্রহের প্রতি যত্ন নেওয়ার অবকাশ হামিদের হয়নি। কারণ তিনি দেশের বাইরে পড়তে যাচ্ছিলেন। ভারতের বরোদায় বিখ্যাত মহারাজা সাহজিরাও বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখান থেকে দুই বছর পর ফিরে এসে তিনি আমার খোঁজ করলেন। শিল্পী আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, সরাসরি বিয়ের প্রস্তাব পাঠাবেন আমার বাবা-মায়ের কাছে। আর্ট কলেজের অফিস থেকে আমার বাড়ির ঠিকানা বের করাটা তাঁর জন্য কঠিন ছিল না।
তাঁকে আমার ভালো লাগত, কিন্তু তাঁর মতো করে ভাবিনি। বাড়িতে বিয়ের প্রস্তাব পাঠানোয় আমি বিব্রত হলাম। সত্যি বলতে, তখন বিয়ে আমি করতে চাইনি। কম বয়সে আর্ট কলেজের বিদ্যা, দীক্ষা এসব মাত্র বুঝতে শুরু করেছি। বাসায় বললাম, আমি বিয়ে করতে চাচ্ছি না। আমার বাবার কিন্তু এদিকে হামিদকে পছন্দ হয়ে গেছে। বললেন, ‘আমার মনে হচ্ছে ছেলে ভালো, তদুপরি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সমস্যা কোথায়?’ আমি বললাম, ‘তিনি একজন শিক্ষক হয়েও কেন এমন করছেন? আমি আর্ট কলেজে আর পড়ব না।’ বাবা বললেন, ‘ওকে বিয়ে করতে পারো। চারুকলায় তোমার একজন অভিভাবক হবে।’
বলেছিলাম আর পড়ব না, কিন্তু আবার এলাম। একদিন কাজ করছি, হামিদুজ্জামান এলেন। বললেন, ‘কেমন চলছে সব?’ আমি নিরাসক্তভাবে বললাম, ‘ভালো।’ তখন আমাদের দ্বিতীয় বর্ষ শেষের পথে। তৃতীয় বর্ষে নিতে হবে নতুন বিষয়। কোন বিষয় নেবো আমি ঠিক করে ফেলেছি। হামিদ বললেন, ‘কোন বিষয় নেবেন?’ বললাম, ‘প্রিন্ট মেকিং।’ হামিদের পছন্দ হলো না। প্রিন্ট মেকিং ওঁর বিষয় নয়। বললেন, ‘ভাস্কর্য নিতে পারেন। বেশি ভালো হবে।’ আমি বললাম, ‘প্রিন্ট মেকিংই নেবো। আমার ভালো লাগে।’ শেষ পর্যন্ত আমাকে ভাস্কর্যই নিতে হয়েছিল। হামিদের কথা একটা কারণ। ব্যক্তিগত কৌতূহলও ছিল। এখন বলতে পারি, সেদিন আমি ভুল করিনি।
যদিও বাসায় তখন হামিদের প্রস্তাব বাবা সদ্বিবেচনায় রেখেছেন, আমাদের আরেকটি মানসিক টানাপোড়েন ছিল। আমরা ছিলাম পাঁচ বোন। আমি ছিলাম তৃতীয়। আমার আগের দুই বোন তখনও বিয়ে করেনি। তাদের অবিবাহিত রেখে আমার বিয়ে করাটা কেমন লাগছিল। কিন্তু হামিদের চাওয়ার কাছে হার মানতে হলো। ছিয়াত্তরের ডিসেম্বরে আমরা ঘরোয়াভাবে বিয়ে করি।
বিয়ের পর চারুকলায় যেদিন প্রথম যাই, সবাই ফুল নিয়ে এগিয়ে এলেন।
সেই মুহূর্তটা ভুলব না। খুব নার্ভাস ছিলাম। আনোয়ারুল হক স্যার, আমিনুল ইসলাম স্যার, আবদুর রাজ্জাক স্যার, মোহাম্মদ কিবরিয়া স্যার, সফিউদ্দিন আহমেদ স্যার, কাইয়ুম চৌধুরী স্যার সবাই ফুল দিয়ে গেলেন। তখন শাহবাগে ফুলের বাজার ছিল না। সব ফুল ছিল চারুকলার। এবং ফুলের তোড়া মালিরা বানিয়ে দিয়েছিলেন। সবাই হামিদের খুব প্রশংসা করছিলেন। বলছিলেন, ‘ও খুব ভালো ছাত্র। তোমার সঙ্গে বিয়ে হওয়ায় আমরা ভীষণ খুশি। তুমি একটু দেখো, ওর কাজ যেন কমে না যায়।’ কথাগুলো আমি মনে রেখেছিলাম।
বিয়ে-পরবর্তী অনেক মজার স্মৃতিই আছে। একটা স্মৃতি বিশেষ মনে পড়ে।
শিল্পী হামিদুজ্জামান
বিয়ের প্রথম দিকে শিল্পী হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই আধুনিক শিল্পকলা সম্পর্কে আমার ধারণা, দর্শন খুব বেশি স্পষ্ট ছিল না। হামিদের কাজ ভালো লাগত। কিন্তু কোন পথে কতটা ভালো, তা নিয়ে বলা সম্ভব হতো না। ধীরে ধীরে যখন বুঝতে শিখলাম, তখন নতুন করে তাঁর শিল্পকর্মকে আবিষ্কার করি। ওঁর একটা বিশেষ গুণ ছিল। দিনরাত কাজ করতেন। কাজ ছাড়া তাঁকে কম সময়ই দেখেছি। আমার ভাস্কর হয়ে ওঠার পেছনে হামিদের অশেষ অনুপ্রেরণা রয়েছে। তাঁর কথা যেমন আমাকে উৎসাহ দিয়েছে, তেমনি উৎসাহিত করেছে কাজের প্রতি ওঁর অদম্য স্পৃহা।
বিবাহিত জীবনের শুরুতে আমরা রায়েরবাজারে থাকতাম। সেখান থেকে চারুকলায় আসা-যাওয়া। পরে আমরা কিছুকাল পল্টনে ছিলাম। আশির দশকের শুরুতে আমিনুল ইসলাম স্যারের ভূমিকায় হামিদুজ্জামান খান চারুকলার মেয়েদের হলের হল কিপার হয়ে এলেন। সরকারি চাকরি, বেতন কম। বেতন কম হলেও তখন টাকার মূল্য ছিল। হামিদ হল কিপার হওয়ায় আমাদের বেশ সুবিধা হয়েছিল। এমনিতেই তিনি অনেকটা সময় কাজ করতেন ডিপার্টমেন্টে। এরপর বাড়ি ফিরতেন। তখন কাজের পরিমাণ আরও বেড়ে গেল। বঙ্গভবনের কাজটা করলেন তখন– ‘পাখি পরিবার’। সিলেটে জালালাবাদ ক্যান্টনমেন্টে তৈরি করলেন ‘হামলা’। তখন বড় বড় কাজ শুরু তাঁর। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতায় বড় কাজগুলো কিছু সুবিধাও পাইয়ে দিয়েছিল।
বিরাশি বা তিরাশি সালে ওঁর যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার একটা সুযোগ এলো। ততদিনে চারুকলা থেকে পাস করে আমি উদয়ন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করি। দেশের বাইরে আরও উৎকৃষ্ট শিল্পী ও শিল্পকলার সঙ্গে তাঁর পরিচয় ঘটে। কাজে আরও উৎকর্ষ যুক্ত হয়। ক্রমশ আন্তর্জাতিক বলয়ে কাজ বাড়তে থাকে। ১৯৮৮ সালে কোরিয়া অলিম্পিকে তাঁর শিল্পকর্ম উপস্থাপিত হলো। ভাস্কর্যের নাম ‘দ্য স্টেপস’। স্টেপস দক্ষিণ কোরিয়াতেই স্থান করে নিয়েছে।
