বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান থেকে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম (এলপি) গ্যাস কিনে বিক্রি করেন তিন হাজারের বেশি পরিবেশক। সাড়ে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার কিনতে পরিবেশকদের কোম্পানি পর্যায়ে বর্তমানে খরচ হয় ৭৮৪ টাকা। আরও কিছু খরচ যুক্ত হয়ে ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করার কথা ৮২৫ টাকায়; কিন্তু বিক্রি হচ্ছে ১ হাজার থেকে ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। বিপিসির একটি তদন্ত প্রতিবেদনেও দামের তারতম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে।
বিপিসির কর্মকর্তারা বলেন, গ্রাহকদের কাছে কম দামে সরবরাহের জন্য মূলত এলপি গ্যাস বিক্রি করা হয়; কিন্তু এই গ্যাস বিক্রি করে পরিবেশকেরা পকেট ভারী করেন। ভোক্তাদের লাভ হয় না।
আরও পড়ুন১২ কেজি এলপিজি সিলিন্ডারে দাম কমেছে ১৯ টাকা০৪ মে ২০২৫বিপিসির এই চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠান হলো পদ্মা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড, মেঘনা পেট্রোলিয়াম লিমিটেড, যমুনা অয়েল কোম্পানি লিমিটেড ও স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানি লিমিটেড (এসএওসিএল)। বিপিসি ও চার অঙ্গপ্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা, বাজারের খুচরা গ্যাস বিক্রেতা, পরিবেশক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে বাড়তি দরে বিক্রির বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া গেছে।
দেশে সরকারি-বেসরকারি—দুভাবে এলপি গ্যাস বিক্রি হয়। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) গ্যাসের দাম নির্ধারণ করে দেয়। সর্বশেষ ৪ মে প্রকাশিত মূল্য সমন্বয়ক আদেশ অনুযায়ী, ভোক্তা পর্যায়ে বেসরকারি খাতে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) ১২ কেজি সিলিন্ডারে দাম ১ হাজার ৪৩১ টাকা। অন্যদিকে সরকারি কোম্পানির মূল স্থাপনা বা ডিপো থেকে পরিবেশকদের সিলিন্ডার কিনতে খরচ হচ্ছে ৭৮৪ টাকায় (১২.
চট্টগ্রাম নগরের বাটালি রোডের তাহমিনা অ্যান্ড সন্স পদ্মা ও এসএওসিএল থেকে গ্যাস নিয়ে ব্যবসা করে। গত বৃহস্পতিবার তাঁর প্রতিষ্ঠানে পদ্মার সাড়ে ১২ কেজি ওজনের গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছিল ১ হাজার ৩৫০ টাকায়। বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে শাহ আলম বলেন, দুই কোম্পানি থেকে যে পরিমাণ গ্যাস তিনি পান, তা দিয়ে দোকান ভাড়াও ওঠে না। এর বাইরে পরিবহনসহ বিভিন্ন খরচ রয়েছে। এ কারণেই বাড়তি রাখতে হয়।
একই দিন নগরের মুরাদপুর, ষোলশহর, বায়েজিদ, কদমতলী এলাকা ঘুরে কোথাও সরকারি চার কোম্পানির গ্যাস সিলিন্ডার পাওয়া যায়নি। নগরের পাহাড়তলীর আরেক পরিবেশক মোহাম্মদ ফজলুর কাছে গ্যাস সিলিন্ডার ছিল। তিনি যমুনা ও এসএওসিএল থেকে গ্যাস নিয়ে ব্যবসা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম কাদের এন্টারপ্রাইজ। বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়ে ফজলু বলেন, কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। এ কারণে নির্ধারিত দামে বিক্রি করা সম্ভব হয় না।
আরও পড়ুনএলপিজি ব্যবসা নিয়ে দ্বন্দ্ব, প্রকাশ্যে এল অর্থ পাচার ও ভোক্তাস্বার্থ১৯ অক্টোবর ২০২৪বাড়তি দাম নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছেন এলপি গ্যাস পরিবেশক সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি খোরশেদুর রহমান ও সাধারণ সম্পাদক আইয়ুব আলী। খোরশেদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, বিপিসির চার কোম্পানি থেকে চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস পাওয়া যায় না। ফলে কম গ্যাস বিক্রি করে দোকানভাড়া, ট্রেড লাইসেন্স ফি, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের লাইসেন্সের নবায়ন ফি তোলা সম্ভব হয় না। এ কারণে বাড়তি দামে বিক্রি করতে হয়।
সরকার–নির্ধারিত দামের চেয়ে বাড়তি নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন বিপিসির চেয়ারম্যান মো. আমিন উল আহসান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার–নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি নেওয়ার বিষয়টি তাঁরা জেনেছেন। এ বিষয়ে তাঁরা পদক্ষেপ নেবেন। পাশাপাশি সরকারি গ্যাস বেসরকারি সিলিন্ডারে ঢুকিয়ে বিক্রি করার বিষয়েও তাঁরা অভিযোগ পেয়েছেন। তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে বিষয়টি বন্ধ করার নির্দেশনা দেবেন।