এর কিছুকালের ভেতর আমি শান্তিনিকেতনে পড়তে গেলাম যখন, সেখানেও হামিদের সুখ্যাতি উপভোগ করেছি। সবাই বলত, হামিদ বাংলাদেশের হেনরি মুর। শুনে ভালো লাগত। সালটা সম্ভবত ১৯৮৮। হামিদুজ্জামান তখন বরদায় মাস্টার্স করছেন।
আমি মনে করি, বাংলাদেশে ভাস্কর্যে হামিদুজ্জামান খান প্রধান। দৃশ্যচিত্রেও তিনি প্রথম দিকেই থাকবেন। দেশের বাইরে গিয়ে আমার পক্ষে যখন তুলনামূলক শিল্পমান যাচাই করা সম্ভব হয়েছে, তখন লক্ষ্য করেছি হামিদুজ্জামানের কাজ উৎকৃষ্ট। আমি বিশ্বাস করি, শিল্প ভেতর থেকে আসতে হয়। তাঁর করা ভাস্কর্য ও দৃশ্যচিত্রগুলো মনের ভেতর থেকে আসা। সেখানে বাস্তব শারীরিক অবয়ব বা হুবহু বাস্তবের অনুগামী দৃশ্য নেই। ওটা হামিদুজ্জামানের একেবারে নিজস্ব। মনের ভেতর একটা মূল অবয়ব থাকে। কিন্তু কাজে সেই অবয়বকে ছাপিয়ে, কিছু চিহ্ন ও প্রতীকসহ তাঁর নিজের দেওয়া অবয়বটাই ফুটে। হামিদুজ্জামানের আঁকা পোর্ট্রেটকে ঘিরেও এ কথা বলা যায়। আমি মনে করি, যা আছে তা হুবহু ফুটিয়ে তোলা শিল্প নয়। সেটা অনুলিপি।
১৯৮৮ সালে হামিদুজ্জামান যখন বরোদায় মাস্টার্স করছিলেন, তখন দিল্লিতে এক চিত্রপ্রদর্শনীতে অংশ নেন। সেখানে মকবুল ফিদা হুসেন ওর শিল্পকর্ম দেখে আগ্রহী হয়ে দীর্ঘ সময় হামিদুজ্জামানের সঙ্গে কথা বলেছিলেন। ওই তরুণ বয়সে সেটা আমার ও আমাদের জন্য প্রেরণার এক প্রোজ্জ্বল মুহূর্ত ছিল, এখনও মনে পড়ে।
পরিশেষে
আমি যখন শান্তিনিকেতনে ছিলাম, ১৯৮৮ ও ১৯৮৯ সালে, হামিদুজ্জামান যথারীতি কাজ নিয়ে ব্যস্ত। তখন আজকের মতো হ্যান্ডফোনের প্রচলন ছিল না। একমাত্র চিঠিতে আমাদের যোগাযোগ হতো। দেড় থেকে দুই মাস ওর সঙ্গে কোনো যোগাযোগ ছিল না। থাকতাম সীমান্ত পল্লিতে বাড়ি ভাড়া করে। পাশেই এক বাড়িতে বেশ কয়েকজন বাংলাদেশি ছাত্রী ছিল। ওরা সংগীত ভবন ও বিদ্যাভবনে পড়ত । অধ্যাপক শর্বরী রায় চৌধুরী, অজিত বাবু, বিপিন দাস আমার শিক্ষক ছিলেন। তারা ভারতসহ সারাবিশ্বে বেশ খ্যাতিমান ভাস্কর ছিলেন। তাদের মাঝে, কাজকর্মে সময় আমারও ভালোই কাটত। কিন্তু তাঁর চিঠির অপেক্ষাতেও থাকতাম। হঠাৎ এক দুপুরে পিয়ন চিঠি নিয়ে এলো। খামটি বেশ ভারী। খুলে দেখি একসঙ্গে প্রায় ২০-২৫টি চিঠি। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে লিখে রাখতেন। এক-দেড় মাস পর একসঙ্গে পোস্ট করেছেন। প্রায়ই এমন করতেন। তখন রাগ হলো ওঁর ওপর। কিন্তু এখন মনে হয়, এই পাগলামোগুলোই তো বলার মতো গল্প হয়ে হৃদয়ে জমা থাকে।
এ বছরের ১৬ মার্চ হামিদুজ্জামান খান আশি বছরে পা রেখেছেন। আমি ওঁর দীর্ঘতম কর্ম ও ভালোবাসাময় জীবন কামনা করি।
লেখক: ভাস্কর ও হামিদুজ্জামান খানের সহধর্মিণী
.উৎস: Samakal
কীওয়ার্ড: ভ স কর য ত য় বর ষ চ র কল য় পর ক ষ আম দ র আম র ব বলল ম বলল ন করল ন প রথম
এছাড়াও পড়ুন:
চিড়া–বাদাম বেচেন কুদ্দুস, বাড়িতে হাজারো বই আর অডিও
আবদুল কুদ্দুস শিকদারের বয়স ৭৩ ছুঁই ছুঁই। এখনো বাড়িতে ভাজা চিড়া, বাদাম আর বুট নিজেই বাইসাইকেল চালিয়ে দোকানে দোকানে বিক্রি করেন। সামান্য আয়ে সংসার চালিয়ে প্রতি মাসে কিছু টাকা বাঁচান, যা দিয়ে সাহিত্যের মোটা মোটা বই কেনেন। এভাবে তিনি সংগ্রহ করেছেন বিভিন্ন কবি-সাহিত্যিকের হাজারখানেক বই। যদিও তিনি নিরক্ষর। পুত্রবধূকে দিয়ে বই পড়িয়ে পাশে বসে শুনে সাহিত্যের রস আস্বাদন করেন তিনি।
শুধু সাহিত্যের বই নয়, আধ্যাত্মিক বা গভীর অনুভূতির প্রকাশ ঘটানো সংগীত বা ভাবসংগীতের সংগ্রাহকও তিনি। তাঁর বাড়ির একটি টিনের ঘরে আড়াই হাজার অডিও রেকর্ডিংয়ের সংগ্রহ বা ক্যাসেট রয়েছে। এতে ধারণ করা আছে অন্তত ১০ হাজার ভাবসংগীত। ক্যাসেট বাজানোর জন্য ১৪টি ক্যাসেট প্লেয়ার সেটও রয়েছে। প্রায় প্রতি রাতে তিনি গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যান। মাঝেমধ্যে ঘরেই বসান ভাবসংগীতের আসর। সাধুসঙ্গে গানের পাশাপাশি গানের কথা ও ভাব নিয়ে আলোচনাও হয়।
গল্পে গল্পে আবদুল কুদ্দুস জানান, জীবনে এক দিনের জন্যও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। পরে অবশ্য নিজের চেষ্টায় কিছুটা অক্ষর চিনেছেন। তবে গড়গড়িয়ে পড়ার মতো শিখতে পারেননি। লিখতেও পারেন না। বইয়ে লেখকের ছবি দেখে তিনি মূলত বই চিনতে পারেন।যশোর শহরের পালবাড়ি রায়পাড়া এলাকায় আবদুল কুদ্দুসের বাড়ি। ১৩ শতক জমির বাড়িতে স্ত্রী, চার ছেলেমেয়ে ও নাতি-নাতনি নিয়ে তাঁর বসবাস। নিজে সাহিত্য পড়তে বা গান গাইতে না পারলেও তিনি সাহিত্য ও ভাবসংগীতের অনুরাগী। গানে তাল লয় সুর তোলার জন্য একতারা, দোতারা ও মন্দিরা রয়েছে তাঁর ঘরে।
গত ২৯ মে কুদ্দুস শিকদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, টিনের চালার একটি ঘরে তাঁর বসবাস। অন্য আরও ঘর রয়েছে। স্ত্রী-সন্তানেরা সেগুলোতে থাকেন। কুদ্দুসের ঘরের এক প্রান্তে একটি চৌকির মতো খাট। খাটে সব সময় মশারি টাঙানো থাকে। মশারির মধ্যে বালিশের দুই পাশে দুটি ক্যাসেট প্লেয়ার ও অসংখ্য ক্যাসেট। সেগুলো এখনো সচল। পাশবালিশের মতো করে একটি দোতারা রাখা আছে মশারির ভেতরে।
আবদুল কুদ্দুস বলেন, দানা গুড়ের ঠিলেয় ঝোল রাখা হয় কেন জানেন? দানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমি হলাম সেই ঝোল। নিজে দানা হতে না পারলেও দানা বাঁচিয়ে রাখার কাজটা ঝোল হিসেবে করে যাচ্ছি।ঘরের অন্য প্রান্তে রাখা দুটি আলমারি। যেগুলো মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, ড. লুৎফর রহমান, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, জসীমউদ্দীনের মতো অসংখ্য কবি-লেখকের বইয়ে ঠাসা। ঘরটি কাঁচা। বৃষ্টিতে ভিজে যেতে পারে কিংবা ইঁদুরে কেটে ফেলতে পারে—এ আশঙ্কায় প্রতিটি বই পলিথিনের মলাটে মুড়িয়ে রাখা। দুই আলমারির মধ্যে বসার জন্য একটি চৌকির মতো বেঞ্চ। টেবিল-চেয়ারও রয়েছে একটা। টেবিলের ওপরে অনেকগুলো কাগজের কার্টন সাজানো রয়েছে। ওই কার্টনের ভেতরে পুরোনো দিনের গানের ক্যাসেট রাখা।
তাঁর বাড়ির একটি টিনের ঘরে আড়াই হাজার অডিও রেকর্ডিংয়ের সংগ্রহ বা ক্যাসেট রয়েছে। এতে ধারণ করা আছে অন্তত ১০ হাজার ভাবসংগীত। ক্যাসেট বাজানোর জন্য ১৪টি ক্যাসেট প্লেয়ার সেটও রয়েছে। প্রায় প্রতি রাতে তিনি গান শুনতে শুনতে ঘুমাতে যান।গল্পে গল্পে আবদুল কুদ্দুস জানান, জীবনে এক দিনের জন্যও স্কুলে যাওয়া হয়নি তাঁর। পরে অবশ্য নিজের চেষ্টায় কিছুটা অক্ষর চিনেছেন। তবে গড়গড়িয়ে পড়ার মতো শিখতে পারেননি। লিখতেও পারেন না। বইয়ে লেখকের ছবি দেখে তিনি মূলত বই চিনতে পারেন। সাহিত্যের প্রতি তাঁর প্রবল অনুরাগ। প্রতি মাসে তিনি দু-একখানা করে লেখকের রচনাসমগ্র কেনেন। বই কেনার এমন নেশা যে সুদে টাকা নিয়েও তিনি বই কিনেছেন। কাউকে পেলেই তাঁকে দিয়ে বই পড়িয়ে নিজে বসে বসে শুনেছেন।
পরিবারের সদস্যরা জানান, এখন অবসর সময়ে পুত্রবধূ সাবিহা খাতুনকে ডেকে বই পড়তে বলেন আবদুল কুদ্দুস। সাবিহা বই পড়ার সময় প্রবল আগ্রহ নিয়ে পাশে বসে তা শোনেন তিনি। সাহিত্যের প্রতি শ্বশুরের এমন আগ্রহ সাবিহা খাতুনও উপভোগ করেন। পড়াশোনা বিদ্যালয়ের গণ্ডি পর্যন্ত পড়াশোনা করা সাবিহা বলেন, ‘আমার শ্বশুর অন্যদের চেয়ে একদমই আলাদা। শিশুর মতো তাঁর মন। সাহিত্য আর বাউলগানের প্রতি তাঁর বেশি আগ্রহ। প্রায়ই আমাকে ডেকে সাহিত্যের বই পড়তে বলেন। আমি পড়ে শোনাই। এতে আমারও বই পড়ার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। আমার স্বামীও এতে উৎসাহ দেন।’
সাহিত্যের প্রতি এমন আগ্রহ কীভাবে এল—জবাবে আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘আমার ঠাকুর দাদা করম আলী ফকিরের বাউলগান ও সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ ছিল। তাঁকে দেখেছি। দাদার বাড়ি বাগেরহাটের চিতলমারী উপজেলায়। পরে অভাবের কারণে বাবা আনিসুর রহমান আমাদের নিয়ে যশোরে চলে আসেন। বাবা রিকশা চালাতেন। আমাকে লেখাপড়া শেখানোর কেউ ছিল না। আমি বুট ভেজে বিক্রির কাজে নেমে পড়লাম। কিন্তু দাদার কাছ থেকে বিভিন্ন কবি–সাহিত্যিকের কথা শুনেছি।’
প্রতি মাসে তিনি দু-একখানা করে লেখকের রচনাসমগ্র কেনেন। বই কেনার এমন নেশা যে সুদে টাকা নিয়েও তিনি বই কিনেছেন। কাউকে পেলেই তাঁকে দিয়ে বই পড়িয়ে নিজে বসে বসে শুনেছেন।আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘কোনো বিষয়ে কিছু জানতে চাইলে একেকজন একেক রকম করে বলত। তাই আমি নিজেই তখন বইপুস্তক কিনে নিজে খোঁজার চেষ্টা করতাম। আশির দশকে বাণী চিরন্তনী নামের বইটি প্রথম কিনেছিলাম। তারপর ভাবগানের বিভিন্ন আসরে গিয়ে সাহিত্য ও গানের প্রতি আগ্রহ বাড়ে।’
আবদুল কুদ্দুসের ওই টিনের ছাপরা ঘুরে গেছেন লোকসংস্কৃতি-গবেষক সাইমন জাকারিয়া। পরে ২০১৩ সালে প্রকাশিত সাইমন জাকারিয়ার বাংলাদেশের লোকসংগীত গ্রন্থের ১৬০ পৃষ্ঠায় যশোর অঞ্চলের ভাবসংগীতের সংগ্রাহক হিসেবে আবদুল কুদ্দুসের ছবি ছাপানো হয়।
আবদুল কুদ্দুসকে আমরা কুদু ভাই নামেই চিনি। তাঁর মধ্যে প্রখর জীবনবোধ ও জীবনদর্শন রয়েছে। একজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে এতটা সাহিত্যানুরাগ আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি।চিত্রশিল্পী ও লেখক অধ্যাপক মফিজুর রহমানযশোরের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী ও লেখক অধ্যাপক মফিজুর রহমানের (রুননু) একক প্রদর্শনীতে জায়গা পেয়েছিল আবদুল কুদ্দুসকে নিয়ে তাঁর আঁকা একটি ছবিও। মফিজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আবদুল কুদ্দুসকে আমরা কুদু ভাই নামেই চিনি। তাঁর মধ্যে প্রখর জীবনবোধ ও জীবনদর্শন রয়েছে। একজন নিরক্ষর মানুষের মধ্যে এতটা সাহিত্যানুরাগ আমি আর কারও মধ্যে দেখিনি। তিনি একজন সুচিন্তক মানুষ।’ ৭৩ বছর বয়সেও নিজে ভাজা বুট দোকানে দোকানে বিক্রি করে বেড়ালেও আবদুল কুদ্দুস কারও মুখাপেক্ষী হতে চান না বলে জানান তিনি।
সাহিত্যচর্চা তাঁকে নানা খারাপ বাসনা থেকে দূরে রেখেছে বলে মনে করেন আবদুল কুদ্দুস। তিনি তেমন বেশি মানুষের সঙ্গে মেশেন না। তাঁর সঙ্গীসাথি সব বাউল সাধকেরা। তাঁর গুরু ছিলেন কুষ্টিয়ার প্রয়াত বাউল সাধক করিম শাহ। তাঁর কাছে জীবনে তিনি গুনে গুনে ৫৬ বার গেছেন। নিজের কাজের বিষয়ে আবদুল কুদ্দুস বলেন, ‘দানা গুড়ের ঠিলেয় ঝোল রাখা হয় কেন জানেন? দানা বাঁচিয়ে রাখার জন্য। আমি হলাম সেই ঝোল। নিজে দানা হতে না পারলেও দানা বাঁচিয়ে রাখার কাজটা ঝোল হিসেবে করে যাচ্ছি।’