আরও পড়ুনপরিবেশকের নামে এলপিজি খালাস করছিল কে, তদন্তে কমিটি০৯ ডিসেম্বর ২০২৪বিপিসির তদন্তবাড়তি দামে এলপি গ্যাস বিক্রি নিয়ে বিপিসির একটি তদন্ত প্রতিবেদনে আলোচনা হয়েছে। ৪ মে ওই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, বিপিসির এলপি গ্যাস পরিবেশক নিয়োগ ও বিপণন নীতিমালাটি পুরোনো। ফলে বাস্তবতার নিরিখে তা হালনাগাদ করা প্রয়োজন। বিইআরসি বা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন নির্ধারিত সরকারি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য ৬৯০ টাকা (বর্তমান মূল্য ৮২৫)। অন্যদিকে বেসরকারি এলপি গ্যাস সিলিন্ডারের মূল্য ১ হাজার ৪৫০ টাকা (বর্তমান মূল্য ১ হাজার ৪৩১ টাকা)। সরকারি ও বেসরকারি গ্যাস সিলিন্ডারের এই মূল্যের পার্থক্য কমানো না গেলে মধ্যস্বত্বভোগীদের দৌরাত্ম্য বৃদ্ধি পাবে।
ভোক্তার ব্যয় কমাতে সরাসরি গ্রাহক পর্যায়ে সিলিন্ডার বিক্রি করা যেতে পারে বলে কমিটির পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিপিসির অধীন কোম্পানিগুলোর ডিপো বা বিক্রয় অফিসের তত্ত্বাবধানে গ্রাহক কার্ডের মাধ্যমে সরাসরি জনগণের কাছে সরকার–নির্ধারিত মূল্যে গ্যাস সিলিন্ডার বিক্রি করা যেতে পারে।
আরও পড়ুনহাজার কোটি টাকায় বিক্রি হলো পেট্রোম্যাক্সের এলপিজি ব্যবসা০১ সেপ্টেম্বর ২০২২বিপিসির তথ্য অনুযায়ী, চার কোম্পানিতে এলপি গ্যাস পরিবেশকের সংখ্যা ৩ হাজার ১০১। গত পাঁচ বছরে মোট এলপি গ্যাস বিক্রি হয়েছে ৫২ হাজার ২৩০ টন বা ৫ কোটি ২২ লাখ ৩০ হাজার কেজি।
সরকারি এলপি গ্যাস বিক্রি করে পরিবেশকেরা লাভবান হন, ভোক্তাদের সুফল মেলে না বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা এম শামসুল আলম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সরকার–নির্ধারিত মূল্যে গ্রাহকেরা গ্যাস পাচ্ছেন কি না, তা তদারকির দায়িত্ব বিইআরসি ও বিপিসির; কিন্তু এই দায়িত্ব তারা ঠিকভাবে পালন করে না। এ সুযোগ নিয়ে পরিবেশকেরা বাড়তি দাম হাতিয়ে নিচ্ছেন। ফলে সরকারি সংস্থাগুলোর তদারকি বাড়াতে হবে।
আরও পড়ুনমোংলা এখন এলপিজির ‘রাজধানী’০১ আগস্ট ২০২৩উৎস: Prothomalo
কীওয়ার্ড: সরক র ন র ধ র ত র ব ষয়ট ব সরক র পর য য় ১২ ক জ তদন ত এলপ জ ব যবস
এছাড়াও পড়ুন:
ইস্টার্ন রিফাইনারিতে রেকর্ড জ্বালানি তেল পরিশোধন
ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেড (ইআরএল) গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ১৫ লাখ ৩৫ হাজার টন অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করেছে। ৫৭ বছরের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ তেল পরিশোধন করল সংস্থাটি। মঙ্গলবার চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় শোধনাগারটির প্রধান কার্যালয়ে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়।
১৯৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ইআরএল বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র সরকারি জ্বালানি তেল পরিশোধনাগার। এখানে বিপিসির মাধ্যমে আমদানি করা অপরিশোধিত তেল থেকে পেট্রোল, ডিজেল, অকটেন, কেরোসিন, এলপিজি, ফার্নেস অয়েলসহ ১৪ ধরনের জ্বালানি উৎপন্ন হয়। সংবাদ সম্মেলনে ছিলেন ইআরএল পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ সচিব নাসিমুল গনি, বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান, বিপিসির সচিব শাহিনা সুলতানা ও ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত।
ইআরএলের চেয়ারম্যান নাসিমুল গনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ, দক্ষ ব্যবস্থাপনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার ফলে গত অর্থবছরে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি তেল শোধন সম্ভব হয়েছে। আগের বছরের তুলনায় এবার শোধন কার্যক্রমে বড় অগ্রগতি হয়েছে। এর আগে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শোধিত হয়েছিল ১২ লাখ ৭৯ হাজার টন; ২০২২-২৩ অর্থবছরে ১৪ লাখ ৪৩ হাজার টন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ১৩ লাখ ৭৭ হাজার টন। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে ১৫ লাখ ১৩ হাজার টন শোধন হয়েছিল, যা এত দিন ছিল সর্বোচ্চ।
বিপিসির চেয়ারম্যান আমিন উল আহসান বলেন, ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটির উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে জমা দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হবে। এ ছাড়া মহেশখালীতে ১০ লাখ টন সক্ষমতার নতুন শোধনাগার এবং পায়রা বন্দরে আরেকটি শোধনাগার স্থাপনের পরিকল্পনা রয়েছে। ইতোমধ্যে মহেশখালীর জন্য জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে বছরে প্রায় ১৫ লাখ টন অপরিশোধিত তেল শোধন করতে পারে ইআরএল। দ্বিতীয় ইউনিট নির্মাণ করা গেলে শোধন ক্ষমতা বেড়ে ৩০ লাখ টনে উন্নীত হবে।
ইআরএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. শরীফ হাসনাত বলেন, বর্তমানে পরিশোধন ক্ষমতা যথেষ্ট না হওয়ায় প্রতিবছর ডিজেলসহ বিভিন্ন জ্বালানি আমদানি করতে হয়। এতে সরকারকে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হয়। ইআরএলের দ্বিতীয় ইউনিট বাস্তবায়িত হলে বছরে প্রায় ২৪ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে।